» » দ্বিতীয় অধ্যায়

জন্ম, কোষ্ঠী-বিচার, পাঠশালার শিক্ষা, পাঠশালায় প্রতিভা, বাল্য-চাপল্য, বাল্য-প্রতিভা, কলিকাতায় আগমন, পীড়িত অবস্থায় প্রতিগমন, পুনরাগমন ও শিক্ষার ব্যবস্থা।

১২২৭ সালের ১২ই আশ্বিন বা ১৮২০ খৃষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দিবা দ্বিপ্রহরের সময় ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাহার পিতা ঠাকুরদাস বাড়িতে ছিলেন না। তিনি কুমারগঞ্জের হাটে গিয়াছিলেন। কুমারগঞ্জ বীরসিংহ গ্রামের অৰ্দ্ধ ক্রোশ অন্তরে। হাট হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় তাঁহার সহিত পিতা রামজয়ের পথে সাক্ষাৎ হয়। রামজয় বলিলেন,—“ঠাকুরদাস, আজ আমাদের এঁড়েবাছুর হয়েছে।” রামজয় পৌত্র ঈশ্বরচন্দ্রকেই লক্ষ্য করিয়া রহস্যচ্ছলে এই কথা বলিয়াছিলেন। ইহার ভিতর কিন্তু সদ্যোজাত শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রকৃত পুর্ব্বাভাস নিহিত ছিল। এঁড়ে গরু, যেমন “একগুঁয়ে,” শিশুও তেমনই “একগুঁয়ে” হইবে, দীৰ্ঘদর্শী প্রবীণ রামজয় বোধ হয় শিশুর ললাট লক্ষণ অথবা হস্তরেখাদি দর্শনে বুঝিয়াছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মও “বৃষ রাশিতে”। “বৃষ রাশিতে” জন্মগ্রহণ করিলে “একগুঁয়ে” অথবা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইতে হয়,—

বৃষবৎ সন্মাৰ্গবৃত্তোঽতিতরাং প্রসন্নঃ সত্যপ্রতিজ্ঞোঽতিবিশালকীর্ত্তিঃ।

প্রসন্নগাত্রোঽতিবিশালনেত্রো বৃষে স্থিত রাত্রিপতে প্রসূতঃ॥”

—ভোজ।

ঈশ্বরচন্দ্রের “একগুঁয়েমি”র পরিচয় তাঁহার জীবনে পরিলক্ষিত হইত। “একগুঁয়ে” লোক দ্বারা ভাল কাজ যেমন অতি ভালরূপে হয়, মন্দ কাজ তেমনই অতি মন্দরূপে হইয়া থাকে। “একগুঁয়েমি”র ফল দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা। এই জন্য ষ্টীফেন জিরার্ড, “একগুঁয়ে” কেরাণীকেই নিজের অধীন কর্ম্মে নিযুক্ত করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি যে কাজ ধরিতেন, সে কাজ না করিয়া ছাড়িতেন না। ভাল মন্দ উভয় কাজে ইহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।

ঠাকুরদাস পিতার কথার প্রকৃত রহস্য বুঝিতে পারেন নাই। তিনি ভাবিইয়াছিলেন, তাঁহাদের বাড়ীতে একটা “এড়েঁ” বাছুর হইয়াছে। সেই সময়ে তাঁহাদের একটা গাভীও পূর্ণগর্ভ ছিল। পিতা-পুত্রে সত্বর বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন। ঠাকুরদাস গোয়ালে গিয়া দেখিলেন, বাছুর হয় নাই। তখন পিতা রামজয় তাঁহার সুতিকাঘরে লইয়া গিয়া সদ্যোজাত শিশুটিকে দেখাইয়া বলিলেন,—“এই সেই “এড়েঁ”; এবং “এড়েঁ” বলিবার প্রকৃত রহস্যটুকু উদ্ঘাটন করিলেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তৃতীয় অনুজ ৺শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয় বলেন,—“তীর্থক্ষেত্র হইতে সমাগত পিতামহ রামজয় বন্দোপাধ্যায় নাড়ীচ্ছেদনের পূর্ব্বে আলতায় ভূমিষ্ঠ বালকের জিহ্বার নিম্নে কয়েকটি কথা লিখিয়া তাঁহার পত্নী দুর্গা দেবীকে বলেন,—লেখার নিমিত্ত শিশুটা কিয়ৎক্ষণ মাতৃদুগ্ধ পায় নাই। বিশেষতঃ কোমল জিহ্বায় আমার কঠোর হস্ত দেওয়ায় এই বালক কিছুদিন তোতলা হইবে। আর এই বালক ক্ষণজন্মা, অদ্বিতীয় পুরুষ ও পরম দয়ালু হইবে এবং ইহার কীর্ত্তি দিগন্তব্যাপিনী হইবে।” বিদ্যারত্ন মহাশয় বলেন,—“তিনি এই সব কথা ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা, মাতামহী ও পিতামহীর মুখে শুনিয়া ছিলেন।” বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বরচিত চরিতে কিন্তু এ কথার উল্লেখ করেন নাই; অধিকন্তু আমাদের বন্ধু বিশ্বকোষ নামক বিবিধ বিষয়ক পুস্তক-সঙ্কলয়িতা শ্রীযুক্ত রায়সাহেব নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয় এ কথার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। বন্ধু তাঁহার জীবনীর তত্ত্ব সংগ্রহ করিয়া “বিশ্বকোষে” মুদ্রিত করিবার জন্য তাঁহার নিকট গিয়াছিলেন। তৎকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভ্রাতা বিদ্যারত্ন মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এ কথার উত্থাপন করিয়াছিলেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“ও সব কথা শুনিও না ও সব অমূলক।”[১]

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মগ্রহণ করিবার কিয়ৎক্ষপ পরে গ্রহবিপ্র কেনারাম আচার্য্য তাঁহার ঠিকুজি প্রস্তুত করেন। আচার্য্য মহাশয় ঠিকুজি প্রস্তুত করিবার কালে ফল বিচার করিয়া বিস্মিত হন। তিনি বালকের ভবিষ্যৎ জীবন শুভজনক বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোষ্ঠী গণনায় এইরূপ নির্দ্ধারিত হয়। কোষ্ঠীগণনায় ভবিষ্যৎ জীবনের পূর্ব্বাভাস পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোষ্ঠপর্য্যালোচনায় তাহা প্রতিপন্ন হয়। আমরা নিয়ে তৎপর্য্যালোচনায় প্রবৃত্ত হইলাম।

