» » চতুর্থ অধ্যায়

বর্ণাকার

বিবাহ, শ্বশুরের পরিচয়, অলঙ্কারে প্রতিষ্ঠা, দয়া, সখ, ও শ্রম।

ঈশ্বরচন্দ্রের ভূয়সী খ্যাতি-প্রতিপত্তি হওয়ায়, নিকটবর্ত্তী গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকে তাঁহাকে কন্যা সমর্পণ করিবার জন্য লালায়িত হন। ক্ষীরপাইনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের সপ্তমবর্ষীয়া কন্যা দিনময়ীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। এ বয়সে তাঁহার বিবাহ করিবার আদৌ ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু পিতার অনুরোধে তিনি বিবাহ করিতে বাধ্য হন। দিনময়ী পাদুকা-কন্যা। পাদুকা-কন্যার সৌভাগ্য-ফলে স্বামীর লক্ষ্মী অচলা হয়। দিনময়ীর পতির অদৃষ্টে তাহাই হইয়াছিল। ভাগ্যবতী দিনময়ী পুত্রকন্যা রাখিয়া স্বামীর পুর্ব্বে ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া নিজ সৌভাগ্যশালিতার এবং শুভগ্রহসম্পন্নতার পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব্বে বহুবর্ষব্যাপক কৃচ্ছসাধ্য সাবিত্রী ব্রতের উদ্‌যাপন করিয়াছিলেন। সকল নারীর ভাগ্যে সধবা অবস্থায় এই কঠোর ব্রতের উদ্‌যাপন করা ঘটিয়া উঠে না। অনেককেই অনুদ্‌যাপিত অবস্থায় তনু ত্যাগ করিতে হয়। দিনময়ী প্রকৃত সাধ্বীর মত সকল দিক বজায় করিয়া, পতিপুত্র রাখিয়া দিব্যধামে প্রয়াণ করেন। এইখানে দিনময়ীর পিতা শক্রঘ্ন ভট্টাচার্য্যের একটু পরিচয় দিই। এ পরিচয়ে পরিণামসম্পর্ক আছে। বংশৌরসের সম্বন্ধ বুঝাইবার জন্য এই পরিচয়।

শক্রঘ্ন ভট্টাচার্য্য অতি তেজস্বী, ক্রোধী ও বলশালী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তৎকালে তাঁহার গ্রামে তাঁহার বলবত্তার তুলনা ছিল না; পরন্তু তিনি সহজাত সহৃদয়তা ও উদারতা গুণে সর্ব্বজনের ভক্তি ও প্রীতি আকর্ষণ করিতেন। তাঁহার বলবত্তা ও উদারভার দুই একটী গল্প শুনুন।

