» » গোচারণের মাঠ

বর্ণাকার
🕮

তৃতীয় প্রহর

 সবুজ ছাপর শোভা

না হরে রাখাল,

দূর হতে ফুল ভরা

লয় লতা জাল।

মাথায় জড়াল লতা,

কাণে দিল ফুল,

সরস মানসে ফিরে,

হরষ অতুল।

একে একে এলো সবে,

গাভী যথা চরে;

ফুল লয়ে কাড়াকাড়ি

সকলেই করে।

লাফালাফি হাতাহাতি

খানিক হইল,

মিটিল লড়াই বাই

সকলে থামিল।

আকাশের পথে নামে

দেব-দিবাকর,

অতীত হয়েছে দিবা

তৃতীয় প্রহর।

আধ পোয়া বেলা আছে,

বলিল রাখাল,

যতনেতে জড় করে

যতেক গোপাল।

‘আমাআ’ বলিয়া গাভী 

দিল যাই সাড়া,

দূরেতে বাছুর চাহে করে

কাণ খাড়া।

‘আহ মা আ’ রবে গাভী

ডাকিল আবার,

লেজ নাড়ি, মাথা ঝাড়ি,

পাশে আসে তার।

রাঙী, কালী, ধলী, গাভী

জুটিল আসিয়া,

পাহাড়ীর ঢালু হতে

চলিছে নামিয়া।

আগু পিছু দুই ধারে

রহিল রাখাল,

সারি দিয়া মাঝে মাঝে

চলিল গোপাল।

গোচারণ মঠে গাভী

আসিছে ফিরিয়া,

যতেক কৃষক যুবা

চলে বাড়ি নিয়া;

আগে পাছে দুই ধারে

চলিছে রাখাল;

সারি দিয়া থাকে থাকে,

আসে গাভী পাল।

 এস ভাই, চল যাই,

ওই বটতলে,

দূরেতে থাকিয়া শোভা

দেখিব সকলে।

সমুখেতে শৈল মালা—

আকাশের গায়,

আবার ঢাকিয়া বুঝি

ফেলিছে ধূঁয়ায়;

সরোবর ঢাকি আছে,

কলমী, কমল;

সুধীর সমীর করে

বকুলে বিচল;

সারা কাল খাড়া আছে

পুরাণ দেউল,

জীবনের সাথী তার,

—হেলান তেঁতুল;

বেউড় বাঁশের ঝাড়

করে কট্‌ কট্‌,

জট গাড়ি গট হয়ে

বসি আছে বট;

ও দিকে গহন বন,

নীরব, বিশাল;

শালতরু যোগ সাধে,

পাহরায় তাল।

তেমনি শামল মাঠ,

মাঝে গাভীদল,

তেমনি সবুজে ঢালা,

করে ঢল ঢল;

সেই ত অসীম নীল

মাথার উপর,

বহে বায়ু, চলে চীল,

ঝরে রবিকর;

শোভার সকলি আছে,

শোভাও ত আছে,

তবে কেন নিরখিয়া

মন নাহি নাচে?

এখন আর ত নাই 

নাচনিয়া কাল,

অনেক বিভেদ আছে,

সকাল, বিকাল।

সকালে নাচিয়া উঠে

সকলের মন,

বিকালে মনের গতি

মৃদুল দোলন;

তখন হাসেন ভানু

উঠতি বয়েস,

অরুণের শরীরেতে

তরুণের বেশ;

কমলে শুকায়ে দেন

শিশিরের জল,

মাঠেতে মাখান রঙ্‌

ঈষৎ পীতল;

তরুরে শিরোপা দেন

মরকত তাজ,

জগতে জাগায়ে দেন

সাধিবারে কাজ,

ঊষার তপন সেই

আশার আধার,

বিকালের রবি ছবি

বিপরীত তার।

সকালের উষাপতি,

মাঝের তপন,

সাঁঝের ভয়েতে এবে

বিচলিত হন;