শুভমস্ত—শকাব্দাঃ ১৭৪২। ৫। ১১। ১৫। ৪১

১৫
২০ ৪৩ ৩৪
৫২ ৫২
৪৭ ১২

জাতাহঃ

১৭৪২ শকের ১২ই আশ্বিন ১৫ দণ্ড ৪১ পল সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্ম হয়। তৎকালে ধনুর্লগ্নের উদয় হইয়াছিল। ইঁহার জন্মলগ্নাবধি তৃতীয় স্থানে বৃহস্পতি, চতুর্থ স্থানে রাহু ও শনি, ষষ্ঠে চন্দ্র, অষ্টমে শুক্র, দশমে রবি, বুধ ও কেতু এবং একাদশ স্থানে মঙ্গল গ্রহ বিদ্যমান ছিল।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মকালীন রবি, বুধ, শনি, রাহু ও কেতু এই পাঁচটী গ্রহ কেন্দ্রস্থানে; বুধ স্বক্ষেত্রে এবং চন্দ্র ও বুধ গ্রহ তুঙ্গস্থানে ছিল। সামান্যরূপ বুধাদিত্য-যোগও ছিল।

একাদি গ্রহ স্বক্ষেত্রে থাকিলে কি ফল?

“কুলতুল্যঃ কুলশ্রেষ্ঠো বন্ধুমান্যো ধনী সুখী।

ক্রমান্ন পসমো ভূপ একাদৌ স্বগৃহে স্থিতে॥”

যাহার একটী গ্রহ স্বক্ষেত্রে থাকে, সেই ব্যক্তি কুলতুল্য হয়। দুইটী থাকিলে কুলশ্রেষ্ঠ, তিনটীতে বন্ধুমান্য, চারিটী হইলে ধনী, পাঁচটীতে সুখী, ছয়টীতে রাজতুল্য এবং সাতটী গ্রহই স্বক্ষেত্রে থাকিলে রাজা হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একটী গ্রহ স্বক্ষেত্রে; এইজন্য তিনি কুলোচিত তেজস্বী ছিলেন। একাদিগ্রহ তুঙ্গগত হইলে কি ফল?

“উৎকৃষ্টাঃ স্ত্রীসুখিনঃ প্রকৃষ্টকার্য্যা রাজপ্রতিরূপকাশ্চ।

রাজান্ একদ্বিত্রিচতুর্ভির্জায়ন্তের্হতঃ পরং দিব্যাঃ॥”

ইতি কুটস্থীয়ে। রঘুবংশ ৫সর্গ ১৩ শ্লোকে মল্লিনাথ।

যাহার একটী গ্রহ তুঙ্গী থাকে, তিনি উৎকৃষ্ট লোক, দুইটী থাকিলে স্ত্রীসুখী, তিনটি থাকিলে উৎকৃষ্ট কার্য্যকারী, চারিটী থাকিলে রাজপ্রতিরূপ, পাঁচটা গ্রহ তুঙ্গী হইলে রাজা হয় এবং নরাকারে অবতীর্ণ-দেবতারই ছয়টী গ্রহ তুঙ্গী হয়। সাতটী গ্রহ একেবারে তুঙ্গী হয় না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দুইটী গ্রহ তুঙ্গী।

ধনবত্তাদিযোগ।

“লগ্নাদতীব বসুমান্ বসুমান্ শশাঙ্কাৎ

সৌম্যগ্রহৈকপচয়োপগতৈঃ সমস্তৈঃ।

দ্বাভ্যাং সমোঽল্পবসুমাংশ্চ তদৃনতয়া

মন্যেষু সৎস্বপি ফলেষ্বিদমুৎকটেন॥”

দীপিকাযাম্॥

জন্মকালে লগ্ন হইতে যদি সমস্ত শুভগ্রহ উপচয়গত অর্থাৎ তৃতীয়, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ স্থানগত হয়, তবে অত্যন্ত ধনবান্ হয়। ঐরূপ জন্মরাশি হইতেও যদি সমস্ত শুভগ্রহ উপচয়গত হয়, তবে ধনবান্ হয়। দুইটী গ্রহ যদি লগ্নের বা রাশির উপচয়গত হয়, তবে মধ্যমরূপ ধনবান্ হয় এবং তদপেক্ষা কম থাকিলে সামান্যরূপ ধনবান্ হয়। অন্যান্য ফলসকল অপেক্ষা ইহারই ফল অধিক হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোষ্ঠীতে লগ্ন হইতে বৃহস্পতি, চন্দ্র ও বুধ এবং জন্মরাশি হইতে শুক্র ও বুধ উপচয়গত।

“বিনয়বিত্তাদীনামধমমধ্যমোত্তমাদ্বিনিরূপণম্।”

দীপিকায়াং ৬৫ শ্লোকঃ

“অধমসমবরিষ্ঠান্যর্ককেন্দ্রাদিসংস্থে

শশিনি বিনয়-বিত্ত-জ্ঞান-ধী-নৈপুণ্যানি।

অহনি নিশি চ চন্দ্রে স্বাধিমিত্রাংশকে বা

সুরগুরু সিতদৃষ্টে বিত্তবান্ স্যাৎ সুখী চ॥”

জন্মকালে চন্দ্র যদি রবির কেন্দ্র (স্বস্থান, চতুর্থ, সপ্তম, দশম) স্থানগত স্থায়, তবে নিয়ম, ধন, জ্ঞান, বুদ্ধি ও নিপুণতা অধমরূপ হয়। চন্দ্র, রবির পণকর (দ্বিতীয়, পঞ্চম, অষ্টম, একাদশ) স্থানে থাকিলে বিনয়াদি মধ্যম রূপ হয়। আর ঐ চন্দ্র যদি রবির আপোক্লিম (তৃতীয়, ষষ্ঠ, নবম, দ্বাদশ) স্থানগত হয়, তবে বিনয়াদি সমস্তই উত্তমরূপ হইয়া থাকে। অথবা চন্দ্র যদি স্বীয় অধিমিত্র গৃহে থাকিয়া বৃহস্পতি বা শুক্র কর্তৃক দৃষ্ট হয়, তবে ধনী ও সুখী হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোষ্ঠীতে চন্দ্র রবির আপোক্লিম-গত; অতএব উহার বিনয়াদি উৎকৃষ্টরূপ ছিল।

তুঙ্গগত চন্দ্রের ফল।

“স্থিরগতিং সুমতিং কমনীয়তাং কুশলতাং হি নৃণামুপভোগতাম্।

বৃষগতো হিমগুর্ভৃশমাদিশেৎ সুকুতিতঃ কৃতিতশ্চ সুখানি চ॥”

