ভৌতিক গল্প
“O Love! In such a wilderness as this.
Where transport with security entwine.
Here is the Empire of thy perfect bliss.
And there art thou a God indeed divine.”
Gertrude of Wyoming.
“But mortal pleasure, what art thou in truth!
The torrents’ smoothness ere it dash below.”
Ibid.

প্রথম সর্গ

মহারণ্যে অন্ধকার, গভীর নেশায়
নির্ম্মল আকাশ নীলে, শশী ভেসে যায় ||
কাননের পাতা ছাদ, নীচে শশিকরে।
পবন দোলায় তারে সুমধুর স্বরে ||
নীচে তার অন্ধকারে, আছে ক্ষুদ্র নদী।
অন্ধকার মহাস্তব্ধ, বহে নিরবধি ||
ভীম তরুশাখা যথা পড়িয়াছে জলে,
কল কল করি বারি সুরবে উছলে ||
আঁধারে অস্পষ্ট দেখি, যেন বা স্বপন!
কলিকাস্তবকময় ক্ষুদ্র তরুগণ ||
শাখার বিচ্ছেদে, কভু, শশধরকর,
স্থানে স্থানে পড়িয়াছে, নীল জলোপর ||
ঘোর স্তব্ধ নদীতটেঃ শুধু ক্ষণে ক্ষণে,
কোন কীট যায় আসে নাড়া দিয়ে বনে ||
শুধু অন্ধকার মাঝে, অলক্ষ্য শরীর!
কোন হিংস্র পশু ছাড়ে, নিশ্বাস গভীর ||
অসংখ্য পত্রের শুধু, ভীষণ মর্ম্মর।
আর শুধু শুনি এক, সঙ্গীতের স্বর ||
গভীর সঙ্গীত সেই! ভাসে নদী দিয়ে।
ভাঙ্গিল গভীর স্তব্ধ স্বরে শিহরিয়ে-
কখন কোমল স্থির করুণার স্বরে,
যেন কোন বিরহিণী কেঁদে কেঁদে মরে ||
শুনিয়ে তা মনে হয়, ঈষৎ আভাস,
যেন কত সুখস্বপ্ন, হয়েছে বিনাশ;
কি কারণে দুঃখোদয় কিসের স্মরণে,
কিছুই বুঝি না তবু, উচাটন মনে ||
ফুলিয়া উঠেছে ধ্বনি, স্থির শূন্য কেটে।
ইচ্ছা করে গগনেতে উঠে যাই ফেটে ||
ছেঁড়ে হৃদয়ের ডোর গভীর যাতনে।
ইচ্ছা করে গলি গিয়ে মিশি গান সনে ||
আর যদি সঙ্গীতের দেহ দেখা পাই!
যতনেতে আলিঙ্গিয়া, মোহে মরে যাই ||

নদীতীরে বৃক্ষ নাহি ছিল এক স্থানে।
দীর্ঘ তৃণে চন্দ্রকর জ্বলিছে সেখানে ||
ছোট গাছে তারামত ফুল্ল পুষ্পদলে।
স্থির তার প্রতিরূপ স্থির নদীজলে ||
সুখস্বপ্নে যেন তারা, নিদ্রাভরে হাসে।
গগন গুমুরে মরে, সুখময় বাসে ||
সেই স্থানে বসি এক নারী একাকিনী।
ফুলহীন বনে যেন স্থলকমলিনী ||
মিশেছে সে চন্দ্রিকায়; ভাবে তার চিত্ত
শুধু সে স্বপ্নের ছায়া, অসত্য অনিতা ||
যৌবন আশার সম ফুল্ল রূপ তার।
দেখিয়া ফিরালে আঁখি, দেখি ফিরে বার ||
স্থিরা ধীরা সুকোমলা বিমলা অবলা।
সবে নব পুরিতেছে যৌবনের কলা ||
মোহন সঙ্গীতে মন বেঁধেছে যতনে।
প্রেম যেন শুনিতেছে আশার বচনে ||
বদনে ললিত রেখা কত হয়ে যায়।
রক্তিম নীরদ যেন শারদ সন্ধ্যায় ||
গলিল নয়নপদ্ম; মুগ্ধ তার মন,
প্রাণ মন জ্ঞান ধন জীবন যৌবন,
সকলি করেছে যেন গীতে সমর্পণ ||
কোথা হতে আসে সেই সুমধুর গান?
কেন তাতে এত আশা? কে হরিল প্রাণ?

