ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
ঐতিহাসিকদের মধ্যে, এমনকী সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থেও, পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা সম্পর্কে আশ্চর্যরকম ঐকমত্য দেখা যায়। এঁদের বক্তব্য, পলাশি সম্বন্ধে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না; এই চক্রান্তের উদ্ভব বা ক্রমবিকাশে ইংরেজদের কোনও ভূমিকা নেই; মুর্শিদাবাদ ‘দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বই ইংরেজদের অনিবার্যভাবে বাংলার রাজনীতিতে টেনে এনেছিল।১’ কিন্তু পলাশির প্রাক্কালে যে-সব ঘটনাবলী এবং আমাদের কাছে যে-সব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্টত দেখা যাবে, ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার ব্যাপারে তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই স্থানীয় চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে প্রধান প্রধান দেশীয় চক্রান্তকারীরা শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খলনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে-বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। মসিয়ে জাঁ ল’ পরিষ্কার জানাচ্ছেন ইংরেজরা কীভাবে দরবারের অভিজাতবর্গের একটি গোষ্ঠীর নবাবের প্রতি বিরূপতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং বুদ্ধিমানের মতো ঠিক ঠিক জায়গায় টাকা ছড়িয়ে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাত করেছিল।
তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে আমাদের কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তা অনেক সময় কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। ষড়যন্ত্রের উন্মেষে কে কখন কাকে প্রথম যোগাযোগ করে তা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন দাবি এবং প্রতিদাবি আছে। আবার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একই ব্যক্তির বয়ানে স্ববিরোধিতা দেখা যায়। অন্য দিকে, এ-সব ক্ষেত্রে সচরাচর হয়ে থাকে, অনেকে আবার ষড়যন্ত্রের খেলায় নিজের ভূমিকা বড় করে দেখাবার জন্য অন্যদের ভূমিকাকে গৌণ করে দেখাবার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট।২ কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও খুব সতর্কতার সঙ্গে তথ্যপ্রমাণগুলির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে ষড়যন্ত্রের কীভাবে উন্মেষ হচ্ছে এবং তা কীভাবে দানা বাঁধছে এবং কীভাবে তার বিকাশ হচ্ছে, পলাশি বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে কে বা কারা সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং শেষপর্যন্ত বিপ্লব সংঘটিত করে কীভাবে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানো হল—তার একটি মোটামুটি সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।
বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অন্তহীন সুযোগ ও দুর্নীতি এবং নিরন্তর পরিবর্তনের যুগ। ওয়াটস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘নবাবের দরবারের অন্তর্কলহ দিন দিন বাড়ছে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী নয়—পুরো দরবারই দুর্নীতিগ্রস্ত।’ লিউক স্ক্র্যাফ্টুন আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন: ‘আমার মনে হয় টলেমি (Ptolemy) যখন ফারসালিয়া (Pharsalia) যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিশরে রাজত্ব শুরু করেন, তখন তাঁর দরবারের যা অবস্থা ছিল তার সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের তুলনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ দরবারের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সবাই যথেচ্ছ ভ্ৰষ্টাচারে লিপ্ত এবং সবাই বিশ্বাসঘাতক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে রোমান সম্রাট সিজার যা করেছিলেন, ক্লাইভের উচিত তাই করা অর্থাৎ রাজ্যটি জয় করে নেওয়া। পুরনো নবাবকে হঠিয়ে নতুন কাউকে নবাব করা যাতে রাজ্যের প্রজারা সুখে থাকতে পারে।৩’