ঢুণ্টিরাজ।

জন্মকালে চন্দ্র, বৃষরাশিগত হইলে, জাত মানবের স্থির গতি, সদ্‌বুদ্ধি, সৌন্দর্য্য, নৈপুণ্য, উপভোগ এবং স্বীয় পুণ্য ও কার্য্য হইতে সুখ হইয়া থাকে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মকালে বৃষ রাশিতে চন্দ্র ছিল।

তুঙ্গগত বুধের ফল। ঢুণ্টিরাজীয়-জাতকভরণে—

“সুবচনানুরতশ্চতুরো নরো লিখনকর্ম্মপরো হি বরোন্নতিঃ।

শশিসুতে যুবতৌ চ গতে সুখী সুনয়নানয়নাঞ্চলচেষ্টিতৈঃ॥”

জন্মকালে কন্যারাশিতে বুধ থাকিলে, জাত মানব সদ্‌বক্তা, চতুর, উত্তম লেখক, উন্নতিমান্ এবং সুন্দরী রমণীর নয়নাঞ্চলচেষ্টাদি দ্বারা সুখী হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মকালে কন্যারাশিতে বুধ আছে।

“লগ্নাৎ কর্ম্মণি তুর্য্যে চ যদি স্যুঃ পাপখেটকাঃ।

স্বধর্ম্মে নিতরাং তস্য জায়তে চঞ্চলা মতিঃ॥”

জাতকালঙ্কারটীকাযাম।

জন্মলগ্নের চতুর্থ ও দশম স্থানে পাপগ্রহ থাকিলে, মানবের স্বধর্ম্মে চঞ্চলা মতি হয়।

“কমাতুরশ্চিত্তহরোঽঙ্গনানাং স্যাৎ সাধুমিত্রঃ সুতরাং পবিত্রঃ।

প্রসন্নমূর্ত্তিশ্চ নরো বৃষস্থে শীতদ্যুতৌ ভূমিসুতেন দৃষ্টে॥”

ঢুণ্টিরাজ।

জন্মকালে বৃষরাশিস্থ চন্দ্রের উপর মঙ্গলের দৃষ্টি থাকিলে, জাত মনুষ্য কামাতুর, কামিনী-মনোরঞ্জন, সজ্জন-বন্ধু, অত্যন্ত পবিত্র এবং প্রসন্ন মূর্ত্তি হয়।

“ব্যয়শে তদ্রিপ্‌ফগতে তত্র দৃষ্টি শুভৈর্গ্রহৈঃ।

দানবীরো ভবেন্নিত্যং সাধুকর্ম্মসু মানবঃ॥”

শম্ভুহোরাপ্রকাশ।

যে ব্যক্তির জন্মকালে লগ্নের দ্বাদশ স্থানের অধিপতি গ্রহ, দ্বাদশের দ্বাদশগত হয়, আর ঐ দ্বাদশ স্থানে শুভগ্রহের দৃষ্টি থাকে, তবে সেই ব্যক্তি সৎকর্ম্মে দান-বীর অর্থাৎ অত্যন্ত দাতা হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লগ্নের দ্বাদশাধিপতি মঙ্গল একাদশ স্থানে আছে এবং ঐ দ্বাদশ স্থানে বৃহস্পতি ও চন্দ্রের দৃষ্টি আছে। উত্তরকালে ইনি একজন প্রসিদ্ধ বদান্য হইয়াছিলেন।

ইতি সংক্ষেপ।

শুভগ্রহ সঙ্গে সঙ্গে। ভবিষ্যৎ জীবনের পূর্বাভাস জন্মগ্রহণে। ক্ষণজন্ম বিদ্যাসাগর মহাশয় জন্মগ্রহণ করিলেন; ধীরে ধীরে অলক্ষ্যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ পিতা ঠাকুরদাসের কুটীরে একটু লক্ষ্মী-শ্রী দেখা দিল। পাড়ায় পাড়ায় রব উঠিল,—“বাড়ুয্যেদের বাড়ীতে পয়মন্ত ছেলে জন্মিয়াছে।” “পয়মন্তের” প্রতিপত্তি বিদ্যাসাগরের বাল্যকাল হইতে। বাল্যকাল হইতে তিনি প্রতিবাসীর প্রীতিপাত্র।

পিতামহ রামজয় জাত পৌত্ত্রের নাম রাখিয়ছিলেন,— ঈশ্বর। পঞ্চম বৎসরে ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যারম্ভ হয়। তখন বীরসিংহ গ্রামের অবস্থা তাদৃশ উন্নত ছিল না। গ্রাম্য-পাঠশালায় বালকদিগের বিদ্যারম্ভ হইত। পাঠশালার শিক্ষা সাঙ্গ হইলে, উহারই মধ্যে অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ-সন্তানের টোলে সংস্কৃত শিক্ষার সুত্রপাত করিতেন। টোলে বিদ্যার পর্য্যাবসান। কেহ কেহ বা জমিদারী সেরেস্তাবিদ্যা শিখিতেন।

সে সময সনাতন সরকার গ্রামের গুরুমহাশয় ছিলেন। সরকার মহাশয় বড় প্রহারপটু ছিলেন বলিয়া ঠাকুরদাস পুত্ত্রের জন্য অন্য গুরুর অন্বেষণ করেন। কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামক এক কুলীন ব্রাহ্মণ তাঁহার মনোনীত হন। কালীকান্তের নিবাস বীরসিংহ গ্রাম। তিনি কিন্তু ভদ্রেশ্বরের নিকট গোরুটী গ্রামে শ্বশুর বাড়ীতে বাস করিতেন। কালীকান্ত স্বকৃত-ভঙ্গকুলীন। কৌলীন্য-কল্যাণে তাঁহার অনেকগুলি বিবাহ হইয়াছিল। ঠাকুরদাস তাঁহাকে আনাইয়া নিজগ্রামে একটী পাঠশালা করিয়া দেন। বালক বিদ্যাসাগর ও গ্রামের অন্যান্য বালকেরা তাঁহার পাঠশালায় পড়িত। তিনি যত্নসহকারে সকলকে শিক্ষা দিতেন। কালীকান্তের সৌজন্যে প্রতিবাসিমণ্ডলী তাঁহার প্রতি বড় অনুরক্ত ছিল।

