প্রথম পাঠ — বিশুদ্ধি

রচনার চারিটি গুণ বিশেষ করিয়া শিখিতে হইবে। এই চারিটির নাম (১) বিশুদ্ধি, (২) অর্থব্যক্তি, (৩) প্রাঞ্জলতা, (৪) অলঙ্কার।

প্রথমে বিশুদ্ধি। রচনার ভাষা শুদ্ধ না হইলে সব নষ্ট হইল। বিশুদ্ধির প্রতি সর্বাগ্রে মনোযোগ করিতে হইবে। বিশুদ্ধি সর্বপ্রধান গুণ।

যাহা বিশুদ্ধ নহে, তাহা অশুদ্ধ। কি হইলে রচনা অশুদ্ধ হয়, তাহা বুঝিলেই, বিশুদ্ধি কি তাহা বুঝিবে।

পূর্বেই বলিয়াছি যে মৌখিক রচনা যেরূপ, লিখিত রচনাও সেইরূপ; তবে কিছু প্রভেদ আছে। লিখিত রচনা কতকগুলি নিয়মের অধীন, মৌখিক রচনা সে সব নিয়মের অধীন নয়। অথবা অধীন হইলেও মৌখিক রচনায় সে সকল নিয়ম লঙ্ঘনে দোষ ধরা যায় না। লিখিত রচনায় যে সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলে দোষ ধরিতে হয়, সেই সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলেই রচনা অশুদ্ধ হইল। সেই সকল দোষের কথা এখন লিখিতেছি।

১। বর্ণাশুদ্ধি। মুখে সকলেই বলে, “পষ্ট” “মেগ” “শপত” “শট” “বাঁদ” “দুবল” “নেত্য” কিন্তু লিখিতে হইবে “স্পষ্ট, মেঘ, শপথ, শঠ, বাঁধ, দুর্বল, নৃত্য।”

২। সংক্ষিপ্তি। মুখে বলি, “কোরে, “কচ্চি”, “কর্‌ব” “কল্লুম” “কচ্ছিলুম” কিন্তু লিখিতে হইবে “করিয়া” “করিতেছি” “করিব” “করিলাম” “করিতেছিলাম” ইত্যাদি।

৩। প্রাদেশিকতা। বাঙ্গালার কোন প্রদেশের লোকে বলে, “কল্লুম”, কোন প্রদেশে, “কল্লেম”, কোথাও, “কল্লাম”, কোথাও “কন্নু”। কোন প্রদেশবিশেষেরই ভাষা ব্যবহার করা হইবে না;—যাহা লিখিত ভাষায় চিরপ্রচলিত, তাহাই ব্যবহৃত হইবে।

অন্যান্য স্থানের অপেক্ষা রাজধানীর ভাষাই সমধিক পরিচিত। অতএব রাজধানীর ভদ্রসমাজে যে ভাষা চলিত তাহা লিখিত রচনায় ব্যবহৃত হইতে পারে। কোন দেশে বলে “ছড়ি” কোন দেশে বলে “নড়ি।” “ছড়ি” কলিকাতার ভদ্রসমাজে চলিত। উহা ব্যবহৃত হইতে পারে। “লগি” “লগা” “চৈড়”—ইহার মধ্যে লগিই কলিকাতায় চলিত, উহাই ব্যবহৃত হইতে পারে। অপর দুইটি ব্যবহৃত হইতে পারে না।

৪। গ্রাম্যতা। কেবল ইতর লোক বা গ্রাম্য লোকের মধ্যে যে সকল শব্দ প্রচলিত, তাহা ব্যবহৃত হইতে পারে না। “কৌশল্যার পো রাম,” “দশরথের বেটা লক্ষ্মণ,” এ সকল বাক্য গ্রাম্যতা-দোষে দুষ্ট।