প্রতি বৎসর ক্ষীরপাই নগরে গাজন হইত। ভট্টাচার্য্য এই গাজনের অধিনেতা ছিলেন। গাজন লইয়া সহর প্রদক্ষিণ করা তখনকার নিয়ম ছিল। স্বয়ং শক্রঘ্ন ভট্টাচার্য্য গাজনের সঙ্গে সঙ্গে যাইতেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ একটী পল্লীর লোক তাঁহার বিষম প্রতিপক্ষ হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহার বিষম প্রতিজ্ঞা হইয়াছিল, তিনি শক্রঘ্নকে গাজন লইয়া তাঁহার পল্লীতে যাইতে দিবেন না। শক্রঘ্ন ভট্টাচার্য্য ইহা জানিতে পারিয়াছিলেন; কিন্তু বলদৃপ্ত ব্রাহ্মণের প্রতিজ্ঞা হইল, তিনি যে কোন প্রকারে হউক, প্রতিপক্ষের পল্লীতে যাইবেন। তিনি গাজন লইয়া সেই দিকে অগ্রসর হন; কিন্তু গিয়া দেখেন, পল্লীর পথের সন্মুখে একটা হস্তী দণ্ডায়মান, তৎপশ্চাতে কিয়দূরে একখানি রথ; তৎপশ্চাতে আরও দূরে প্রতিপক্ষেরা অবস্থিত ছিলেন। ভট্টাচার্য্য বুঝিলেন এ সব গতিরোধের ব্যবস্থা। তিনি কিন্তু কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ না করিয়া পথ হইতে একখানি ইট্‌ কুড়াইয়া লইলেন। পরে হস্তীর শুণ্ড বগলে চাপিয়া রাখিয়া সেই ইষ্টক খণ্ডদ্বারা হস্তীকে এমনই প্রহার করিলেন যে, হস্তী তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া গর্জ্জন করিতে করিতে পলায়ন করিল। পরে ভট্টাচার্য্য সবলে রথখানা একাকী টানিয়া ফেলিয়া দেন। দুর্দ্দান্ত বীরের বিক্রমব্যাপার দেখিয়া প্রতিপক্ষ পলায়ন করেন। ভট্টাচার্য্য ক্রোধান্বিত হইয়া একাকী তাঁহাদের পশ্চাৎ ধাবিত হন। প্রতিপক্ষের দলপতি হালদার ভয়ে বাটীর দ্বার রুদ্ধ করিয়া দেন। ভট্টাচার্য্য পদাঘাতে লৌহকীলকবিশিষ্ট দ্বার ভগ্ন করিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করেন। তাঁহার পায়ে একটা লৌহশলাকা ফুটিয়া গিয়াছিল। তাহাতেও তাঁহার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তাঁহার শ্যালক ও অন্যান্য আত্মীয়বর্গ আসিয়া, তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিয়া বলিলেন,— “ভট্টাচার্য্য করিয়াছ কি, পায়ে যে পেরেক ফুটিয়াছে।” ভট্টাচার্য্য বলিলেন,—“বটে বটে, টানিয়া বাহির করিয়া লও।” পেরেক বাহির করা হইল। ভট্টাচার্য্যের নিবৃত্তি নাই। তিনি প্রতিপক্ষের দলপতি হালদারের অন্বেষণে বাড়ীর ভিতরের দিকে ছুটিলেন। দলপতির লোকেরা ভয়ে তাঁহাকে এমনই স্থানে ভয়ঙ্কররূপে ইষ্টকাঘাত করেন যে, তাহাতে ভট্টাচার্য্য বড় কাতর হইয়া পড়েন। তখন তাঁহার আত্মীয়েরা তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া বাড়ীতে লইয়া আসেন।

প্রতিপক্ষের দল ভাবিলেন,—ভট্টাচার্য্যকে সাংঘাতিক আঘাত লাগিয়াছে; তিনি বোধ হয়, আদালতে নালিশ করিবেন। ভট্টাচার্য্যের মনোগতভাব জানিবার নিমিত্ত তাঁহারা এক জন চর পাঠাইয়া দেন। ভট্টাচার্য্য চরকে দেখিয়াই তাহার অতিপ্রায় বুঝিলেন। তিনি বলিলেন,—“হালদার ভাবিয়াছে, আমি নালিশ করিব। নালিশ করিব কি রে! উকিল পেয়াদাকে পয়সা খাওয়াইব? এবার সে মারিয়াছে, আগামী বারে আমি মারিব। নালিশ-ফৌজদারী করিলে আর গাজন কি থাকিবে?” চর এই কথা শুনিয়া চলিয়া যায়। পরে প্রতিপক্ষ সকলেই তাঁহার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন এবং ক্ষমা ভিক্ষা করেন। দলপতি হালদার বলেন,—“ভট্টাচার্য্য! তোমার বলপরীক্ষার জন্যই ঐরূপ করিয়াছিলাম। তুমি দ্বিতীয় ভীম বটে; তোমার শুধু বল নহে; মনুষত্ব্য আছে। তোমার তেজ আছে, তোমার ভবিষ্যৎ ভাবিবার বুদ্ধি আছে। আমায় ক্ষমা কর।”

হালদারের কথা শুনিয়া ভট্টাচার্য্য বলিলেন,—“এ সব কথায় আর কাজ নাই; আজ আমার বাড়ীতে তোমাদের সকলকে খাইয়া যাইতে হইবে।”

প্রতিপক্ষগণ ভট্টাচার্য্যের নিমন্ত্রণ পরমানন্দে রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহারা ভট্টাচার্য্যের বাড়ীতে পরম পরিতোষপূর্ব্বক আহারাদি করিয়া বিদায় লইয়াছিলেন।

