সোমবার সাপ্তাহিক জেল-টহলের দীর্ঘ প্রোগ্রাম ঘাড়ে নিয়ে সদলবলে শুরু করেছি পরিক্রমা। এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ড ঘুরছি, আর শুনে চলেছি কয়েদী বাহিনীর হরেক রকম অভিযোগ। কার পৈতৃক সম্পত্তি জোর করে দখল করেছে কোন্ দুর্দান্ত জোতদার, প্রতিকার চাই; কে ছ মাস ধরে বাড়ির খবর পায় নি, জানতে চায় কেমন আছে রুগ্না স্ত্রী আর অসহায় অপোগণ্ডের দল; কে হাসপতালে যেতে চেয়েছিল কাল পেটের ব্যথার ‘দাওয়াই’ খেতে, মেট নিয়ে যায়নি, বলেছে আগে দেখা কোনখানে তোর দরদ, তারপর বোঝা যাবে….

ছোকরা-ব্যারাক শেষ করে ফিমেল ওয়ার্ড অর্থাৎ জেনানা ফাটকের গেটের সামনে গিয়ে প্রসেশন থেমে গেল। কপাটের গায়ে ঝুলছে একটা সরু দড়ি। টানতেই ভিতরে বেজে উঠল মিষ্টি ঘণ্টার আওয়াজ। মিনিটখানেক পরেই দরজা খুলে সেলাম জানাল ফিমেল ওয়ার্ডার। সিপাই বাহিনী রইল বাইরে। উপর মহলের অফিসারদের নিয়ে ঢুকে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে মেট্রনের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের হুঙ্কার : এস্কাট্ আটেনশন্।

কোনও কালে হয়তো কোনও গ্রাম্য পাঠশালায় মাসকয়েক শ্লেট হাতে যাতায়াত করেছিল গিরিবালা মেট্রন। Squad Attention! এতবড় একটা কটমট ইংরেজি কমাণ্ড তার মুখে আসবার কথা নয়। জেলের তরফ থেকে তাতে কোনও লোকসান হয় নি। কাজ ঠিকই চলে যায়। মানে না বুঝলেও ঐ অভিনব পেটেণ্ট বুলি কানে যাওয়া মাত্র সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে মেয়ে-কয়েদীর দল। আজও তারা একই সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তারপর ‘নালিশ’ জানাবার পালা। একটি প্রৌঢ়া কয়েদী এগিয়ে দিল একখানা পোস্টকার্ডের চিঠি। বললাম, কী চাই তোমার?

পড়ে দেখুন বাবা। বড্ড কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার। পরের বাড়িতে ফেলে এসেছি। দেখবার কেউ নেই। আপনি মা-বাপ। দয়া করে হুকুম দিলে কাছে এনে রাখতে পারি। আমার যে খাবার মায়েপোয়ে ভাগ করে খাবো।

বললাম, তোমাকে তো আগেই বলেছি, সাত-আট বছরের ছেলে জেলখানায় রাখবার আইন নেই; ছ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স, তারাই শুধু থাকতে পারে মায়ের সঙ্গে।

মেয়েটি আর কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে রইল মাথা নীচু করে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম দু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা।

নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। লাইনের শেষে অনেকটা যেন তাচ্ছিল্যভরে দাঁড়িয়ে আছে একটি তরুণী। রূপ আছে, কিন্তু সে শুধু আকৃতিগত, অর্থাৎ তার একমাত্র সাক্ষ্য ওর ঐ অবয়ব। রূপের ভিতরে যে প্রাণ থাকে, তার কোনও চিহ্ন নেই। যে লাবণ্য, যে মাধুর্য যৌবনের অত্যাজ্য সহচর তাদেরও খুঁজে পাওয়া শক্ত। রূঢ় কঠিন মুখের উপর দুটি রুক্ষ ক্লান্ত চোখ। দেখে হঠাৎ মনে হবে, দয়া মায়া স্নেহ, প্রীতি ভালবাসা দিয়ে গড়া সংসারের যে একটা কোমল দিক আছে, তার দেখা সে পায়নি; পেলেও তার সবটুকু স্নিগ্ধতা কে যেন ওর ভিতর থেকে নিংড়ে নিয়ে গেছে। যেন একটি পালিশহীন পাথরের মূর্তি। কৌতূহলহীন শূন্য দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

“কাল এসেছে সেসন্স্ কোর্ট থেকে”—বললেন আমার ‘আমদানী সেরেস্তার’ ডেপুটিবাবু।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী তোমার নাম?