পাঠশালায় প্রতিভার পরিচয়। বালক ঈশ্বরচন্দ্র তিন বৎসরে পাঠশালার পাঠ সাঙ্গ করেন। এই সময় তাঁহার হস্তাক্ষর বড় সুন্দর হইয়াছিল। তখন সর্ব্বত্র হস্তাক্ষর সমাদৃত হইত। হস্তাক্ষর বিবাহের সর্ব্বোচ্চ সুপারিস। গুরু কালীকান্ত, বালক বিদ্যাসাগরের বুদ্ধিমত্তা ও ধৃতি-ক্ষমতা দেখিয়া প্রায় বলিতেন,—“এ বালক ভবিষ্যতে বড় লোক হইবে।” এই সময় বালক বিদ্যাসাগর প্লীহা ও উদরাময় পীড়ায় আক্রান্ত হন। এই জন্য তাঁহাকে জননীর মাতুলালয় পাতুলগ্রামে যাইতে হয়। তাঁহার মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু তাঁহাদের সঙ্গে ছিলেন। পাতুল গ্রামে ক্রমাগত ছয় মাস কাল চিকিৎসা হয়। খানাকুল-কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত কোঠারা-গ্রামবাসী[২] কবিরাজ রামলোচনের চিকিৎসাগুণে বালক বিদ্যাসাগর সে যাত্রা রক্ষা পান। পাতুলগ্রামে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিয়া, তিনি বীরসিংহ গ্রামে পুনরাগমন করেন। পুনরায় কালীকান্তের উপর তাঁহার শিক্ষাভার সমৰ্পিত হয়। কালীকান্ত ঈশ্বরচন্দ্রকে বড় ভাল বাসিতেন। প্রত্যহ সন্ধ্যার পর তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে পাঠশালার চলিত অঙ্কপ্রভৃতি শিক্ষা দিতেন। রাত্রিকালে তাঁহাকে কোলে করিয়া লইয়া বাড়ীতে রাখিয়া আসিতেন। এই কালীকান্তের প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরকাল ভক্তিমান্ ছিলেন।

বিদ্যাসাগর বাল্যকালে বড় দুষ্ট ছিলেন। তাঁহার বালকসুলভ অনেক “দুষ্টুমি”রই পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকেই তো বাল্যকালে দুষ্টু হইয়া থাকে; কিন্তু সকলের কথা তো আর স্মরণীয় হয় না; পরন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠায়ও স্থান পায় না। ভবিষ্যৎ জীবন যাঁহার উজ্জ্বলতম হয়, তাহার বাল্যজীবন জানিতে লোকের আগ্রহ হইয়া থাকে। তাঁহার বাল্য জীবনের “দুষ্টুমি”টুকু জানিতে কেমন যেন মিষ্ট লাগে। ভগবান মানবাকারে লীলাচ্ছলে কৃষ্ণরূপে গোপগোপীদের ঘরে প্রবেশ করিয়া দুগ্ধ হাঁড়ি ভাঙিতেন; শ্রীশ্রীমহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বাল্যকালে গঙ্গাতীরে ব্রাহ্মণদের নৈবেদ্য কাড়িয়া খাইতেন; সেক্সপিয়র বাল্যকালে দুষ্টু ছেলেদের সঙ্গে ছুটিয়া হরিণ চুরি করিয়াছিলেন; কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের জ্বালায় তাহার জননী জ্বালাতন হইতেন। কোথায় কিছু নাই, একবার বালক ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ঘরের একখানা সেকেলে সাবেক ছবি দেখিয়া বড় ভাইকে বলিয়াছিলেন,—“দাদা। ছবিখানিতে ঘা-কতক চাবুক লাগাইয়া দাও তো”। বড় ভাই শুনেন নাই। তখন ওয়ার্ডসওয়ার্থ আপনি সপাসপ, চাবুক বসাইয়া দেন। বিলাতী পাদরী ডাক্তার পেলী বাল্যকালে বড় দুষ্টু ছিলেন। তখন তাঁহার জ্বালায় রাত্রিকালে পাড়ার লোক ঘুমাইতে পারিত না। এমন অনেক প্রতিষ্ঠাশালী প্রতিভাবান ব্যক্তির বাল্যজীবনের বাল্য স্বভাবোচিত “দুষ্টুমি”র কথা শুনা যায়। ছেলে দুষ্ট হইলে অনেকে অনেক সময় এই সব দৃষ্টান্তের স্মরণ করিয়া ভবিষ্যতের জন্য বুক বাঁধিয়া থাকেন। এক সময় এক ব্যক্তি একটি পুত্রকে সঙ্গে করিয়া লইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“এ ছেলেটা ভবিষ্যতে বড় লোক হবে।” আগন্তুক বলিলেন,—“মহাশয়! এ বড় দুষ্ট।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“দেখ ছেলেবেলায় আমি অমনই ছিলাম; পাড়ার লোকের বাগানের ফল পাড়িয়া চুপি চুপি খাইতাম; কেহ কাপড় শুখাইতে দিয়াছে, দেখিলে, তাহার উপর মলমূত্র ত্যাগ করিয়া আসিতাম; লোকে আমার জ্বালায় অস্থির হইত।”

বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ “বাল্য-দুষ্টুমির” কথা নিজে স্বীকার করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার আরও “দুষ্টুমি”র দুই একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মথুর মণ্ডল নামে একজন প্রতিবেশী ছিল। মথুর মণ্ডলের জননী ও স্ত্রী, বালক বিদ্যাসাগরকে বড় ভালবাসিতেন। বালক বিদ্যাসাগর কিন্তু প্রায় প্রত্যহ পাঠশালায় যাইবার সময় মথুরের বাড়ীর দ্বারদেশে মলমূত্র ত্যাগ করিতেন। মথুরের মাতা ও স্ত্রী দুই হস্তে তাহা মুক্ত করিতেন। বধু কোন দিন বিরক্ত হইলে, শাশুড়ী বলিতেন,—“ইহাকে কিছু বলিও না। ইহার ঠাকুরদাদার মুখে শুনিয়াছি, এ ছেলে একজন বড় লোক হইবে।” এক দিন বালক বিদ্যাসাগরের গলায় ধানের “সুঙা” আট্‌কাইয়া গিয়াছিল। তাহাতে তিনি মৃতকল্প হন। পিতামহী অনেক কষ্টে সেই ‘সুঙা’ বাহির করিয়া দিলে তিনি রক্ষা পান। দুষ্ট বালক প্রত্যহ ধান্যক্ষেত্রের পাশ দিয়া যাইতে যাইতে ধানের শিষ তুলিয়া চিবাইয়া খাইত। এক দিন তাঁহার উক্তরূপ ফল ফলিয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সেই বাৰ্দ্ধক্যের শান্ত দান্ত স্থির ধীর মূর্ত্তি দেখিলে কেহ মনে করিতে পারিত না যে, বাল্যে তিনি এত দুষ্ট ছিলেন। বস্তুতঃ প্রায় দেখিতে পাই, অনেকের বাল্যের দুষ্ট প্রকৃতি অধিক বয়সে পরিবর্ত্তিত হইয়া যায়।