আর এক সময় ভট্টাচার্য্য এক দোকানে বসিয়া আছেন, এমন সময় চারিমণী কলাই-বোঝাই এক ছালা আসিয়া উপস্থিত হয়। উপস্থিত সকলে বলিল,—“ভট্টাচার্য্য! তুমি যদি এই ছা্লা বহিয়া বাড়ী লইয়া যাইতে পার, তাহা হইলে তোমায় এই কলাই দি।” ভট্টাচার্য বলিলেন,—“পারি বটে; কিন্তু সোজা হইয়া যাইব না; দুই পা ও দুই হাত মাটীতে রাখিয়া গরুর মত চলিব; তোমরা আমার পিঠে এক খানি লেপ দিয়া তাহার উপর কলাই চাপাইয়া দিবে।”

তাহাই হইল। ভট্টাচার্য্য সেখান হইতে প্রায় আধক্রোশ দূরে সেই চারিমণী ছালা বহিয়া বলদের মত হাঁটিয়া বাড়ী গিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ২০০/৩০০ দুই শ তিন শ লোক গিয়াছিল। বাড়ীতে পৌঁছিলে সকলে ভট্টাচার্য্যকে কলাই লইতে অনুরোধ করে। ভট্টাচার্য্য বলেন —“আমি কলাই কি করিব? কোথায় রাখিব? তোমরা উপযুক্তরূপ চাউল তরি-তরকারী প্রভৃতি লইয়া এস; এই কলায়ে দাইল হউক; রাঁধিয়া বাড়িয়া সবাই আনন্দে আহার করিব।” তাহাই হইল।

এক সময় ভট্টাচার্য্যের গ্রামস্থ ভুবন ঘোষ নামক এক সদ্‌গোপ নিকটবর্ত্তী একটী খালের নিকট বেণাবনের ভিতর লোক ঠেঙ্গাইয়া মারিত। ঘোষ খুব বলবান ছিল। গ্রামের লোক তাহার জন্য সদা শঙ্কিত থাকিত। এক দিন ভট্টাচার্য্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলেন—“শতু! তুই থাকিতে ঘোষ জব্দ হয় না।”  শক্রঘ্ন বলিলেন,—“তাহার আর কি, এত দিনতো বল নাই।” শক্রঘ্ন ঘোষকে জব্দ করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।

শত্রুঘ্ন এক দিন প্রাতঃকালে চুপি চুপি গিয়া বেণাবনে লুকাইয়া থাকেন। কিয়ৎক্ষণ থাকিয়া তিনি দেখিলেন, সমস্ত বন আন্দোলিত হইতেছে। তিনি বুঝিলেন, ঘোষ কাহাকে ধরিয়াছে। বাস্তবিক ঘোষ সে দিন এক জন পশ্চিমে খোট্টাকে ধরিয়াছিল। খোট্টাটা খুব বলবান ছিল, ঘোষ তাঁহাকে সহজে পাড়িতে পারে নাই। দুই জনে ধস্তাধস্তি হইতেছিল। ভট্টাচার্য্য এই সময় তাহাদের সন্মুখে উপস্থিত হন। তাঁহাকে দেখিয়া ঘোষ ভায়া শিকার ছাড়িয়া সম্মুখে একটা শিমূল গাছে উঠিয়া পড়ে। এই সময় খোট্টাটা অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। ভট্টাচার্য্য তাঁহাড় মুখে জল দিয়া তাহার চৈতন্য সম্পাদন করেন। পরে তিনি শিমূল বৃক্ষের তলায় গিয়া তাহার উপর উঠিতে চেষ্টা করেন। স্থূলকায় হেতু উঠিতে না পারিয়া তিনি সিমূলতলে দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরে তিনি বলিলেন —“ঘোষ! তুই কতক্ষণ থাক্‌বি? তোকে না মারিয়া আমি যাইতেছি না।” ঘোষ গাছের উপর বসিয়া থর থর কাঁপিতে লাগিল। সে কোনমতে গাছ হইতে নামিল না। ঘোষ গাছ হইতে কিছুতেই নামিতেছে না দেখিয়া ভট্টাচার্য্য বলিলেন,—“নামিয়া আয়; আমার পা ছুঁইয়া দিব্যি কর যে, আর এ কাজ করবি না; তা হ’লে এ যাত্রা তোকে ক্ষমা করিব।”

ঘোষ বলিল,—“তুমি পৈতা ছুইয়া দিব্যি কর, আমি নামিয়া গেলে আমাকে মারবে না, তা হলে আমি নাম্‌বো।”

ভট্টাচার্য্য হাসিয়া কহিলেন,—“আমি পৈতা ছুঁইয়া দিব্য করিলে তোর বিশ্বাস হইবে কেন?”

