» » গোচারণের মাঠ

বর্ণাকার

অক্ষয়চন্দ্র সরকার

গোচারণের মাঠ

‘গোচারণের মাঠ’ শ্রীঅক্ষয়চন্দ্র সরকার রচিত যুক্তাক্ষর বর্জিত শিশুপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ, এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১২৮৭ বঙ্গাব্দে, ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে। কাব্যখানি চুঁচুড়া থেকে সাধারণী যন্ত্রালয়ে শ্রীনন্দলাল বসু কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল; মূল্য রাখা হয়েছিল ৵৹ দুই আনা মাত্র। দুষ্প্রাপ্য এই কাব্যখানির প্রচ্ছদ ও অন্যান্য বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি।

ভূমিকা

শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এই ‘গোচারণের মাঠ’ পড়িয়া আমাকে যে পত্র লেখেন তাহা ভূমিকা স্বরূপ প্রকাশ করিলাম, ইহাতে আর কিছু না হয়, আমার আশার এবং আক্ষেপের কথা ব্যক্ত করিবে।

শ্রীঅক্ষয়চন্দ্র সরকার।

আশীর্ব্বাদ বিজ্ঞাপনঞ্চ বিশেষঃ

তোমার গোচারণের মাঠ পড়িয়াছি। ২৪ পৃষ্ঠা কাব্য খানির মধ্যে একটিও যুক্তাক্ষর নাই;—বাঙ্গালী ভাষা তোমার আজ্ঞাধীন, যদি ইহা প্রমাণ করিবার জন্য লিখিয়া থাক, তবে তোমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইয়াছে স্বীকার করিতে হইবে।

তোমার উদ্দেশ্য যাহাই হউক, যুক্ত অক্ষর ছাড়িয়া দেওয়াতে একটা বড় সুফল ফলিয়াছে। অতি সরল বাঙ্গালী ভাষায় কাব্য খানি লিখিত হইয়াছে। বাঙ্গালা ভাষায় যে সকল শব্দে যুক্ত অক্ষর আছে, সে গুলি প্রায় সংস্কৃত মুলক। অতএব যুক্ত-অক্ষর পরিত্যাগ করিলে কাজে কাজেই কট মট, সংস্কৃতবহুল ভাষাও পরিত্যক্ত হয়; যে সরল বাঙ্গালায় লোকে কথা বার্ত্তা কয়, সেই ভাষা আসিয়া পড়ে। ভাষা সম্বন্ধে ইহা সামান্য লাভ নহে। যত দিন না প্রচলিত বাঙ্গালায় বহি লেখার পদ্ধতি চলিত হয়, তত দিন সাধারণ লোকে বহি পড়িবে না; সাধারণ লোকে বহি না পড়িলে, লেখার উদ্দেশ্য সফল হইবে না, আর ভাষারও প্রকৃত পুষ্টিলাভ হইবে না।

এমন কথা বলি না, যে প্রচলিত বাঙ্গালায় যুক্ত-অক্ষর নাই; বা যুক্ত অক্ষর বিরল। যুক্ত-অক্ষর ছাড়িয়া দিলে, এমন কি অধিক ক্ষণ কথা বার্ত্তা চলে না। তবে চলিত বাঙ্গালায় যুক্ত-অক্ষর কম, কেতাবি বাঙ্গালায় বেশী। তুমি দেখাইয়াছ, যে যুক্ত-অক্ষর একেবারে ছাড়িয়া দিয়াও ভাল ভাষায় ভাল কাব্য লেখা যায়।

যুক্ত-অক্ষর ছাড়িয়া দিয়া কবিতা লেখা, এই প্রথম নহে তাহা আমি জানি; “পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল”—প্রভৃতি সকলেরই মনে আছে, আর তার পরও কোন কোন লেখক অসংযুক্ত বর্ণে কবিতা লিখিয়াছেন, এমনও স্মরণ হইতেছে। কিন্তু সে সকলের সঙ্গে তুলনায় “গোচারণের মাঠের” একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। সে গুলি ছন্দোবিশিষ্ট হইলেও, কবিতা নহে।—কবিত্ব সেগুলিতে প্রায় নাই। যে সকল শিশুরা যুক্ত অক্ষর ভাল পড়িতে পারে না, তাহাদিগের কাব্য পাঠের জন্যই সে গুলি লেখা হইয়াছে। কিন্তু ছেলেদের কবিত্ব-হীন কাব্য পড়াইয়া কোন লাভ আছে কি না—আমার সন্দেহ। লোকের বিশ্বাস আছে যে ছন্দ ও মিল বিশিষ্ট রচনায় ছেলেদের মন হরণ করে, সেই জন্য গদ্য অপেক্ষা পদ্য পড়িতে ছেলেরা ভাল বাসিতে পারে। কিন্তু ফলে কি তাই? আমিত কোন শিক্ষকের মুখে শুনি নাই যে ছেলেরা গদ্যপাঠ অপেক্ষায় পদ্যপাঠে অধিক মনযোগী হয়। বোধ হয়, যত দিন ছেলেরা পাঠ্য পদ্যে কর্কশ উপদেশ, আর নীরস বর্ণনা ভিন্ন আর কিছুই পাইবে না, তত দিন গদ্যে পদ্যে তাহাদের সমান আদর বা অনাদর থাকিবে। ফলে, কবিত্ব-শূন্য কাব্য ছেলেদের পড়ান বিড়ম্বনা মাত্র। বিদ্যালয়ে কাব্য গ্রন্থ পড়াইবার উদ্দেশ্য কি? সাধারণ লোকের বিশ্বাস যে কাব্যে ভাষা শিক্ষা ভাল হয়। পোপের প্রাচীন কথার দ্বারা অনেকে এ সংস্কার সমূলক বলিয়া প্রমাণ করিতে চান। বিদেশীয় ভাষার পক্ষে ইহা সত্য হইলে হইতে পারে, দেশীয় ভাষার পক্ষে তত সত্য কি না,—আমার সন্দেহ। বালককে কাব্য পড়াইবার এক মাত্র উদ্দেশ্য—আমি স্বীকার করি—কাব্যের উন্নত ভাবের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি। ইহা কেবল পদ্যের দ্বারা সিদ্ধ হয় না—কবিত্বের প্রয়োজন। তোমার এই “গোচারণের মাঠ” অতি সরল ভাষায় লিখিত হইলেও, কবিত্ব-পূর্ণ। অনেক স্থানে উঁচু দরের কবিত্ব ইহাতে দেখিয়াছি। ছেলেদের যদি কাব্য পড়াইতে হয়, তবে এই খানিই তাহার উপযোগী। কিন্তু তাই বলিয়া, ইহা যে এ দেশের পাঠশাল স্কুলে চলিবে এমন ভরসা আমি করি না। যদি চলে তবে আমি বিস্মিত হইব। যাহা চলিবার যোগ্য তাহা চলিবে, শিক্ষা বিভাগের এমন নিয়ম নহে। শিক্ষা বিভাগে কেন, যাহা চলিবার যোগ্য তাহা তুমি কোথায় চলিতে দেখিয়াছ?

চুঁচুড়া,
২২এ বৈশাখ, ১২৮৭
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।