গ্রোশ্যাস[১], ১৫৮৩ খৃঃ অব্দে, হলণ্ডের অন্তঃপাতী ডেল্‌ফট নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবকালেই অসাধারণবিদ্যোপার্জ্জন দ্বারা অত্যন্ত খ্যাতি প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন; অষ্টবৰ্ষ বয়ঃক্রমকালে, লাটিন ভাষায় কাব্যরচনা করেন; চতুর্দশ বৎসরের সময়, পণ্ডিতসমাজে গণিত, ব্যবহারসংহিতা ও দর্শনশাস্ত্রের বিচার করিতে পারিতেন; ১৫৯৮ খুঃ অব্দে, হলণ্ডের রাজদূত বর্নিবেণ্টের সমভিব্যাহারে পারিস রাজধানী গমন করেন, তথায় বুদ্ধিনৈপুণ্য ও সুশীলতা দ্বারা ফ্রান্সের অধিপতি সুপ্ৰসিদ্ধ চতুর্থ হেনরির নিকট ভূয়সী প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, এবং সর্ব্বত্র অদ্ভুত পদাৰ্থ বলিয়া পরিগণিত ও প্রশংসিত হয়েন। হলণ্ডপ্ৰত্যাগমনের পর, তিনি ব্যবহারজীবের ব্যবসায় অবলম্বন করিলেন, এবং সতর বৎসর বয়সে, ধৰ্ম্মাধিকরণে প্ৰথম বারেই এমন অসাধারণ রূপে আত্মপক্ষ সমর্থন করিলেন যে, তদ্দ্বারা অতি প্ৰভূত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিলেন, এবং অল্পকালমধ্যে প্রধান ব্যবহারজীবের পদে অধিরূঢ় হইলেন।

বীরনগরের অধ্যক্ষের মেরি রিজর্সবৰ্গনাম্নী এক তনয়া ছিল। গ্রোশ্যাস, ১৬০৮ খৃঃ অব্দে, ঐ কামিনীর পাণিগ্রহণ করিলেন। এই রমণী রমণীয় গুণগ্ৰাম দ্বারা গ্ৰোশ্যাসের যোগ্য ছিলেন, এবং গ্রোশ্যাসের সহধৰ্ম্মিণী হওয়াতেই, তাঁহার গুণের সমুচিত সমাদর হইয়াছিল। কি সম্পত্তি, কি বিপত্তি, সকল সময়েই তাঁহারা পরস্পর অবিচলিত সদ্ভাবে ও যৎপরোনাস্তি প্ৰণয়ে কালযাপন করিয়াছিলেন। কিঞ্চিৎ পরেই দৃষ্ট হইবেক, নিগৃহীত স্বামীর ক্লেশশান্তিবিষয়ে, ঐ পতিপ্ৰাণা কামিনীর ঐকান্তিক প্ৰণয়ের কি পৰ্য্যন্ত উপযোগিতা হইয়াছিল।

গ্রোশ্যাস অত্যন্ত কুৎসিত সময়ে ভূমণ্ডলে আসিয়াছিলেন। ঐ কালে জনসমাজ ধৰ্ম্ম ও দণ্ডনীতি বিষয়ক বিষম বিসংবাদ দ্বারা সাতিশয় বিসঙ্কুল ছিল। মনুষ্যমাত্ৰেই ধৰ্ম্মসংক্রান্ত বিবাদে উন্মত্ত, এবং ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের ঔদ্ধত্য ও কলহপ্ৰিয়তা দ্বারা সৌজন্য ও দয়া দাক্ষিণ্য একান্ত বিলুপ্ত হইয়াছিল। গ্রোশ্যস, আম্মিনিয় সাম্প্রদায়িক[২] ও সৰ্ব্বতন্ত্রপক্ষীয়[৩] ছিলেন। তিনি স্বীয়ব্যবসায়িককাৰ্য্যোপলক্ষে ত্বরায় এমন বিবাদীবাগুরাতে পতিত হইলেন যে, তাহা হইতে মুক্ত হওয়া অত্যন্ত দুরূহ হইয়া উঠিল। তাঁহার তুল্যমতাবলম্বী পূৰ্ব্বসহায় বর্নিবেণ্ট অভিদ্রোহাভিযোগে ধৰ্ম্মাধিকরণে নীত হইলে, তিনি স্বীয় লেখনী ও আধিপত্য দ্বারা তাঁহার যথোচিত সহায়তা করিলেন। কিন্তু তাঁহার সমুদায় প্ৰয়াস বিফল হইল। ১৬১৯ খুঃ অব্দে, বর্নিবেণ্টের প্রাণদণ্ড হইল, এবং গ্রোশ্যাস দক্ষিণ হলণ্ডের অন্তঃপাতী লোবিষ্টিনের দুর্গমধ্যে যাবজ্জীবন কারানিরুদ্ধ হইলেন। এইরূপ দারুণ অবিচারের পর, তাঁহার সর্ব্বস্ব হৃত হইল।