মামুলী প্রশ্ন; নবাগত সবাইকে যা করে থাকি। নিতান্ত অবহেলাভরে হাতের টিকিটখানা বাড়িয়ে ধরে বলল, পড়ে দেখুন না? শুধু নাম কেন, আরো অনেক কিছু পাবেন।

আবার অফিসার মহলে একটা চাপা চাঞ্চল্য দেখা দিল। একজন সাধারণ কয়েদীর মুখ থেকে এই জাতীয় উদ্ধত উত্তরে তাঁরা অভ্যস্ত নন। ডিসিপ্লিন রক্ষার তাগিদে আমারও কিছু একটা ‘অ্যাকশন’ নেবার প্রয়োজন ছিল। সেখানে ত্রুটি রয়ে গেল। আর কিছু না বলে টিকিটখানাই শুধু তুলে নিলাম ওর হাত থেকে। চোখ বুলিয়ে দেখলাম নাম—জ্ঞানদা মল্লিক। ঘরে আগুন দেবার অপরাধে চার বছরের জেল দিয়েছেন সেন্সস্ জজ। অজ্ঞাতসারে আর-একবার চোখ পড়ল ওর মুখের দিকে। হঠাৎ মনে হল, নিজের হাতে যে আগুন সে জ্বেলেছে, তার চেয়েও হয়তো কোনও প্রচণ্ড আগুন অদৃশ্য হয়ে ছিল তার বুকের মধ্যে, যার খবর কেউ পায় নি, জজসাহেব বোধহয় জানতে চাননি, কিংবা পারেন নি।

টিকেটখানা ফিরিয়ে দিতেই একটা বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল ওর পাতলা ঠোঁটের কোণে। তার সঙ্গে শ্লেষ মিশিয়ে বলল, আর কিছু জানতে চাইলেন না? কেন আগুন দিয়েছিলাম? কাকে পুড়িয়ে মেরেছি?

এহেন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। তবু বিস্ময়ের ভাব চেপে রেখে বললাম, বলতে চাও সে সব?

—আপত্তি কী? কতবার তো বললাম। বলে বলে মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রথমে পাড়ার পাঁচজন ভদ্দরলোক, তারপর পুলিসের দারোগা, উকিলবাবুরা, ছোট হাকিম, আর শেষটায় জজসাহেব। সবাইকে বলেছি। একবার নয়, দুবার নয়, অনেকবার। চান তো আপনাকেও শোনাতে পারি।

বললাম, আমি শুনতে চাই না। তুমি কী ছিলে বা কী করেছ, তা দিয়ে আমার দরকার নেই। তোমাকেও তাই বলি, সে সব কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করো।

জ্ঞানদার ওষ্ঠের কোণে সেই কুঞ্চন-রেখাটা মনে হল আর নেই। চোখের তারায় একটু বিস্ময় কিংবা ঐ-জাতীয় কিছু লক্ষ্য করলাম। আমার এ উত্তর হয়তো সে প্রত্যাশা করে নি।

কয়েকদিন পরেই জজসাহেবের রায়ের নকল এসে গেল। অন্য সকলের মতো জ্ঞানদাকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল—আপীল করবে কিনা। আঙুল দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ছাড়া আর কেনও জবাব পাওয়া যায় নি। তবু যদি কদিন পরে আবার মত বদলায়, এই ভেবে আমার ডেপুটি জেলর নথিপত্রগুলো আনিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তার ভিতর থেকে কাহিনী যা পাওয়া গেল অনেকটা মামুলী ধরনের

