উৎসর্গ

বাংলার অগ্নি-নাগিনি মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব

আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা

মিসেস এম. রহমান সাহেবার

পবিত্র চরণারবিন্দে –

এমনই প্লাবন-দুন্দুভি-বাজা ব্যাকুল শ্রাবণ মাস–

সর্বনাশের ঝান্ডা দুলায়ে বিদ্রোহ-রাঙা-বাস

ছুটিতে আছিনু মাভৈঃ-মন্ত্র ঘোষি অভয়কর,

রণ-বিপ্লব-রক্ত-অশ্ব কশাঘাত-জর্জর!

সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে,

ওগো নাগমাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে!

কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে,

নির্জিত তব ফণা-নিঙড়ানো গরলের ধারা গলে;

পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন-চূর

আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর!

আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল সে তব ফণা-ছায়া-দোল

হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল।

ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল,

নোয়াইল শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল!

ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী

উল্লাসে ‘জয় জয় নাগমাতা’ হাঁকিল জয়-ধ্বনি!

বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল!

দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি পতাকা জ্বালা-উজল!

তারপর মা গো কোথা গেলে তুমি, আমি কোথা হনু হারা,

জাগিয়া দেখিনু, আমারে গ্রাসিয়া রাহু রাক্ষস-কারা!

শৃঙ্খলিতা সে জননীর ব্যথা বাজিয়া এ ক্ষীণ বুকে

অগ্নি হয়ে মা জ্বলেছিল খুন, বিষ উঠেছিল মুখে,

শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখি সম

পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম,—

সে আক্রমণ ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ,

বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ।

হাতে পায়ে কটি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল,

অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ, তৃষায় মেলে না জল,

কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনিকো আলো বায়ু,

তারই মাঝে আসি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে স্নায়ু –

এত যন্ত্রণা তবু সব যেন বুকে ক্ষীর হয়ে ওঠে,

শত্রুর হানা কণ্টক-ক্ষত প্রাণে ফুল হয়ে ফোটে!–

এরই মাঝে তুমি এলে নাগমাতা পাতাল-বন্ধ টুটি

অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি!

তোমার মমতা-মানিক-আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,

তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী! তোমার আঁচল পাতা

নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে

ফণা তব মা গো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে! –

আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,

সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে,

নহে তার তরে, – সব সন্তানে তুমি যে বেসেছ ভালো,

তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো,

শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি,–

সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি!

হুগলি

১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১

তোমার নাগ-শিশু

নজরুল ইসলাম