ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : শরৎকালে
শরৎকালে প্রাতঃসমীরণ যখন স্নিগ্ধ-মধুর সঞ্চরণে চন্দ্রনাথের কক্ষে প্রবেশ করিত, সারা রাত্রির দীর্ঘ জাগরণের পর চন্দ্রনাথ এই সময়টিতে ঘুমাইয়া পড়িত। তাহার পর তপ্ত সূর্যরশ্মি জানালা দিয়া তাহার মুখের উপর, চোখের উপর পড়িত, চন্দ্রনাথের আবার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। কিন্তু ঘুমের ঘোর কিছুতেই কাটিতে চাহিত না, পাতায় পাতায় জড়াইয়া থাকিত, তথাপি সে জোর করিয়া বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া পড়িত। সারাদিন কাজকর্ম নাই, আমোদ নাই, উৎসাহ নাই, দুঃখ-ক্লেশও প্রায় নাই; সুখের কামনা ত সে একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছে। শীর্ণকায়া নদীর উপর দিয়া সন্ধ্যার দীর্ঘ ভারবাহী তরণী যেমন করিয়া এপাশ ওপাশ করিয়া হেলিয়া দুলিয়া বাঁকিয়া চুরিয়া মন্থরগমনে স্বেচ্ছামত ভাসিয়া যায়, চন্দ্রনাথের ভাবী দিনগুলাও ঠিক তেমনি করিয়া এক সূর্যোদয় হইতে পুনঃ সূর্যোদয় পর্যন্ত ভাসিয়া যাইতে থাকে। সে নিঃসংশয়ে বুঝিয়াছে, যে দিগন্ত-প্রসারিত কালোমেঘ তাহার মুখের সূর্যকে জীবনের মধ্যাহ্নেই আচ্ছাদিত করিয়াছে, এই মেঘের আড়ালেই একদিন সে সূর্য অস্তগমন করিবে। ইহজীবনে আর সাক্ষাৎলাভ ঘটিবে না। তাহার নীবব, নির্জন কক্ষে এই নিরাশার কালো ছায়াই প্রতিদিন ঘন হইতে ঘনতর হইতে লাগিল এবং তাহারি মাঝখানে বসিয়া চন্দ্রনাথ অলস-নিমীলিত চোখে দিন কাটাইয়া দিতে লাগিল।
হরকালী বলেন, এই অগ্রহায়ণ মাসেই চন্দ্রনাথের আবার বিবাহ হইবে। চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া থাকে। এই চুপ করিয়া থাকা সম্মতি বা অসম্মতির লক্ষণ, তাহা নির্ণয় করিতে স্বামীর সঙ্গে তাঁহার তর্ক-বিতর্ক হয়। মণিশঙ্করবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, চন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কিছু বলা যায় না।
এবার কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা। মণিশঙ্করের ঠাকুর-দালান হইতে সানাইয়ের গান প্রাতঃকাল হইতে গ্রামবাসীদের কানে কানে আগামী আনন্দের বার্তা ঘোষণা করিতেছে। চন্দ্রনাথের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। নিমীলিতচক্ষে বিছানায় পড়িয়া শুনিতেছিল, একে একে কত কি সুর বাজিয়া যাইতেছে। কিন্তু একটা সুরও তাহার কাছে আনন্দের ভাষা বহিয়া আনিল না; বরঞ্চ ধীরে ধীরে হৃদয়-আকাশ গাঢ় কালোমেঘে ছাইয়া যাইতে লাগিল। আজ হঠাৎ তাহার মনে হইল, এখানে আর ত থাকা যায় না; একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিল, আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নে, রাত্রির গাড়িতে এলাহাবাদ যাব।
এ কথা হরকালী শুনিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিলেন, ব্রজকিশোর আসিয়া বুঝাইতে লাগিলেন, এমন কি মণিশঙ্কর নিজে আসিয়াও অনুরোধ করিলেন যে আজ ষষ্ঠীর দিনে কোথাও গিয়া কাজ নাই।
চন্দ্রনাথ কাহারও কথা শুনিল না।
দুপুরবেলা হরিবালা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সরযূ গিয়া অবধি এ বাটীতে তিনি আসেন নাই।
চন্দ্রনাথ তাঁহাকে দেখিয়া বলিল, হঠাৎ ঠানদিদি কি মনে ক’রে!
ঠানদিদি জবাব না দিয়া প্রশ্ন করিলেন, আজ বিদেশে যাচ্চ?
চন্দ্রনাথ বলিল, যাচ্চি।
পশ্চিমে যাবে?
যাবো।
হরিবালা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, দাদা, আর কোথাও যাবে কি?
চন্দ্রনাথ হরিবালার অভিপ্রায় বুঝিয়া বলিল, না। তাহার পর অন্যমনস্কভাবে এটা-ওটা নাড়িতে লাগিল।
হরিবালা যে কত কথা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে তাঁহার লজ্জা করিতেছেল, সাহসও হইতেছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সাহস করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, দাদা, তার একটা উপায় করলে না? দুইজনের দেখা হওয়া অবধি দুইজনেই মনে মনে তাহার কথাই ভাবিতেছিল,—তাই এই সামান্য কথাটিতে দুইজনের চক্ষেই জল আসিয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ সামলাইয়া লইয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, উপায় আর কি করব দিদি?
কাশীতে সে আছে কোথায়?
বোধ হয়, তার মায়ের কাছে আছে।
তা আছে, কিন্তু—
চন্দ্রনাথ মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কি?