পাঠশালের বিদ্যা সাঙ্গ হইলে, কালীকান্ত, ঠাকুরদাসকে এক দিন বলেন,—“ইহার পাঠশালার লেখা-পড়া সাঙ্গ হইয়াছে; এ বালক বড় বৃদ্ধিমান; ইহাকে তুমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া কলিকাতায় রাখ, তথায় ভাল করিয়া ইংরেজী বিদ্যার শিক্ষা দাও।” কালীকান্তের কথা শুনিয়া ঠাকুরদাস বালক বিদ্যাসাগরকে কলিকাতায় আনাই স্থির করেন।

এই সময় পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের দেহত্যাগ হয়। তাঁহার মুত্যু হইবার পর ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে বা ১২৩৬ সালের কার্ত্তিক মাসের শেষ ভাগে ঠাকুরদাস, গুরুমহাশয় কালীকান্তের পরামর্শে ঈশ্বরচন্দ্রকে লইয়া কলিকাতা যাত্রা করেন। সঙ্গে কালীকান্তু ও আনন্দরাম গুটি নামক ভৃত্য ছিল। অষ্টম-বর্ষীয় বালক, গৃহ পরিত্যাগ করিয়া বিদেশে যাইতেছে দেখিয়া, বালক বিদ্যাসাগরের স্নেহময়ী জননী মুক্তকণ্ঠে রোদন করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর যেমন মাতৃভক্ত ছিলেন, তাঁহার জননীও তেমনই পুত্ত্রবৎসল ছিলেন।

পিতা, পুত্র, গুরুমহাশয় এবং ভৃত্য,—চারি জনকেই পদব্রজে কলিকাতায় আসিতে হইয়াছিল। তখন জলপথ বড় সুগম ছিল না। উলুবেড়ের নূতন খালও তখন কাটা হয় নাই। গাঙের মাঝ দিয়া নৌকা করিয়া আসাটাও বড় বিপদ্-সঙ্কুল ছিল। একে তো ঝড়তুফানের ভয়, তাহার উপর দস্যু-ডাকাতের উপদ্রব; কাজেই গৃহস্থ লোক বড় কেই নৌকা করিয়া আসিত না। ব্যবসাদার মহাজনেরা নির্দিষ্ট দিনে জোট বাঁধিয়া যাতায়াত করিত মাত্র। এতদ্ভিন্ন অনেককেই হাঁটা পথে আসিতে হইত। যাতায়াতের সময় অনেকেই মধ্যে মধ্যে চটি বা আত্মীয়বর্গের বাটীতে আশ্রয় লইত। ঠাকুরদাসও সদল-বলে প্রথম দিন পাতুলগ্রামে মামা-শ্বশুরের বাটীতে বিশ্রাম করেন। পর দিন তিনি সন্ধ্যার সময় দশ ক্রোশ দূরস্থিত সন্ধিপুর গ্রামে এক জন আত্মীয় ব্রাহ্মণের বাটীতে থাকেন। পর দিন তাঁহার শেয়াখালা হইতে শালিখার বাঁধা রাস্তা দিয়া কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র যে ধারকতাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিপ্রভাবে ভবিষ্যৎ জীবনে কীর্ত্তিকুশলতা লাভ করিয়াছিলেন, এই পথের মাঝে সেই সুকুমার কোমল বয়সেই তাহার নিদর্শন দেখাইয়াছিলেন। বিশাল বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্ভব এইখানে হইল।

এই পথের মাঝে “মাইল-ষ্টোন” অর্থাৎ পথের দূরত্ব জ্ঞাপক শিলাখণ্ড দেখিয়া বালক ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞাসা করেন,—“বাবা, বাটনা বাটিবার শিলের মতন এটা কি গা?” পিতা ঠাকুরদাস ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,—“ইহার নাম ‘মাইল-ষ্টোন”—আধক্রোশ অন্তর এইরূপ এক একটা ‘মাইলষ্টোন’ পোতা আছে। ইংরেজী অক্ষরে মাইলের অঙ্ক লেখা।” ঈশ্বরচন্দ্র “মাইলষ্টোন” দেখিয়া ১ হইতে ১০ পর্য্যন্ত ইংরেজি অক্ষর শিখিয়া লইলেন। মধ্যে এক স্থানের “মাইল-ষ্টোন” দেখান হয় নাই। ঈশ্বরচন্দ্র বলেন,—“আমরা একটা, মাইল-ষ্টোন দেখিতে ভুলিয়া গিয়াছি।” গুরুমহাশয় কালীকান্ত বলেন,—“ভুলি নাই, তুমি শিখিয়াছ কি না, জানিবার জন্য তোমাকে দেখাই নাই।”

ক্রমে সন্ধ্যার সময় তাঁহারা শালিখার ঘাটে গঙ্গা পার হইয়া কলিকাতায় বড়বাজারের দয়েহাটায় শ্রীযুক্ত জগদ্‌দুর্লভ সিংহের বাটীতে উপস্থিত হন। এই জগদ্‌দুর্লভ সিংহের পিতা ভাগবতচরণ সিংহ ঠাকুরদাসকে বাড়ীতে আশ্রয় দিয়াছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের কলিকাতায় আসিবার পূর্ব্বে তাঁহার মৃত্যু হয়। জগদ্‌দুর্লভ বাবু পিতার ন্যায় ঠাকুরদাসকে ভক্তি-শ্রদ্ধা, এমন কি তাঁহাকে পিতৃসম্বোধনও করিতেন। জগদ্‌দুর্লভ একমাত্র বাড়ীর কর্ত্তা। বয়স তাঁহার তখন ২৫ পঁচিশ বৎসর মাত্র। গৃহিণী, জ্যেষ্ঠা, ভগিনী, তাঁহার স্বামী ও দুই পুত্ত্র, এক বিধবা কনিষ্ঠা ভগিনী ও তাঁহার এক পুত্ত্র,—এইমাত্র তাঁহার পরিবার।

