লীলা মজুমদার
শুধু গল্প নয়
স্কূপ
একটা সাক্ষাৎকারের কথা বলি শোন। আমি তো আর সত্যিকার সাংবাদিক নই, কাজেই এটা যে ঠিক এই ভাবেই ঘটেছিল, তা বলতে পারছি না। তবে না ঘটবার কোনো কারণও নেই। শোন তবে। কিন্তু তার আগে জেনে রাখো, সাংবাদিকদের ছাড়া ডিটেকটিভদের চলে না। ডিটেকটিভদের ছাড়া সাংবাদিকদেরও চলে না।
সাংবাদিকরা সর্বদা চমকপ্রদ চাঞ্চল্যকর অবিশ্বাস্য সব সত্যিকার ঘটনা খুঁজে বেড়ায়। তাকে বলে স্কূপ। সাধারণত চোর, ধাপ্পাবাজ, খুনেগুণ্ডা, ব্যাংকডাকাত, চোরাচালানকারী বিষয়ক সত্যি ঘটনার ওপর একটু রংচং চড়ালে দোষ হয় না। কিন্তু আগাগোড়া বানিয়ে লিখলে মেলা ঝামেলা হতে পারে। আমার তো আর সে-সব বালাই নেই। বানিয়ে লিখলেও দোষ নেই। দুঃখের বিষয়, সব চেয়ে অস্বস্তিকর স্কূপগুলো সব সময় ছাপা হয় না।
শিবশংকর একজন উঠতি সাংবাদিক। তার ওপর যাকে বলা যায় টিকটিকিশাস্ত্র, তাই নিয়ে পাগল। ওর কাছে আমার সব জ্ঞাতব্য প্রশ্নের উত্তর পাই। যে বিষয়ে ও কিছুই জানে না, তার পর্যন্ত জবাব পাই। তাতে আমার ভারি সুবিধা হয়। এদিকে সাংবাদিকদের মধ্যে ভারি রেষারেষি; যে যত বড় বড় স্কূপ সবার আগে নিজের কাগজে পৌঁছে দিতে পারে, তার সাফল্য তত বেশি। অথচ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা না থাকলেও মুশকিল। প্রত্যেককে যদি প্রত্যেক জায়গায় সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে যেতে হত, তাহলে কেউই কিছু করে উঠতে পারত না। তাই ওরা একটা অলিখিত খবর —সমবায় মতো তৈরি করে। সেখানে যে যা তথ্য পায় সব জমা দেয়, এবং সেখান থেকেই সব খবর সরবরাহ হয়। তবে যে যার পেটোয়া খবরের সবচেয়ে সঙ্গীন জায়গাটা সম্ভবত চেপে যায়, নিজেদের কাগজের এক-তরফা ব্যবহারের জন্য। ঐটুকু ওদের কর্তব্য। এটা আমিও মানি।
এইখানে ডিটেকটিভ এবং দুষ্কৃতকারীদের প্রবেশ। চাঞ্চল্যকর খবরের তারাই হল ১ নং কাঁচা মাল। বলেছি তো এ সমস্ত তথ্য আমি শিবশংকরের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। তার মতো দক্ষ সংবাদ-সরবরাহকারী আর আমার জানা নেই। তাছাড়া সে মালপো খেতে ভালোবাসে। খেতে খেতে সে একদিন বলে বসল— ‘আপনারা জগৎকে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন বলে দুষ্কৃতকারীদের সামাজিক উপকারিতার দিকটা বুঝতে পারেন না। ওদের পক্ষটা তো আর শুনতে পান না।’ মহা রেগে, মালপোর বাটি সরিয়ে রেখে বললাম— ‘কিসের উপকারিতা?’
