বিধি বিড়ম্বনায় “বিদ্যাসাগর” যথাসময়ে প্রকাশিত হয় নাই। তিন মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। দৌর্ব্বল্য জন্য দুই মাস “বিদ্যাসাগর” সম্বন্ধে কোন কাজ করিতে পারি নাই। ইহা অবশ্য বিড়ম্বনার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহোদর শ্রীযুক্ত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়, সর্ব্বপ্রথম বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী প্রকাশ করেন। তাঁহার নিকট আমার সর্ব্বাগ্রে কৃতজ্ঞতা-স্বীকার কর্ত্তব্য। “বিদ্যাসাগর” প্রকাশে অনেকেই অনেক প্রকারে আমাকে সাহায্য করিয়াছেন। পুস্তকের অভ্যন্তরে তাঁহাদের নামোল্লেখ আছে। আমি তাঁহাদের নিকট চির-কৃতজ্ঞতা-পাশে বদ্ধ রহিলাম।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, আমাকে অনেক চিঠি-পত্র দিয়া সাহায্য করিয়াছেন। তাঁহার নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবন-ঘটিত যে সমুদয় চিঠি-পত্র ছিল, সে সমুদয়ই পাইবার আশা পাইয়াছিলাম। আমার দুরদৃষ্টবশতঃ তাহার কতক হস্তান্তরিত হইয়া পড়ে। যাহা হউক, তিনি আমাকে যে সব দুর্লভ আবশ্যক চিঠি-পত্র দিয়াছেন, তাহার জন্য তাঁহার নিকট আমি চির-ঋণী।

আমি বহু কষ্টে, বহু শ্রমে এবং অর্থব্যয়ে যে সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছি, হয়ত তাহাদের কাহারও কাহারও উপযুক্ত ব্যবহার করিতে পারি নাই। আশা আছে, ভবিষ্যতে আমা অপেক্ষা যোগ্যতর জীবনী-লেখকের হস্তে তাহাদের সদ্ব্যবহার হইবে। আমি যাহা সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা যদি কোন সময়, সাধারণের সম্পত্তিরূপে, সাধারণের হিতার্থে নিয়োজিত হয়, তাহা হইলে, আমার সংগ্রহ-শ্রম সার্থক হইবে।

নানা কারণে, মূল ইংরেজি চিঠি-পত্র প্রকাশ করিতে পারিলাম না। মূলের সৌন্দর্য্য অনুবাদে রক্ষিত হয় না। তবে অনেকটা ভাবগ্রহ হইয়া থাকে। এই জন্য ইংরেজী চিঠি-পত্রাদির বাঙ্গালায় মর্ম্মানুবাদ দিয়াছি।

ইংরেজী চিঠি-পত্রাদির অনুবাদ সম্বন্ধে আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু শ্রীযুক্ত ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এম, এ, শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনাথ বসু, বি, এল, সোদরপ্রতিম শ্রীমান্ নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, বি, এ, শ্রীমান্ কানাইলাল ঘোষ এবং আমার শ্রদ্ধাস্পদ সহকারী শ্রীযুক্ত হরিমোহন মুখোপাধ্যায় অনেকটা সাহায্য করিয়াছেন। ভূতপূর্ব্ব ডাইরেক্টর টনি সাহেব, অনুগ্রহপূর্ব্বক সংস্কৃত-কলেজের পুরাতন কাগজপত্র দেখিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। সংস্কৃত-কলেজের ভূতপূর্ব্ব অধ্যক্ষ মহা-মহোপাধ্যায় পণ্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন মহাশয়, তৎসম্বন্ধে সহায়তা করিয়াছিলেন। নিম্নলিখিত পত্রে তাহার প্রমাণ,—

শ্রীশ্রীদুর্গা
শরণং
সংস্কৃত কলেজ
৮। ৮। ৯২

সবিনয়নিবেদনমিদম্।

শ্রীযুক্ত ডিরেক্টর সাহেবের চিঠি আসিয়াছে। ৺বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী সম্বন্ধে কলেজ হইতে যাহা অনুসন্ধান করেন, তাহা পাইতে পারেন। ইতি

ভবদীয়স্য

শ্রীমহেশচন্দ্র শর্ম্মা।

বিদ্যাসাগরকে হিন্দু যে চক্ষে দেখিয়া থাকে এবং হিন্দুর যে চক্ষে দেখা কর্ত্তব্য, বিদ্যাসাগরের কার্য্যালোচনায় তাহা বুঝাইবার প্রয়াস পাইয়াছি। সে সম্বন্ধে কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি, তাহার বিচার বিজ্ঞ পাঠকগণই করিবেন।

প্রার্থনা

মানুষ অপূর্ণ। তাই মানুষের কাজ একেবারে ভ্রমবর্জ্জিত হয় না। আমি মূঢ়, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, “বিদ্যাসাগরকে” একেবারে ভ্রমশূন্য করিব। বিশেষতঃ ষোড়শ বর্ষাধিক কাল বাঙ্গালা ছাপাখানার সহিত কুটুম্বিতা করিয়াও যখন আমার এইরূপ স্পর্দ্ধিত প্রতিজ্ঞা, তখন আমার মূঢ়তা অপরিমেয় ও অমার্জ্জনীয়। কেবল ছাপাখানার দোহাই দিয়া আত্ম-নিষ্কৃতির প্রয়াস পাইলে, প্রত্যব্যয় হয়। ছাপাখানার ভ্রম অনেকাংশে অক্ষরগত। আমার ভ্রম বিষয়, ভাব ও ভাষা সংক্রান্ত। কেবল ভ্রম কেন, কোন কোন স্থানে ত্রুটি ও সংশয় আছে। আমার সবিনয় নিবেদন, পাঠকবর্গ অনুগ্রপূর্ব্বক অক্ষরগত ভ্রম স্বয়ং সংশোধন করিয়া লইবেন। আত্মকৃত যে ভ্রম-ত্রুটি বুদ্ধিগোচর হইয়াছে, তাহার যথাযোগ্য সংশোধন করিয়া লইতে সঙ্কুচিত নহি। আমার বুদ্ধিগোচর হয় নাই, এমন ভ্রমও থাকিতে পারে। দয়া করিয়া, কেহ তাহা দেখাইয়া দিলে, অকৃতজ্ঞতার কলঙ্কে কলুষিত হইব না।