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, তখনকার দিনে ভারতীয়দের মতো ইউরোপীয়রাও (ইংরেজরাও বটে) সমান দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। তারা তৎকালীন অবস্থার ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল এবং কোনওরকম ন্যায়নীতি বা বিবেকদংশনের তোয়াক্কা না করে দরবারের অমাত্যদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। জাঁ ল’ লিখেছেন যে ইংরেজদের বৃত্তান্ত পড়লে প্রত্যয় জন্মাতে পারে যে ফরাসিরা নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নবাবের দরবারের অমাত্যদের তাদের দলে টেনে নিয়েছে। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, ল’ সাফাই গাইছেন, ইংরেজরাই ভ্ৰষ্টাচারের মাধ্যমে পুরো দরবারকেই হাত করে নেয়। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করেছেন যে, ইংরেজদের মতো ফরাসিরাও দুর্নীতির সাহায্যে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উৎকোচের মাধ্যমে অমাত্যদের দলে টানার প্রতিযোগিতায় ইংরেজরা ফরাসিদের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিল। এই ব্যর্থতার অনেকখানি অবশ্য তাঁর এবং সে জন্যই সাফাই গাইবার সরে বলছেন, ‘ইংরেজরা অবশ্য বরাবর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থসামর্থ্য নিয়োগ করতে পেরেছিল।৪’
বস্তুতপক্ষে ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকে জাঁ ল’-র মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কার (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত দরবারের অভিজাতবর্গকে নিজ নিজ দলে টানার জন্য ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। জাঁ ল’ এবং ওয়াটস দু’জনেই অকপটে স্বীকার করেছেন যে তারা উৎকোচ দিয়ে দরবারের অমাত্যদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও উভয়েই এর জন্য দোহাই দিয়েছেন, দরবারের ভ্ৰষ্টাচারকে, যেখানে উৎকোচ ছাড়া কিছুই হয় না।৫ ল’র তুলনায় ওয়াটসের হাতে টাকাকড়ি ছিল অনেক বেশি এবং তা দিয়ে শুধু দরবারের গণ্যমান্যদেরই ইংরেজরা দলে টানেনি, এমনকী মুৎসুদ্দিদেরও হাত করেছিল। এ-কাজে ওয়াটসের প্রধান সহায়ক ছিলেন উমিচাঁদ। ওয়াটস ১১ এপ্রিল একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখছেন: ‘নবাবের অমাত্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কারণ তাদের আমরা (টাকাকড়ি দিয়ে) সন্তুষ্ট করতে পারিনি। উমিচাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কিছু খরচাপাতি করে হলেও ওইসব ব্যক্তিদের আমাদের দলে টানা একান্তভাবে উচিত।৬’ ফলে যেখানে জাঁ ল’ সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের খবরাখবরের জন্য শুধুমাত্র গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করতেন, সেখানে ওয়াটস ও উমিচাঁদের যৌথপ্রচেষ্টায় ইংরেজরা নবাবের প্রভাবশালী অমাত্যদের হাত করতে পেরেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার—চন্দননগর আক্রমণের সময় যাঁর সহযোগিতা ইংরেজদের পক্ষে খুবই কার্যকর হয়েছিল। ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিদের অর্থভাণ্ডারের দৈন্যের জন্য ল’-কে দরবারের চুনোপুঁটিদের হাত করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল এবং তারাই শেষপর্যন্ত ফরাসিদের ডুবিয়েছিল।
সে যাই হোক, মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষ এবং দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও ক্লাইভ এবং ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে কলকাতায় পৌঁছোন, তখনও কিন্তু যড়যন্ত্রের কোনও আভাস পাওয়া যায় না। আসলে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠাবার সময় যে নির্দেশ দিয়েছিল (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল। এই নির্দেশের মধ্যেই অভিযানের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়,’ অভিযাত্রীদলের উদ্দিষ্ট হবে না, ‘বাংলার নবাবের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ বা নবাব হওয়ার মতো উচ্চাভিলাষী কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন তারা গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে।৭’ উপরোক্ত নির্দেশের শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘দুর্বল শাসক’ এবং ‘তাঁর দরবারের বেশির ভাগ লোকই তাঁর প্রতি বিরূপ৮’ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ করেছিল৯’ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।
ক্লাইভ বাংলা অভিযান সম্বন্ধে যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব,১০’ তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না। তিনি এবং ওরম (Ome) কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের বিশদ পরিকল্পনার কথা জানতেন—এই পাণ্ডুলিপিটি মাদ্রাজেই ছিল। ১৭৪৯-৫০ সালে ক্লাইভ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তাঁর মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে, তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।১১ এ-সবের পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাজের উপকূল অঞ্চলের পরিস্থিতির জন্য বাংলা থেকে কোম্পানি তাঁকে সরিয়ে নিতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ, তা সহজেই বোধগম্য।
নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে হয়তো কিন্ত ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সে জন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করার দরকার ছিল। অংশত সেটা আবিষ্কার করার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি থেকে (৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭) তা সুস্পষ্ট১২:
নবাবের সৈন্যদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজনকে আমাদের দলে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য হুগলি আক্রমণ এবং দখল করা এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।…এতে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।
১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।১৩
পলাশি বিপ্লবে ইংরেজদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে (এবং কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে এ বিপ্লবে ফরাসিদের এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও হতাশা ঢাকতে গিয়ে) জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে সবাই নবাবের পরিবর্তন চাইছিল এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে ওটা শীঘ্রই হবে। তাঁর নিজের ধারণা ছিল, তিন-চারশো ইউরোপীয় সৈন্য এবং অল্প সংখ্যক তেলেঙ্গা সৈন্য এ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যদি ফরাসিরা এরকম একটি বাহিনীর সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার শত্রুদের হাত মিলিয়ে দিতে পারত, তা হলে ফরাসিরাই বাংলার মসনদে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে বসাতে পারত। অবশ্য সে ব্যক্তি পুরোপুরি তাদের পছন্দের লোক নাও হতে পারত। সে ব্যক্তিকে অবশ্যই জগৎশেঠ, মুসলিম অভিজাতশ্রেণী ও হিন্দু রাজন্যবর্গের পছন্দসই হতে হত।১৪ কিন্তু ফরাসিরা কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিল না— ঘটনাক্রমও যতটা ইংরেজদের অনুকূলে ছিল, ফরাসিদের পক্ষে ততটা নয়।
শওকত জঙ্গের পরাজয়ের পর এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইংরেজরাই একমাত্র শক্তি যারা বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু জাঁ ল’ বলছেন, এর জন্য ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল মর্শিদাবাদের দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি দল তৈরি করা যার মাধ্যমে এ-বিপ্লব সম্ভব হতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। কারণ জগৎশেঠরা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ইংরেজদের ততটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জগৎশেঠরাই ইংরেজদের সাহায্য করতে পারত এবং কিছুটা সময় দিলে তাঁরাই দরবারে সিরাজ-বিরোধী একটি দল তৈরি করতে পারত এবং শেষপর্যন্ত, এমনকী ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে পারত। কিন্তু তার জন্য বেশ কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করা ইংরেজদের পোষাত না। এ ছাড়া হিন্দু বলে জগৎশেঠদের বেশ কিছুটা শঙ্কা এবং ভয়ও ছিল যাতে তারা নিজেরা বিপদের মুখে না পড়ে। তাদের উৎসাহ ও উস্কে দিতে ইংরেজদের দিক থেকে প্রয়োজন ছিল নবাবের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু একটা করা। কিন্তু তারা তা করেনি। সিরাজদ্দৌল্লাকে পুরোপুরি নিজের দলে টানতে ব্যর্থ হয়ে জাঁ ল’ এমন অবধি বলছেন যে ‘আমি শুধু দেখতে চাই ইংরেজরা সিরাজদ্দৌলাকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ছেড়েছে।১৫’
পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব সম্বন্ধে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ১৭৫৭-এর এপ্রিলের প্রথমদিক পর্যন্ত এ চক্রান্ত একেবারেই দানা বাঁধেনি। জাঁ ল’ অবশ্য বলছেন যে ১৭৫৬-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করার জন্য সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদ থেকে পুর্ণিয়া অভিমুখে যাত্রা করার আগেই সিরাজের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। মীরজাফরসহ অভিজাত সামরিক গোষ্ঠীর কয়েকজন এতে জড়িত ছিলেন। এঁরা ঠিক করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে শওকত জঙ্গের যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর একাংশ নিষ্ক্রিয় থাকবে। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন (এবং আশ্চর্য, বেশ কিছুটা হতাশার সুরে) বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়াতে পুরো জিনিসটাই ভেস্তে যায়।১৬ ফারসি ইতিহাস সিয়র থেকেও জানা যায় যে এরকম একটা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছিল—মীরজাফর শওকত জঙ্গকে নাকি একটি চিঠির মাধ্যমে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং তাঁর কাছ থেকে মসনদ ছিনিয়ে নিতে উসকানি দিয়েছিলেন। উক্ত লেখক এটাও জানাচ্ছেন যে, মীরজাফর এবং অন্য কয়েকজন সৈন্যাধ্যক্ষ শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবে গণ্য করছিলেন।১৭ কিন্তু ষড়যন্ত্র কোনও বাস্তবরূপ নেওয়ার আগেই ভেস্তে যায়। অবশ্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবের বিরুদ্ধে এরকম চক্রান্ত বেশ কয়েকবারই হয়েছিল। কিন্তু তার অধিকাংশই দানা বাঁধার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং মীরজাফর পলাশির আগে শওকত জঙ্গের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও তার খুব একটা গুরুত্ব নেই।
তবে পলাশির প্রাক্কালে মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষের চাপা আগুনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজরা এই অসন্তোষের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র পাকা করে। ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের খবর বাংলায় পৌঁছুতেই ইংরেজদের আশঙ্কা হল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাত হবার সম্ভাবনা প্রবল। তার ফলে তারা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবরূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। জাঁ ল’ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোটা ইংরেজদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল (had become an absolute necessity) এবং সেই কারণেই তার আগে ফরাসিদের বিতাড়ন করাটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে চন্দননগর দখল করার পর বিপ্লব অনেক সহজসাধ্য হয়ে যাবে। অবশ্য ল’ এটাও বলেছেন যে, ফরাসিদের না তাড়িয়েও ইংরেজরা নবাবের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজস করে বিপ্লব সংঘটিত করতে পারত কারণ এই শত্রু দলে ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অনেক প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি।১৮
অবশ্য আমরা আগেই বলেছি জাঁ ল’-র দেওয়া তথ্য সবসময় নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি (সবাই নয়, ল’ যা বলছেন) বিপ্লব সংঘটিত করতে আগ্রহী ছিল এবং এরা সম্ভবত ইংরেজদের সঙ্গে তলায় তলায় যোগসাজশও করছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে বিপ্লবের বা ষড়যন্ত্রের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, সবাই বেড়ার ধারে অপেক্ষা করে ছিল। আর ইংরেজরা তাদের প্রকাশ্যভাবে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পীড়াপীড়ি করছিল। পরে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমরা তা দেখাব। ক্লাইভকে লেখা ১১ এপ্রিলের চিঠিতে ওয়াটস পরিষ্কার জানাচ্ছেন যে নবাবের অমাত্যদের অধিকাংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং তারা ফরাসিদের শক্তির জয়গান করছে।১৯ আর স্ত্র্যাফ্টন ওয়ালসকে (Walsh) ৯ এপ্রিল লিখছেন, ফরাসিরা নবাবের ঘনিষ্ঠ কিছু লোককে ঘুষ দিয়ে হাত করেছে, ফলে তারা ইংরেজদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফরাসিদের বর্তমান অর্থাভাবের জন্য তাদের ধরে রাখতে পারছে না। এই সুযোগে ইংরেজরা কিছু খরচাপাতি করে এদের দলে টানতে সক্ষম হচ্ছে।২০ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদ দরবারে পরস্পরবিরোধী দুটি গোষ্ঠী বিরাজ করলেও এবং দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নবাবের প্রতি অসন্তোষ থাকলেও, তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র বিশেষ দানা বাঁধেনি।
ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। স্ক্র্যাফ্টন লিখছেন২১:
ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে….ঘটনা স্রোত যদি অন্যদিকে যায় [বিরোধের দিকে?] সেটা ভেবে এখন থেকে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন যেটা বিপদের সময় আমাদের কাজে লাগবে। কোম্পানির অনুগত একজন নবাবকে [বাংলার মসনদে] বসাতে পারলে ব্যাপারটা কোম্পানির পক্ষে কী গৌরবজনকই না হবে!…আর পরে [ভবিষ্যতে] আমাদের পক্ষে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে এ আশঙ্কায় এখন থেকে আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং সে জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি (my old favourite scheme) সফল হতে পারে।