বছর পনেরো বয়সে বিয়ে হয়েছিল জ্ঞানদার। বাপ মারা গেছেন তার অনেক আগে। বিধবা মায়ের কী একটা দুর্নাম ছিল। প্রতিবেশীদের আনুকূল্যে সেই খবরটা পল্লবিত হয়ে যখন তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তারপর আর সেখানে তার ডাক পড়ে নি। স্বামী দেবতাটি কদিন পরেই আর-একজনের কপালে সিঁদুর দিয়ে নির্বিবাদে ঘর-সংসার শুরু করেছেন, এ খবর যথাসময়ে পাওয়া গিয়েছিল। তারপরেও অপেক্ষা করে ছিল জ্ঞানদা। কিন্তু তার আসন্ন যৌবন অপেক্ষা করল না, এবং সেদিকে চেয়ে আশেপাশের মাংস-ভুক পুতঙ্গের দলে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সামান্য দু-চার বিঘা ধানের জমি এবং অন্যান্য সম্বল যা ছিল, বরপক্ষের দাবি মেটাতেই তার প্রায় সবটাই উড়ে গিয়েছিল। যেটুকু পড়েছিল তা দিয়ে দুটি মানুষের পেট চলে না।

এক মুদীর দোকান থেকে ধারে জিনিস আসত। তার পাওনার পরিমাণ বেড়ে বেড়ে এমন একটা অঙ্কে গিয়ে দাঁড়াল, যা শোধ দেওয়া ওদের পক্ষে কোনও কালেই সম্ভব নয়। সেজন্য মেয়ের ভাবনার অন্ত ছিল না, কিন্তু মাকে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হত না। কারণটা জ্ঞানদা তখনও বুঝতে পারে নি। বুঝল সেইদিন, যেদিন মুদীপুত্রের তরফ থেকে তার দেহের দুয়ারে এল সেই ঋণ পরিশোধের দাবি। প্রথমটা ফণা তুলে উঠেছিল, কিন্তু মিইয়ে যেতেও দেরি হয় নি, যখন দেখল, সে দাবির পেছনে রয়েছে মায়ের সমর্থন। শুধু সমর্থন নয়, প্রশ্রয়। জ্ঞানদারা উচ্চবর্ণ, মুদী নিচু জাত। তার পক্ষে ভদ্রপল্লীতে আনাগোনা করা নিরাপদ ছিল না। সুতরাং জ্ঞানদাকেই যেতে হত নৈশ অভিসারে। লোকালয় থেকে খানিকটা দূরে একটা বাগানবাড়ির নির্জন ঘরে মুদীটি বসে থাকত মিলনের অপেক্ষায়।

লোকটা মুদী হলেও হৃদয়টা উদার বলতে হবে। নারী-মাংসের স্বাদ একা একা উপভোগ করে কিছুদিন পরেই অতৃপ্তি দেখা দিল। জুটিয়ে ফেলল দু-চারটি বন্ধুবেশী ভাগীদার। কিন্তু জ্ঞানদা এমন বেঁকে বসল যে, বহু চেষ্টা করেও তাকে বন্ধুদের আসরে টেনে নামানো গেল না। মুদী দমবার পাত্র নয়। শুরু হল পীড়ন ও লাঞ্ছনা। ক্রমে সংসার অচল হয়ে দাঁড়াল, মা চঞ্চল হয়ে উঠলেন, কিন্তু জ্ঞানদা রইল অটল। চরম দিন এল এক শীতের রাতে। তার দু’দিন আগে থেকেই চলেছে উপবাস, তার সঙ্গে মায়ের অকথ্য গঞ্জনা। শেষ পর্যন্ত রাজী হল জ্ঞানদা। খবর পাঠাল সেই মুদীর ছেলের কাছে, “রাত বারোটা নাগাদ বাগানবাড়িতে যাচ্ছি। দয়া করে আজকের রাতটা একাই থেকো। কাল থেকে তোমার বন্ধুরাও থাকবে।”

মুদী তাতেই খুশী। স্ফূর্তির মাত্রাটা বোধ হয় একটু বেশি হয়ে পড়েছিল। তার পরেই বেহুঁশ ঘুম। রাত তিনটের সময় সুযোগ বুঝে পাশ থেকে ধীরে ধীরে উঠে পড়ল জ্ঞানদা। আঁচলের তলায় লুকিয়ে এনেছিল এক বোতল কেরোসিন, আর একরাশ ছেঁড়া ন্যাকড়া প্রণয়ীর পকেট থেকে সন্তর্পণে তুলে নিলে দেশলাই। তারপর নিঃশব্দে বাইরে এসে দরজায় শিকল তুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরো।

