মুক্ত-পিঞ্জর

ভেদি দৈত্য-কারা

উদিলাম পুন আমি কারা-ত্রাস চির-মুক্ত বাধাবন্ধ-হারা

উদ্দামের জ্যোতি-মুখরিত মহা-গগন-অঙ্গনে –

হেরিনু, অনন্তলোক দাঁড়াল প্রণতি করি মুক্ত-বন্ধ আমার চরণে।

থেমে গেল ক্ষণেকের তরে বিশ্ব-প্রণব-ওংকার,

শুনিল কোথায় বাজে ছিন্ন শৃঙ্খলে কার আহত ঝংকার!

কালের করাতে কার ক্ষয় হল অক্ষয় শিকল,

শুনি আজি তারই আর্ত জয়ধ্বনি ঘোষিল গগন পবন জল স্থল।

কোথা কার আঁখি হতে সরিল পাষাণ-যবনিকা,

তারই আঁখি-দীপ্তি-শিখা রক্ত-রবি-রূপে হেরি ভরিল উদয়-ললাটিকা।

পড়িল গগন-ঢাকে কাঠি,

জ্যোতির্লোক হতে ঝরা করুণা-ধারায়–ডুবে গেল ধরা-মা’র স্নেহ-শুষ্ক মাটি,

পাষাণ-পিঞ্জর ভেদি, ছেদি নভ-নীল–

বাহিরিল কোন্ বার্তা নিয়া পুন মুক্তপক্ষ অগ্নি-জিব্রাইল!

দৈত্যাগার দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ রোষে হাঁকিল প্রহরী!

কাঁদিল পাষাণে পড়ি

সদ্য-ছিন্ন চরণ-শৃঙ্খল!

মুক্তি মার খেয়ে কাঁদে পাষাণ-প্রাসাদ-দ্বারে আহত অর্গল!

শুনিলাম – মম পিছে পিছে যেন তরঙ্গিছে

নিখিল বন্দির ব্যথা-শ্বাস –

মুক্তি-মাগা ক্রন্দন-আভাস।

ছুটে এসে লুটায়ে লুটায়ে যেন পড়ে মম পায়ে;

বলে – ‘ওগো ঘরে-ফেরা মুক্তি-দূত!

একটুকু ঠাঁই কিগো হবে না ও ঘরে-নেওয়া নায়ে?’

নয়ন নিঙাড়ি এল জল,

মুখে বলিলাম তবু – ‘বন্ধু! আর দেরি নাই, যাবে রসাতল

পাষাণ-প্রাচীর-ঘেরা ওই দৈত্যাগার,

আসে কাল রক্ত-অশ্বে চড়ি, হেরো দুরন্ত দুর্বার!’ –

বাহিরিনু মুক্ত-পিঞ্জর বুনো পাখি

ক্লান্ত কণ্ঠে জয় চির-মুক্তি ধ্বনি হাঁকি –

উড়িবারে চাই যত জ্যোতির্দীপ্ত মুক্ত নভ-পানে,

অবসাদ-ভগ্ন ডানা ততই আমারে যেন মাটি পানে টানে।

মা আমার! মা আমার! এ কী হল হায়!

কে আমারে টানে মা গো উচ্চ হতে ধরার ধূলায়?

মরেছে মা বন্ধহারা বহ্নিগর্ভ তোমার চঞ্চল,

চরণ-শিকল কেটে পরেছে সে নয়ন-শিকল।

মা! তোমার হরিণ-শিশুরে

বিষাক্ত সাপিনি কোন টানিছে নয়ন-টানে কোথা কোন্ দূরে!

আজ তব নীলকণ্ঠ পাখি গীতহারা

হাসি তার ব্যথা-ম্লান, গতি তার ছন্দহীন, বদ্ধ তার ঝরনাপ্রাণধারা!

বুঝি নাই রক্ষীঘেরা রাক্ষস-দেউলে

এল কবে মরু-মায়াবিনী

সিংহাসন পাতিল সে কবে মোর মর্ম-হর্ম্যমূলে!

চরণ-শৃঙ্খল মম যখন কাটিতেছিল কাল –

কোন্ চপলার কেশ-জাল

কখন জড়াতেছিল গতিমত্ত আমার চরণে,

লৌহবেড়ি যত যায় খুলে, তত বাঁধা পড়ি কার কঙ্কণবন্ধনে!

