তিন

যমুনা কহিল, ‘ভাই মলিনা, ভরত সিংহকে বড় দেখিতে ইচ্ছা করে, সে নাকি বড় যোদ্ধা, বড় সাহসী বীরপুরুষ।’

মলিনার মুখের উপর কাল ছায়া পড়িল, বলিল, ‘বাবা বলেন, তাহার তুল্য যোদ্ধা রাজপুতের মধ্যে নাই, শত হস্তের মধ্যে কোন মৃগই তাহার বর্শার ফলা ছাড়াইয়া যাইতে পারে না, বাহুর এত বলের কথা কোথাও শুনিয়াছ কি?’

যমুনা বলিল, ‘আহা যদি প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা না দিতাম।’

মলিনা আগ্রহের সহিত কহিল, ‘সেই ভাল, প্রাণদণ্ডাজ্ঞা মার্জনা করিয়া দাও।’

যমুনা মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘মহারানীর আজ্ঞার প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’

মলিনা বলিল,—’মহারানী হইয়া কেন এমন করিলে?’

‘সে রাজ্যের শত্রু—মহারানীর শত্রু, সিংহাসন তাহার প্রাণ লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে—আমি নিজে তত হই নাই। সে কথা যাউক, কিন্তু একবার তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করে। পর্বতের মত ভীম শরীর, গালপাট্টা দাড়ি, হস্তপদগুলা লৌহের মত—চক্ষু দুটি সাদা রক্তবর্ণ—কেমন মলিনা, একবার দেখিতে সাধ হয় না?’

‘হয় বৈ কি! বলে দাও এইখানে প্রাসাদের নীচে তাহাকে দাঁড় করাক, আমরা গবাক্ষ দিয়া দেখিব।’

‘ছিঃ, বীরপুরুষের কি অপমান করিতে আছে? ইহাতে তাহার বড় ক্লেশ হইবে—আজ সন্ধ্যার সময় আমরা পুরুষের বেশে কারাগারে গিয়া দেখিয়া আসিব।’

সন্ধ্যার পর তাহারা দুইটি কিশোর রাজপুত সাজিয়া দ্বারপালের নিকট রানীর অনুজ্ঞাপত্র দেখাইয়া প্রবেশ করিল। ঘরে ঘরে কত শৃঙ্খলাবদ্ধ রাজপুত বন্দী বসিয়া আছে দেখিতে পাইল। দাড়ি গোঁফ, গালপাট্টা, লোহার মত শরীর এমন কতজন কাতরমুখে সময় কাটাইতেছে দেখা গেল, কিন্তু কাহাকেও ভরত সিংহের মত বোধ হইল না।

দুইজনের মধ্যে কেহ বলিল, ‘ওই।’ কেহ বলিল, ‘দূর, একি রাজপুত্রের মত দেখিতে?’ দুইজনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল একটা কক্ষে প্রহরীর সংখ্যা কিছু অধিক, জিজ্ঞাসা করিল, ‘এ ঘরে কে আছে?’

প্রহরী বলিল—’রাজকুমার ভরত সিংহ।’

‘যাইতে দিবে?’

প্রহরী মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না।’

তাহারা অনুজ্ঞাপত্র দেখাইয়া কহিল, ‘মহারানীর আদেশে আমরা সর্বস্থান যাইবার অধিকার পাইয়াছি।’

প্রহরী সসম্মানে পথ ছাড়িয়া দিল।

তাহারা ভিতরে প্রবেশ করিয়া অবাক হইয়া গেল। এই রাজপুত্র! পরিষ্কার শয্যার উপর একজন ক্ষীণকায় শুভ্র ক্ষুদ্র দেহ লইয়া ঘুমাইয়া আছে। মলিনা কহিল, ‘এই রাজপুত্র!’ যমুনা বলিল, ‘এই ভরত সিংহ, এই দেহে এত শক্তি?’ মলিনা বলিল, ‘এতো আমাদের সমবয়সী।’ যমুনা প্রতিবাদ করিল, ‘না আমাদের চেয়ে বড়। আমার দাদা স্বর্গে গিয়াছেন, তিনি বাঁচিয়া থাকিলে এত বড় হইতেন।’

মলিনা ডাকিল, ‘রাজপুত্র।’

রাজপুত্র ফিরিয়া দেখিল। সে শুধু চক্ষু মুদিয়া ছিল। কহিল, ‘কে তোমরা?’

‘আমরা আপনাকে দেখিতে আসিয়াছি। আমরা রাজার আত্মীয়।’

যমুনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘পীড়া কিছু উপশম হইয়াছে কি?’

‘না, বড় ক্লেশ পাইতেছি। বস।’

তাহারা কাছে বসিল।

মলিনা জিজ্ঞাসা করিল, ‘রাজপুত্র এখানে কোনরূপ অসুবিধা বোধ করিতেছেন?’

‘না, দুর্জয় সিংহ যথেষ্ট যত্ন করিতেছেন।’

সে রাত্রে ফিরিয়া যাইবার সময় মলিনা, যমুনার হাত ধরিয়া বলিল, ‘সখি, অভিমন্যু বধ করিবে?’