ললিতা তাহার নাম-রাজার নন্দিনী।
জননী না ছিল তার, বিমাতা বাঘিনী।
রাজা বড় নিষ্ঠুর সতত দেয় জ্বালা;
গোপনে কতই কাঁদে মাতৃহীনা বালা।
দুর্জ্জনের সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ-
শুনে কেঁদে কেঁদে তার চক্ষু যেন অন্ধ।
মন্মথ নামেতে যুবা, সুঠাম, সুন্দর,
বচনে অমিয় ক্ষরে নারীমনোহর।
মোহিল ললিতাচিত তার দরশনে।
গোপনে বিবাহ হৈল মিলিল দুজনে।
জানিল বিবাহবার্ত্তা দুরন্ত রাজন্।
কন্যারে ডাকিয়া বলে পরুষ বচন ||
এ পুরী আঁধার কেন কর কলঙ্কিনী।
শীঘ্র যাও দেশান্তরে না হতে যামিনী ||
কাল যদি দেখি তোরে, বধিব পরাণ।
ভয়ে বালা সেই দণ্ডে করিলা প্রস্থান ||
মন্মথ লইয়া তারে তুলিল নৌকায়।
ভয়ে ভীত দুই জনে নদী বেয়ে যায় ||
পথিমধ্যে দস্যুদল আসিয়া রোধিল।
ললিতারে কাড়ি লয়ে বনে প্রবেশিল ||
অলঙ্কার কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল তারে।
ললিতা একাকী ফিরে নদী ধারে ধারে ||
কোথায় মন্মথ গেল, তরি কোন্ ভিতে।
রজনী গভীরা তবু ভয় নাই চিতে।
এমন সময়ে শোনে সঙ্গীতের ধ্বনি।
মন্মথ গাইছে গীত বুঝিল অমনি ||
বুঝিল সঙ্কেত করে সেই প্রিয়জন,
নদীতীরে চন্দ্রালোকে বসিল তখন।
তীরেতে লাগিল তরি অতিদ্রুত হয়ে।
দেখিতে দেখিতে দুয়ে দুয়ের হৃদয়ে ||
কতই আদর করে, পেয়ে সোহাগিনী।
কতই রোদন করে কাতরা কামিনী ||

তখন ললিতা কয়,       “আর জ্বালা নাহি সয়,
পড়িয়া দস্যুর হাতে, যে দুঃখ হে পেয়েছি।
কাড়ি নিল অলঙ্কার, লাঞ্ছনা কত আমার,
তীরে তীরে কেঁদে কেঁদে এতদূর এয়েছি ||
দেখা হবে তব সাথ, হেন নাহি জানি নাথ,
দয়া করি কালী আজি রেখেছেন চরণে।”
পতি বলে “শুন প্রিয়ে, তোমা ধনে হারাইয়ে,
মরিব বলিয়ে আজি, প্রবেশিনু কাননে ||
দেখিলাম দুই ধার, মহারণ্যে অন্ধকার,
নীরবে নির্ম্মলা নদী, তার মাঝে বহিছে।
ভীষণ বিজন স্তব্ধ, নাহি জীব নাহি শব্দ,
তরুদলে ঢুলে জলে, ঘুমাইয়া রহিছে ||
যে স্থির অরণ্য নদী, যেন বা সৃজনাবধি,
কোন জীব কোন কীট, তথা নাহি নড়েছে।
প্রথমে যে ছিল যথা, এখনও রয়েছে তথা,
মৃত্যুর ভীষণ ছায়া, সর্ব্বস্থানে পড়েছে ||
ভয়েতে গগন পানে, চাহিলে ভুলিনু প্রাণে,
বিমল সুনীলকাশে, শশী হেসে যেতেছে।
ভাবিলাম প্রকৃতির, সকলি গভীর স্থির,
শুধু এ হৃদয় কেন, এত দুঃখ পেতেছে!
মরি যদি পারিতাম, গোলে জল হইতাম,
এ স্থির সলিলে মিশে, হৃদয় ঘুমাইত।
তথা রিপু চিন্তাহীন, রহিতাম চিরদিন,
ললিতার দুঃখ তবে, কিসে হৃদে আইত ||

