চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বাটী-সংলগ্ন উদ্যানের অপর প্রান্ত

[অদূরে সরস্বতী নদীর কিছু কিছু দেখা যাইতেছে, বিজয়া ও কানাই সিং। দয়াল প্রবেশ করিলেন]

দয়াল। তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্চি মা। শুনলাম এইদিকেই এসেছো, ভাবলাম বাড়ি যাবার আগে এদিকটা দেখে যাই যদি দেখা মেলে।

বিজয়া। কেন দয়ালবাবু।

দয়াল। আজ তৃতীয়া, পূর্ণিমা হলো সতেরোই। আর কটা দিন বাকী বলো ত মা?
বিবাহের সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন এই ক’দিনেই সম্পূর্ণ করে নিতে হবে। অথচ রাসবিহারীবাবু সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর ফেলে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

বিজয়া। দায়িত্ব নিলেন কেন?

দয়াল। এ যে আনন্দের দায়িত্ব মা,—নেবো না?

বিজয়া। তবে অভিযোগ করচেন কেন?

দয়াল। অভিযোগ করিনি বিজয়া; কিন্তু মুখে বলচি বটে আনন্দের দায়িত্ব, তবু কেন জানিনে, কাজে উৎসাহ পাইনে, মন কেবলি এর থেকে দূরে সরে থাকতে চায়!

বিজয়া। কেন দয়ালবাবু?

দয়াল। তাও ঠিক বুঝিনে। জানি এ-বিবাহে তুমি সম্মতি দিয়েছ, নিজের হাতে নামসই করেছ,—আগামী পূর্ণিমায় বিবাহও হবে, তবু এর মধ্যে যেন রস পাইনে মা। সেদিন আমার অসম্মানে বিরক্ত হয়ে তুমি বিলাসবাবুকে যে তিরস্কার করলে সে সত্যই রূঢ়, সত্যই কঠোর; তবু, কেন জানিনে মনে হয়ে এর মধ্যে কেবল আমার অপমানই নেই, আরও কিছু গোপন আছে যা তোমাকে অহরহ বিঁধচে। (কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া) তোমার কাছে সর্বদা আসিনে বটে, কিন্তু চোখ আছে মা। তোমার মুখে আসন্ন-মিলনের স্বর্গীয় দীপ্তি কৈ,—কৈ সে সূর্যোদয়ের অরুণ আভা? তুমি জানো না মা, কিন্তু কতদিন নিরালায় তোমার ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখখানি আমার চোখে পড়েছে। বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ উথলে উঠেচে—

বিজয়া। না দয়ালবাবু, ও-সব কিছুই নয়।

দয়াল। আমার মনের ভুল, না মা?

বিজয়া। (ম্লান হাসিয়া) ভুল বৈ কি।

দয়াল। তাই হোক মা, আমার ভুলই যেন হয়। এ-সময়ে বাবার জন্যে বোধ করি মন কেমন করে—না বিজয়া? (বিজয়া নীরবে মাথা নাড়িয়া সায় দিল) (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) এমন দিনে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন!

বিজয়া। আমাকে কি জন্যে খুঁজছিলেন বললেন না ত দয়ালবাবু?

দয়াল। ওঃ—একেবারেই ভুলেচি। বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপাতে হবে, তোমার বন্ধুদের সমাদরে আহ্বান করতে হবে, তাঁদের আনবার ব্যবস্থা করতে হবে,—তাই তাঁদের সকলের নামধাম জানতে পারলে—

বিজয়া। নিমন্ত্রণপত্র বোধ করি আমার নামেই ছাপানো হবে?

দয়াল। না মা, তোমার নামে হবে কেন? রাসবিহারীবাবু বর-কন্যা উভয়েরই যখন অভিভাবক তখন তাঁর নামেই নিমন্ত্রণ করা হবে স্থির হয়েছে।

বিজয়া। স্থির কি তিনিই করেছেন?

দয়াল। হাঁ, তিনিই বৈ কি।

বিজয়া। তবে এ-ও তিনিই স্থির করুন। আমার বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই।

দয়াল। (সবিস্ময়ে) এ কেমনধারা জবাব হলো মা! এ বললে আমরা কাজের জোর পাব কোথা থেকে?

বিজয়া। হাঁ দয়ালবাবু, সেদিন নরেনবাবুকে কি আপনি একতাড়া চিঠি দিয়েছিলেন?