নাটক ও উপন্যাস গ্রন্থে, যে স্থানে কথোপকথন লিখিত হইতেছে, সেখানে এই চারিটি দোষ অর্থাৎ বর্ণাশুদ্ধি সংক্ষিপ্ত প্রাদেশিকতা ও গ্রাম্যতা থাকিলে দোষ ধরা যায় না। কেন না মৌখিক রচনা এ সকল নিয়মের অধীন নহে বলিয়াছি। কথোপকথন মৌখিক রচনা মাত্র। কবিতা রচনাতেও অনেক স্থানে এ সকল নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়।

৫। ব্যাকরণ-দোষ। রচনায় ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি বজায় রাখিতে হইবে। ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি এখানে লেখা যাইতে পারে না—তাহা হইলে এইখানে একখানি ব্যাকরণের গ্রন্থ লিখিত হয়। কিন্তু উদাহরণস্বরূপ দুই একটা সাধারণ নিয়ম বুঝাইয়া দেওয়া যাইতেছে।

সন্ধি। সংস্কৃতের নিয়ম, সন্ধির যোগ্য দুইটি বর্ণ একত্রে থাকিলে সকল স্থানেই সন্ধি হইবে। কিন্তু বাঙ্গালার নিয়ম তাহা নহে, বাঙ্গালার সমাস ব্যতীত সন্ধি হয় না। যে দুইটি শব্দে সমাস হয় না, সে দুইটি শব্দে সন্ধিও হইবে না।

সহজ উদাহরণ;—“সঃ অস্তি,” সংস্কৃতে, “সোহস্তি” হইবে; কিন্তু বাঙ্গালায় “তিনি আছেন” “তিন্যাছেন” হইবে না। “অঙ্গুলি” “উত্থিত” এই দুইটি শব্দ সংস্কৃতে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মধ্যে আর কিছু না থাকিলে, “অঙ্গুল্যুত্থিত” হইয়া যাইবে, কিন্তু বাঙ্গালায় যদি বলি, “তিনি অঙ্গুলি উত্থিত করিলেন,” সে স্থলে “তিনি অঙ্গুল্যুত্থিত করিলেন,” এরূপ কখনই লিখিতে পারিব না। কেন না এখানে সমাস নাই।

বাঙ্গালায় সন্ধির দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, সংস্কৃতে ও অসংস্কৃতে কখন সন্ধি হইবে না। “আমার অঙ্গুলি” বলিতে হইবে, “আমারাঙ্গুলি” হয় না। সন্ধি করিতে হইলে, “মমাঙ্গুলি” বলিবে, সেও ভাল বাঙ্গালা হয় না—কেন না সমাস নাই। “মড়াহারী পক্ষী” বলা যায় না; “শবাহারী” বলিতে হইবে। “গাধাকৃত পশু” বলা যায় না; “গর্দভাকৃত” বলিতে হইবে। সকলেই “মনান্তর” বলে, কিন্তু ইহা অশুদ্ধ। কেন না “মন” বাঙ্গালা শব্দ; সংস্কৃত মনস্, প্রথমায় মনঃ, এজন্য, “মনোদুঃখ”, “মনোরথ” শুদ্ধ।

তৃতীয় নিয়ম। যদি দুইটি শব্দ অসংস্কৃত হয়, তবে কখনই সন্ধি হইবে না। যথা, “পাকা আতা” সন্ধি হয় না।

সমাজ। সমাসেরও নিয়ম ঐরূপ; সংস্কৃতে এবং অসংস্কৃতে সমাস হয় না। যেমন, “মহকুমাধ্যক্ষ”; “উকীলাগ্রগণ্য”; “মোক্তারাদি” এ সকল অশুদ্ধ। অথচ এরূপ অশুদ্ধি এখন সচরাচর দেখা যায়।

উভয় শব্দ সংস্কৃত হইলেও সমাস করা না করা লেখকের ইচ্ছাধীন। “অধরের অমৃত” বলিতে পার, অথবা “অধরামৃত” বলিতে পার। “অধরামৃত” বলিতে সমাস হইল “অধরের অমৃত” বলিলে সমাস হইল না। সন্ধি করা না করাও লেখকের ইচ্ছাধীন। কেহ লেখেন “অধরামৃত”, কেহ লেখেন “অধর অমৃত”।