দাউ দাউ করে সেগুলো যখন জ্বলে উঠল, জ্ঞানদার মনে হল, এই আগুনটাই বোধহয় এতকাল চাপা ছিল তার সারা বুক জুড়ে। আজ সেটা বাইরে বেরিয়ে আসতেই নিবে গেল তার অন্তরের জ্বালা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তৃপ্ত চক্ষু মেলে দৃশ্যটা সে উপভোগ করল। আরও হয়তো করত, কিন্তু তার পরেই এল মরণাহতের অন্তিম চীৎকার–কে আছ বাঁচাও! হঠাৎ কোথা থেকে তার সমস্ত দেহ জুড়ে বিদ্যুৎ-প্রবাহের মতো ছুটে এল একরাশ ভয়। দুহাতে কান চেপে ধরে ছুটে চলল জ্ঞানদা। নিজের ঘরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।

দিনের পর দিন নানা রকম অভিযোগ আসতে লাগল জ্ঞানদার নামে। কাউকে মানে না। কাজকর্ম তার খুশিমত করে, বেশির ভাগই করে না। বলতে গেলে শুনিয়ে দেয় কড়া কথা। মেট্রনকে যখন তখন অপমান করে বসে। সহবন্দিনীরা বোঝাতে এলে নিঃশব্দে চলে যায় সেখান থেকে, নয়তো ঝাঁকিয়ে ওঠে—নিজের চরকায় তেল দাও গে। ‘রিপোর্ট’ লেগেই থাকে। বিচারের জন্যে আমার সামনে যখন হাজির করেন জেলর সাহেব, কোনও প্রশ্নেরই জবাব দেয় না, পীড়াপীড়ি করলে বিরক্তির সুরে বলে ওঠে, আমি আবার কি বলব, ওদের কাছেই তো শুনলেন সব।

একদিন বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর পাঁচজন যেমন চলছে, তেমনি করে চলবার চেষ্টা করো। যারা ভালোভাবে থাকে, নিয়মমতো কাজকর্ম করে, মেয়াদ শেষ হবার অনেক আগেই তারা বেরিয়ে যায়।

কথার মাঝখানেই এল অসহিষ্ণু জবাব—উঃ, আর কত বক্তৃতা করবেন! ওসব রেখে শাস্তি-টাস্তি যা দেবার দিয়ে দিন। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

এর পরেই আর-একটা কী গুরুতর অপরাধে বেশ কিছুদিনের জন্যে তাকে সেল্-এ বন্ধ করতে হল, আমাদের শাস্ত্রে যাকে বলে solitary confinement ।

পরের সপ্তাহে অন্য সব মেয়েদের ‘ফাইল’-পরিদর্শন শেষ করে জ্ঞানদার ছোট্ট নির্জন ঘরটির সামনে গিয়ে যখন থামলাম, জেলের নিয়মমতো তৎক্ষণাৎ তার উঠে দাঁড়াবার কথা। সে ধার দিয়েও গেল না! যেমন ছিল তেমনি বসে রইল দেওয়ালে হেলান দিয়ে। একবার তুলেই নামিয়ে নিল রুক্ষ চোখ দুটো, কপালে দেখা দিল বিরক্তির কুঞ্চন। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে বললাম, তুমি লেখাপড়া জান?

–কেন, তা দিয়ে আপনার কী দরকার?

—জানতে চাইছিলাম, বই-টই পড়বে?

সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের সুরে বলল, ঠাট্টা করছেন নাকি?

—হচ্ছে কী জ্ঞানদা? ধমকে উঠল মেট্রন।

কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলল, হবে আবার কী? এদিকে তো শুনি “রিপোর্ট” হলে বই পড়তে দেওয়া হয় না, তাই নাকি আইন। দেখছিও তাই। তাহলে এ কথা জিজ্ঞেস করার মানে কী?