“ভাবি এ প্রকার, ছাড়িতে হুঙ্কার,
কাঁপিল কানন স্তব্ধ।
শিহরি অন্তরে, কি জানি কি ডরে,
কাঁপে হৃদি শুনি শব্দ ||
হুতাশ নাশিতে, সঙ্কেত বাঁশীতে,
গায়িলাম দুখ যত।
বাজাইয়া তায়, মরি লো তোমায়,
সঙ্কেত করেছি কত!
একবার যাই, মুরলী বাজাই,
আপনি নয়ন ঝোরে।
গলে হৃদি দুখে, এক মাত্র সুখে;
বাঁশী কি মোহিল মোরে!
গাই পরক্ষণে, দেখি নিশাবনে,
একাকিনী রূপবতী।
হয়ে চমকিত, তীরে এই ভীত,
লইলাম শীঘ্রগতি ||
কে জানে কেমনে, আশা এলো মনে,
আমারি ললিতা হবে।
কত ভাগ্য ধনি, পাই হারা মণি,
আর ছাড়া নাহি হবে?”

ললিতা
“নারে প্রাণ নারে, আর হে তোমারে,
আঁখি ছাড়া করিব না।
রহিব দুজনে, গোপন কাননে,
দেখিবে না কোন জনা ||
কাজ নাই দেশে, তথা শুধু দ্বেষে,
হেন প্রেম নাশ করে।
গঞ্জন যন্ত্রণা, কলঙ্ক রটনা,
মিলন না হয় ডরে ||
যেখানে প্রণয়, হৃদয়ে না রয়,
যেখানে তোমা না পাই।
সে দেশ কি দেশ, সে গৃহে বিদ্বেষ,
কখন যেন না যাই ||
এখানে মন্মথ, প্রণয়ের পথ,
কলঙ্কের কাঁটা হীন।
হেরি তব মুখে, নিরমল সুখে,
স্বর্গসুখে হব লীন ||
জ্বালা পৃথিবীর, সব হবে স্থির,
শুধু সুখময় মন।
লইয়ে মন্মথ, যাহা মনোমত,
করিব সকল ক্ষণ ||”
মন্মথ
“হে বিধি হে বিধি, কর কর বিধি,
এই কপালে আমার।
বল তার চেয়ে, স্বর্গপদ পেয়ে,
কি সুখে আছে হে আর ||
বিচ্ছেদ যাতনা, দিব না দিব না,
এ জনমে প্রেয়সীরে।
কাল পূর্ণ হলে, সুখে তব কোলে,
মরে যাব ধীরে ধীরে ||”