আসলে এ সময়ে বা তার কাছাকাছি সময়ে ইংরেজরা উমিচাঁদের সহায়তায় পলাশির ষড়যন্ত্রের কিছুটা বাস্তবরূপ দিতে সক্ষম হয়। উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাশক্তির ওপর ওয়াটসের তখন অগাধ আস্থা ছিল এবং তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল উমিঁচাদ এ ব্যাপারে ইংরেজদের যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। ওয়াটস ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে লেখেন: ‘উমিঁচাদ এবং আমি একটি বিষয় নিয়ে অনেকবার আলোচনা করেছি। বিষয়টি আপনার কাছে কীভাবে ব্যক্ত করব বুঝতে পারছি না। স্ক্র্যাফ্টনকে বিষয়টি সম্বন্ধে খুলে বলেছি এবং তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে আমি আর উমিচাঁদ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তাতে আপনার এবং মেজরের [ওয়াটসন] অনুমোদনের অভাব হবে না।২২ বলা বাহুল্য, এখানে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথাই বিধৃত হয়েছে।
পলাশির ষড়যন্ত্র যে কিছুটা দানা বাঁধছে তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওয়ালসকে লেখা স্ত্র্যাফ্টনের ১৮ এপ্রিলের চিঠিতে। এতে আছে যে স্ক্র্যাফ্টন উমিঁচাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উমিচাঁদ তাঁকে বলেন যে, নবাব যদি কোনওভাবে আলিনগরের চুক্তি (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) ভঙ্গ করেন, তা হলে ইংরেজদের উচিত নবাবকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসানো। উমিচাঁদ নাকি এটাও জানান যে, ইয়ার লতিফ একজন যোগ্য ব্যক্তি, সচ্চরিত্র এবং জগৎশেঠদের সমর্থনপুষ্ট।২৩ এর দিন দুয়েক পরে আবার স্ক্র্যাফ্টন ওয়ালসকে জানান যে, নবাব ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন, দরবার থেকে তাদের ‘ভকিল’কে বার করে দিয়েছেন এবং মীরজাফরকে পলাশি অভিমুখে যাত্রা করার আদেশ দিয়েছেন। এরপর স্ক্র্যাফ্টন যা লিখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।২৪
ঈশ্বরের দোহাই, নবাবকে আমাদের এখনকার মতো শান্ত করা দরকার [কারণ] এখনও সব ব্যবস্থা পাকা হয়নি [things are not yet ripe]। উমিচাঁদ জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। জগৎশেঠ কেন আগেই উমিচাঁদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা আমি জানি। কারণটা হল, আমরা যেন ইয়ার লতিফকে নবাব করি, তাঁর এই ইচ্ছের কথা উমিচাঁদকে জানাবার জন্য….আমাদের ধীরেসুস্থে এগুতে হবে যাতে আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় [Let us strike slow and steady that we may strike sure]।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- P. J. Marshall, Bengal, p. 91; C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray. ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 11, 12; পলাশী, পৃ. ১২,১৬।
- দৃষ্টান্তস্বরূপ, Scrafton, Reflections, and Watts, Memoirs.
- Watts’ Memoirs, p.74; ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 189.
- ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.
- ঐ; Hil, I, clxxvii.
- Orme Mss., vol. 170, f. 99, Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.
- Clive to Select Committee, Fort St. George, 2 July 1757, Hill, II, p. 442.
- Hill, II, p.440.
- তাঁর পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.
- Powis Collection, Box 20, John Brown to Clive, 27 Feb. 1752, quoted in Mark Bence-Jones, Clive of India, p. 92.
- সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Bengal Letters Received, vol. 23, f. 405.
- ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., Inida, V,f. 1275; Orme Mss., O.V. 170,f. 397.
- Law’s Memoir, Hill, III, pp. 173-74.
- ঐ, পৃ. ১৭৫-৭৭।
- ঐ, পৃ. ১৭৪।
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬।
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 185.
- ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 322.
- ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.
- ঐ, Hill, III, p. 343. জোরটা আমার দেওয়া।
- ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.
- ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.
- ওয়ালসকে স্ক্র্যাটফ্ন, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 349-50.