ঘোষ বলিল,—“আমি তোমার পা ছুঁইয়া দিব্যি ক’রলে তুমি বিশ্বাস কর্‌বে; আর তুমি ব্রাহ্মণ, পৈতা ছুঁইয়া দিব্যি কর্‌লে আমি বিশ্বাস করব না?”

ভট্টাচার্য্য পৈতা ছুঁইয়া দিব্য করিলেন। ঘোষ নামিয়া আসিয়া ভট্টাচার্য্যের পা ছুঁইয়া দিব্য করিল, ভট্টাচার্য্য ক্ষমা করিলেন। ঘোষ চলিয়া গেল। পরে ভট্টাচার্য্য সেই আহত খোট্টাটিকে সঙ্গে লইয়া বাড়ী ফিরিয়া যান। তিনি খোট্টাটিকে যথাযোগ্য আহারাদি করাইয়া বিদায় দেন।

ভট্টাচার্য্যের প্রতাপে সেই সময় অনেক দস্যু-লেঠাল জব্দ হইয়াছিল।

একবার তাঁহার পৃষ্ঠব্রণ হয়। ডাক্তার অস্ত্র করিবার পূর্ব্বে “ক্লোরোফরম্” করিয়া তাঁহাকে অজ্ঞান করিবার উপক্রম করেন। তিনি বলিলেন,—“অজ্ঞান করবে কেন? অস্ত্র কর, অমি অজ্ঞান হইয়া আছি।” ডাক্তার ছুরি বসাইলেন, ছুরি ভাঙ্গিয়া গেল। তাঁহার দেহের চর্ম্ম ঠিক হাতীর শুঁড়ের মত কঠিন ছিল। ডাক্তার ভাবনায় পড়িলেন, কি করিবেন। অন্য ছুরি আনিলেও ত কঠিন চর্ম্মে ভাঙ্গিয়া যাইবে। তখন শত্রুঘ্ন নিজে এক উপায় বাহির করিলেন। কামার ঘর হইতে কাস্তিয়ায় ধার দিয়া আনিয়া কাস্তিয়া ক্ষত মুখে প্রবিষ্ট করিয়া কড়, কড়, শব্দে ফোঁড়া কাটা শেষ করিলেন। এতাবৎকাল ভট্টাচার্য্য যাতনাব্যঞ্জক মুখভঙ্গী বা কোন শব্দ না করিয়া অম্লানবদনে বসিয়া রহিলেন।

দিনময়ী এই তেজস্বী সরল সাহসী পুরুষের কন্যা। ইহার পরিচয় যথাস্থানে পাইবেন। সে পরিচয়ে বংশ-গৌরবের ফল-প্রমাণ। এখন ঈশ্বরচন্দ্রের পাঠ্যপ্রতিষ্ঠার পর্য্যালোচনা করা যাউক।

পঞ্চদশ বর্ষ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র অলঙ্কার-শ্রেণীতে প্রবেশ করেন। সেই সময় পণ্ডিত প্রবর প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ মহাশয় অলঙ্কার-শ্রেণীর অধ্যাপন করিতেন। এই শ্রেণীতে ঈশ্বরচন্দ্র অন্যান্য ছাত্র অপেক্ষা অল্পবয়স্ক ছিলেন। এক বৎসরের মধ্যে তিনি সাহিত্যদর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলঙ্কার গ্রন্থ পাঠ করেন। অলঙ্কারের বাৎসরিক পরীক্ষায় তিনি সর্ব্বোচ্চ পারিতোষিক প্রাপ্ত হন। তখন পুস্তক ও টাকা পারিতোষিকের ব্যবস্থা ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র এই কয়েকখানি পুস্তক পাইয়াছিলেন–রঘুবংশ, সাহিত্যদর্পণ, রত্নাবলী, মালতীমাধব, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্ব্বশী, মৃচ্ছকটীক।