বালক ঈশ্বরচন্দ্র এই পরিবারের বড় প্রীতিপাত্র হইয়াছিলেন। পর দিন প্রাতঃকাল হইতেই এই প্রীতির সূত্রপাত হইয়াছিল। বালক নিজের অদ্ভুত ধারকতা-শক্তিবলে সিংহপরিবারের সকলকেই স্তম্ভিত করিয়াছিলেন। যে দিন সন্ধ্যার সময় বালক ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হন, তাহার পর দিন পিতা ঠাকুরদাস, জগদ্‌দুর্লভ বাবুর কয়েকখানি ইংরেজী বিল ঠিক দিতেছিলেন। সেই সময় বালক ঈশ্বরচন্দ্র বলেন,—“বাবা, আমি ঠিক দিতে পারি।” কেবল বলা নহে; সত্য সত্যই বালক কযেকখানি বিল ঠিক দিয়াছিলেন। একটীও ভুল হয় নাই। উপস্থিত ব্যক্তিগণ চমৎকৃত হইলেন। গুরু কালীকান্ত পুলকিতচিত্তে ও প্রফুল্লবদনে ঈশ্বরচন্দ্রের মুখচুম্বন করিয়া বলিয়া উঠেন,–“বাবা ঈশ্বর, তুমি চিরজীবী হও। তোমায় যে আমি অন্তরের সহিত ভালবাসিতাম, আজ তাহা সার্থক হইল।”

মানব-জীবনের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করিলে ইহা বড় বিস্ময়ের বিষয় বলিয়া মনে হয় না। অসীম প্রতিভাসম্পন্ন বা অপরিমেয় বিদ্যাবুদ্ধিশালী বহুসংখ্যক ব্যক্তির বাল্যকালে ভবিষ্যৎ জীবনের পূর্বাভাসের পরিচয় এইরূপ পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ জীবনে যাঁহার যে শক্তিপুষ্টির প্রতিপত্তি, বাল্যজীবনে তাঁহার সেই শক্তির অঙ্কুরোৎপত্তি। এই জন্য মিণ্টন্‌ বলিয়াছেন,—

“The childhood shows the man as morning shows the day.”

প্রাতঃকাল-দৃষ্টে যেমন দিবার বিষয় বুঝা যায়, মানবের বাল্যকাল দৃষ্টে তাঁহার উত্তর কাল তেমনই বোধগম্য হয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলিয়াছেন,—

“Child is the father of man.”

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যখন সাত-আট বৎসরের সময় কলিকাতায় আসেন, তখন এক জন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন,—“ঈশ্বর, কলিকাতায় কেমন আছ?” ভবিষ্যতের কবি উত্তর দিলেন,—

“রেতে মশা, দিনে মাছি।

এই নিয়ে কলকাতায় আছি।”

বঙ্কিমচন্দ্র এক দিনে “ক, খ” শিখিয়াছিলেন।

জন্‌সনের অন্যান্য গুণের মধ্যে ধারকতা-শক্তির প্রতিষ্ঠা সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল। যে সময়ে বালক জন্‌সন সবেমাত্র লেখা পড়া শিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেই সময়ে এক দিন তাঁহার মাতা তাঁহাকে একখানি প্রার্থনা-পুস্তক মুখস্থ করিতে দেন। মুখস্থ করিতে বলিয়া মাতা উপরে উঠিযা যান। পুত্র পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া বলেন,—“মা, মুখস্থ করিয়াছি।” সত্য সত্যই বালক অনায়াসে সমস্ত মুখস্ত বলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি দুই বার মাত্র পুস্তকখানি পড়িয়াছিলেন।

পোপ ১২ বার বৎসর বয়সে কবিতা লিখিয়াছিলেন।[৩] বাল্যকালে তিনি কবিতা লিখিতেন। তাঁহার পিতার কিন্তু তাহা অভিপ্রেত ছিল না। এই জন্য পিতা তাঁহাকে কবিতা লিখিতে নিষেধ করেন; পোপ কিন্তু তাহা শুনিতেন না। এক দিন তাঁহার পিতা এই জন্য তাঁহাকে প্রহার করেন। প্রহারের পরও বালক কবিতায় বলিয়া ফেলিল,—

“Papa pao pity take,

I will no more verses make.”

মিল্টন্ বাল্যকালে যে পদ্য লিখিয়াছিলেন, তাহা দেখিয়া তাৎকালিক প্রসিদ্ধ লেখকবর্গ বিস্মিত ও লজ্জিত হইয়াছিলেন।

বিখ্যাত বিলাতী কারিকর (Mechanic) স্মিটন্‌ ছয় বৎসর বয়সে কলের ছাঁচ প্রস্তুত করিয়াছিলেন।

এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এ সব অমানুষিকী শক্তিরই পরিচয়। ইহা লইয়া ভাবিতে ভাবিতে কত মহা মহা চিন্তাশীল দার্শনিক ইহ-জগতের সুখৈশ্বর্য্য ভোগবিলাস পরিত্যাগ করিয়া চিন্তার অনন্ত সমুদ্রে ডুবিয়া গিয়াছেন। আমরা ক্ষুদ্র জীব, তাঁহার কি মীমাংসা করিব? তবে যখনই দেখি, তখনই বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া থাকি এবং ভাবিয়া অকূল সমুদ্রে নিমগ্ন হই। সে বিচার-বিতর্কের শক্তি নাই এবং তাহার প্রবৃত্তিও নাই। সবই প্রারব্ধ কর্ম্মের ফল বলিয়া বুঝি এবং তাহা বুঝিয়াই নিশ্চিন্ত হই। আমরা শাস্ত্রবিশ্বাসী শাস্ত্রের কথা মানি। শাস্ত্রের কথা শুনিতে পাই,—বাল্যপ্রতিভা পূর্ব্ব জীবনের সাধনার ফল। ধ্রুব-প্রহ্লাদ পূর্ব্ব জন্মের সাধনার ফলে বাল্যে ভগবদ্ভক্ত হইয়াছিলেন।[৪]

বালক বিদ্যাসাগরের বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় পাইয়া উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হইয়াছিলেন। সকলেরই সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ,— ঈশ্বরচন্দ্রকে কোন একটা ভাল স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হয়। পুত্রের প্রশংসাবাদে পিতা ঠাকুরদাস পুলকিত হইয়া বলেন,— “আমি ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু স্কুলে পড়াইব।” উপস্থিত সকলেই বলিলেন,—“আপনি দশ টাকা মাত্র বেতন পান, আপনি পাঁচ টাকা বেতন দিয়া কিরূপে হিন্দু স্কুলে পড়াইবেন?”