দ্বিতীয় সর্গ


মরি প্রেম যার মনে, সে কি চায় রাজ্যধনে,
প্রিয়মুখ ত্রিসংসার তায়।
হৃদে তার যে রতন, আলো করে ত্রিভুবন,
অন্য মণি নিবায় বিভায় ||
এক মোহে সদা মত্ত, না জানে আপনি মর্ত্ত্য,
যাহা দেখে তাই প্রেমাকুল।
রবি শশী তারাকাশ, পয়োদ পবনশ্বাস,
সাগর শিখর বনফুল ||
যেন লক্ষ বিদ্যাধরে, সদা কর্ণে গান করে,
কি মধুর শব্দহীন ভাষা।
হেরিয়ে সামান্য কলি, নয়ন সলিলে গলি,
উছলে অনন্ত ভালবাসা ||
প্রেমে যার মন বাঁধা, না পারে দিবারে বাধা,
সমুদ্র শিখর নদী বনে।
কলঙ্ক বিপদ ক্লেশ, ঝটিকার ধরি বেশ,
শিরোপরি গরজয়ে যত।
আশ্রয় করিয়া আশা, প্রণয়ীতে ভালবাসা,
প্রণয়ীর প্রাণে বাড়ে তত ||
জ্বালা সয় নিরবধি, সেও ভাল পায় যদি,
একবার আঁখির মিলন।
দুঃখের গভীর বনে, সেই স্বপ্নে সুখ মনে,
প্রেম রীতি কে জানে কেমন ||


চলিল চরণ চন্দ্রবদনী।
ঢলিয়ে ঢলিয়ে মন্দচরণী।
ঊষার প্রখর তারকা ধনী।
চলিল গজেশগামিনী ||
উভয়ে মরেছে হৃদি যাতনে।
উভয়ে পেয়েছে প্রাণরতনে।
কাঁধে কাঁধে ধরি চলে কাননে।
গভীর নীরব যামিনী ||
শিরোপরে শাখা বিনান ঘন।
আসিবে কেমনে শশিকিরণ।
তরল তিমির ভীষণ বন।
দেখিয়া শিহরে কামিনী।
আঁধার আকাশে নক্ষত্রাবলি।
তেমনি কাননে কুসুম কলি।
আমোদে হৃদয়ে যেতেছে গলি।
সে নব নীরদ দামিনী ||
ষণ তিমিরে ভীষণ স্থির।
মাঝে মাঝে খসে পত্র শাখীর।
ধীরে ধীরে ঝরে নির্ঝর নীর।
আঁধারে নিরখে রঙ্গিণী ||
লাগিয়া নির্ঝরে ঈষৎ আলো।
দেখে ফুলময় সে জল কালো।
আঁধারে কুসুম পরশে গাল।
শিহরে সরোজ অঙ্গিনী ||
যেতে পতি সনে চন্দ্রবদনী
মরি কি সঙ্গীত শুনিল ধনী।
ললিত মোহন গভীর ধ্বনি।
নির্ঝর নিনাদ সঙ্গিনী ||
নীরব কানন উঠে শিহরি।
শিহরে দুজনে দুজনে ধরি।
হৃদয়ে হৃদয়ে গাঁথিল মরি।
বাঁধিল মনঃকুরঙ্গিনী ||


স্তব্ধ বনে অন্ধকারে, ভেসে ভেসে চারি ধারে
মোহে তায় দুই জনে, আপনাকে ভুলিল।
দুজনার মুখ চেয়ে, দুজনারে বুকে পেয়ে,
প্রেম আর সেই গানে, এক হয়ে মিলিল |
জ্ঞান পেয়ে কহে কেন, এ গহনে ধ্বনি হেন,
এ ধ্বনি দেবের যেন, চল দেখি যাইয়ে।
আ মরি! কহিছে ধনী, শুনি নাই হেন ধ্বনি,
হরিল কানন ভয়, হৃদয় নাচাইয়ে ||
বনমাঝে যায় যত, ধ্বনি সুনিকট তত,
দেখে শেষে তরু কত, কুঞ্জ এক ঘেরেছে।
স্থির শোভা কিবা তার, বুঝি প্রেম আপনার,
সাধের প্রমোদাগার, তার মাঝে করেছে ||