বিচারারম্ভের পূর্ব্বে, গ্রোশ্যাস কোনও সাংঘাতিক রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। তৎকালে তাঁহার সহধৰ্ম্মিণী, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকার করিবার নিমিত্ত সাতিশয় উৎসুক্য হইয়াও, কোনও ক্রমে তাঁহার নিকটে যাইতে পান নাই; কিন্তু তাঁহার দণ্ডবিধানের পর, কারাবাসসহচরী হইবার প্রার্থনায় ব্যগ্ৰতাপ্রদর্শন পূর্ব্বক আবেদন করিয়া, তদ্বিষয়ে অনুমতি প্ৰাপ্ত হইলেন। গ্রোশ্যস, তাঁহার এইরূপ অনিৰ্ব্বচনীয় অনুরাগ দর্শনে মুগ্ধ ও প্রীত হইয়া, এক স্বরচিত লাটিন কাব্যে তাঁহার ভূয়সী প্ৰশংসা লিখিয়াছেন, এবং তাঁহার সন্নিধানাবস্থানকে কারাবাসক্লেশরূপ অন্ধতমসে সূৰ্য্যকারোদয়স্বরূপ বর্ণনা করিয়াছেন।

হলণ্ডের লোকেরা গ্রোশ্যাসের গ্রাসাচ্ছাদননির্বাহার্থে আনুকূল্য করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার পত্নী সমুচিতগৰ্ব্বপ্রদর্শন পূর্ব্বক উত্তর দিলেন, আমার যাহা সংস্থান আছে। তদ্দ্বারাই তাঁহার আবশ্যক ব্যয় নির্বাহ করিতে পারিব, অন্যের আনুকূল্য আবশ্যক নাই। তিনি, স্ত্রীজাতিসুলভবৃথাশোকপরবশ না হইয়া, সাধ্যানুসারে পতিকে সুখী ও সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। গ্রোশ্যাসের অধ্যয়নানুরাগও এক বিলক্ষণ বিনোদনোপায় হইয়াছিল। বস্তুতঃ, গুণবতীভাৰ্য্যাসহায় ও প্রশস্তপুস্তকমণ্ডলীপরিবৃত ব্যক্তির সাংসারিক সঙ্কটে বিষন্ন হইবার বিষয় কি। তথাহি, গ্রোশ্যাস, যাবজ্জীবন কারাবাসাদণ্ডে নিগৃহীত হইয়াও, নিজ পত্নীর সন্নিধান ও অভিমত অধ্যয়ন দ্বারা প্ৰফুল্ল চিত্তে কালযাপন করিয়াছিলেন।