বাঙ্গালায় সন্ধি সমাসের বাহুল্য ভাল নহে। সহজ রচনায় উহা যত কম হয়, তত ভাল।

প্রত্যয়। প্রত্যয় সম্বন্ধে সংস্কৃতের যে নিয়ম, বাঙ্গালা রচনায় সংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহারকালে সেই সকল বজায় রাখিতে হইবে। “সৌজন্যতা” “ঐক্যতা” এ সকল অশুদ্ধ। “সৌজন্য” “ঐক্য এইরূপ হইবে।

সংস্কৃত শব্দের পরে অসংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহার হইতে পারে না। “মূর্খামি” বলা যায় না, কেন না “মূর্খ” সংস্কৃত শব্দ, “মি” সংস্কৃত প্রত্যয় নহে; “মূর্খতা” বলিতে হইবে। “অহম্মুখ” সংস্কৃত শব্দ; এজন্য “আহাম্মুখি” অশুদ্ধ, “অহম্মুখতা” বলিতে হইবে।

স্ত্রীত্ব। সংস্কৃতে এই নিয়ম আছে যে, বিশেষ্য যে লিঙ্গান্ত হইবে, বিশেষণও সেই লিঙ্গান্ত হইবে। যথা, সুন্দরী বালিকা, সুন্দর বালক; বেগবান্ নদ, বেগবতী নদী।

বাঙ্গালায় এই নিয়মের অনুবর্তী হওয়া লেখকের ইচ্ছাধীন। অনেকেই সুন্দরী বলিকা লেখেন; কিন্তু সুন্দর বালিকাও বলা যায়। বিশেষতঃ বিশেষণ বিশেষ্যের পরে থাকিলে ইহাতে কোন দোষই হয় না। যথা, “এই বালিকাটি বড় সুন্দর।” “রামের স্ত্রী বড় মুখর।” অনেক সময়ে বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গান্ত হইলে বড় কদর্য শুনায়। যথা, “রামের মা উত্তমা পাচিকা” এখানে “উত্তম পাচিকা” বলিতে হইবে।

বাঙ্গালা রচনায় স্ত্রীত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি নিয়ম প্রবল;—

১। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে পুংলিঙ্গান্ত রাখিতে পার। যেমন সুন্দর বালিকা উর্বর ভূমি। কিন্তু পুংলিঙ্গান্ত বা ক্লীবলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে কখন স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে পার না। “পঞ্চমী দিবস” “মহতী কার্য” “সুবিস্তৃতা জনপদ” এ সকল অশুদ্ধ।

২। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে ইচ্ছামত স্ত্রীলিঙ্গান্ত না করিলে, না করিতে পার; কিন্তু যদি কতকগুলি বিশেষণ থাকে আর তাহার একটিকে স্ত্রীলিঙ্গান্ত কর, তবে আর সকলগুলিকেও স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে হইবে। “সুন্দর বালিকা” বলিতে পার, কিন্তু “সুসজ্জিতা সুন্দর বালিকা” বলিতে পার না, “সুসজ্জিতা সুন্দরী বালিকা” বলিতে হইবে। “প্রখর নদী” বলিতে পার, কিন্তু “কুলপ্লাবিনী প্রখর নদী” বলিতে পার না; এখানে “প্রখরা” বলিতে হইবে।

৩। বিশেষণ হইলে সংস্কৃত শব্দই স্ত্রীলিঙ্গান্ত হয়, অসংস্কৃত বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গান্ত হয় না। যথা “একটা বড় বাঘিনী” ভিন্ন “একটা বড়ী বাঘিনী” বলা যায় না; “ঢেঙ্গা মেয়ে” ব্যতীত “ঢেঙ্গী মেয়ে” বলা যায়। “ফুটো কৌড়ি” “ফুটী কৌড়ি” নহে। হিন্দীর নিয়ম বিপরীত। হিন্দীতে “ফুটী কৌড়ি” বলিতে হইবে।

