সিন্ধু হিন্দোল
‘সিন্ধু-হিন্দোল’ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ মুতাবিক ১৯২৭ খৃষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশক শ্রীগোপালদাস মজুমদার, ডি. এম. লাইব্রেরি, ৬১ কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট, কলিকাতা। মুদ্রাকর শ্রীনিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য, সারস্বত প্রিণ্টিং ওয়ার্কস, ৬ নিবেদিতা লেন, বাগবাজার, কলিকাতা। রয়্যাল অক্টোভো আকার; ৫৮ পৃষ্ঠা; মূল্য এক টাকা ছয় আনা।
এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে, এই বছরের জুলাই মাসে হেমন্তকুমার সরকারকে সঙ্গে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে আসেন। কয়েকদিন পর হেমন্তকুমার সরকার কলকাতায় ফিরে গেলেও মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের আমন্ত্রণে তাঁর মাতামহ শিক্ষাব্রতী মরহুম খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ-র তামাকুমণ্ডীর বাড়িতে নজরুল কিছুকাল অবস্থান করেন। এখানেই তিনি ২৭ জুলাই থেকে ২ আগষ্টের মধ্যে ‘অ-নামিকা’, ‘গোপন-প্রিয়া’, ‘সিন্ধু—প্রথম তরঙ্গ’, উৎসর্গ-পৃষ্ঠার পূর্বে যোজিত দুটি চরণ, ‘সিন্ধু—দ্বিতীয় তরঙ্গ’, মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহার ও তাঁর ভগ্নী শামসুন্নাহারকে উৎসর্গ-কবিতা এবং ‘সিন্ধু—তৃতীয় তরঙ্গ’, রচনা করেন। ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘বাংলার আজিজ’ কবিতাটি এবং ‘বুলবুল’ গ্রন্থে সঙ্কলিত একাধিক গানও এ-সময়ে রচিত হয়। বিভিন্ন কবিতায় পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপের মধ্যে পাঠভেদে দেখা যায়।
‘সিন্ধু’ প্রথম তরঙ্গ ১৩৩৩ অগ্রহায়ণের, দ্বিতীয় তরঙ্গ ১৩৩৩ পৌষের এবং তৃতীয় তরঙ্গ ১৩৩৩ মাঘের ‘কালিকলমে’ প্রকাশিত হয়।
‘পথের স্মৃতি’ গানটি ১৩২৭ মাঘের ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় ‘ছায়ানট’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
‘অতল পথের যাত্রী’ ১৩৩৩ কার্তিকের ‘বঙ্গবাণী’তে বের হয়েছিল।
‘অভিযান’ ১৩৩৩ ভাদ্রে ঢাকার মাসিক ‘অভিযান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘চাঁদনী রাতে’ রচিত হয়েছিল ‘জয়দেবপুরের পথে’; এটি ১৩৩৩ কার্তিকের ‘অভিযানে’ প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অভিযান অকালে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটি ১৩৩৭ বৈশাখের ‘জয়তী’তে প্রকাশিত হয়। মূল কবিতাতে চরণ সংখ্যা ছত্রিশ; আটাশ চরণের পরে আছে নিম্নের ছয়টি চরণ—
ছুটিতেছে গাড়ি, ছায়াবাজি-সম কত কথা ওঠে মনে,
দিশাহারা-সম ছোটে খ্যাপা মন জলে থলে নভে বনে!
এলোকেশে মোর জড়ায়ে চরণ কোন্ বিরহিনী কাঁদে,
যত প্রিয়-হারা আমারে কেন গো বাহু-বন্ধনে বাঁধে!
নিখিল বিরহী ফরিয়াদ করে আমার বুকের মাঝে,
আকাশে-বাতাসে তাদেরি মিলন তাদেরি বিরহ বাজে।
গ্রন্থভুক্ত কবিতাটিতে কয়েকটি চরণ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। মূল কবিতায় পঞ্চম ও ষষ্ঠ এবং নবম ও দশম চরণগুলি নিম্নরূপ—
নীলম প্রিয়ার নীলা গুল-রুখ্ নাজুক নেকাবে ঢাকা,
দেখা যায় ঐ নতুন চাঁদের কালোতে আবছা আঁকা।
* * *
নীহার-নেটের ঝাপসা মশারি; যেন ‘বর্ডার’ তারি
দিক-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি।
এই কবিতা সম্পর্কে কথাশিল্পী আবুল ফজল লিখেছেন—
‘তিনি [নজরুল ইসলাম] সে-সময় [১৯২৬ সালে কেন্দ্রীয় আইন-সভায় নির্বাচন-কালে] একদিন আবদুল কাদিরকে সঙ্গে নিয়ে জয়দেবপুর গিয়াছিলেন। গাড়িতে বসে তার সুবিখ্যাত কবিতা ‘চাঁদনী রাতে’ রচনা করেন। রাত্রে আকাশে যখন চাঁদ উঠেছে, চাঁদের আলোয় সারা আকাশ যখন তোলপাড়, আর প্রকৃতি যখন উতলা, তখন কবির মনের ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে পারেনি নির্বাচন কি গজনভী সাহেব।’—
—[সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন, ৪২০-৪২১ পৃষ্ঠা]
নির্বাচনে কবির প্রতিদ্বন্ধিতা সম্পর্কে ১২ই অক্টোবর ১৯২৬ মুতাবিক ২৫শে আশ্বিন ১৩৩৩ তারিখের ‘গণবাণী’তে লেখা হয়—
‘বাংলার বরেণ্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা বিভাগের মুসলমান কেন্দ্র হতে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য-পদ-প্রার্থী হয়েছেন।’
‘মাধবী-প্রলাপ’ ১৩৩৩ জ্যৈষ্ঠের ‘কালিকলমে’ প্রকাশিত হয়। প্রথম বর্ষে ‘কালিকলমের’ সম্পাদক ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও মুরলীধর বসু; কৃষ্ণনগর হতে কবি ১০-৪-২৬ তারিখের একপত্রে শৈলজানন্দকে লেখেন—
‘মাধবী-প্রলাপ পাঠালুম। বৈশাখেই দিও। দরকার হলে অদল-বদল করে নিও কথা—অবশ্য ছন্দ রক্ষা করে।’
—[নজরুল-রচনা-সম্ভার, কলিকাতা সংস্করণ, ২৫৬+১৫ পৃষ্ঠা]
‘দ্বারে বাজে ঝন্ঝার জিঞ্জির’ ১৩৩৪ বৈশাখের ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘সিন্দু-হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থটি ‘হবীবুল্লাহ্ বাহার ও শামসুননাহার’কে উৎসর্গ করেছিলেন। শামসুন্নাহার ছিলেন হবীবুল্লাহ বাহারে বোন, তিনিও কবিতা লিখে পাঠক প্রিয় হয়েছিলেন—তাঁর কবি নাম ‘শামসুন্নাহার মাহমুদ’। উৎসর্গ পাতার পূর্বে যে দুটি চরণ ছিল, তা হল—
আলোর মতো জ্বলে ওঠো। ঊষার মতো ফোটো
তিমির চিরে জ্যোতির মতো প্রকাশ হয়ে ওঠো!
(তামাকুমণ্ডী)
চট্টগ্রাম, ৩০.৭.২৬