কথাটা মিথ্যা নয়। জেল-লাইব্রেরী কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বই পেতে পারে তারাই যাদের স্বভাব ও চালচলন নির্দোষ। কারা-অপরাধে যারা শাস্তিভোগ করছে, বই পড়বার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত।

জ্ঞানদার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, আমি জানতে চাইছি, তুমি পড়তে চাও কিনা! বই দেওয়া হবে কি না হবে, সেটা আমি বুঝবো!

—বেশ, দিতে পারেন, নিতান্ত উদাসীন সুরে বলল জ্ঞানদা।

—কী বই পড়বে?

—কী বই আবার! গল্প-টল্প থাকলে দেবেন পাঠিয়ে। আপনাদের ঐ ধৰ্ম্মের কথা আর পঞ্চাশ গণ্ডা উপদেশ আমার ভালো লাগে না।

সেটা ছিল লীগ সরকারের আমল। অলিখিত আইন অনুসারে জেল-লাইব্রেরীর বই নির্বাচনেও ‘রেশিও’ মেনে চলতে হত। ফিফটি-ফিটি। গল্পের বই বলতে যা পড়েছিল আলমারির কোণে, তার মধ্যে বেশির ভাগই ‘ছোলতান ছায়েবের কেরামতি’ কিংবা ‘লায়লা বিবির কেচ্ছা’। সে-সব ও পড়বে না। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একখণ্ড শ্রীম- কথিত কথামৃত। কী মনে হল ঐখানাই দিলাম পাঠিয়ে।

সপ্তাহান্তে আবার যখন গেলাম ওদের ওয়ার্ডে, আমি কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই কলকণ্ঠে বলে উঠল জ্ঞানদা, খু-ব বই পাঠিয়েছিলেন যা হোক! ঐ বুঝি আপনার গল্পের বই? সেদিনই তো বললাম, ও-সব ধর্ম্মের বুলি আমার সহ্য হয় না। ও ছাই আমি খুলিও নি। ঐ পড়ে আছে, নিয়ে যেতে পারেন। দিতে চান তো একটা নবেল-টবেল দেবেন। ঐ ‘ছোট জমাদারনী’ যা পড়ে।

‘ছোট জমাদারনী’ আমার জুনিয়ার ফিমেল ওয়ার্ডার। তার বয়স তিরিশের নিচে। মেয়ে-স্কুলে ক্লাস সেভেন না এইট পর্যন্ত পড়েছিল বোধ হয়। ডিউটিতে যখন আসে, স্কার্টের তলায় লুকিয়ে আনে, হয় কোনও লোমহর্ষণ ডিটেকটিভ উপন্যাস, নয়তো কোনও আধুনিক লেখকের চিত্তহরণ প্রেমের গল্প। নাম শুনলেই রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। ‘প্রণয়- কণ্টক’, ‘পরিণয়-জ্বালা’ কিংবা ‘সচিত্র যৌবন ফোয়ারা’। প্রাণমাতানো প্রচ্ছদপট। একটি হাবাগোবা গোবর গণেশ উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকের পাশে স্বল্পবসনা চটুলনয়না সুন্দরী যুবতী! সেই সব বই পড়ে ছোট জমাদারনী। জেল লাইব্রেরি তার কদর বোঝে না। তাই অগত্যা কথামৃতের পক্ষেই ওকালতি শুরু করলাম। বললাম, নাম দেখেই ভয় পাচ্ছ কেন? ওটাও গল্পের বই। অনেক মজার মজার কথা আছে। পড়েই দেখো না একবার!

জ্ঞানদা আর কথা বাড়াল না। ভাব দেখে মনে হল, আমার ওকালতির সবটুকুই বোধ হয় মাঠে মারা গেল।

পরের সপ্তাহে কী কারণে রাউণ্ডে যাওয়া হল না। দিন পনেরো পরে আবার যখন দেখা হল ওর সঙ্গে, মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নিতে ভুলে গেলাম। কোনও সোনার কাঠির মায়াস্পর্শে যেন রাতারাতি বদলে গেছে জ্ঞানদা। সে উগ্রতা নেই, তার জায়গায় এসেছে একটি কোমল শ্রী। সে লজ্জাহীন প্রগল্ভতা নেই, দু-চোখভরা লাজনম্র মধুর সঙ্কোচ। জড়সড় হয়ে দাঁড়াল আমার বিস্ময়-মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে। দু-গণ্ডে ছড়িয়ে গেল এক ঝলক রক্তিমাভা। মৃদু হেসে স্নিগ্ধকণ্ঠে বলল, দরজাটা একটু খুলতে বলুন না?