কিন্তু, তাঁহার পত্নী তদীয় উদ্ধারসাধনে একান্ত অধ্যবসায়িনী ছিলেন। যাঁহারা অসন্দিগ্ধ চিত্তে তাঁহাকে পতিসমভিব্যাহারে কারাগারে বাস করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন, বোধ হয়, পতিপ্ৰাণা কামিনীর বুদ্ধিকৌশলে ও উদ্যোগে কি পৰ্য্যন্ত কাৰ্য্যসাধন হইতে পারে, তাঁহারা তদ্বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তিনি, এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, এই অভিলষিতসমাধানের উপায়চিন্তনে বিরতা হয়েন নাই; এবং যদ্বারা এতদ্বিষয়ের আনুকূল্য হইবার সম্ভাবনা, তাদৃশ ব্যাপার উপস্থিত হইলে, তদ্বিষয়ে কোনও ক্রমেই উপেক্ষা করিতেন না।

গ্রোশ্যাস সন্নিহিতনগরবর্ত্তী বন্ধুবর্গের নিকট হইতে পাঠার্থ পুস্তকানিয়নের অনুমতি পাইয়াছিলেন। পাঠসমাপ্তির পর, সেই সকল পুস্তক করগুকমধ্যগত করিয়া প্রতিপ্রেরিত হইত। ঐ সমভিব্যাহারে তাঁহার মলিন বস্ত্ৰও ক্ষালনার্থে রজকালয়ে যাইত। প্ৰথমতঃ, রক্ষকেরা তন্ন তন্ন করিয়া ঐ করগুকের বিষয়ে অনুসন্ধান করিত; কিন্তু কোনও বারেই সন্দেহোদ্বোধক বস্তু দৃষ্টিগোচর না হওয়াতে, ক্রমে শিথিলপ্ৰযত্ন হয়। গ্রোশ্যসের পত্নী, রক্ষিগণের উত্তরোত্তর অযত্নপ্ৰাদুৰ্ভাব দেখিয়া, পতিকে সেই করগুকমধ্যগত করিয়া স্থানান্তরিত করিবার উপায় কল্পনা করিলেন। বায়ুপ্রবেশার্থে তিনি তাহাতে কতিপয় ছিদ্ৰ প্ৰস্তুত করিলেন; এবং গ্রোশ্যাস এইরূপ সংক্ষিপ্ত স্থানে রুদ্ধ হইয়া কত ক্ষণ পৰ্য্যন্ত থাকিতে পারেন, ইহাও পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। অনন্তর, তিনি এক দিবস, দুৰ্গাধ্যক্ষের অসন্নিধানরূপ সুযোগ দেখিয়া, তাহার সহধৰ্ম্মিণীর নিকটে গিয়া, নিবেদন করিলেন, আমার স্বামী অত্যধিক অধ্যয়ন দ্বারা শরীরপাত করিতেছেন; এজন্য, আমি সমুদায় পুস্তক এক কালে ফিরিয়া দিতে বাসনা করি।

এইরূপ প্রার্থনা দ্বারা তাঁহার সম্মতিলাভ হইলে, নিরূপিত সময়ে গ্রোশ্যস করণ্ডকমধ্যে প্ৰবেশ করিলেন। দুই জন সৈনিক পুরুষ অধিরোহণী দ্বারা অতি কষ্টে করণ্ডক অবতীর্ণ করিল। ঐ করণ্ডক সমধিক ভারাক্রান্ত দেখিয়া, তাঁহাদের অন্যতর পরিহাস পূর্ব্বক কহিল, ভাই! ইহার ভিতরে অবশ্যই এক আর্ম্মিনিয় আছে। গ্রোশ্যাসের পত্নী অব্যাকুল চিত্তে উত্তর করিলেন, হাঁ ইহার মধ্যে অনেক আর্ম্মিনিয় পুস্তক আছে বটে। যাহা হউক, সৈনিক পুরুষ, করণ্ডকের অসম্ভবভারদর্শনে সন্দিহান হইয়া, উচিতবোধে অধ্যক্ষপত্নীর গোচর করিল। কিন্তু তিনি কহিলেন, ইহার মধ্যে বহুসংখ্যক পুস্তক আছে, তাহাতেই এত ভারী হইয়াছে; গ্রোশ্যাসের শারীরিকস্বাস্থ্যরক্ষার্থে, তাঁহার পত্নী ঐ সমুদায় পুস্তক এক কালে ফিরিয়া দিবার নিমিত্ত অনুমতি লইয়াছেন।