এ কুঞ্জ হইতে যেন আসিছে সঙ্গীত।
হেন ভাবি দুই জনে আইল ত্বরিত ||
নিকুঞ্জ প্রবেশ মাত্র থামিল সে ধ্বনি।
কানন পূর্ব্বের মত নীরব অমনি ||
আশ্চর্য্য হইয়া দোঁহে রহিলেক স্থির।
দেখিতেছে শোভা কুঞ্জ গগন শরীর ||
কেহ নাই বন কিম্বা গগন ভিতর।
তথাপি কেমনে এলো এ মধুর স্বর ||
ললিতার জ্ঞান হলো প্রবেশ সময়।
যেন কোন স্বপ্ন-দৃষ্ট মত শোভাময়
দুই মনোরম রূপ নারী নরাকারে,
দেখিল চকিত মত নিকুঞ্জের ধারে ||
মন্মথ মোহিনী প্রতি কহিছে হে প্রিয়ে।
দেখি কালিকার দিন এখানে রহিয়ে ||
আজিকার মত যদি কালিকায় হবে।
দেব কি মানব যক্ষ জানা যাবে তবে ||
আজিকার মত এসো রই এই স্থানে।
এমন মোহন স্থান পাবে কোন্‌খানে ||


মোহিনী মন্মথ সনে মনোমত স্থলে।
এমন যামিনী যাপে এমন বিরলে ||
এমন বিপদহীন বিজন কানন।
এমন বিরল প্রেম গম্ভীর এমন ||
কে জানে সে সত্য কি না স্বপন নিশার।
বলে এলে কে জানিত হেন তবে তার ||
রবে না এমন সুখ মানব কপালে।
ভাবিয়ে বিচল চিত্ত এ সুখের কালে ||
এই ভয় মনোমাঝে হয় আর যায়।
যেন কোন মেঘ-ছায়া পড়িছে ধরায় ||
এই মত গেল নিশি নিকুঞ্জ মন্দিরে।
সে দিন কাটালে সুখে নিশি এলো ফিরে ||


কাননে যামিনী পরকাশে, নিরমল নীলে শশী ভাসে।
নিশীথে নিদ্রিত বন, নিদ্রা যায় মেঘগণ,
নিদ্রা যায় বাতাস আকাশে ||
উঠিল নীরবে আচম্বিত, প্রেমময় ললিত সঙ্গীত।
স্থির শূন্যে ভেসে যায়, গগন গহন তায়,
শিহরিছে পুলক পূরিত ||
যেন কেহ বিরহের জ্বরে, প্রেমময়ী পরশে শিহরে।
নাথহৃদে ছিল ধনী, গলিল শুনিয়ে ধ্বনি,
মোহে মিশে প্রাণে প্রাণেশ্বরে ||
গভীর নিশ্বাসে থামে গান, অবকাশে তারা পায় জ্ঞান।
জানিল সে কালিকার, সেই ধ্বনি পুনর্ব্বার,
হেথা হতে গেছে অন্য স্থান ||
প্রেয়সীরে কহিছে মন্মথ, ধ্বনি যে জুড়ায় শ্রুতিপথ।
এখানে গেয়েছে কাল, কামিনি লো কি কপাল!
আজ ধ্বনি অন্য স্থান গত ||
আজি গীত গাইছে যথায়, চল মোরা যাইব তথায়।
কে গায় কিসের তরে, কেন গায় স্থানান্তরে,
করি চল যাহে জানা যায় ||
নাথ সনে লক্ষ্য করি ধ্বনি, চলে বনে শশাঙ্কবদনী।
ঘন গাঁথা তরুদলে, ঘন তম তার তলে,
ভয়ঙ্কর নীরব কেমনি ||
পূর্ব্বমত নিকুঞ্জ মণ্ডলে, আসিল সে প্রেমিক যুগলে
পূর্ব্বমত স্বপ্নসম, দুই রূপ নিরুপম,
যথা হইতে দ্রুত গেল চলে ||