মোটা মোটা গরাদে-দেওয়া ভারী দরজাটা খুলে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎবেগে এগিয়ে এসে আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল মেট্রন আর ফিমেল ওয়ার্ডার। মেয়েমানুষ হলেও খুনী তো! কী জানি কী করে বসে!

মাথা নত করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল জ্ঞানদা। গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করল আমার পায়ের কাছটিতে। অস্ফুট মৃদু কণ্ঠে যেন আপনমনে বলল, ‘আজ ভারী ভালো লাগছে মনটা’! কপালের উপর থেকে রুক্ষ চুলগুলো সরিয়ে আমার মুখের দিকে আয়ত চোখ মেলে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, এসব কি সত্যি? এমনি ছিলেন ঠাকুর? এমনি আত্মভোলা সরল সদাশিব! এমন সুন্দর কথা সত্যিই বলে গেছেন তিনি?’

এগুলো হয়তো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলেও উত্তর সে চেয়েছিল তার নিজেরই মনের কাছে। আমি উপলক্ষ মাত্র। তাই চুপ করেই রইলাম। আমার পরিষদ-দলেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে যাবার পর বললাম, বইটা তাহলে ভালো লেগেছে তোমার?

এ কথার আর উত্তর এল না, শুধু চোখ দুটো বুজে এল, মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ল একটি তৃপ্তিময় মৃদু হাসি। কয়েক মুহূর্ত তেমনি তন্ময় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে ফিরে গেল তার সেলের মধ্যে।

কয়েকদিন পরে আবার এক রিপোর্ট এল জ্ঞানদা মল্লিকের নামে। গিরিবালাকে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার? বলল, পনেরো দিন পেরিয়ে গেছে বলে কেরানীবাবু বইটা ফেরত চেয়েছিলেন। হুকুম শোনা দূরে থাক উল্টে দশ কথা শুনিয়ে দিয়ে বলেছে, ইচ্ছে হয় রিপোর্ট করুন গে। আমার যা বলবার আমি বড় সাহেবের কাছেই বলব।

গিরিবালা বেচারীর জন্যে দুঃখ হল। এ রকম চীজ বোধ হয় একটিও জোটে নি তার এতবড় মেট্রন-জন্মে! অথচ কী করা যায়! বললাম, না দিতে চায় থাক না! ওকে ঘাঁটিয়ে কী লাভ? কেরানীবাবুকে ডেকে আমিই বরং বলে দেবো।

বলা বাহুল্য, এই উলটো বিচার মেট্রনের মনঃপূত হল না। তার গম্ভীর মুখ এবং দ্রুত প্রস্থানের ভঙ্গি দেখেই তা বোঝা গেল।

জ্ঞানদার তরফেও অভিযোগ ছিল। পরের সপ্তাহে দেখা হল ওর সেলের দরজায়। যেতেই বলে উঠল, আপনার ঐ কেরানীবাবুটিকে একটু ধমকে দেবেন তো! যখন তখন বলে পাঠায় ঐটুকু বই শেষে করতে কদিন লাগে? শুনুন কথা! এ বই যে কোনোদিন শেষ হয় না, সে কথা ওকে বোঝাই কেমন করে?