আজ যবে পলে পলে দিন-গণা পথ-চাওয়া পথ

বলে – ‘বন্ধু, এই মোর বুক পাতা, আনো তব রক্ত-পথ-রথ –’

শুনে শুধু চোখে আসে জল,

কেমনে বলিব, ‘বন্ধু! আজও মোর ছিঁড়েনি শিকল!

হারায়ে এসেছি সখা শত্রুর শিবিরে

প্রাণ-স্পর্শমণি মোর,

রিক্ত-কর আসিয়াছি ফিরে!’…

যখন আছিনু বদ্ধ রুদ্ধ দুয়ার কারাবাসে

কত না আহ্বান-বাণী শুনিতাম লতা-পুষ্প-ঘাসে!

জ্যোতির্লোক মহাসভা গগন-অঙ্গন

জানাত কিরণ-সুরে নিত্য নব নব নিমন্ত্রণ!

নাম-নাহি-জানা কত পাখি

বাহিরের আনন্দ-সভায় – সুরে সুরে যেত মোরে ডাকি।

শুনি তাহা চোখ ফেটে উছলাত জল –

ভাবিতাম, কবে মোর টুটিবে শৃঙ্খল,

কবে আমি ওই পাখি-সনে

গাব গান, শুনিব ফুলের ভাষা

অলি হয়ে চাঁপা-ফুলবনে।

পথে যেত অচেনা পথিক,

রুদ্ধ গবাক্ষ হতে রহিতাম মেলি আমি তৃষ্ণাতুর আঁখি নির্নিমিখ!

তাহাদের ওই পথ-চলা

আমার পরানে যেন ঢালিত কী অভিনব সুর-সুধাগলা!

পথ-চলা পথিকের পায়ে পায়ে লুটাত এ মন,

মনে হত, চিৎকারিয়া কেঁদে কই –

‘হে পথিক, মোরে দাও ওই তব বাধামুক্ত অলস চরণ!

দাও তব পথচলা পা-র মুক্তি-ছোঁয়া,

গলে যাক এ পাষাণ, টুটে যাক ও-পরশে এ কঠিন লোহা!’

সন্ধ্যাবেলা দূরে বাতায়নে,

জ্বলিত অচেনা দীপখানি,

ছায়া তার পড়িত এ বন্ধন-কাতর দু-নয়নে!

ডাকিতাম, ‘কে তুমি অচেনা বধূ কার গৃহ-আলো?

কারে ডাক দীপ-ইশারায়?

কার আশে নিতি নিতি এত দীপ জ্বাল?

ওগো, তব ওই দীপ সনে

ভেসে আসে দুটি আঁখি-দীপ কার এ রুদ্ধ প্রাঙ্গণে!’ –

এমনই সে কত মধু-কথা

ভরিত আমার বদ্ধ বিজন ঘরের নীরবতা।

ওগো, বাহিরিয়া আমি হায় এ কী হেরি –

ভাঙা-কারা বাহু মেলি আছে মোর সারা বিশ্ব ঘেরি!

পরাধীনা অনাথিনি জননী আমার –

খুলিল না দ্বার তাঁর,

বুকে তাঁর তেমনই পাষাণ,

পথতরুছায় কেহ ‘আয় আয় জাদু’ বলি জুড়াল না প্রাণ!

ভেবেছিনু ভাঙিলাম রাক্ষস-দেউল

আজ দেখি সে দেউল জুড়ে আছে সারা মর্মমূল!

ওগো, আমি চির-বন্দি আজ,

মুক্তি নাই, মুক্তি নাই,

মম মুক্তি নতশির আজ নতলাজ!

আজ আমি অশ্রুহারা পাষাণ-প্রাণের কূলে কাঁদি –

কখন জাগাবে এসে সাথি মোর ঘূর্ণি-হাওয়া রক্ত-অশ্ব উচ্ছৃঙ্খল আঁধি!

বন্ধু! আজ সকলের কাছে ক্ষমা চাই –

শত্রুপুরীমুক্ত আমি আপন পাষাণপুরে আজি বন্দি ভাই!