কাঁপিয়ে বিষম ভয়ে বলে হাঁ রে বিধি।
এমন সুখেতে কেন হেন কর বিধি ||
পৃথিবীতে কোন স্থান সুখের কি নয়?
কানন বাসেও কি গো বিপদ নিশ্চয় ||
দেবতা কুপিত বলি দুজনাতে ভীত।
কি হবে তৃতীয় রাত্রে দেখিতে চিন্তিত ||
তৃতীয় নিশীথে গীত আর এক স্থানে।
পূর্ব্বমত তথা গিয়া ভয়ে মরে প্রাণে ||
সেই মত পেলে ভয় চতুর্থ রজনী।
পঞ্চম রজনীযোগে কোথায় সে ধ্বনি?


তমিস্রা পঞ্চম নিশা, গগন মণ্ডলে।
ভীষণ আঁধার বসি, ঘন বনতলে ||
নীরব নিস্পন্দ তম, সঙ্গীতের আশে।
সময় হইল তবু, সে ধ্বনি না আসে ||
বিকট আননে ভয়, ঘুমায় কাননে।
দেখে স্তব্ধ স্পন্দহীন, যত তরুগণে-
পাপান্ধ-তিমিরময়, যেন কার মন,
নীরবে করাল কার্য্য, করিছে কল্পন ||
শুষ্ক শুষ্ক পাতা খসি, মাঝে মাঝে পড়ে।
যথা পড়ে তথা পচে, নাহি আর নড়ে ||
পাইয়া অলক্ষ্য লক্ষ্য, কুসুমের বাস।
আমোদে আঁধার দেহ, না ছাড়ে নিশ্বাস ||
পত্র-চন্দ্রাতপ তলে, ক্ষুদ্র খাল চলে।
নাহি দেখা যায় ভাল, নাহি শব্দ জলে ||
ঘুমায়ে পড়িলে জলে, পুষ্পবৃক্ষাবলী।
আঁধারে কলিকাগুচ্ছ, নিরখি কেবলি ||
নীরবে ঝরিয়া ফুল, স্তব্ধে ভেসে যায়।
পতিহীনা বিরহীর, প্রেম আশা প্রায় ||
শুষ্ক ফল খসি জলে, পড়ে একবার।
অমনি চমকে বুক, মন্মথ বামার ||
অন্ধকার মাঝে আলো দুয়ের বদন।
বরষার শশী যেন, মেঘে আচ্ছাদন ||
ভীম স্তব্ধে ভয়ে ভীত, বসি তারা তথা।
উড়ু উড়ু করে প্রাণ, নাহি সরে কথা ||
ভাবে আজি কেন, এত কাঁদিছে অন্তর।
বলিতে বলিতে নারে, হৃদি গরগর ||
সুখের কাননে আজি, কেন কাল ভাব।
ভীষণ স্বপন যেন, দেখিছে স্বভাব ||
আপনি নয়ন কেন, ঝরে অকারণ।
বুঝি আজি ছেড়ে যাবে, জীবন রতন ||
হৃদে ধরি পরস্পরে, মুখপানে চায়।
কেঁদে যেন কি বলিবে, বলিতে না পায় ||
ললিতা লুকাল মাথা, প্রাণনাথ কোলে।
কাঁদিয়ে মুছায় পতি, প্রিয়া আঁখিজলে ||


এখনো এলো না কেন সঙ্গীতের ধ্বনি।
ভীষণ নীরব! হা রে! আছে কি ধরণী?
অকস্মাৎ কোথা হয় গভীর গর্জ্জন।
কাঁপিল গভীর বন কাঁপিল দুজন ||
অদ্ভুত নিনাদ উড়ে যায় বন দিয়ে।
অন্ধকার ভীমতল হইল আসিয়ে ||
ভীমতর নাদে যেন কাঁপে নভ হৃদি।
কাঁদিয়া উঠিল দোঁহে, “হা বিধি! হা বিধি!”