৪। অসংস্কৃত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষণ ভাল শুনায় না। “গর্ভবতী মেয়ে” না বলিয়া “গর্ভবতী কন্যা” বলাই ভাল। “সুশীলা বউ” না বলিয়া “সুশীলা বধূ” বলা উচিত। “মুখরা চাকরাণী” না বলিয়া “মুখরা দাসী” বলিব।

কারক। সকল বাক্যে কর্তা ও কর্ম যেন নির্দিষ্ট থাকে। বাঙ্গালায় এ বিষয়ে ভুল সর্বদা হয়। “আমাকে মারিয়াছে।” কে মারিয়াছে তাহার ঠিক নাই। “বুঝি দেশে রহিতে দিল না।” কে রহিতে দিল না তাহার ঠিক নাই।

দ্বিতীয় পাঠ — অর্থব্যক্তি

তোমার যাহা বলিবার প্রয়োজন, রচনায় তাহা যদি প্রকাশ করিতে না পারিলে, তবে রচনা বৃথা হইল। অর্থব্যক্তির বিশেষ কোন নিয়ম নাই, তবে দুই একটা সঙ্কেত আছে।

যে কথাটিতে তোমার কাজ হইবে, সেই কথাটি ব্যবহার করিবে। তাহা শুনিতে ভাল নয়, কি বিদেশী কথা, এরূপ আপত্তি গ্রাহ্য করিও না। এক সময়ে লেখকদিগের প্রতিজ্ঞা ছিল যে, সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করিবে না। কিন্তু এখনকার উৎকৃষ্ট লেখকেরা প্রায়ই এ নিয়ম ত্যাগ করিয়াছেন। যে কথাটিতে মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তাঁহারা সেই কথাই ব্যবহার করেন।

একটি উদাহরণ দিতেছি। তুমি কোন আদালতের ইশ্‌তিহারের কথা লিখিতেছ। আদালত হইতে যে সকল আজ্ঞা, সকলের জানিবার জন্য প্রচারিত হয়, তাহাকে ইশ্‌তিহার বলে। ইহার আর একটি নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন” সংস্কৃত শব্দ, ইশ্‌তিহার বৈদেশিক শব্দ, এজন্য অনেকে “বিজ্ঞাপন” শব্দ ব্যবহার করিতে চাহিবেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একটু দোষ আছে, তাহার অনেক অর্থ হইয়া উঠিয়াছে। গ্রন্থকর্তা গ্রন্থ লিখিয়া গ্রন্থের পরিচয় জন্য প্রথম যে ভূমিকা লেখেন তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। দোকানদার আপনার জিনিস বিক্রয়ের জন্য খবরের কাগজে বা অন্যত্র যে খবর লেখে, তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। সভা কি রাজকর্মচারীর রিপোর্টের নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন” শব্দের এইরূপ অর্থের গোলযোগ আছে। এস্থলে, আমি ইশ্‌তিহার শব্দই ব্যবহার করিব। কেন না, ইহার অর্থ সকলেই বুঝে, লৌকিক ব্যবহার আছে। অর্থেরও কোন গোল নাই।

দ্বিতীয় সঙ্কেত এই যে, যদি এমন কোন শব্দই না পাইলাম যে তাহাতে আমার মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তবে যেটি উহারই মধ্যে ভাল, সেইটি ব্যবহার করিব। ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া অর্থ বুঝাইয়া দিব। দেখ, “জাতি” শব্দ নানার্থ। প্রথম, জাতি (Caste) অর্থে হিন্দুসমাজের জাতি; যেমন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈবর্ত ইত্যাদি। দ্বিতীয়, জাতি অর্থে দেশবিদেশের মনুষ্য (Nation); যেমন ইংরেজজাতি, ফরাসীজাতি, চীনজাতি। তৃতীয়, জাতি অর্থে মনুষ্যবংশ (Race); যেমন আর্যজাতি, সেমীয়জাতি, তুরাণীজাতি ইত্যাদি। চতুর্থ, জাতি অর্থে কোন দেশের মনুষ্যদিগের শ্রেণীবিশেষ মাত্র (Tribe); যেমন, য়িহুদায় দশজাতি ছিল। পঞ্চম, ‘নানাজাতি পক্ষী’, ‘কুক্কুরের জাতি’ (Species) বলিলে যে অর্থ বুঝায়, তাই। ইহার মধ্যেও কোনও অর্থ প্রকাশ করিতে গেলে, জাতি ভিন্ন বাঙ্গালায় অন্য শব্দ নাই। এস্থলে জাতি শব্দই ব্যবহার করিতে হইবে। কিন্তু ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, কোন্ অর্থে ‘জাতি’ শব্দ ব্যবহার করা যাইতেছে। বুঝাইয়া দিয়া উপরে যেমন দেওয়া গেল, সেইরূপ উদাহরণ দিলে আরও ভাল হয়।