ঠানদিদি ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া মৃদুকন্ঠে কহিলেন, রাগ করো না দাদা—
চন্দ্রনাথ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।
ঠানদিদি তেমনি মৃদু মিনতির স্বরে বলিলেন, কিছু টাকাকড়ি দিয়ো দাদা—আজ যেন সে একলা আছে, কিন্তু দু’দিন পরে—
চন্দ্রনাথ কথাটা বুঝিয়াও বুঝিল না, বলিল, কি দু’দিন পরে?
বড় বড় দু’ফোটা চোখের জল হরিবালা চন্দ্রনাথের সম্মুখেই মুছিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, তার পেটে যা আছে, ভালয় ভালয় তা যদি বেঁচে-বত্তে থাকে, তা হ’লে—
চন্দ্রনাথের আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি সে বলিয়া উঠিল, ঠানদিদি আজ বুঝি ষষ্ঠী?
হ্যাঁ, ভাই।
আজ তা হ’লে—
যাবে না মনে কচ্চ?
তাই ভাবছি।
তবে তাই করো। পূজোর’পর যেখানে হয় যেয়ো, এ ক’টা দিন বাড়িতেই থাক।
কি জানি কি ভাবিয়া চন্দ্রনাথ তাহাতেই সম্মত হইল।
বিজয়ার পর একদিন চন্দ্রনাথ গোমস্তাকে ডাকিয়া বলিল, সরকারমশাই, কাশীতে তাকে রেখে আসবার সময় হরিদয়াল কি কিছু ব’লে দিয়েছেলেন?
সরকার কহিল, তাঁর সঙ্গে আমার ত দেখা হয় নি।
চন্দ্রনাথ ভয় পাইয়া কহিল, দেখা হয় নি? তবে কার কাছে দিয়ে এলেন? তার মায়ের সঙ্গে ত দেখা হয়েছিল?
সরকার মাথা নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে না, বাড়িতে ত কেউ ছিল না।
কেউ ছিল না? সে বাড়িতে কেউ থাকে কি না, সে সংবাদ নিয়েছিলেন ত? হরিদয়াল আর কোথাও উঠে যেতেও ত পারেন!
সরকার কহিল, সে সংবাদ নিয়েছিলাম। দয়াল ঘোষাল সেই বাড়িতে থাকতেন।
চন্দ্রনাথ নিঃশ্বাস ফেলিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ পর্যন্ত কত টাকা পাঠিয়েছেন?
আজ্ঞে, টাকাকড়ি ত কিছু পাঠাই নি।
পাঠান নি! চন্দ্রনাথ বিস্ময়ে, বেদনায়, উৎকণ্ঠায় পাংশুবর্ণ হইয়া কহিল, কেন?
সরকার লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া কহিল, মামাবাবু বলেন, পাঁচ টাকার হিসাবে কিছু পাঠালেই হবে।
জবাব শুনিয়া চন্দ্রনাথ অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল।
পাঁচ টাকার হিসাবে? কেন, টাকা কি মামাবাবুর? আপনি প্রতি মাসে কাশীর ঠিকানায় পাঁচ শ টাকা করে পাঠাবেন।
সরকার, যে আজ্ঞে, বলিয়া স্তম্ভিত হইয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল।
হরকালী এ কথা শুনিয়া চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন, সে পাগল হয়েচে। সরকারকে তলব করিয়া অন্তরাল হইতে জোর করিয়া হাসিলেন। হাসির ছটা ও ঘটা বৃদ্ধ সরকার শুনিতেও পাইলো, বুঝিতেও পারিল। হরকালী কহিলেন, সরকারমশাই, কত টাকা পাঠাতে বলেচে?
প্রতিমাসে পাঁচ শ টাকা।
ভিতর হইতে পুনর্বার বিদ্রূপের হাসি শুনিয়া সরকার ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
হরকালী অনেক হাসিয়া পরিশেষে গম্ভীর হইলেন। ভিতর হইতে বলিলেন, আহা, বাছার রাগ হ’লে আর জ্ঞান থাকে না। সে পোড়া-কপালীর যেমন অদৃষ্ট! আমি পাঁচ টাকা ক’রে দিতে বলেচি, তাই রেগে উঠেচে। বলে, পাঁচ শ টাকা করে দিও। বুঝলেন সরকারমশায়, চন্দ্রনাথের ইচ্ছা নয় যে, এক পয়সাও দেওয়া হয়।
কথাটা কিন্তু সরকার মহাশয় প্রথমে তেমন বুঝিল না; কিন্তু মনে মনে যত হিসাব করিল, তত বোধ হইতে লাগিল, হরকালীর কথাটাই সত্য। যাহাকে বাড়ি হইতে বাহির করা হইয়াছে, তাহাকে কি কেহ ইচ্ছাপূর্বক অত টাকা দেয়?
ভাবিয়া চিন্তিয়া সে বলিল, তা আপনি যা বলেন।
বলব আর কি! এই সামান্য কথাটা বুঝলেন না?
সরকার মহাশয় অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তাই হবে।
হ্যাঁ, তাই। আপনি কিন্তু পাঁচ টাকা হিসাবে পাঠাবেন। চন্দ্র না দেয়, আমার হিসেব থেকে পাঁচ টাকা পাঠাবেন।
হরকালী মাসিক পঞ্চাশ টাকা করিয়া নিজের হিসাবে হাতখরচ পাইতেন।
সরকার মহাশয় প্রস্থান করিবার সময় বলিল, তাই পাঠাব।
চন্দ্রনাথ বাড়ি নাই। এলাহাবাদ গিয়াছে। সরকার মহাশয় তাহাকে পত্র লিখিয়া মতামত জানিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু পরে মনে হইল, এরূপ অসম্ভব কথা লইয়া অনর্থক তোলাপাড়া করিয়া নিজের বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়া লাভ নাই।