১০
গভীর জলদ নাদ, গড়ায় আকাশ ছাদ,
থেকে থেকে উচ্চতর স্বনে।
পবন করিছে জোর, যেন সাগরের সোর,
হুঙ্কারে গরজে প্রাণপণে ||
বারেক চঞ্চলাভায়, দেখি নীল মেঘ গায়,
কটা মাথা নাড়ে ক্ষিপ্তবন।
পাতা উড়ে ঢাকে ঘনে, পড়িতেছে ঘোর স্বনে,
বড় বড় মহীরুহগণ ||
ঘোরতর চীৎকার, লক্ষ লক্ষ অনিবার,
মানুষ চিবায় ভূতগণে।
সমুদ্র সমান সোরে, বরিষা আছাড়ে জোরে
রেগে রেগে গর্জ্জে বায়ু সনে ||
উপরি উপরি ধ্বনি, আছাড়ে সহস্রাশনি,
খণ্ডে খণ্ডে ছেঁড়ে বা গগন।
বিদারিয়ে বিটপীরে, বজ্রাগ্নি পোড়ায় শিরে,
কাঁদে যত সিংহ ব্যাঘ্রগণ ||

১১
ভীষণ নীরব। যেন মরেছে ধরণী।
হে ধাতঃ কাঁপালো স্তব্ধ আবার কি ধ্বনি ||
বলিছে গম্ভীর স্বরে, “রে নরযুগল।
দেবের নিকুঞ্জে এসে পাও কর্ম্মফল ||”
ফিরে বার ঘর ঘর, গরজিল জলধর,
মাতিল মরুৎ ফিরে বার।
চেচায় অশনি ঘন, ভীমবলে তরুগণ,
মত্ত শির নাড়িছে আবার ||

১২
থামিল ঝটিকারণ, হলো নিশাশেষ।
শ্বেতমেঘময়াকাশে, উদিল নিশেশ ||
জলে করে জলময়, কানন নিকুঞ্জ।
তরু লতা তৃণ ভূম, পুষ্পলতা পুঞ্জ ||
ফুলময় ছোট খাল বিমল চঞ্চল।
ছায়াকারী শাখা হতে ঝরে বিন্দুজল ||
উজ্জ্বল পুলিনতলে ম্লান তারা মত।
মরিয়ে রয়েছে ঝড়ে ললিতা মন্মথ ||
মানবের কি কপাল! সংসার কি ছার!
বহিতে জীবন ভার কে চাহিবে আর
নাথভুজে মাথা দিয়ে পড়েছে মোহিনী।
মুখে মুখে কাঁদে যেন দুটি সরোজিনী ||
ললিতার মুখশশী ভিজে বরিষায়।
সরোজ শিশির মাথা মাটিতে লোটায় ||
শীতল ললাটে জলে জ্বলে শশধর।
জলে ভিজে পড়ে আছে অলকানিকর ||
ফুটায় কবরী চারু, দীর্ঘ তৃণোপরে।
মন্মথ রয়েছে তবু নাহি তুলে ধরে ||
এখনো সুস্থির মুখ রূপের ছায়ায়।
প্রাণ গেল তবু রূপ নাহি ছাড়ে তায় ||
সেরূপ ঘুমায় যেন, সন্ধ্যা ধরাপরে;
ভয়ে প্রকৃতির যেন নিশ্বাস না সরে ||
স্থির শ্বেত ভাল সেই, নহে নিরমল।
দেখিলে শিহর হয় শরীর বিকল ||
পড়ি তায় মরণের ভয়ঙ্কর ছায়া।
চন্দ্রিকায় যেন কালো, কাদম্বিনী কায়া ||
যেন চন্দ্রকরে স্থির বারিধি বিস্তার।
পড়ে তায় শিখরীর ছায়া অন্ধকার ||
কোমল পল্লব নীল মুদেছে নয়ন।
এরি কি কটাক্ষে ছিল সুখের স্বপন?
এখনি কেঁদেছে কত কাঁদিবে না আর।
সফরী সমান নাহি নাচিবে আবার ||
বুঝি তার প্রিয় তারা মন্মথ বদনে।
চাহিতে চাহিতে বুঝি মুদেছে মরণে ||
মানবের কি কপাল! এই সে হৃদয়।
কোথা তার প্রেম মোহ কোথা আশা ভয়!
বিবাস বিমল পড়ি শশীর কিরণে।
ভিতরে নিস্পন্দ যেন জগৎ এক্ষণে ||
এক বৃন্তে দুটি ফুল মুখে মুখ দিয়ে।
সে হৃদি কুসুমাসনে পড়েছে ছিঁড়িয়ে ||
তেমনি একাঙ্গে এরা থেকে চিরকাল।
মরিল অধরাধরে কি সুখ কপাল ||
যার লাগি ছিল বেঁচে পারিত বাঁচিতে।
তারি সনে মরে গেল তাহারি হৃদিতে ||
সুখের কপাল! কত সংসার যাতনা।
বিকার বিয়োগ শোক সহিতে হলো না ||
ছিঁড়িয়াছে ভীম ঝড়ে একই প্রহারে।
কাটে নি ক্রমশঃ কীট, প্রাণের সুসারে ||
গভীর গোপনগামী সুখ-স্রোতোপরে।
পড়ে নাই ভেসে ভেসে ডুবিতে সাগরে ||
যা হবার হইয়াছে এই মাত্র স্থির।
এই আছে অবশেষ, সে প্রেমশশীর ||
ওইখানে দেহাম্বুজ মাটি হয়ে যাবে।
জানিবে কে? দেখিবে কে? কেঁদে কে ভিজাবে?