ঠাকুরদাস বলিলেন,—“পাঁচ টাকায় যেরূপে হউক, সংসার চালাইব।” ঠাকুরদাসের হৃদয় তখন উচ্চাকাঙক্ষার প্রজ্বলিত অনল-শিখায় উদ্দীপিত। বালকের প্রতিভা-কথা স্মরণ করিয়া, ব্রাহ্মণ আপনার দারিদ্র্য-দুঃখ বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। দরিদ্র-ব্রাহ্মণ পূর্ণানন্দে পূর্ণভাবে নিমগ্ন। ঠাকুরদাস পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রকে হিন্দু স্কুলে পড়াইবেন বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন; কিন্তু তিন মাস কাল তাহা আর ঘটিয়া উঠে নাই। এই তিন মাস কাল ঈশ্বরচন্দ্র নিকটবর্ত্তী একটী পাঠশালায় যাইতেন। এই পাঠশালার গুরুমহাশয় সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বরচিত চরিতে লিখিয়াছেন—“পাঠশালার শিক্ষক স্বরূপচন্দ্র দাস, বীরসিংহের শিক্ষক কালীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অপেক্ষা শিক্ষাদান বিষয়ে বোধ হয় অধিকতর নিপুণ ছিলেন।” দুর্ভাগ্যেরর বিষয়, আজ কাল বাঙ্গালা শিক্ষার এরূপ সুনিপুণ গুরুমহাশয় দুর্লভ। এ দুলর্ভতার হেতু লোকের প্রকৃতি-প্রবৃত্তির পরিবর্ত্তন। এখন পাঠশালাও আছে, গুরুমহাশয়ও আছে; নাই সেই তলস্পর্শিনী শিক্ষা; আর নাই সেই সুদক্ষ শিক্ষক; এখনকার পাঠশালা ইংরেজিরই রূপান্তর; গুরু অন্যরূপ হইবে কিসে?

“কর্ত্তব্যোমহদাশ্রয়ঃ, মহাজনের এই মহাবাণী অবশ্যপালনীয়। এ বাণীর সাক্ষাৎ ফল প্রত্যক্ষীভূত হইয়াছিল, ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্য জীবনে। জগদ্‌দুর্লভ সিংহ কেবল যে পিতাপুত্রকে আশ্রয় মাত্র দিয়াছিলেন, তাহা নহে; তাঁহার পরিবাববর্গ ও তিনি স্বয়ং তাঁহাদিগকে যথেষ্ট সমাদর করিতেন। জগদ্‌দুৰ্লভ বাবুর কনিষ্ঠা ভগিনী রাইমণি, বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে পুত্রপেক্ষা ভালবাসিতেন। এই রমণী সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং বলিয়াছেন,—“স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনাপ্রভৃতি সদ্‌গুণ বিষয়ে, রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়ন-গোচর হয় নাই। এই দয়াময়ীর সৌম্য মূর্ত্তি, আমার হৃদয়মন্দিরে দেবীমূর্ত্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিরাজমান্ রহিয়াছে।” প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উত্থাপিত হইলে, তদীয় অকৃত্রিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারিতেন না।

বাস্তবিক রাইমণির সেই অকৃত্রিম যত্ন-স্নেহ ব্যতিরেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কলিকাতায় থাকা দায় হইত। তিনি স্নেহময়ী মাতা ও পিতামহীর কথা ভাবিয়া প্রথম প্রথম বড় ব্যাকুল হইতেন। পিতা সর্ব্বক্ষণ তাঁহার নিকট থাকিতে পারিতেন না। তিনি প্রাতে একপ্রহরের সময় কর্ম্মস্থানে যাইতেন এবং রাত্রি এক প্রহরের সময় বাসায় ফিরিয়া আসিতেন। এই সময় রাইমণি এবং জগদ্‌দুর্লভ বাবুর অন্যান্য পরিবার নানা মিষ্ট কথায় ঈশ্বরচন্দ্রকে ভুলাইয়া রাখিতেন এবং নানাবিধ আহারীয় ও অন্যান্য মন-ভুলান জিনিষপত্র দিয়া অনেকটা সান্ত্বনা করিতেন। এইরূপ অনেক দীনহীন বালক মহদাশ্রয়ে প্রীতিস্নেহে প্রতিপালিত হইয়া পরিণামে কীর্ত্তিমান হইয়া গিয়াছেন। কলিকাতার কোটিপতি রামদুলাল সরকার বাল্যকালে যদি হাটখোলার সেই সদাশয় দত্ত-পরিবারে প্রতিপালিত না হইতেন, তাহা হইলে কে বলিতে পারে, তিনি ভবিষ্যৎ-জীবনে অতুল ধনের অধিকারী হইয়া অক্ষয় কীর্ত্তি-সঞ্চয়ে সমর্থ হইতেন? রামদুলালের বাল্য-দরিদ্রতা এবং দত্ত-পরিবারের তৎপ্রতি সদাশয়তার কথা স্মরণ হইলে বাস্তবিকই মনে এক অচিন্তনীয় ভাবের উদয় হয়। বিলাতের বিখ্যাত গ্রন্থকার জনাথন্ সুইফট্ যদি বাল্যকালে স্যার্ উইলিয়ম্ হামিল্টনের আশ্রয় না লইতেন এবং জার্ম্মাণ পণ্ডিত হিম্‌ ধর্ম্মপিতার সাহায্য না পাইতেন, তাহা হইলে এ জগতে তাহারা ফুটিতেন কি না সন্দেহ।

বালক বিদ্যাসাগর অগ্রহায়ণ মাসে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন; কিন্তু ফাল্গুন মাসের প্রারম্ভে রক্তাতিসার রোগে আক্রান্ত হন। ক্রমে পীড়া এত দূর উৎকট হইয়া পড়ে যে, মল-মূত্রত্যাগে তিনি সর্ব্বদা সাবধান হইতে পারিতেন না। তাঁহার পিতাকে অনেক সময় স্বহস্তে মলমূত্র পরিষ্কার করিতে হইত। ঐ পল্লীর দুর্গাদাস কবিরাজ তাঁহার চিকিৎসা করেন; কিন্তু রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল। বীরসিংহ গ্রামে সংবাদ যায়। পিতামহী সংবাদ পাইয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হন। তিনি কলিকাতায় দুই দিন থাকিয়া ঈশ্বরচন্দ্রকে বাড়ী লইয়া যান। তথায় সাত আট দিনের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় ঈশ্বরচন্দ্র সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিয়াছিলেন।

বৈশাখ মাস পর্য্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ীতে ছিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রারম্ভে পিতা ঠাকুরদাস তাঁহাকে পুনরায় কলিকাতায় আনয়নার্থ বীরসিংহ গ্রামে গমন করেন। এবারও পদব্রজে আসা স্থির হয়। পূর্ব্ব বারে সঙ্গে ভৃত্য ছিল। ভৃত্য মধ্যে মধ্যে বালককে কাঁধে করিয়া আনিয়াছিল। এবার পিতা জিজ্ঞাসিলেন,—“কেমন ঈশ্বর! তুমি চলিয়া যাইতে পরিবে, না আনন্দরামকে সঙ্গে করিয়া লইব?” বালক বাহাদুরী করিয়া বলিল,—“না, আমি চলিয়া যাইতে পারিব।” বিদ্যাসাগরের বাহাদুরীর পরিচয় বাল্য কাল হইতে।

