ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্
[তিরোভাব]
এ কী বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ!
বে-দরদ দিল্ কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর শোক।
জান-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ,
কব্জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ, খাক চুমে নীলা তাজ।
জিব্রাইলের আতশি পাখা সে ভেঙে যেন খান খান,
দুনিয়ার দেনা মিটে যায় আজ তবু জান আন্-চান!
মিকাইল অবিরল
লোনা দরিয়ার সবই জল
ঢালে কুল মুল্লুকে, ভীম বাতে খায় অবিরল ঝাউ দোল।
এ কি দ্বাদশীর চাঁদ আজ সেই? সেই রবিয়ল আউওল?
ঈশানে কাঁপিছে কৃষ্ণ নিশান, ইস্রাফিলের ও প্রলয়-বিষাণ আজ
কাতরায় শুধু! গুমরিয়া কাঁদে কলিজা-পিষানো বাজ!
রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান?
তারও বুক বেয়ে আঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান!
জমিন্-আশমান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্রাক্,
চিখ্ মেরে কাঁদে ‘আরশে’ র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক!
হুরপরি শোকে হায়
জল- ছলছল চোখে চায়।
আজ জাহান্নমের বহ্নি-সিন্ধু নিবে গেছে ক্ষরি জল,
যত ফিরদৌসের নার্গিস-লালা ফেলে আঁশু-পরিমল।
মৃত্তিকা-মাতা কেঁদে মাটি হল বুকে চেপে মরা লাশ,
বেটার জানাজা কাঁদে যেন – তাই বহে ঘন নাভি-শ্বাস!
পাতাল-গহ্বরে কাঁদে জিন, পুন মলো কি রে সোলেমান?
বাচ্চারে মৃগী দুধ নাহি দেয়, বিহগীরা ভোলে গান!
ফুল পাতা যত খসে পড়ে, বহে উত্তর-চিরা বায়ু,
ধরণির আজ শেষ যেন আয়ু, ছিঁড়ে গেছে শিরা স্নায়ু!
মক্কা ও মদিনায়
আজ শোকের অবধি নাই!
যেন রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদসম ছুটে।
কাঁপে ঘন ঘন কাবা, গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে।
নকিবের তূরী ফুৎকারি আজ বারোয়াঁর সুরে কাঁদে,
কার তরবারি খান খান করে চোট মারে দূরে চাঁদে?
আবুবকরের দর দর আঁশু দরিয়ার পারা ঝরে,
মাতা আয়েষার কাঁদনে মুরছে আশমানে তারা ডরে!
শোকে উন্মাদ ঘুরায় উমর ঘূর্ণির বেগে ছোরা,
বলে ‘আল্লার আজ ছাল তুলে নেব মেরে তেগ্ , দেগে কোঁড়া।’
হাঁকে ঘন ঘন বীর –
‘হবে, জুদা তার তন শির,
আজ যে বলিবে নাই বেঁচে হজরত – যে নেবে রে তাঁরে গোরে।’
আজ দারাজ দস্তে তেজ হাতিয়ার বোঁও বোঁও করে ঘোরে!
গুম্বজে কে রে গুমরিয়া কাঁদে মসজিদে মস্জিদে?
মুয়াজ্জিনের হোশ্ নাই, নাই জোশ চিতে, শোষ হৃদে!
বেলালেরও আজ কণ্ঠে আজান ভেঙে যায় কেঁপে কেঁপে,
নাড়ি-ছেঁড়া এ কী জানাজার ডাক হেঁকে চলে ব্যেপে ব্যেপে!
উস্মানের আর হুঁশ নাই কেঁদে কেঁদে ফেনা উঠে মুখে,
আলি হাইদর ঘায়েল আজি রে বেদনার চোটে ধুঁকে!
আজ ভোঁতা সে দুধারি ধার
ওই আলির জুলফিকার!
আহা রসুল-দুলালি আদরিণী মেয়ে মা ফাতেমা ওই কাঁদে,
‘কোথা বাবাজান।’ বলি মাথা কুটে কুটে এলোকেশ নাহি বাঁধে!
হাসান-হুসেন তড়পায় যেন জবে-করা কবুতর,
‘নানাজান কই!’ বলি খুঁজে ফেরে কভু বার কভু ঘর।
নিবে গেছে আজ দিনের দীপালি, খসেছে চন্দ্র-তারা,
আঁধিয়ারা হয়ে গেছে দশ দিশি, ঝরে মুখে খুন-ঝারা!