দয়াল। দিয়েছি মা। সেদিন হঠাৎ দেখি একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে এক বাণ্ডিল পুরানো চিঠি। তাঁর বাবার নাম দেখে তাঁর হাতেই দিলাম। কোন দোষ হয়েছে কি মা?

বিজয়া। না দয়ালবাবু, দোষ হবে কেন? তাঁর বাবার চিঠি তাঁকে দিয়েছেন এ ত ভালোই করেছেন। চিঠিগুলো কি আপনি পড়েছিলেন?

দয়াল। (সবিস্ময়ে) আমি? না, না, পরের চিঠি কি কখনো পড়তে পারি?

বিজয়া। চিঠির সম্বন্ধে আপনাকে তিনি কি কিছু বলেন নি?

দয়াল। একটি কথাও না। কিন্তু কিছু জানবার থাকলে তাঁকে জিজ্ঞেসা করে আমি কালই তোমাকে বলতে পারি।

বিজয়া।কালই বলবেন কি করে? তিনি ত আর এদিকে আসেন না।

দয়াল। আসেন বৈ কি। আমাদের বাড়িতে রোজ আসেন।

বিজয়া। রোজ? আপনার স্ত্রীর অসুখ কি আবার বাড়লো? কৈ, সে কথা ত আপনি একদিনও বলেন নি?

দয়াল। (হাসিয়া) না মা, এখন তিনি বেশ ভালোই আছেন। তাই বলিনি। নরেনের চিকিৎসা এবং ভগবানের দয়া।

[হাতজোড় করিয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন]

বিজয়া। ভালো আছেন, তবু কেন তাঁকে প্রত্যহ আসতে হয়?

দয়াল। আবশ্যক না থাকলেও জন্মভূমির মায়া কি সহজে কাটে? তা ছাড়া, আজকাল ওঁর কাজকর্ম নেই, সেখানে বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেউ নেই—তাই সন্ধ্যেবেলাটা এখানেই কাটিয়ে যান। আমার স্ত্রী ত তাঁকে ছেলের মত ভালবাসেন। ভালবাসার ছেলেও বটে। এমন নির্মল, এমন স্বভাবতঃ ভদ্রমানুষ আমি কম দেখেচি মা। নলিনীর ইচ্ছে সে বি. এ. পাস করে ডাক্তারি পড়ে। এ বিষয়ে তাকে কত উৎসাহ কত সাহায্য করেন তার সীমা নেই। ওঁর সাহায্যে এরই মধ্যে নলিনী অনেকগুলো বই পড়ে শেষ করেছে। লেখাপড়ায় দু’জনের বড় অনুরাগ।

বিজয়া। তা হোক, কিন্তু আপনি কি আর কিছু সন্দেহ করেন না?

দয়াল। কিসের সন্দেহ মা?

বিজয়া। আমার মনে হয় কি জানেন দয়ালবাবু?

দয়াল। কি মনে হয় মা?

বিজয়া। আমার মনে হয় নলিনীর সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে প্রকাশ করা উচিত।

দয়াল। ও—এই বলচ? সে আমারও মনে হয়েছে মা, কিন্তু তার ত এখনো সময় যায়নি। বরঞ্চ দু’জনের পরিচয় আরো একটু ঘনিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সহসা কিছু না বলাই উচিত।

বিজয়া। কিন্তু নলিনীর পক্ষে ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁর মনস্থির করতে হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু ইতিমধ্যে নলিনীর—

দয়াল। সত্যি কথা। কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে যতদূর শুনেচি তাতে,—না না নরেনকে আমরা খুব বিশ্বাস করি। তাঁর দ্বারা যে কারো কোন ক্ষতি হতে পারে, তিনি ভুলেও যে কারো প্রতি অন্যায় করতে পারেন, এ আমি ভাবতেই পারিনে। কিন্তু একি, কথায় কথায় যে তুমি অনেক দূর এগিয়ে এসেছ। এতখানিই যদি এলে, চল না মা, তোমার এ বাড়িটাও একবার দেখে আসবে। নলিনীর মামী কত যে খুশী হবে তার সীমা নেই।

বিজয়া। চলুন, কিন্তু ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে যে।

দয়াল। হলোই বা। আমি তার ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া সঙ্গে কানাই সিং ত আছেই।

[উভয়ের প্রস্থান