এক
রাঠোন রাজকুমারী যমুনাবাই ছেলেবেলায় তাহার পিতার ক্রোড়ে বসিয়া বলিত—‘বাবা, তুমি সিংহাসনে বসিয়া বিচার কর না কেন?’ অজয় সিংহ কন্যার শির চুম্বন করিয়া বলিতেন—‘মা, তোমার বুড়ো বাবার বড় ভুল হয়, তাই সে আর বিচার করে না—সিংহাসনে বসিয়া শুধু ক্ষমা করিতে ভালবাসে। তুমি যখন ঐ স্বর্ণ সিংহাসনে বসিবে, তখন কি করিবে যমুনা?’
যমুনা বলিত—‘আমি নিজে বিচার করিব। অপক্ষপাত বিচার করিয়া যে দোষী তাহাকে নিশ্চয় শাস্তি দিব। দোষ করিলে আমি কাহাকেও ক্ষমা করিব না।’
বৃদ্ধ রাজা হাসিতেন। বলিতেন—‘মা, ক্ষমা কেহ করে না—ক্ষমা হৃদয় হইতে আপনি বাহির হইয়া দোষীর দোষটুকুকে এমন স্নেহের সহিত কোলে লইয়া বসে যে রাজাও সে মুখ দেখিয়া নিজের চোখের জল সামলাইতে পারে না। ক্ষমা আপনি ক্ষমা করে। ভুল প্রমাদের সংসারে এ স্বর্গীয় প্রবৃত্তি মানুষের হৃদয়ের একটি ছোট নির্জন প্রান্তে বসিয়া থাকে, প্রয়োজন হইলে সে শতমুখী অমৃত প্রস্রবিণীর মত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়ে; কেহই তাহার গতিরোধ করিতে পারে না। আমিও সে গতিরোধ করিতে পারি না—তাই লোকে বলে—বৃদ্ধ অজয় সিংহ শুধু ক্ষমা করিতেই আছে।’
‘আমি কিন্তু নিজেই বিচার করিব—মিছামিছি কখন ক্ষমা করিব না।’
‘যদি কখন আমার বয়স পাও’—বৃদ্ধ রাজা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘যদি কখন তেমনটি ঘটে, তখন দেখিতে পাইবে রাজা হইয়া রাজসিংহাসনে বসিয়া বিচার করার মত ঘৃণার কাজ আর নাই—যখন দেখিতে পাইবে একটি মাত্র কথার জন্য হৃদয়ের সমস্ত রক্ত ছুটিয়া গিয়া ব্যাকুলভাবে দোষীর পদতল ধৌত করিয়া দিবার জন্য তুমুল তুফান তুলিয়াছে, তখন তোমার এই বৃদ্ধ পিতার কথা মনে করিবে ত?’
যমুনার চক্ষে জল আসিল, বলিল—‘সে কি বাবা?’
বৃদ্ধ রাজা মলিনমুখে হাসিয়া কহিলেন—’যখন যৌবনকাল ছিল তখন সিংহাসনে বসিয়া বিচার করিতাম; এখন আর সে ক্ষমতা নাই। এখন দেখিতেছি, এ বিশ্বে শুধু একজন বিচারকর্তা আছেন; তিনি পাপ-পুণ্যের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই বলিতে পারেন—কে দোষী, কে নির্দোষ। আমরা মাত্র শুধু বিচারের ভান করি আর অবিচার করি।