গড়াইয়া পড়ে ভানু

থির নাহি রয়,

গেলে রে বয়স কাল

হেন দশা হয়।

যে আলোকে পুলকিত

হয়েছিল লোক,

ভুলেছিল হৃদয়ের

গুরুতর শোক;

খরতর হলে যাহা

সহা নাহি যায়,

অভিভূত ছিল জীব

দুপর বেলায়;

এখন আলোক আছে,

—আভা তাহে নাই,

রোদ যেন ভাঙা ভাঙা

করে সাঁই সাঁই।

তখন তপন-কর

ঝলসে, ঝলকে,

তর তর সরে এবে

পলকে পলকে;

বড় লোক হীন-মানে

কারো নাহি লাভ,

তপন পতনে হের

জগতের ভাব।

মলিনী কমল-মণি,

মুদিছে নয়ন,

হু হু হু হুতাশ ছাড়ে

দুখে সমীরণ।

কাঁদে গাছ, ঝরে পাতা,

কুসুম শুকায়,

দুলিয়া দুলিয়া লতা

মরম জানায়;

তেঁতুল, বাবলা, বক,

জড় সড় হয়,

হিয়ায় লেগেছে আসি

আঁধারের ভয়।

মাঠেতে সবুজ লীলা

ভরপূর ছিল,

পাতলা হলুদে এবে

শরীর ঢাকিল;

বুড়ুটে বুড়ুটে রঙ—

ঘোলা ঘোলা মত,

জলুস, তরাস নাই,

আভা নাই তত;

নদগদ নড়ে গাভী,

ধায় না বাছুর,

অতি ধীরে লেজ নাড়ে,

নীরবেতে খুর;

দৈয়াল রসাল রাগে,

না করে বিকল,

হিয়ায় না বিঁধে তীর

‘ফটীঈক জল,’

এখন পাপিয়া সুরো

বিমানেতে ভাসে,

‘উহু উহু সব্‌ গেলো,’

রব কাণে আসে।

সরলা কৃষক বালা

খাটে সারাদিন,

না জানে বিলাস ভোগ,

লালস সৌখীন;

বিকালে বিরাম পায়,

গৃহ কাজ হ’তে,

কাঁখেতে কলস লয়ে

আসে সেই পথে;

পুরাণ দীঘির পাড়ে

সেই ভাঙা ঘাট,

সারি সারি বসে সবে

নাহি জানে ঠাট;

দিনের দুখের কথা

কহিতে লাগিল,

বালিকার মাঝে যারা

পতিহীনা ছিল,—

না কহে অধিক কথা,

না নাড়ে নয়ন,

ডুবিছে তপন দেব

দেখে এক মন।

ভাঙা ঘাটে; রবি পাটে;

দেখিল আঁধার,

ভাঙা কপালের কথা

মনে হল তার;

উপরে দেবতা পানে

দেখিল চাহিয়া,

‘উহু উহু সব্‌ গেল,’

বলিল পাপিয়া;

চখে কি পড়িল বলি

বাঁপিল আঁচল,

নামিল কাঁপিল তাহে

সরোবর জল।

ছাড়ায়ে আধেক মাঠ

আসিছে রাখাল,

দেহে মনে বল নাই,

লেগেছে বিকাল।

তখন শুনেছ গীত

“(তোরা) যাবি যদি আয,

এবে সে সাহস নাই,

  শুন গীত গায়;—

গান।

—‘যে যাবার সে যাউক,’

পূববীতে বলে,

‘আমি ত যাব না কভু

যমুনারি জলে,’

“যমুনার জলে আমি

ছায়া দেখিয়াছি,

সে অবধি যমুনার

কূল ছাড়িয়াছি;

ছায়ার মায়ার বশে

হই আন-মনা,

যে যাবে সে যা’ক জলে

আমি ত যাব না;

সম্পূর্ণ।