এক দাসী এই গোপনীয় পরামর্শের মধ্যে ছিল, সে ঐ করাণ্ডকের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিল। কারণ্ডক এক বন্ধুর আলয়ে নীত হইলে, গ্রোশ্যাস অব্যাহত শরীরে তন্মধ্য হইতে নিৰ্গত হইলেন, রাজমিস্ত্রির বেশপরিগ্রহ ও করে কর্ণিক ধারণ পূর্ব্বক, আপণের মধ্য দিয়া গমন করিয়া, নৌকারোহণ করিলেন এবং ব্রাবণ্টে উপস্থিত হইয়া তথা হইতে শকটযানে এণ্টওয়ের্প প্ৰস্থান করিলেন। ১৬২১ খৃঃ অব্দের মার্চ মাসে, এই ব্যাপার সম্পন্ন হয়। গ্রোশ্যাসের সহধৰ্ম্মিণীর যত দিন এরূপ দৃঢ় প্রত্যয় না জন্মিল, গ্রোশ্যাস সম্পূর্ণ রূপে বিপক্ষাবর্গের ক্ষমতার বহির্ভূত হইয়াছেন, তাবৎ তিনি সকলের এই বিশ্বাস জন্মাইয়া রাখিয়াছিলেন যে, তাঁহার স্বামী অত্যন্ত রোগাভিভূত হইয়া শয্যাগত আছেন।

কিয়ৎ দিন পরে এই বিষয় প্রকাশ হইলে, তিনি পূর্ব্বাপর সমুদায় স্বীকার করিলেন। তখন দুৰ্গাধ্যক্ষ ক্ৰোধে অন্ধ হইলেন এবং তাঁহাকে দৃঢ় রূপে রুদ্ধ করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্লেশ দিতে লাগিলেন। পরিশেষে, তিনি রাজপুরুষদিগের নিকট আবেদন করিয়া মুক্তি প্ৰাপ্ত হইলেন। কতকগুলা পামর প্রস্তাব করিয়াছিল, তাঁহাকে যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ করা কৰ্ত্তব্য। কিন্তু অনেকেরই অন্তঃকরণে করুণাসঞ্চার হওয়াতে, তাহা অগ্ৰাহ্য হইল। ফলতঃ, সকলেই তাঁহার বুদ্ধিকৌশল, সহিষ্ণুতা ও পতিপরায়ণতা দর্শনে ভূয়সী প্ৰশংসা করিয়াছিলেন।

গ্রোশ্যাস ফ্রান্সে গিয়া নিৰ্ভয় ও নিশ্চিন্ত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ দিবস পরে, তাঁহার পরিবারও তাঁহার সহিত সমাগত হইলেন। পারিস রাজধানীতে বাস করা বহুব্যয়সাধ্য; এজন্য গ্রোশ্যস প্রথমতঃ কিছু কাল অর্থের অসঙ্গতিনিবন্ধন অত্যন্ত ক্লেশ পাইয়াছিলেন। অবশেষে, ফ্রান্সের আধিপতি তাঁহার বৃত্তি নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দিলেন। তিনি অবিশ্রান্ত গ্ৰন্থরচনা করিতে লাগিলেন; তাঁহার যশঃশশধর, সমুদায় ইয়ুরোপমধ্যে বিদ্যোতমান হইতে লাগিল।