শিবশংকর হাত বাড়িয়ে বাটি থেকে বড় বড় চার-পাঁচটা মালপো তুলে নিয়ে বলল— ‘আমিই কি আর আগে অত জানতাম। ঘটুর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আমার চোখ খুলে গেছে। ঘটু হল গিয়ে যাকে মনস্তত্ত্ববিদ্রা হয়তো বলবেন আবশ্যিক দুষ্কৃতকারী। অর্থাৎ চুরিচামারি জুয়োচুরি ইত্যাদি অহিংস, কিন্তু লাভজনক দুষ্কর্ম না করে ও থাকতে পারে না। ওর নিজের কোনো দোষ নেই, ওর মনের মধ্যে একটা কিছু রোগ আছে যা ওকে ঐ সব করতে বাধ্য করে। যেমন কারো কারো ফিটের ব্যামো থাকে ৷ তাদের কি জেলে দেওয়া হয়?
সে যাই হোক গে, জামাইবাবুর বড় ভগ্নীপতি হলেন বড় জেলের সুপারিনটেণ্ডেণ্ট, সে তো জানেনই। তাঁকে বলেকয়ে ঘটুর সাক্ষাৎকার নিলাম। প্রাইভেটলি। অর্থাৎ ভিজিটিং আওয়ারে নয়। অন্য সময়ে। ওর নিজের ঘরে। জেলের ডাক্তারবাবুর সামনে এবং ঘরের অন্য দুজন বাসিন্দাকে সরিয়ে! তাদের কি রাগ! ‘এ রকম পক্ষপাতিত্বের কি মানে হতে পারে? আমরা বিক্ষোভ করব।’ করলও খানিকটা— চলবে না, চলবে না! তারপর লপসির সময় হয়ে যাওয়াতে, বলে গেল——এখানেই এর শেষ নয়, এটা শুধু টিফিনের ছুটি। ঘটুও চঞ্চল হয়ে উঠল— ‘হিংসে করে আমার ভাগটাও খেয়ে নেবে না তো স্যার?’ ডাক্তারবাবু বললেন— ‘আহা, বলেছি তো, তোমার জন্য আমার বাড়িতে বাড়তি রান্না হচ্ছে। তুমি এখন শিবশংকরের প্রশ্নের জবাব দাও তো ভাই।’ ঘটু আঁৎকে উঠল— ‘এঁরা! প্রশ্ন নাকি? অংকটংক নয় তো?”
শিবশংকর : আরে না, না। নিজে ও-সব জানলে তো প্রশ্ন করব।
ঘটু : (নিশ্চিন্ত হয়ে ) ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলুন কি জানতে চান।
শিব : (খুদে রেকর্ডার খুলে) আচ্ছা বলদিকিনি, তুমি ৫-৬ মাস অন্তর একবার করে এখানে মাস দুই কাটিয়ে যাও কেন?
ঘটু : ছুটি করি, স্যার। ডাক্তারবাবু থেকে থেকে যে জন্যে শান্তিনিকেতনে যান। হাওয়া বদল না করলে মানুষ বাঁচে? শরীর মনের একটু যত্ন না নিলে চলে?
শিব : তাই বলে পাঁচিল ঘেরা হয়ে, লপসি খেয়ে?
ঘটু : (চটে) কেন, লপসিটা খুব খারাপ হল কিসে? একটু কাঁচা লংকা আর সরষের তেলের ব্যবস্থা করলে আমার বৌয়ের রান্নার চেয়ে ঢের ভালো।
শিব : কিন্তু বন্ধ থাকতে হয় যে?
ঘটু : আহা, ঘুরে ঘুরে পালিয়ে দৌড়ে লুকিয়ে ছিপিয়ে পয়সা কামানো বুঝি খুব আরামের?
শিব : তবে ওসব কর কেন?
ঘটু : কি মুশকিল, ঐ তো আমার কাজ। অন্য কাজ আমার ধাতে সয় না। দেশের কত উপকার করি বলুন। আমি তো দেশপ্রেমিক।
শিব : এ্যা, বল কি!