চন্দ্রিকার নীলাকাশ গায়, দুটি দেবদারু দেখা যায়।
ভীম বনে তলে তার, অতি স্তব্ধ অনিবার,
কাল যেন প্রহরী তাহায় ||
সেই নদী সেই তরুবরে, দুখময় তর তর স্বরে,
বারেক না ক্ষান্ত আছে, নক্ষত্রমণ্ডলী আছে,
অদ্যাপি বিলাপ কেন করে ||
গম্ভীর সে ধ্বনি নিরবধি, যেন বা সন্ধ্যায় শরন্নদী।
শুনিলে শিহরি স্মরি, মেধার মারুতোপরি,
জানিনে যেতেছি কি জলধি ||
শ্যামলা গুল্মিনী চির নব, ব্যাপিয়াছে সেই স্থান সব।
তারাফুল তারা ধরে, অনন্ত আমোদ করে,
সুধাপানে শিহরিছে নভ ||
এ কাননে গভীর এমন, কে করে রে বাঁশরী বাদন।
অনিবার নিশাভাগে, যেন কার অনুরাগে,
গায়ে সাধে মনের যাতন ||
মোহমন্ত্রে তার স্থির বন, শোনে ধ্বনি-বিহীন স্পন্দন।
পত্রটি নাহিক সরে, যেতে যেতে শুনে স্বরে,
নাহি সরে নীরধরগণ ||
চন্দ্রিকার শূন্য কুঞ্জোপর, মোহন স্বপ্নজ শোভাধর।
কারা যেন শুনে তায়, উড়ে নীল নভ গায়,
মর্ম্মরিত প্রচুর অম্বর ||
তাহে কত সুধাবাস ঝরে, কুসুম বরিষে কুঞ্জোপরে।
ভাঙ্গে স্বপ্ন ঊষা আসি, অমনি নীরব বাঁশী,
গল্যে যায় সে রূপ নিকরে ||
ধূলি হয়ে এই কুঞ্জবনে মন্মথ-মোহিনী নাথ সনে।
প্রতি নিশি এই মত, হয় যথা নিদ্রাগত,
ললিতা মন্মথ দুই জনে ||

Watch Full Movie Online Streaming Online and Download

Leave a Reply