সাগর-সলিল ফোঁপায়ে উঠে সে আকাশ ডুবাতে চায়,
শুধু লোনা জল তার আঁশু ছাড়া কিছু রাখিবে না দুনিয়ায়।
খোদ খোদা সে নির্বিকার,
আজ টুটেছে আসনও তাঁর!
আজ সখা মহ্বুবে বুকে পেতে দুখে কেন যেন কাঁটা বেঁধে,
তারে ছিনিবে কেমনে যার তরে মরে নিখিল সৃষ্টি কেঁদে!
বেহেশ্ত সব আরাস্তা আজ, সেথা মহা ধুম-ধাম,
গাহে হুরপরি যত, ‘সাল্লালাহু আলায়হি সাল্লাম।’
কাতারে কাতারে করজোড়ে সবে দাঁড়ায়ে গাহিছে জয়, –
ধরিতে না পেরে ধরা-মা-র চোখে দর দর ধারা বয়।
এসেছে আমিনা আবদুল্লা কি, এসেছে খদিজা সতী?
আজ জননীর মুখে হারামণি-পাওয়া-হাসা হাসে জগপতি!
‘খোদা, একী তব অবিচার!’
বলে কাঁদে সুত ধরা-মা-র।
আজ অমরার আলো আরও ঝলমল, সেথা ফোটে আরও হাসি,
শুধু মাটির মায়ের দীপ নিভে গেল, নেমে এল অমা-রাশি
* * * * *
আজ স্বরগের হাসি ধরার অশ্রু ছাপায়ে অবিশ্রাম
ওঠে একী ঘন রোল – ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লাম।’
ঈমান—বিশ্বাস। বিশ্ব-বয়তুল্লাহ্—বিশ্বরূপ ‘কাবা’ বা আল্লার ঘর। ওয়ে—ওগো, বাছা। মারহাবা—সাবাস। ‘সরওয়ারে কায়েনাত’—সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। ‘শর্ওয়ান’—নওশেরওয়ান নামক পারস্যের বিখ্যাত দানশীল বাদশাহ্। বান্দা—হুজুরে-হাজির গোলাম, বন্দনাকারী। ফেরাউন, শাদ্দাদ, নমরুদ, মার্ওয়ান—বিখ্যাত ঈস্বরদ্রোহী সব। তাজি—দ্রুতগামী অশ্ব। বোর্রাক—উচ্চৈঃশ্রবার মত স্বর্গের শ্রেষ্ঠ অশ্ব। আসমান—আকাশ। পরওয়ান—পরোয়ানা। সাচ্চারই—সত্যেরই। বোরহান—প্রমাণ। রোয়ে—কাঁদে। আমিনা—হজরত মোহাম্মদ (সা) জননীর নাম। খোদার হাবিব—আল্লার বন্ধু (হজরতের খেতাব)। আবদুল্লাহ্—হজরতের স্বর্গগত পিতা। রুহ্—আত্মা। ‘গমি’—দুঃখ। ‘গমি’ নাই—দুঃখ করো না। ভরপুর—পূর্ণ। ‘কমি’—অপূর্ণ। ‘কমি’ নাই—আজ কিছু অপূর্ণ নাই।
আজরাইল—যমদূত। বে-দরদ—নির্মম। সুরাখ—ঝাঁঝরা। খাক্—মাটি। নীলা তাজ—আজরাইলের মাথার তাজ নীলবর্ণ। জিবরাইল—প্রধান ফেরেশতা ও স্বর্গীয় বার্তাবহ। আতশি—অগ্নিময়। মিকাইল—একজন ফেরেশতার নাম। কুল মুল্লুকে—সর্বদেশে। ইসরাফিল—প্রলয়-বিষাণধারী ফেরেশতা। রসুল—প্রেরিত পুরুষ। আজাজিল—শয়তানের নাম। তাজি বোর্রাক—বোররাক নামক স্বর্গীয় ঘোড়া। আরশ—খোদার সিংহাসন। ফিরদৌস—বেহেশ্ত, স্বর্গবিশেষের নাম। নার্গিস লালা—ফুলের নাম।
তন্—দেহ। দরাজ দস্তে—বিশাল হাতে। জুলফিকার—হজরত আলীর দুধারী তলোয়ার। মাহ্বুব—প্রিয়।