ফ্রান্সের প্রধান মন্ত্রী কার্ডিনাল রিশিলিয়ু গ্রোশ্যাসকে অনন্যমনঃ ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া ফ্রান্সের হিতচিন্তাবিষয়ে ব্যাসক্ত হইবার নিমিত্ত অনুরোধ করেন। কিন্তু গ্রোশ্যাস, প্ৰাকৃত জনের ন্যায়, তাঁহার সমুদায় প্ৰস্তাবে সম্মত না হওয়াতে, তিনি তাঁহাকে অধীনতা নিবন্ধন বিস্তর ক্লেশ দিয়াছিলেন। গ্রোশ্যস, এই রূপে নিতান্ত হতাদর হইয়া, স্বদেশপ্ৰত্যাগমনার্থে অতিশয় উৎসুক হইলেন। তদনুসারে, ১৬২৭ খৃঃ অব্দে, তাঁহার সহধৰ্ম্মিণী, বন্ধুবর্গের সহিত পরামর্শ করিয়া কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যস্থিরীকরণার্থ, হলণ্ড প্ৰস্থান করিলেন।

গ্রোশ্যস প্ৰত্যাগমনবিষয়ে প্রাড়্‌বিবাকদিগের অনুমতি লাভ করিতে পারিলেন না; কিন্তু তৎকালে দণ্ডনীতিবিষয়ে যে নিয়মপরিবর্ত্ত হইয়াছিল, তাঁহার উপর নির্ভর করিয়া, স্বীয় সহধৰ্ম্মিণীর উপদেশানুসারে, সাহস পূর্ব্বক রটার্ডাম নগরে উপস্থিত হইলেন। যৎকালে তাঁহার নামে বিচারালয়ে অভিযোগ হইয়াছিল, তখন তিনি কোনও প্রকারেই অপরাধস্বীকার ও ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে চাহেন নাই; বিশেষতঃ, এমন দৃঢ় রূপে আত্মপক্ষ রক্ষা করিয়াছিলেন যে, তাঁহার বিপক্ষেরা অত্যন্ত অপদস্থ ও অবমানিত হয়; এজন্য তাঁহারা তৎকাল পৰ্য্যন্ত তাঁহার পক্ষে খড়্গহস্ত হইয়াছিল। কতকগুলি লোকে তাঁহার প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করিলেন। কিন্তু প্রাড়্‌বিবাকেরা এই ঘোষণা করিয়া দিলেন, যে ব্যক্তি গ্রোশ্যাসকে রুদ্ধ করিয়া দিতে পারিবেক সে উপযুক্ত পুরস্কার প্রাপ্ত হইবেক। গ্রোশ্যাসের জন্মভূমি বলিয়া যে দেশের মুখ উজ্জ্বল হইয়াছে, তত্ৰত্য লোকেরা তাঁহার প্রতি এইরূপ নৃশংস ব্যবহার করিল।

তিনি হলণ্ড পরিত্যাগ করিয়া, হস্বৰ্গ নগরে গিয়া, দুই বৎসর অবস্থিতি করিলেন। তথায় অবস্থানকালে, সুইডেনের রাজ্ঞী ক্ৰিষ্টিনার অধিকারে বিষয়কৰ্ম্মস্বীকারে সম্মত হওয়াতে, রাজ্ঞী তাঁহাকে ফ্রান্সের রাজসভায় দৌত্যকাৰ্য্যে নিযুক্ত করিলেন। তিনি তথায় দশ বৎসর অবস্থিতি ও কতিপয় উৎকৃষ্ট গ্ৰন্থ রচনা করিলেন। উক্ত কাল পরেই, নানাকারণবশতঃ দৌত্যপদ দুরূহ ও কষ্টপ্ৰদ বোধ হওয়াতে, তিনি বিরক্ত হইয়া কৰ্ম্মপরিত্যাগপ্রার্থনায় আবেদন করিলেন। তাঁহার প্রার্থনা গ্ৰাহ্য হইল। তিনি সুইডেনে প্ৰত্যাগমনকালে হলণ্ডে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার দেশীয় লোকেরা পূৰ্ব্বে তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অকৃতজ্ঞতা প্ৰকাশ করিয়াছিল, এক্ষণে বিশিষ্টরূপ সমাদর করিল।