তৃতীয় পাঠ — প্রাঞ্জলতা

প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যাহা লিখিবে, লোকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা। কিন্তু অনেক লেখক এ কথা মনে রাখেন না। কতকগুলি নিয়ম, আর কতকগুলি কৌশল মনে রাখিলে রচনা খুব প্রাঞ্জল করা যায়। দুই রকমই বলিয়া দিতেছি।

১। একটি বস্তুর অনেকগুলি নাম থাকিতে পারে, যেমন আগুনের নাম অগ্নি, হুতাশন অথবা হুতভুক্, অনল, বৈশ্বানর, বায়ুসখা ইত্যাদি। এখন, আগুনের কথা লিখিতে গেলে ইহার মধ্যে কোন্ নামটি ব্যবহার করিব? যেটি সবাই জানে, অর্থাৎ আগুন বা অগ্নি। যদি বলি, “হুতভুক্ সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র সঞ্চালিত হয়,” তবে অধিকাংশ বাঙ্গালী আমার কথা বুঝিবে না। যদি বলি যে, “অগ্নির সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র চলে” সকলেই বুঝিবে।

২। অনর্থক কতকগুলা সংস্কৃত শব্দ লইয়া সন্ধি সমাসের আড়ম্বর করিও না—অনেকে বুঝিতে পারে না। যদি বলি, “মীনক্ষোভাকুল কুবলয়” তোমরা কেহ কি সহজে বুঝিবে? আর যদি বলি, “মাছের তাড়নে যে পদ্ম কাঁপিতেছে,” তবে কে না বুঝিবে?

৩। অনর্থক কথা বাড়াইও না। অল্প কথায় কাজ হইলে, বেশী কথার প্রয়োজন কি? “এবম্বিধ বিবিধ প্রকার ভয়াবহ ব্যাপারের বশীভূত হইয়া, যখন সূর্যদেব পূর্বগগনে অধিষ্ঠান করিয়া পৃথিবীতে স্বীয় কিরণমালা প্রেরণ করিলেন, তখন আমি সেই স্থান পরিত্যাগ পূর্বক অন্যত্র গমন করিলাম।” এরূপ না বলিয়া যদি বলি, “এইরূপ অনেক বিষয়ে ভয় পাইয়া, যখন সূর্য উঠিল তখন আমি সেস্থান হইতে চলিয়া গেলাম” তবে অর্থের কোন ক্ষতি হয় না, অথচ সকলে সহজে বুঝিতে পারে।

৪। জটিল বাক্য রচনা করিও না। অনেকগুলি বাক্য একত্র জড়িত করা হইলে বাক্য জটিল হয়। যেখানে বাক্য জটিল হইয়া আসিবে, সেখানে জটিল বাক্যটি ভাঙ্গিয়া ছোট ছোট সরল বাক্যে সাজাইবে। উদাহরণ দেখঃ—

“দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের যেরূপ শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে পল্লীগ্রাম যে জলহীন হইবে, এবং তদ্ধেতুক যে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে, এরূপ অনুমান করিয়াও অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি তাহার প্রতিবিধানে যত্ন করেন না, দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