ঘটু : তা নয় তো কি? আমাদের জন্য কত হাজার হাজার লোক করে খাচ্ছে, তা কখনো ভেবেছেন? বেশি ঝামেলা করেন যদি তাহলে আমরা দলেদলে চুরি কম্ম ছেড়ে দেব, হ্যাঁ। আমাদের ইউনিয়ন আছে জানেন? খবরের কাগজ থেকে মাইনে পান, কি-ই বা বোঝেন। আমরা সবাই কাগজে চাকরি নিলে এই ধরুন ডাক্তারবাবুর চাকরিটা ফাল্তু ডিক্লেয়ার হয়ে যাবে না? টিকটিকিরা সক্কলে, পাহারাদার, ওয়ার্ডার, জেলার, উকিল, মোক্তার, আদালত, পুলিশ, সব ফালতু হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ লোক না খেতে পেয়ে মরবে। তাই চান?
শিব : (এতক্ষণে একটু সুযোগ পেয়ে) না, না, তা মোটেই বলছি না। চুরি করবে বই কি। যার যা কাজ।
ঘটু : ‘হ্যাঁ, পথে আসুন বাছাধন। স্রেফ পরের উপকারের জন্য আমরা কুকর্ম করি এটা কাগজে ফলাও করে লিখতে ভুলবেন না। অকৃতজ্ঞতা বড় খারাপ। আর কি জানতে চান, একটা ছাঁচি পান পেলে বলতে পারি।’
(ডাক্তারবাবুর কৌটো থেকে ছাঁচি পান প্রদান)
শিব : ইয়ে—মানে শরীরটরীর ভালো থাকে তো?
ঘটু : থাকবে না-ই বা কেন? সুপারিনটেণ্ডেণ্টের ফুল বাগানে কাজ করি। ছোটবেলার শখ। বাবা ছিল মালী। তা বৌ লাউ-কুমড়ো ছাড়া কিছু ফলাতে দেবে না। এখানে আমার গোলাপ বাগিচাটে দেখে আসুন। চক্ষু সাৰ্থক হবে। মাইনে পাই। একমাত্র দুঃখ আর ১৫ দিন বাদে কুঁড়িগুলো ফুটতে শুরু করবে, ঠিক তখনি আমার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে।—আচ্ছা, ডাক্তারবাবু, আমি যদি এনার হাতঘড়িটে ছিনিয়ে নিই, তাহলে মেয়াদ বাড়বে না?
ডাক্তার : না, না, ও কি কথা! আমি বরং তোমাকে ওঁর প্রাইভেট মালীর কাজ পাইয়ে দেব। কিন্তু ও কি সব উটকো কথা বলছো বাপ? বয়স হচ্ছে, ঘটু, দুষ্কম্মের পথ ছাড়ো। আজকাল ওষুধ বেরিয়েছে। তাই খেলে কুকর্মের ইচ্ছাই চলে যায়।
ঘটু : ও, খবরের কাগজ-মশাই, দেখছেন তো কি নির্বান্ধব পুরীতে থাকি, কারো ওপর ভরসা করতে পারি না। লিখবেন আমাদের দুঃখের কথা। আপনিও আমাকে দুষ্কৃতকারী বলে ঘেন্না করছেন নাকি?
শিব : না, না, ছি, কি যে বল। আমি বরং এবার উঠি। আমারো নীতিজ্ঞানটুকু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কাসুন্দি দিলে লপসি আরো ভালো লাগতে পারে মনে হয়।
এই বলে কাসুন্দির নতুন শিশিটা ঘটুকে দিয়ে শিবশংকর ভারি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আপিসে ফিরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খাসা একটা স্কূপ লিখেও ফেলল। তার টাইটেল দিল ‘দুর্নীতির উল্টো পিঠ। দুঃখের বিষয়, সম্পাদক মশাই মন দিয়ে সবটা পড়ে বললেন—’ এ সব সত্যি কথা কখনো ছাপানো যায়? তুমি কি আমার চাকরি খেয়ে নিতে চাও নাকি, এ্যাঁ? না না, ঐ বইমেলাটেলাই তো বেশ ছিল। এ-সব দুর্বুদ্ধি ছাড়ো!’ যাচ্চলে।