তিনি সুইডেনে উপস্থিত হইয়া, ক্ৰিষ্টিনাকে সমস্ত কাগজ পত্র বুঝাইয়া দিয়া, লুবেক প্ৰত্যাগমনে প্ৰবৃত্ত হইলেন; কিন্তু পথিমধ্যে অত্যন্ত দুৰ্যোগ হওয়াতে প্রত্যাবৃত্ত হইতে হইল। পরিশেষে, নিতান্ত অধৈৰ্য্য হইয়া, ঝড় বৃষ্টি না মানিয়া, তিনি এক অনাবৃত শকটে আরোহণ পূর্বক প্রস্থান করিলেন। কিন্তু এই অবিমৃষ্যকারিতাদোষেই তাঁহার আয়ুঃশেষ হইল। রষ্টক পৰ্য্যন্ত গমন করিয়া তাঁহাকে বিরত হইতে হইল। তিনি ঐ স্থানেই, ১৬৪৫ খৃঃ অব্দে, আগষ্টের অষ্টাবিংশ দিবসে, ত্ৰিষষ্টি বৎসর বয়ঃক্রম কালে, প্রিয়তমা পত্নী এবং ছয় পুত্রের মধ্যে চারিটি রাখিয়া, কালগ্ৰাসে পতিত হইলেন।

গ্রোশ্যাস নানা বিষয়ে নানা গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছেন। সকলে স্বীকার করেন, তদীয় গ্ৰন্থপরম্পরা দ্বারা বিজ্ঞানশাস্ত্রের সুচারুরূপ অনুশীলনের পথ পরিষ্কৃত হইয়াছে। তাঁহার সন্দর্ভসমূহের মধ্যে অধিকাংশই নিরবচ্ছিন্ন শব্দবিদ্যাসংক্রান্ত, সুতরাং গ্রীক ও লাটিন ভাষার জ্ঞানসাপেক্ষ। এক্ষণে ঐ দুই ভাষার পূর্ব্ববৎ অনুশীলন নাই, এজন্য তৎসমুদায় অধুনা একপ্রকার অকিঞ্চিৎকর হইয়া উঠিয়াছে। আর, ঐ কারণবশতই, তাঁহার আলঙ্কারিক গ্ৰন্থ সকলও একান্ত উপেক্ষিত হইয়াছে। তিনি লাটিন ভাষায় নৈসৰ্গিক ও জাতীয় বিধান বিষয়ে সন্ধিবিগ্ৰহবিধিনামক যে গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছেন, অধুনাতন কালে তাহাতেই তাঁহার কীৰ্ত্তি পৃথ্বীমণ্ডলে দেদীপ্যমান রহিয়াছে। ঐ উৎকৃষ্ট গ্রন্থ দ্বারা ইয়ুরোপীয় অধুনাতন বিধানশাস্ত্রের বিশিষ্টরূপ শ্ৰীবৃদ্ধিলাভ হইয়াছে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. ইহার প্রকৃত নাম হুগো গ্রূট। গ্রূট্‌ শব্দ লাটিন ভাষায় সাধিত হইলে গ্রোশ্যাস হয়। ইনি গ্রূন্ট অপেক্ষা গ্রোশ্যস নামেই বিশেষ প্ৰসিদ্ধ।
  2. খৃষ্টধৰ্ম্মাবলম্বীদিগের মধ্যে আম্মিনিয়স্‌ নামে এক ব্যক্তি এক নূতন সম্প্রদায় প্ৰবর্ত্তিত করেন। প্ৰবৰ্ত্তকের নামানুসারে ইহার নাম আর্ম্মিনিয়া সম্প্রদায় হইয়াছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকদিগের সহিত এই নূতন সম্প্রদায়ের অনুযায়ী লোকদিগের অত্যন্ত বিরোধ ছিল।
  3. যেখানে রাজা নাই সর্ব্বসাধারণ লোকের মতানুসারে যাবতীয় রাজকাৰ্য্য নির্ব্বাহ হয় তাহাকে সর্ব্বতন্ত্র বলে। সর্ব্ব—সর্ব্বসাধারণ, তন্ত্র—রাজ্যচিন্তা।