পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[পরেশ প্রবেশ করিল। তাহার পরিধানে চওড়া পাড়ের শাড়ী, গায়ে ছিটের জামা, গলায় কোঁচানো চাদর, কিন্তু খালি পা]

পরেশ। মা-ঠান, তিনটে-চারটে বেজে গেল পালকি এলো না ত? আমার মা কি বলচে জানো মা-ঠান? বলচে, বুড়ো দয়ালের ভীমরতি হয়েছে, নেমন্তন্ন করে ভুলে গেছে।

বিজয়া। তোর বুঝি বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে পরেশ?

পরেশ।হিঁ—বড্ড খিদে পেয়েছে।

বিজয়া। কিচ্ছু খাসনি এতক্ষণ?

পরেশ। না কেবল সকালে দুটি মুড়ি-মুড়কি খেয়েছিনু, আর মা বললে, পরেশ, নেমন্তন্ন-বাড়িতে বড় বেলা হয়, দুটো ভাত খেয়ে নে। তাই—দেখো মা-ঠান, এই এত্ত ক’টি খেয়েছি।

[এই বলিয়া সে হাত দিয়া পরিমাণ দেখাইয়া দিল। জিজ্ঞাসা করিল—]

পরেশ। তোমার ক্ষিদে পায়নি মা-ঠান?

বিজয়া।(মৃদু হাসিয়া)আমারও ভারী ক্ষিদে পেয়েছে রে।

[পরেশের মা প্রবেশ করিল]

পরেশের মা। পাবে না দিদিমণি, বেলা কি আর আছে! বুড়ো করলে কি বল ত’—ভুলে গেল না ত? লোক পাঠিয়ে খবর নেব?

বিজয়া। ছি ছি, সে করে কাজ নেই পরেশের মা।যদি সত্যিই ভুলে গিয়ে থাকেন ভারী লজ্জা পাবেন।

পরেশের মা। কিন্তু নেমন্তন্ন-বাড়ির আশায় তোমার পরেশ যে পথ চেয়ে চেয়ে সারা হলো। বোধ হয় হাজার বার নদীর ধারে গিয়ে দেখে এসেছে পালকি আসচে কিনা। যা পরেশ, আর একবার দেখ গে। (পরেশ প্রস্থান করিলে পরেশের মা পুনশ্চ কহিল) কিন্তু সত্যিই আশ্চয্যি হচ্চি তাঁর বিবেচনা দেখে। কাল অত বেলায় ত ডাক্তারবাবুকে নিয়ে বাড়ি গেলেন, আবার ঘণ্টা-কয়েক পরেই দেখি বুড়ো লণ্ঠন নিয়ে নিজে এসে হাজির। পরেশের মা, তোমার দিদিমণি কোথায়? বললুম ওপরে নিজের ঘরেই আছেন। কিন্তু এত রাত্রিরে কেন আচায্যিমশাই? বললেন, পরেশের মা, কাল দুপুরে আমাদের ওখানে তোমরা খাবে। তুমি, পরেশ, কালীপদ, আর আমার মা বিজয়া। তাই নেমন্তন্ন করতে এসেছি। জিজ্ঞেসা করলুম, নেমন্তন্ন কিসের আচায্যিমশাই? বললেন, উৎসব আছে। কিসের উৎসব দিদিমণি?

বিজয়া। জানিনে পরেশের মা। আমাকে গিয়ে বললেন, কাল দ্বিপ্রহরে আমার ওখানে খেতে হবে মা। পালকি-বেহারা পাঠিয়ে দেব, হেঁটে যেতে পারবে না। কিন্তু ততক্ষণ কিছু খেয়ো না যেন। জিজ্ঞেসা করলুম, কেন দয়ালবাবু? বললেন, আমার ব্রত আছে। তুমি গিয়ে পা দিলে তবেই সে ব্রত সফল হবে। ভাবলুম মন্দির ত? হয়ত কিছু-একটা করেছেন। কিন্তু এমন কাণ্ড হবে জানলে স্বীকার করতুম না পরেশের মা।

[রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। একি কাণ্ড! এখনো যাওনি—চারটে বাজল যে!

পরেশের মা। পালকি পাঠাবার কথা, এখনো আসেনি।

রাস। এমনই তার কাজ। পালকি যদি সে না পেয়েছিল একটা খবর পাঠালে না কেন? আমি যোগাড় করে দিতুম।মধ্যাহ্ন-ভোজন যে সায়াহ্ন করে দিলে। ভারী ঢিলে লোক, এইজন্যেই বিলাস রাগ করে। আবার আমাকেও পীড়াপীড়ি,—সন্ধ্যার পরে যেতেই হবে।

[ছুটিয়া পরেশের প্রবেশ]

পরেশ। পালকি এস্‌তেছে মা-ঠান।

[রাসবিহারীকে দেখিয়াই সে সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল]

রাস।বলিস কি রে? এস্‌তেছে? তোরই মোচ্ছব রে! দেখিস পরেশ, নেমন্তন্ন খেয়ে তোকে না ডুলিতে করে আনতে হয়।(বিজয়ার প্রতি) যাও মা আর দেরী করো না—বেলা আর নেই। গিয়ে পালকিটা পাঠিয়ে দিও,—আমি আবার যাব। না গেলে ত রক্ষে নেই, মান-অভিমানের সীমা থাকবে না। সে এ বোঝে না যে দুদিন বাদে আমার বাড়িতেও উৎসব,—কাজের চাপে নিঃশ্বাস নেবার অবকাশ নেই আমার। কিন্তু কে সে কথা শোনে! রাসবিহারীবাবু পায়ের ধূলো একবার দিতেই হবে! কাজেই না গিয়ে উপায় নেই। রাত হলে কিন্তু যেতে পারব না বলে দিও। যাও তোমরা মা,—আমি ততক্ষণ মিস্ত্রীর কাজের হিসেবটা দেখে রাখি গে। প্রায় ষাট-সত্তর জন উদয়াস্ত খাটছে,—প্রাসাদতুল্য বাড়ি, কাজের কি শেষ আছে! অতিথিরা যাঁরা আসবেন, বলতে না পারেন আয়োজনের কোথাও ত্রুটি আছে।

[এই বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন, অন্যান্য সকলেও বাহির হইয়া গেল]