এই বাক্য অতি জটিল। সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু ছোট ছোট বাক্যে ইহাকে বিভক্ত করিয়া লইলে কত সহজ হয় দেখ। “দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে। যেরূপ শোচনীয় অবস্থায় দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে অনেক পল্লীগ্রাম জলহীন হইবে। পল্লীগ্রাম সকল জলহীন হইলে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে। অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি ইহা অনুমান করিয়াছেন। কিন্তু অনুমান করিয়াও তাঁহারা ইহার প্রতিবিধানের যত্ন করেন না। ইহা দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

একটি বাক্যের স্থানে ছয়টি হইয়াছে। কিন্তু বুঝিবার আর কোন কষ্ট নাই।

৫। উদাহরণ। যেখানে স্থূল কথাটা বুঝিতে কঠিন, সেখানে উদাহরণ প্রয়োগে বড় পরিষ্কার হয়। এই গ্রন্থে সকল কথার উদাহরণ দেওয়া গিয়াছে, সুতরাং উদাহরণের আর পৃথক্ উদাহরণ দিবার প্রয়োজন নাই।

৬। সম্প্রসারণ। স্থূল বাক্যটি বড় সংক্ষিপ্ত হইলে অনেক সময়ে বুঝিবার কষ্ট হয়। এমন স্থলে সম্প্রসারণ করিবে। অশ্বের উদাহরণ পূর্বে প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে দিয়াছি; তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।

“অশ্ব শৃঙ্গহীন উদ্ভিদ্‌ভোজী চতুষ্পদ বিশেষ।”

ইহাতে অনেক কথা বুঝিবার কষ্ট আছে। যাহা যাহা বুঝিবার কষ্ট, তাহার প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে সম্প্রসারিত বাক্যগুলিতে পরিষ্কার হইয়াছে। আর এক প্রকারের উদাহরণ দেখ।

মনে কর, এ বৎসর বৃষ্টি কম হইয়াছে। লোকে বলে “ঊন বর্ষায় দুনো শীত।” অর্থাৎ যে বার বৃষ্টি কম হয় সে বার শীত বেশী হয়। মনে কর, তুমি সে কথা জান না। এমন অবস্থায় ভাদ্র মাসে তোমাকে যদি কেহ বলে, “এ বৎসর শীত বেশী হইবে,” তাহা হইলে তুমি তাহার কথার মর্ম কিছু বুঝিতে পারিবে না, হয়ত তাহাকে পাগল মনে করিবে। কিন্তু সে যদি নিজ বাক্যের সম্প্রসারণ করিয়া বলে, “যে যে বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, সেই সেই বৎসর বেশী শীত হইয়াছে দেখা গিয়াছে। এ বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, অতএব এ বৎসর বেশী শীত হইবে।” তাহা হইলে বুঝিবার কষ্ট থাকে না।

ন্যায়শাস্ত্রে ইহাকে বলে “অবয়ব” বলে। ন্যায়শাস্ত্রে অবয়বের এইরূপ উদাহরণ দেয়, যথা—

“পর্বতে আগুন লাগিয়াছে,

কেন না পর্বতে ধুঁয়া দেখিতেছি।”

যেখানে যেখানে ধুঁয়া দেখা গিয়াছে, সেইখানে আগুন দেখা গিয়াছে।

এই পর্বতে ধুঁয়া দেখা যাইতেছে,

অতএব ইহাতে আগুন লাগিয়াছে।

অনেক সময়ে এইরূপ লিখিলে রচনা বড় পরিষ্কার হয়।

চতুর্থ পাঠ — অলঙ্কার

অলঙ্কার ধারণ করিলে যেমন মনুষ্যের শোভা বৃদ্ধি পায়, অলঙ্কার ধারণ করিলে রচনারও সেইরূপ শোভা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অলঙ্কার প্রয়োগ বড় কঠিন। আর, সকল প্রকার রচনায় অলঙ্কারের সমাবেশ করা যায় না; বিশেষ, যাহারা প্রথম রচনা করিতে শিখে, তাহাদিগের পক্ষে অলঙ্কার প্রয়োগ বিধেয় নহে। অতএব অলঙ্কার সম্বন্ধে কিছু লেখা গেল না।

Leave a Reply