একদিন পণ্ডিত প্রবর তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বাড়ীতে তাঁহাকে সাহিত্যদর্পণের আবৃত্তি করিতে দেখিয়া তাৎকালিক বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রবেত্তা জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মহাশয় বলিয়াছিলেন,—“এত ছোট ছেলে সাহিত্যদর্পণের এমন সুন্দর আবৃত্তি করিতে পারে, ইহা বড় আশ্চর্য্যের বিষয়।” তর্কপঞ্চানন মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রকে পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছিলেন,—“এই বালকের বয়োবৃদ্ধি হইলে, বালক বাঙ্গালা দেশের অদ্বিতীয় লোক হইবে।”

এই সময় ঈশ্বরচন্দ্র কলেজে মাসিক ৮৲ আট টাকা বৃত্তি প্রাপ্ত হন। তিনি যাহা বৃত্তি পাইতেন, তাহা পিতাকে আনিয়া দিতেন। পুত্রের প্রথমাবস্থার বৃত্তিলব্ধ টাকায় পিতা ঠাকুরদাস বীরসিংহ গ্রামের নিকট কতকটা জমি ক্রয় করিয়াছিলেন। এই জমিতে তাঁহার টোল বসাইবার সংকল্প ছিল। টোল বসাইয়া ছাত্র রাখিয়া সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারবৃদ্ধি করিবেন, পিতার এই সাধ বরাবর ছিল। পুত্রের বিদ্যা-গৌরব-সংবৃদ্ধির সঙ্গে তাহার চিরপোষিত সাধ সংবর্দ্ধিত হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রায়ই বন্ধুবান্ধবের নিকট একথা বলিতেন। বীরসিংহ গ্রামে যখন প্রথমে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তখন বিশুদ্ধ সংস্কৃত শিক্ষাই দেওয়া হইত। সংস্কৃতকলেজে ইংরাজী শিক্ষাপ্রবর্তনের সময় ঐ বিদ্যালয়েও ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্তিত হইয়াছিল। ঠাকুরদাস কি জানিতেন যে, তাহার পুত্র ভবিষ্যজীবনে টোলের পরিবর্ত্তে গ্রামে উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত করিতে পরিবেন? ঈশ্বরচন্দ্র যে বৃত্তির টাকা পাইতেন, পরে পিতা তাহার সমস্ত লইতেন না।

ঈশ্বরচন্দ্র বৃত্তির টাকায় হস্তলিখিত পুঁথি ক্রয় করিয়াছিলেন। এই সব পুঁথি তাহার লাইব্রেরীতে বিদ্যমান ছিল। কেবল তাহাই নহে, তিনি বাল্য কাল হইতে পরদুঃখমোচনে ব্রতী হইয়াছিলেন। সেই ক্ষুদ্র বুকখানি অনন্তব্যাপিনী; কিন্তু দয়া যেমন, উপায় তো তেমন নহে; তবুও যে কোন উপায়ে যথাশক্তি দানে, দীনের দুঃখোদ্ধারে তিনি প্রাণান্তপণ করিতেন। অবশিষ্ট যে টাকা থাকিত, তিনি সেই টাকায় জল খাইতেন। জল খাইবার সময় যে সকল বালক তাঁহার নিকটে থাকিত, তিনি তাহাদিগকেও জল খাওয়াইতেন। কাহারও ছেঁড়া কাপড় দেখিলে, নিজের হাতে পয়সা না থাকিলেও, দরওয়ানের নিকট ধার করিয়া তিনি তাহাদের কাপড় কিনিয়া দিতেন। বাসায় কেহ অসিলে, তৎক্ষণাৎ তিনি তাহাকে জল খাওয়াইতেন। সে ভাবিত, ঈশ্বরচন্দ্র বড় মানুষের ছেলে; কিন্তু ঈশ্বর কিসে বড়, তাহা বুঝিত না। সবাই কি বুঝে, বাগানের ছোট চারা আম গাছটী কিসে অমৃতময় সুমিষ্ট আম প্রদান করে। কোন সমবয়স্ক বালকের পীড়া হইলে, ঈশ্বরচন্দ্র সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া, তাহার সেবা-শুশ্রুষা করিতেন। কাহারও কোন সংক্রামক পীড়া হইলে, অপর কেহ তাহার নিকট যাইত না; তিনি কিন্তু অম্লানবদনে ও অকুণ্ঠিতচিত্তে তাহার মলমুত্রাদি পরিষ্কার করিতেন।