ঐ জেলের মেয়াদ আমার শেষ হয়ে এসেছিল। আবার কোথায় গিয়ে ছাউনি ফেলতে হবে, সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলাম। হঠাৎ এল সেই অমোঘ আদেশ। শেষবারের মতো যখন ঢুকলাম জেনানা ফাটকের গেটে, তার অনেক আগেই জ্ঞানদার সেলের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু সেই নিরালা ছোট্ট কুঠরির মায়া ছাড়তে চায় নি। মেট্রনকে বলে কয়ে ইচ্ছা করেই বেছে নিয়েছিল নির্জন-বাস। আমাকে দেখে বেরিয়ে এসে প্রণাম করল সেইদিনকার মতো। শুধু মাটিতে মাথা ঠেকানো নয়, কম্পমান কোমল হাতে তুলে নিল পায়ের ধুলো। উঠে দাঁড়াতেই নজরে পড়ল থমথম করছে মুখ, চোখ দুটো ফুলো-ফুলো। তার কোণে শুকিয়ে আছে জলের রেখা, বোধহয় মুছতে ভুলে গেছে। হঠাৎ বলে উঠল অশ্রুরুদ্ধ করুণ কণ্ঠে, এবার যে ওরা আমার কথামৃত কেড়ে নিয়ে যাবে!

সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল চোখের জল। যদ্দূর সম্ভব সহজ সুরেই বললাম, নিলেই বা! তার জায়গায় দুখানা নতুন বই পেয়ে যাচ্ছ তুমি। সেগুলো তোমার। কোনোদিন কেউ ফেরত চাইবে না।

—সত্যি! সিক্ত চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল জ্ঞানদার। তারপর বলল, অনেক দয়া করেছেন, অনেক স্নেহ পেয়েছি আপনার কাছে। শেষবারের মতো আর একটা জিনিস চাইব।…দেবেন তো?

—কি জিনিস বলো?

—ওদের একটু সরে যেতে বলুন।

হাতের ইশারায় অনুচরদের সরিয়ে দিলাম। জ্ঞানদা এগিয়ে এল আমার একান্ত কাছটিতে। ফিসফিস করে বলল, একখানা ঠাকুরের ছবি।

তখনকার জেলের আইনে কয়েদীর পক্ষে কোনও ছবি বা ফোটোগ্রাফ রাখা নিষিদ্ধ আইন রক্ষার ভার কাঁধে নিয়ে নিজের হাতে তা লঙ্ঘন করি কেমন করে? কিন্তু এদিকে যে দুটি সজল চোখ আমার পানে চেয়ে অধীর প্রতীক্ষায় উন্মুখ, তাদের সে কথা বোঝানো যায় না। তার প্রয়োজনও হল না। হঠাৎ কখন আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, দেবো। পরদিন জ্ঞানদার কোনও এক কল্পিত আত্মীয়ের তরফ থেকে দু-খণ্ড কথামৃত ওর নামে জমা দেওয়া হল। তার মধ্যে লুকানো রইল একখানা ঠাকুরের ছবি।

জ্ঞানদার কাহিনী এইখানেই শেষ হল। এর পরের অংশটুকু আমার। আমারই এক লজ্জার কাহিনী!

সেই দিন থেকে বছরের পর বছর এক জেল থেকে আরেক জেলে ঘুরেছি। মাঠে, মন্দিরে, গৃহস্থের পূজার ঘরে যখনই যেখানে চোখে পড়েছে ঠাকুরের কোন ছবি, তার পাশটিতে ফুটে উঠত একখানা অশ্রুলাঞ্ছিত নারীর মুখ। লজ্জায়, অপরাধে, ক্ষোভে, অনুশোচনায় ছট্‌ফট্ করে বেড়াতাম। এ আমার কী হল! পরমহংসের পাশে পাপীয়সী! কাকে বলি আমার এ অধঃপতনের ইতিহাস?

তারপর অকস্মাৎ একদিন মনে হল, নিজের পাশে ঐ স্থানটি ঠাকুরই ওকে দিয়েছেন। এই হতভাগিনী মেয়েটা, সংসারে কারও কাছে যে আশ্রয় পায়নি, তিনি তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। তাঁরই ‘কথামৃতের’ সঞ্জীবনী ধারায় ও নতুন করে বেঁচে উঠল। দৈবক্রমে সে অমৃত আমিই এনে ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আমি তার বাহক। এ তো আমার লজ্জা নয়, এ আমার গৌরব!

।। তৃতীয় পৰ্ব সমাপ্ত।।