এবার পিতাপুত্রে চলিয়া আসিয়া প্রথম দিন পাতুলগ্রামে আশ্রয় লন। পাতুলগ্রাম বীরসিংহ হইতে ছয় ক্রোশ দূর। ঈশ্বরচন্দ্রের এ দিন চলিতে কষ্ট হয় নাই। তারকেশ্বরের নিকট রামনগর গ্রামে ঠাকুরদাসের কনিষ্ঠা ভগিনী অন্নপূর্ণাকে দেখিতে যাইবার প্রয়োজন হয়। তিনি তখন পীড়িতা ছিলেন। রামনগর পাতুলগ্রাম হইতে ছয় ক্রোশ দূরবর্তী। পিতাপুত্রে দুই জনে প্রাতঃকালে রামনগর অভিমুখে যাত্রা করেন। তিন ক্রোশ পথ গিয়া, ঈশ্বরচন্দ্র আর চলিতে পারেন নাই। পা টাটাইয়া ফুলিয়া যায়। পিতা বড়ই বিপদগ্রস্ত হন। তখন বেলা দুই প্রহরের অধিক। ঈশ্বরচন্দ্র তখন এক রকম চলচ্ছক্তিলীন। পিতা বলিলেন—“বাবা! একটু চল, আগে মাঠে ফুট তরমুজ খাওয়াইব।” ঈশ্বরচন্দ্র অতি কষ্টে প্রাণপণে হাঁটিয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন। সেই মাঠের কাছে গিয়া ফুটতরমুজ খাইলেন। পেটু ঠাণ্ডা হইয়াছিল বটে; পা কিন্তু আর উঠে নাই। পিতা রাগ করিয়া পুত্রকে ফেলিয়া কিয়দ্দূর চলিয়া যান; কিন্তু আবার ফিরিয়া আসিয়া রোরুদ্যমান পুত্রকে কঁধে করিয়া লন। দুর্ব্বলদেহ পিতা। অষ্টম বর্ষের বলবান বালককে কত দূর কাঁধে করিয়া লইয়া যাইবেন? খানিক দূর গিয়া আবার তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে কাঁধ হইতে নামাইয়া দেন; বিরক্ত হইয়া দুই একটা চপেটাঘাত করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন ভিন্ন আর কি উপায় ছিল? এখন একেবারে চলচ্ছক্তি-হীন। পিতা আবার পুত্রকে কাঁধে করিলেন, এইরূপ একবার কাঁধে করিয়া, একবাব নামাইয়া একটু একটু বিশ্রামান্তর চলিয়াছিলেন। এইরূপ অবস্থায় তাঁহারা সন্ধ্যার পূর্ব্বে রামনগরে উপস্থিত হন। পর দিন তাঁহারা শ্রীরামপুরে থাকিয়া, তৎপর দিবস কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

এই বার আবার বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিবার কথা। পিতা ঠাকুরদাস ঈশ্বরচন্দ্রকে সংস্কৃত শিখাইবাব মানস করেন। তাঁহার ইচ্ছা, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিখিলে দেশে তিনি টোল করিয়া দিবেন। এই সময়ে মধুসূদন বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতৃ-মাতুল রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপুত্র। মধুসূদন বাচস্পতি ঠাকুরদাসকে পরামর্শ দেন – “আপনি ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে পড়িতে দেন, তাহা হইলে আপনকার অভিপ্রেত সংস্কৃত শিক্ষা সম্পন্ন হইবে; আর যদি চাকুরী করা অভিপ্রেত হয়, তাহারও বিলক্ষণ সুবিধা আছে; সংস্কৃত কলেজে পড়িয়া যাহারা ল’ কমিটার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাহারা আদালতে জজপণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হইতে পারে। অতএব আমার বিবেচনায় ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে পড়িতে দেওয়া উচিত। চতুষ্পাঠী অপেক্ষা কলেজে রীতিমত সংস্কৃত শিক্ষা হইয়া থাকে।”

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আত্ম-জীবনীতে এই সকল কথা আছে, অধিকন্তু তিনি লিখিয়া গিয়াছেন,—“বাচস্পতি মহাশয় এই বিষয় বিলক্ষণরূপে পিতৃদেবের হৃদয়ঙ্গম করিয়া দিলেন। অনেক বিবেচনার পর বাচস্পতি মহাশয়ের ব্যবস্থা অবলম্বনীয় স্থির হইল।”

এই সময় ঠাকুরদাস সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণাধ্যাপক পণ্ডিত গঙ্গাধর তর্কবাগীশের সহিতও এ সম্বন্ধে পরামর্শ করিয়াছিলেন। শেষে সংস্কৃত কলেজে দেওয়াই স্থির হয়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. আমাদের অপর কোন কোন আত্মীয়ের নিকটে এরূপ শুনিয়াছি। পরলোকগত মহেন্দ্রনাথ কিনিধি মহাশযও ঐরুপ বলেন।
  2. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বরচিত জীবন-চরিতে “কোঠরা” স্থলে “কোটরী” মুদ্রিত হইয়াছে। “উগ্রক্ষত্রিয় প্রতিনিধি” পত্রিকার খানাকুলকৃষ্ণ নগর নিবাসী পরলোকগত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি “পল্লীসমাজ” নামক খানাকুল-কৃষ্ণ নগরের ইতিহাসে প্রথমে ঐ ভ্রমের উল্লেখ করেন; কিন্তু তিনি এক ভ্রম শোধন করিতে, অন্য ভ্রমে নিপতিত হইয়াছিলেন। তিনি কবিরাজ শ্রীধর সুধাকরের নাম লিখিয়াছেন।
  3. Ode on solitude.
  4. ভগবান ধ্রুবকে বলিয়াছিলেন,—
    যৎ ত্বয়া প্রার্থিতং স্থানমেতৎ প্রাপসাতি বৈ ভবান।
    ত্বয়াহং তোষিতঃ পূর্ব্বম্ অন্যজন্মনি বালক।”
    বিষ্ণুপুরাণ, ধ্রুবচরিত্র, ১ম অঃ, ৮৩ শ্লোঃ।
    ***
    “অন্যেষাং তদ্‌বরং স্থানং কুলে স্বায়ম্ভুবস্য যৎ।
    তস্যৈতদবরং বাল যেনাহং পরিতোষিতঃ।
    বিষ্ণুপুরাণ, ধ্রুবচরিত্র, ১ম অঃ, ১২ অঃ, ৮৮ শ্লোঃ।