বালক বিদ্যাসাগর যখন বীরসিংহ গ্রামে যাইতেন, তখন সর্ব্বাগ্রে গুরুমহাশয় কালীকান্তের বাড়ীতে গিয়া, তাঁহাকে প্রণাম করিতেন। পরে ক্রমে ক্রমে তিনি প্রত্যেক প্রতিবাসীর বাড়ী গিয়া, প্রত্যেকের তত্ত্ব লইতেন। কাহারও পীড়াদি হইলে, তিনি নির্ব্বিকারচিত্তে তাহার সেবাশুশ্রুষাদি করিতেন। এই জন্য তখন বালক বিদ্যাসাগর গ্রামবাসী কর্ত্তৃক দয়াময় নামে অভিহিত হইতেন। তিনি তখন বিদ্যাসাগর হন নাই; কিন্তু দয়ার সাগর হইয়াছিলেন। কুকুরবিড়ালটা মরিলেও তাঁহার চক্ষে জল পড়িত। বালকের কি অসীম দয়া!

যাঁহারা বাল্য কালে তাঁহার মাননীয় ছিলেন, বয়সে তাঁহারা তাঁহার নিকট সমান সম্মান পাইতেন। তাঁহারা বিদ্যা-বুদ্ধিতে হীন হইলেও, বিদ্যাসাগর বিদ্যাভিমানে বা পদগৌরবে গর্ব্বিত হইয়া, কখনই তাঁহাদের প্রতি অসম্মান প্রকাশ করিতেন না; বরং তাঁহারা পূর্ব্বকার স্নেহভাব বিস্মৃত হইয়া তাঁহার প্রতি সম্মান প্রকাশ করিলে, তিনি কুণ্ঠিত ও লজ্জিত হইতেন। বিদ্যাসাগর যখন কলেজের উচ্চ পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তখন কলেজের তদনীন্তন কেরাণী রামধন বাবু তাঁহাকে দেখিয়া সসন্ত্রমে গাত্রোত্থান করিতেন। পাঠ্যবস্থায় বিদ্যাসাগর ইহার পরম স্নেহভাজন ছিলেন। ইঁহাকে এইরূপ সসন্ত্রমে সম্মান করিতে দেখিয়া বিদ্যাসাগর একদিন বলিয়াছিলেন,—“আমি আপনার সেই স্নেহপাত্রই আছি, আপনি অমন করিয়া আমাকে লজ্জা দিবেন না।” বিদ্যাসাগরের অমায়িকতা ও বিনয়নম্রতা দেখিয়া রামধন বাবু বিস্মিত হইয়াছিলেন।

বিদ্যাসাগরের বাল্যকালে সখ্ ও সাধের মধ্যে ছিল, কবির গান শোনা। তিনি সমবয়স্ক বালকদিগকে লইয়া কবির গান করিতেন। কবির গানপ্রিয়তা-সম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প আছে। তিনি যখন চাকুরী করিয়া উপায়ক্ষম হন, তখন এক দিন স্বগ্রাম হইতে কলিকাতায় আসিতেছিলেন। মধ্যে তিনি এক রাত্রি এক চটিতে অবস্থান করেন। প্রাতঃকালে তিনি শুনিলেন, চটীতে এক জন অতি সুমিষ্ট-স্বরে কবির গান গাহিতেছে। তিনি উঠিয়া গিয়া সেই লোকটীর নিকট গমন করিলেন। যতক্ষণ সে গান করিতেছিল, তিনি ততক্ষণ নিঃশব্দে ও আনন্দোৎসুক হৃদয়ে গান শুনিতেছিলেন। গান থামিয়া গেলে, তিনি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, লোকটীর বাড়ী তথা হইতে ৬/৭ ছয় সাত ক্রোশ দূরে এবং তাহার নিকট কবির গান সংগৃহীত আছে। তিনি তখন তাহাকে বলিলেন,—“ভাই! আমি তোমার সঙ্গে যাইব; আমাকে তোমায় কতকগুলি গান দিতে হইবে।” লোকটি স্বীকার পাইল। পরে তিনি সেই লোকটীর বাড়ীতে গিয়া অনেক গান সংগ্রহ করিয়া আনেন। যেখানে যে কবির গান শুনিতেন, তিনি তাহা সংগ্রহ করিয়া রাখিতেন। তাহার নিকট কবির গানের একখানি প্রকাণ্ড খাতা ছিল। সখের মধ্যে এই কবির গান শোনামাত্র এবং খেলা ছিল কেবল কপাটী ও লাঠী-খেলা। এই সময় সংস্কৃত কলেজে পালোয়ান-কুস্তীর আখড়া ছিল। তিনি, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রভৃতি সতীর্থগণ মিলিয়া কুস্তি করিতেন। তিনি অনেক সময় সমবয়স্ক বালকদিগের সঙ্গে জুটিয়া মাঠ হইতে ধান কাটিয়া আনিতেন। এই সব কথা এবং বাজার করা, রন্ধন করা প্রভৃতির কথা, বন্ধুবান্ধবদিগের নিকট অবসর-ক্রমে খুলিয়া বলিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় কখন কুণ্ঠিত বা লজ্জিত হইতেন না। ইহাতে তো মহতের মাহাত্ম্য-ক্রটী হয় না; বরং এই সব কথা শ্রোতার মুখ হইতে প্রচারিত হইয়া, সাধারণের অনেক বিষয়ে শিক্ষাস্থানীয় হয়।

অলঙ্কারের শ্রেণীতে পড়িবার সময় তাহাকে দুই বেলা রন্ধন করিতে হইত। রন্ধন-ভারে ও গুরুতর পাঠপরিশ্রমে তিনি উদরাময় রোগে আক্রান্ত হন। প্রত্যহ রক্তভেদ হইত। কলিকাতায় রোগ আরাম হইল না। অগত্য তাঁহাকে পল্লীগ্রামে যাইতে হইল। সেখানে দিনকতক থাকিলে রোগ সারিয়া যায়। তিনি কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। আবার সেই রন্ধন ও অধ্যয়ন। তবে মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটা সাহায্য করিতেন এবং মধ্যে মধ্যে বাজারও করিয়া দিতেন। একদিন দীনবন্ধু, সন্ধ্যার সময় বাজার করিতে গিয়া, যোড়াসাঁকোর নূতন বাজারের এক স্থানে বসিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত ইতস্ততঃ বহু দিকে অনুসন্ধান করিতে করিতে নূতন বাজারে যাইয়া ভ্রাতাকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখিতে পান এবং তথা হইতে তাহাকে তুলিয়া লইয়া আসেন। শুনিতে পাই, ইহার পর হইতে ঈশ্বরচন্দ্র ভ্রাতা দীনবন্ধুকে আর বড় একটা একাকী বাহিরে যাইতে দিতেন না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ১২৪২ সালে ঈশ্বরচন্দ্র অলঙ্কার শ্রেণীতে পাঠ করেন। ইতঃপূর্ব্বে শিক্ষা-প্রথার প্রচলন সম্বন্ধে দুইটী দল হইয়াছিল। এক দল প্রাচ্য শিক্ষা প্রচলনের, অপরটী পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রচলনের পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। প্রথমতঃ প্রাচ্যপ্রথার প্রচলনকারীরা প্রবল হইয়াছিলেন। তদানীন্তন অনেক উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত সরকারী কর্ম্মচারী তাঁহাদিগের সহিত যোগ দিয়াছিলেন। ক্রমে কিন্তু এদেশীয় শক্তিশালী ব্যক্তিদিগের সাহায্যে অপর পক্ষ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিলেন। লাটসাহেবের অন্যতম সভ্য মেকলে সাহেব অভিমত প্রকাশ করেন যে, ভারতে কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলিত করা উচিত। তাঁহার মত প্রবল হইল। প্রাচ্যপ্রথাকামীদের আর মস্তক তুলিবার শক্তি রহিল না। ইংরেজী শিক্ষাপ্রসারের ইহা একটী সুদৃঢ় স্তর।
  2. এই সময় কলেজে মাসিক পাঁচ টাকা ও আট টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল।