সংসারে ‘শেষ’ বলে যে একটা কথা আছে, সে শুধু কথার কথা। আসলে শেষ হয় না কিছুই। বীজের মধ্যে যেমন নবাঙ্কুর, শেষের মধ্যে তেমন নবারম্ভ। জীবনটাকে নাটক বলতে চান, বলুন। আমার আপত্তি শুধু এক জায়গায়—সে নাটকে ‘মূর্ছা ও পতন’ যতই থাক, যবনিকা-পতন নেই। তার অগণিত দৃশ্য জুড়ে কেবল অন্তহীন ‘প্রবেশ’ ও ‘প্রস্থান’। এই আমাকে দিয়েই দেখুন। জেলখানার লোক আমি। কারা-রক্ষা এবং কয়েদী-শাসন আমার একমাত্র পবিত্র ধর্ম। একদিন কী দুর্মতি হল! শাসনদণ্ড সরিয়ে রেখে তুলে নিলাম লেখন-দণ্ড। তারপর যেদিন ভুল ভাঙল, দেখলাম, আগাগোড়া সবটাই আমার লোকসানের পালা। না পেলাম লেখকের খ্যাতি, না জুটল শাসকের খেতাব। শুধু কি তাই? সরকারী আপিসের সতীর্থেরা হুঁকো বন্ধ করলেন, সাহিত্য-বাসরের স্বজাতিরা জাতে তুললেন না। বাঁয়ে ভ্রুকুটি, ডাইনে নাসিকা-কুঞ্চন। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, সরকারী চাকরির তকমা বুকে ঝুলিয়ে লক্ষ্মীর উপাসনায় বাধা নেই, কিন্তু সরস্বতীর কমলবনে প্রবেশ নিষেধ।
গিরীনদা বলতেন, বক আর কচ্ছপে কোনদিন মিল হয় না। জোর করে মেলাতে গেলে যা দাঁড়ায়, সুকুমার রায় তার নাম দিয়েছেন বকচ্ছপ। সে এক আজব জীব, নাইদার বার্ড নর বীস্ট। কোনো দলেই তার জায়গা নেই।
তাই মনে মনে স্থির করেছিলাম, এইখানেই শেষ হোক। আমার এই তামসলোকের অন্তরাল থেকে যে দু-চারটি বর্ণহীন ছবি নিতান্ত খেয়ালের বশে একদিন তুলে ধরেছিলাম মুক্ত দুনিয়ার মানুষের কাছে, তার উপর নেমে আসুক সমাপ্তির যবনিকা। যে পথটা ধরেছিলাম, সেটা আমার নেশাও নয়, পেশাও নয়, ক্ষণিকের খেয়াল মাত্র। তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। ফলও পেয়েছি হাতে হাতে। অতএব রইল আমার লেখনী। ব্যাটনের জয় হোক।
কিন্তু হল না। আবার আমাকে আসতে হল। আবার এসে খুলতে হল লৌহকপাটের নিষিদ্ধ অর্গল। কেন? তা আমি জানি না। নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পাইনি। এইটুকু শুধু জানি, যে কথা প্রথমেই বলেছি—অবসান বলে কোনো শব্দ নেই বিধাতার অভিধানে।
প্রত্যক্ষ কারণ না থাক, একটা কিছু আছে, যাকে উপলক্ষ্য করে এই পুনশ্চের আবির্ভাব। আপাতদৃষ্টিতে সেটা একখানা চিঠি। ‘চিঠি’ বললে তাকে বাড়িয়ে বলা হবে। খাতা থেকে ছিঁড়ে-নেওয়া এক টুকরো কাগজে কয়েকটি মাত্র লাইন। তার মধ্যে—
যাক; সে কাহিনী যথাস্থানে বলব। আপাতত আরো খানিকটা পিছনে সরে গিয়ে গুরুদাসবাবুর প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক
গুরুদাস সমাদ্দার ছিলেন কোর্ট-ইন্সপেক্টর। অর্থাৎ পদে পুলিস, পেশায় মোক্তার। কোমরে রিভলবার বেঁধে ঘোড়া বা জীপ ছুটিয়ে ডাকাত ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা কিংবা ডজনখানেক কাঁদুনে গ্যাস ইষ্টকবর্ষী জনতার উপর লাফিয়ে পড়া—এই সব বড় বড় পুলিসী ব্যাপার তাঁর কার্য-তালিকার বাইরে। তাঁর একমাত্র বড়াইয়ের ক্ষেত্র ফৌজদারী কোর্ট এবং হাতিয়ার ইণ্ডিয়ান পিনাল কোড়। আসল উকিল-মোক্তারদের সঙ্গে কোর্টবাবুদের তফাত শুধু পোশাকের। তাঁদের সাদা পেন্টুলন, কালো কোট, আর ওঁর ছিল খাকী টিউনিকের উপর স্যাম-ব্রাউন বেল্ট, তার উপর ক্রাউন-মার্কা হেলমেট। এই জাঁদরেল পরিচ্ছেদে সজ্জিত হয়ে পালিশ-উঠে-যাওয়া নড়বড়ে টেবিলের উপর বিপুল মুষ্ট্যাঘাত করে যখন হুঙ্কার ছাড়তেন—ইওর অনার, কে বলবে ল কলেজ দূরে থাক, একটা সাধারণ কলেজের চৌকাঠও কোনোদিন লঙ্ঘন করে নি সমাদ্দার সাহেব। সাবেকী আমলের এনট্রান্স-ফেল। ভগ্নীপতি ছিলেন দারোগা। তাঁরই তদবিরের জোরে এল. সি. অর্থাৎ লিখিয়ে-কনেস্টবল রূপে প্রথম প্রবেশ। তারপর ক্রমে ক্রমে জমাদার এবং ছোট ও বড় দারোগার সিঁড়িগুলো অতিক্রম করে কাঁচাপাকা গোঁফ এবং মাথাজোড়া টাক নিয়ে কোর্টবাবুর গদি। সংক্ষেপে এই হল সমাদ্দার সাহেবের চাকরি-জীবনের ইতিবৃত্ত।
কোর্ট-পুলিসের দপ্তরে বড় থেকে ছোট সকলেই ইন্সপেক্টরবাবুর মতো হাফ-পুলিস। পোশাক আছে, প্রতাপ নেই। হাবিলদার বা সিপাই যে কজন থাকে তাদের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, রিজার্ভ লাইনের ধাক্কা কিংবা কোতোয়ালি থানার ধকল সইতে পারে নি বলেই ওইখানটা ওদের শেষ পরিণতি। একজন সুরসিক হাকিমকে একবার বলতে শুনেছিলাম, কোর্ট-পুলিসের ক্যাম্প হল পুলিস-ফোর্সের পিঁজরাপোল। কথাটার মধ্যে অতি-ভাষণ হয়তো কিছু আছে, কিন্তু সত্যের অপলাপ নেই।
কোর্টবাবুর এই ক্ষুদ্র বাহিনীই হচ্ছে জেল আর পুলিসের ভিতরকার সূক্ষ্ম হাইফেন। নটা বাজবার আগেই কোনোরকমে একটা উর্দি চড়িয়ে হাবিলদার আর তার জনকতক অনুচর জোড়া কয়েক হাতকড়া এবং একটা মোটা দড়ি হাতে নিতান্ত ঢিলেঢালা মেজাজে পান চিবোতে চিবোতে উঠবে গিয়ে জেল-অফিসের বারান্দায়। কেউ কেউ আবার সেইখানেই একটু গড়িয়ে নেয়। মাঝে মাঝে রাইটারদের* তাগিদ দেয়, লাট সাহেবদের খানা হল? লাট সাহেব মানে ঐদিন যারা কোর্টে যাবে সেই সব হাজতী আসামী। হাজতের মেট যথাসময়ে তাদের হাজির করবে জেল ডেপুটিবাবুর সেরেস্তায়। নাম ডাকা হবে ওয়ারেন্ট ধরে ধরে। তারপর একটা হাতকড়ায় দুজন দুজন করে গেঁথে এবং কোমরে দড়ি জড়িয়ে হাবিলদার সাহেব সদলবলে যাত্রা করবেন কাছারির উদ্দেশে।
[*Writer অর্থাৎ লেখাপড়া-জানা কয়েদী, যারা আপিসের কাজে সাহায্য করে।]
এই বিচিত্র প্রসেশন যখন রাস্তা দিয়ে চলে, কৌতূহলী পথিক পাশ কাটিয়ে যাবার সময় একটু মুচকি হেসে মন্তব্য করে তার সঙ্গীর কানে কানে, কতগুলো চোর যাচ্ছে দেখেছ? ‘চোরে’রা সে-সব বড় একটা গায়ে মাখে না। গল্প করতে করতে এগিয়ে যায়। বড় জোর গায়ের চাদর দিয়ে মাথাটা ঢেকে নেয়, চেনা লোকের চোখ এড়াবার জন্যে।
কোর্ট-হাজতের খবরদারি এবং দরকারমত সেখান থেকে আসামীদের নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন কোর্টের কাঠগড়ায় তোলা—সে-সবও ওদের কাজ-এই হাবিলদার আর তার দলবল। তারপর দিনের শেষে ওরাই আবার দড়ি-বাঁধা প্রসেশন নিয়ে জেলখানার পথ ধরে। শোভাযাত্রা এক হলেও; যাত্রীরা সব এক নয়। সকালবেলা যারা এই পথ ধরে গিয়েছিল, তাদের কারও কারও ভাগ্যে জুটেছে মুক্তি, তার জায়গা পূরণ করেছে নতুন মুখ।
এ দৃশ্য অনেক দিন আমার নজরে পড়েছে এবং প্রতিবারই নিজের মনকে প্রশ্ন করেছি, চোর ডাকাত খুনী বদমাশ পকেটমারদের এই যে বিচিত্র মিছিল, এদের চেয়ে শান্তিপ্রিয় জীব আমাদের সভ্য এবং ভদ্রসমাজে আছে কি? ইচ্ছা করলেই যে-কোনো মুহূর্তে গুরুদাসবাবুর পিঁজরাপোলের ওই কৃষ্ণের জীবকটিকে ধূলিসাৎ করে ওরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো উধাও হয়ে যেতে পারে। যায় না কেন, তার কারণ বোধ হয় ওই নিরীহ মানুষ কটার উপর এদের এক ধরনের অদ্ভুত অনুকম্পা। এই ‘চোর’-গুলোর হাতেই যে তাদের প্রহরী-বাহিনীর অন্নের থালা।
সেইদিনকার কথাই বলি। সাতটা বেজে গেছে। জেলখানার নৈশ আপিস সরগরম। ডেপুটি জেলার রতনবাবুর হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে—নাম কেয়া? বাপকা নাম? কাঁহা ঘর? চীজ বাতাও—। নবাগত আসামী এবং কয়েদীদের নাম-ধাম মিলিয়ে নিচ্ছেন ওয়ারেন্টের সঙ্গে এবং তারই উপর লিখে নিচ্ছেন ওদের চীজ অর্থাৎ কাপড়-চোপড় জিনিসপত্রের তালিকা। পাশের ঘরে বসে আমি ক্যাশবুক চেক করছি। টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে হেডক্লার্ক এগিয়ে ধরছেন ভাউচার এবং অন্যান্য কাগজপত্র। ‘সুপার’-এর রবারস্ট্যাম্প যেখানে যেখানে আছে, তার নীচে ছোট্ট করে লিখে দিচ্ছি একটা করে এম. সি. মলয় চৌধুরীর সংক্ষিপ্তসার। কাল সকালবেলা সই করবার সময় ওই ধোবী-মার্কটুকু না দেখলে আমার মেজর আই. এম. এস. মনিব ওই মোটা খাতাটা ছুঁড়ে মারবেন হেডক্লার্কের মুখের উপর। হাজার দেড়েক টাকার বিনিময়ে এই জেলখানায় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেই তিনি আমাদের কৃতার্থ করেছেন। তার উপরে আবার দায়িত্ব? অসম্ভব। সে বোঝা বইবে এই তিনশো টাকার জেলার। তারই নিদর্শন ঐ এম. সি.। ওই দুটো তুচ্ছ অক্ষরের খুঁটির উপর ভর করেই তিনি অন্ধবেগে চালিয়ে যাবেন তাঁর মূল্যবান স্বাক্ষরের এঞ্জিন। ওইটুকু দেখতে পেলেই তিনি নিশ্চিন্ত। জানবার, বুঝবার, ভাববার তাঁর কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই।
গুড ঈভনিং, মিস্টার চৌধুরী।
গুড্ ঈভনিং। আসুন, আসুন। এত রাত্তিরে, কী ব্যাপার?
গুরুদাসবাবু চেয়ারটা টেনে নিয়ে তার উপর গা এলিয়ে দিয়ে মুখে একটা শব্দ করে বললেন, পুলিসের আবার রাত্তির! আসামী নিয়ে এলাম।
আসামী নিয়ে! আসামীরা আজকাল ইন্সপেক্টরের কাঁধে চড়ে আসে নাকি!
ইন্সপেক্টর তো ছার! তেমন তেমন আসামী আই. জি. পুলিসের ঘাড়েও চড়ে!
উত্তরে একটা কী বলতে যাচ্ছিলাম, দরজার দিকে নজর পড়তে থেমে গেলাম। হাবিলদারের সঙ্গে যাকে ঢুকতে দেখলাম, তিনি আসামী নন–আসামিনী। চলবার ভঙ্গিটা বেশ সপ্রতিভ। বেশভূষা সাধারণ। কিন্তু তার মধ্যে রুচির পরিচয় আছে। স্ত্রী-জাতির বয়স নির্ধারণে আমি চিরদিন ভুল করে থাকি। তবে এই মেয়েটির তারুণ্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। সমাদ্দার বসেছিলেন দরজার দিকে পিছন করে। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন এবং বিরক্তির সুরে বললেন তাঁর হাবিলদারকে লক্ষ্য করে, এখানে আনতে কে বলল তোমাকে? ও ঘরে নিয়ে যাও।
ওরা সরে যাবার পর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলাম সমাদ্দারের দিকে। উনি জবাব দিলেন—একরারী আসামী। থানা থেকে পাঠিয়েছিল কনফেশন রেকর্ড করবার জন্যে। করে ফেললেই ঢুকে যেত। কিন্তু আমার এস. ডি. ও সাহেব এক ফ্যাকড়া তুললেন। কোথায় নাকি কী গোলমাল আছে! যে অপরাধ ও নিজের ঘাড়ে নিতে চাইছে আসলে সেটা ও করেছে কিনা সন্দেহ। আমার ওপর হুকুম হল, নিজে সঙ্গে করে রেখে আসুন জেলখানায়। আরও খানিকটা ভাবতে দিন। আপনাকেও বলতে বলেছেন সাবধানে- টাবধানে রাখতে, কেউ আবার বিগড়ে না দেয়!
গলা খাটো করে চোখে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত যোগ করলেন গুরুদাসবাবু, আসল ব্যাপার তো বুঝতেই পারছেন। সেই চিরন্তন রূপের খেলা। কিন্তু বাইরে যারা ভোলায় ভেতরে তারা ফাঁসায়—এ জ্ঞান তো এখনও হয় নি। হাকিম হলেও বয়স অল্প।
কেসটা কী? —খুট-টুন নাকি? মাঝখানে প্রশ্ন করে বসলাম।
খুন না হলেও তার চেয়ে এককাঠি সরেস। ব্ল্যাকমেলিং। রূপের ফাঁদ পেতে রূপো ধরার ফন্দি।
ভালো ব্যবসা। কিন্তু কনফেস্ করছে কেন?
কী জানি মশাই! জড়িয়ে-টড়িয়ে পড়েছে হয়তো কারও সঙ্গে। যাক, আপনি কাজ করুন। আমি উঠি। হাকিম না ছাড়লে কাল সকালেই আবার ছুটতে হবে তো। চাকরি মন্দ হয় নি, কী বলেন? মুখে বিরক্তির ভাব দেখিয়ে খুশী মনেই প্রস্থান করলেন সমাদ্দার
সাহেব।
মিনিট কয়েক পরেই সেই হাবলিদার এসে জানাল, মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আনতে বলে দিলাম। স্বচ্ছন্দ লঘু পায়ে এগিয়ে এসে, বাধা দেবার আগেই পায়ের ধুলো নিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি এখানে কবে এলেন?
তুমি চেন নাকি আমাকে? বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করলাম।
বাঃ, চিনি না? সে চেহারা নেই। তবু ঘরে ঢুকেই আমি চিনতে পেরেছি।
একটু থেমে আবার বলল, আপনার নিশ্চয়ই মনে নেই আমার কথা! কেমন করে থাকবে? কত বছর হয়ে গেল!— কেমন একটা উদাস সুর লাগল ওর শেষের কথাটায়। মুখের উপর ঘনিয়ে এল কোন দূরাগত অতীত দিনের ছায়া। আমি তখন প্রাণপণে হাতড়ে চলেছি মনের মধ্যে, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না—কবে কোথায় যেন দেখেছি, ওই টানা ভ্রূর তলায় ভাসা-ভাসা চঞ্চল দুটি চোখ, বাঁ দিকের গালে ছোট্ট সুন্দর একটি তিল, পাতলা ঠোঁটের নীচে অপরূপ চিবুকের রেখা।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল মেয়েটি। হয়তো বুঝতে চাইল, আমি চিনতে পেরেছি কি না। তারপর বলল, তখন আপনি কুমিল্লায়। সভাপতি হয়ে গিয়েছিলেন মণিমেলার বার্ষিক উৎসবে। একটা মেয়ে কপালে চন্দন আর গলায় বেলফুলের গোড়ে দিয়ে বরণ করেছিল, মনে পড়ে? তারপর আপনার পাশটিতে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেছিল—”বন্দী বীর”। খুব সুখ্যাতি করেছিলেন আপনি!
ও–ও, তুমি সেই অপর্ণা।
নামটা এখনও মনে আছে আপনার! বিস্ময়ে আনন্দে উচ্ছল কণ্ঠে বলে উঠল মেয়েটি। অথচ মানুষটিকে ভুলে গেছি। তাই হয়। নাম ঠিকই থাকে, মানুষ বদলে যায়। … কী করব, বলো? কোথায় সেই রোগা ছিপছিপে দশ-এগারো বছরের ফ্রকপরা মেয়ে, আর কোথায়—
পূর্ণাঙ্গ-যৌবনা অপর্ণার দিকে চেয়ে কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলাম। সুন্দর মুখখানা নেমে এল নীচের দিকে এবং তার উপর ছুটে এল একঝলক রক্তের আভা। প্রসঙ্গটার মোড় ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, এবার সবটাই মনে পড়েছে। সভার মাঝখানে হঠাৎ ঝড় এসে পড়ায় খুব বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিন। সভাপতির ভাষণটা আর দিতে হয় নি।
কিন্তু ভাষণের বদলে একদল শ্রোতাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিতে হয়েছিল। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল অপর্ণা।
তাতে বরং লাভই হয়েছিল সভাপতির। চা আর গরম গরম পাঁপরভাজা খাইয়েছিলেন তোমার মা।
ইশ! মার কথায় বুঝি রাজী হয়েছিলেন আপনি? কত সাধাসাধি! কিছুতেই খাবেন না। তারপরে বলে বসলেন, অপর্ণা যদি করে দেয়, তবে খেতে পারি। আমি তো ভয়ে মরি। চা করতে কি শিখেছি তখন! দুধ আর চিনি দুটোই বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি কিন্তু বলেছিলেন, খুব সুন্দর হয়েছে।
বলেছিলাম নাকি?
আরও কী কী বলেছিলেন, সব আমার মনে আছে। কাছে ডেকে আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, বড় হয়ে কী হতে চাও? আমি সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় জবাব দিয়েছিলাম, ডাক্তার। আপনি আমার মুখের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ডাক্তার কেন, তুমি হবে রাজরানী। হেসে উঠেছিলাম, রাজরানী! হ্যাঁ, এমনই একটা ছোট রাজ্যের রানী—বলে আমাদের সেই সাজানো ঘরখানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন কিন্তু আপনার কথার ঠিক মানেটা ধরতে পারি নি। তবু ভারি মিষ্টি লেগেছিল, ছোটদের জন্য লেখা আপনার সেই গল্পগুলোর মতো। আমার চেয়েও খুশী হয়েছিল মা। আস্তে আস্তে কেমন ধরা-ধরা গলায় বলেছিল, সেই আশীর্বাদ করুন। আমি যেন দেখে যেতে পারি। বড় হয়ে বুঝলাম, আমার মনের কথাই বলেছিলেন সেদিন। বোধ হয় সব মেয়ের মনের কথা। একটি ছোট্ট রাজ্য, একান্তভাবে আমার, আমি তার রানী। এর চেয়ে বড় সাধ আর কী আছে মেয়েদের জীবনে! কিন্তু কই, আপনার সে আশীর্বাদ তো ফলল না!
অপর্ণার মৃদুকণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল। ভিজে উঠল চোখের পাতা। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে মৃদু হাসি টেনে এনে বলল, আপনার কাজের ক্ষতি হল, এবার আমি যাই। কাল সকালে একবার আসতে পারব?
বললাম, সকালে আমি বড্ড ব্যস্ত থাকি।
তা হলে বিকালে?
কাল তো তোমার কোর্টে যাবার দিন।
তা হোক, তবু আপনার কাছে আসতেই হবে একবার। আমার যে অনেক কথা বলবার আছে।
একটুখানি অপেক্ষা করল। তারপর বোধ হয় আমার থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তরল কণ্ঠে বলল, আচ্ছা সত্যি বলুন তো, দশ বছর আগে সেই যে আমাকে দেখেছিলেন, তারপরে কেমন করে কোন্ পথ ধরে এখানে এসে দাঁড়ালাম, সে-সব কথা জানতে আপনার একটু ইচ্ছে হচ্ছে না?
তোমার বাবা কি ওখানেই আছেন?
জানি না।
মা?
মা নেই।
দেখে মনে হচ্ছে, তুমি খুব ক্লান্ত। এখন যাও, যা হোক কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়ো গে।
আমার কথার জবাব না দিলে আমি কখনো যাব না। ছেলেমানুষের মতো মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অভিমানের সুরে বলল অপর্ণা।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম, কী জবাব দেব, বলো? এটা তো বুঝতেই পারছি, এখানে যখন এসে পড়েছ, যে পথ দিয়ে এসেছ, সেটা সরল নয়, সুখেরও নয়। তার বেশী জেনে আর কী লাভ?
উত্তরে একটা কী বলতে যাচ্ছিল অপর্ণা, পিছনে বুটের আওয়াজ শুনে থেমে গেল। সশব্দে ঘরে ঢুকল চীফ হেডওয়ার্ডার। বুট এবং সেলাম ঠুকে রিপোর্ট দাখিল করল—বাষাট্ আদমি কাছারিসে আয়া। একষাট্ বন্ধ হো গিয়া। আউর—। রিপোর্ট অসমাপ্ত রেখে তাকাল অপর্ণার দিকে। বললাম, ওকেও নিয়ে যাও। জমাদারনীকে একবার-
জমাদারনী হাজির হ্যায়, হুজুর
সিনিয়র ফিমেল ওয়ার্ডার পিছনেই ছিল। এগিয়ে এসে সেলাম করল। জিজ্ঞাসা করলাম, খাবারদাবার আছে তো?
আছে, বাবা। এক ফাইল ভাত, দুটো কম্বল, থালা বাটি সব ঠিক আছে।
অপর্ণার দিকে তাকালাম। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল এবং আর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল জমাদারনীর সঙ্গে।
.
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দশ বছর পিছনে ফেলে-আসা একটি কালবৈশাখী সন্ধ্যা আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগল। মণিমেলার উৎসব। প্রধান উদ্যোক্তা একদল কিশোর-কিশোরী। নিমন্ত্রণপত্রে সময় রয়েছে চারটে। সওয়া চারটেয় গিয়ে দেখি, সভামণ্ডপের সাজ-সজ্জা সবে শুরু হয়েছে। সভাপতির মঞ্চের চারদিকে রঙিন কাগজের শিকল জড়ানো তখনও শেষ হয় নি। অগত্যা কাছাকাছি এক ভদ্রলোকের বৈঠকখানায় আশ্রয় নিলাম। ছেলেমেয়েদের অবাধ্যতা এবং সেই সঙ্গে জিনিসপত্রের দুর্মূল্যতা সম্বন্ধে গবেষণা চলতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পরে ডাক পড়ল। যথারীতি মালাদান এবং বরণ ইত্যাদির পর কার্যসূচীর প্রথম দফা ঘোষণা করতে যাচ্ছি, একটি পাণ্ডা-স্থানীয় ছেলে কানে কানে জানিয়ে দিল, উদ্বোধন-সঙ্গীত গাইবে যে মেয়েটি, হঠাৎ সর্দি লেগে তার গলাটা বসে গেছে, আধঘণ্টা সময় নিয়েছেন ডাক্তার। বিকল্প হিসাবে আর কাউকে পাওয়া যাবে কিনা, প্রস্তাব করতেই ছেলেটি হেসে বলল, তা কী করে হয়, স্যার? এক মাস ধরে কত আশা করে রিহার্সাল দিচ্ছে নমিতা!
অতএব নিরুপায়। গায়িকার গলা বসে গিয়ে সভাকেও একেবারে বসিয়ে দিয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পরে নমিতার গলার সুরের আলো যেমন জ্বলে উঠেছে, বিদ্যুতের আলো গেল নিবে। শুরু হল হট্টগোল। তার মধ্যে নিঃশব্দে বসে আছি। সেই ছেলেটি এসে বার বার বিনয় প্রকাশ করতে লাগল, আপনার বড় কষ্ট হল, স্যার। আর পাঁচ মিনিট। হঠাৎ পাশ থেকে কলকণ্ঠে বলে উঠল একটি কিশোরী, তাতে আর কী হয়েছে! সেবার তো এর চেয়েও কষ্টে পড়েছিলেন বর্ধমানে।
খবরটা জানা ছিল না। জানতে চাইলাম, কোন্ বার?
কেন, আপনার গল্পেই তো আছে! পাঁচটায় সভা, গিয়ে দেখেন কেউ নেই, সব লোক গেছে সার্কাস দেখতে। প্রথম শো ভাঙবার পর নটার সময় শুরু হল ফাংশান। তারপর—বেশ লিখেছেন কিন্তু—’সারারাত আর কোন খাবার না জুটলেও একটা জিনিস প্রাণভরে খেয়েছিলাম। সেটা হচ্ছে মশার কামড়।’
চপল কণ্ঠের মিষ্টি হাসির রোল ভরে দিল অন্ধকার সভামঞ্চ। মনে পড়ল, উত্তর পুরুষের জবানিতে এইরকম একটা গল্প লিখেছিলাম বটে কোন এক ছেলেদের মাসিক পত্রে। কিন্তু গল্প যে শুধু গল্প, সেটা আর যেখানেই হোক, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের বোঝাতে যাওয়া বিড়ম্বনা। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, কোথায় যেন পড়েছিলাম, একজন খ্যাতনামা আধুনিক সাহিত্যিকের কথা। বলছেন, নিজেকে নায়ক করে প্রেমের গল্প লেখার বিপদ অনেক। বন্ধুরা একবর্ণও বিশ্বাস করে না, কিন্তু গৃহিণী সবটাই বিশ্বাস করে বসেন।
এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতাও কম করুণ নয়। সাম্প্রতিক ঘটনা। প্রৌঢ় বয়সে যৌবনের স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে একটি চঞ্চলা পাহাড়ী কিশোরীকে আশ্রয় করে কিঞ্চিৎ রোমান্স সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। বন্ধুরা অনেক অনেক সরস মন্তব্য করেছেন। সহাস্যে উপভোগ করেছি। হঠাৎ একদিন আমার কলেজ-গামী পুত্রের জনৈক সহপাঠী এসে সাগ্রহ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা জ্যাঠামশাই, কার্শিয়াং স্টেশনে সেই যে চলে গেল, তারপর কাঞ্ছির সঙ্গে আর আপনার দেখা হয় নি?’
তাই বলছিলাম, উত্তম পুরুষের বিপদ সর্বত্র। যাক সে কথা।
যথাসময়ে অর্থাৎ বিজ্ঞাপিত সময়ের ঘণ্টা দুই পরে সভার কাজ শুরু হল। দেড়-হাত লম্বা ঠাসবুনানি প্রোগ্রাম। মাঝামাঝি পৌঁছবার আগেই চারদিক আঁধার করে এল ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে আর-এক দফা আলো নেভার পালা। উঠব কি উঠব না স্থির করবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃষ্টি।
আমার আসন ছিল একটা বারান্দায়। তার সামনে খোলা উঠোনে শামিয়ানা টাঙিয়ে শ্রোতাদের বসবার জায়গা। কড়কড় শব্দে কোথায় বাজ পড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎচমক। সেই আলোতে দেখলাম, সভার চিহ্নমাত্র নেই। কয়েকটি ছেলেমেয়ে, ওদের ভাষায় মণি-ভাইবোন শুধু বসে আছে আমার চারদিক ঘিরে। বাজ পড়ার শব্দে একেবারে গা ঘেঁষে এগিয়ে এল। এরাই বোধ হয় সভার উদ্যোক্তা। তাই সভাপতিকে ফেলে পালাতে পারে নি, কিংবা দূরের বাসিন্দা বলে পালানো সম্ভব হয় নি।. সেই ছেলেটিকে লক্ষ্য করলাম। তার দায়িত্বই তো সবচেয়ে বেশী। কী একটা বলতে এসেছিল, এমন সময় শোনা গেল একটি কিশোরী কণ্ঠের আবদার—একটা গল্প বলুন না? চারদিক থেকে সমবেত সমর্থনে আমার ক্ষীণ আপত্তি তলিয়ে গেল। শুধু সমর্থন নয়, তার সঙ্গে সংশোধন—বেশ বড় গল্প কিন্তু, আর বেশ মজার।
অতএব শুরু হল গল্প। অন্ধকারে শ্রোতৃবৃন্দের মুখ দেখা গেল না, কিন্তু আমার মুখের উপর অনুভব করলাম তাদের উজ্জ্বল চোখের নীরব স্পর্শ।
গল্প যখন শেষ হল, ঝড় পড়ে গেছে, কিন্তু বৃষ্টি বন্ধ হয় নি। আমার সঙ্গে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম এতক্ষণ। এবার গাড়োয়ানের তাগিদে সজাগ হয়ে উঠলাম। সেই ছেলেটি, বোধ হয় ‘মধ্যমণি’, সবিনয়ে প্রস্তাব করল আমার পাড়ার কাছাকাছি থাকে এমনি গুটিকয়েক ছেলেমেয়েকে পৌঁছে দেবার ভার আমাকে বহন করতে হবে। না করে উপায় কী! কিন্তু গাড়োয়ান বেঁকে বসল এবং ডবল বসশিশ কবুল না করা পর্যন্ত সোজা হল না।
দুর্গা বলে রওনা দেওয়া গেল। তখন খেয়াল হয় নি, গাড়ি তো গাড়োয়ান একা চালায় না। আরও দুটি প্রাণী আছে তার সহচর। তাদের সঙ্গে কোন বন্দোবস্ত হয় নি। ফলে খানিকক্ষণ চলবার পর তারা হঠাৎ নিশ্চল হয়ে গেল; খবরের কাগজের ভাষায় যার নাম ‘অবস্থান ধর্মঘট’। শাসন এবং তোষণের মিলিত প্রয়োগ নিষ্ফল হবার পর বকশিশের মাত্রাটা আর এক টাকা বাড়িয়ে দিলাম। চালকের মুখ থেকে সে কথা শোনামাত্র তার বাহনযুগল আবার সচল হলেন। তাদের এই প্রভুভক্তিটা এমন অর্থপূর্ণ যে আমার কিশোর সহযাত্রীদের কলহাস্যে অন্ধকার নির্জন পথ মুখর হয়ে উঠল।
সবাইকে পৌঁছে দেবার পর শেষ বাড়িটা অপর্ণাদের। ওর মা বাইরে এসে আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। তার পরের কথা আগেই কিছু বলা হয়েছে।
ওর বাবা ছিলেন ওখানকার জজ কোর্টের উকিল। পসার এবং প্রতিষ্ঠা প্রথম শ্রেণীর। ভদ্রলোক বাড়ি ছিলেন না। আমাদেরই মতো কোথাও বোধ হয় আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। মহিলাটির স্বাস্থ্য, বেশ-বাস, দুচারখানি দামী অলঙ্কার, যে ঘরটিতে বসেছিলাম তার সাজ- সজ্জা এবং বিশেষভাবে লক্ষণীয় তাঁর মুখের সেই পরিতৃপ্ত হাসিটুকু – এসব থেকে এক মুহূর্তেই বুঝেছিলাম, পরিবারটি শুধু সম্পন্ন নয়, সুখী। অপর্ণা ওঁদের একমাত্র সন্তান। মায়ের মত সেও একদিন এমনি একটা সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য ভরা সংসারের রাজ্যভার হাতে তুলে নেবে, সেইটাই সহজ এবং স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল। ডাক্তারের মত পরের ঘরের স্বাস্থ্য নিয়ে স্বাস্থ্যক্ষয় নয়, তার হাতে থাকবে নিজের ঘরের স্বাস্থ্য ও শ্রী ফুটিয়ে তোলার পবিত্র ভার। তাই বোধ হয় আমার মুখ থেকেই আপনিই বেরিয়ে গিয়েছিল, ডাক্তার নয়, তুমি হবে রাজরানী। তার মা খুশী হয়েছিলেন। সে নিজেও কম খুশী হয় নি। কিন্তু আমাদের সেদিনকার সেই সমবেত শুভকামনা সফল হয় নি। রাজ্যপাট পায় নি অপর্ণা। পেলেও কেড়ে নিয়ে গেছে কোন্ অলক্ষ্য অদৃষ্টের অভিশাপ! হারিয়ে গেছে রানীর সিংহাসন। ছন্নছাড়া রিক্ত বেশে আজ সে আমার রাজ্যে প্রবেশ প্রার্থিনী।
জেলখানার লোক আমি। এই পাষাণপুরীর পাঁচিলের মধ্যে কাটিয়ে দিলাম সারাজীবন। এক জেল থেকে আর এক জেলে ঘুরেছি, আর দেখেছি মসিকলঙ্কিত মানুষের মিছিল—জীবনের রাজপথ যাদের ডাক দেয় নি, কিংবা ডাক দিয়েও সাড়া পায় নি; রিপুর তাড়না, অথবা ভাগ্যের প্রতারণা যাদের টেনে নামিয়ে নিয়ে গেছে এমন এক আঁধার সর্পিল পিচ্ছিল পথে যার শেষ প্রান্ত এই লৌহতোরণ। সে পথে চলতে গিয়ে কারও গায়ে লেগেছে পাঁক, কারও পায়ে ফুটেছে কাঁটা, নর্দমার বিষ-বাষ্পে কারও বা বিষিয়ে গেছে নিঃশ্বাস। সমাজ ও সভ্যতার লৌহ-পেষণ তাদের দেহ থেকে নিংড়ে নিয়েছে স্নেহ প্রীতি দয়া মায়া ঘৃণা লাঞ্ছনা আর শাসনের সাঁড়াশি চালিয়ে বুকের ভিতর থেকে উপড়ে নিয়েছে মানবতার শেষ অঙ্কুর। সেই বিবর্তনের গভীর চিহ্ন আমি দেখেছি ওদের মুখের প্রতিটি রেখায়। কিন্তু আমার অন্তরে আজ আর তার ছাপ পড়ে না। তার পিছনে যে ইতিহাস, তার জন্যেও জাগে না কোন কৌতূহল। অভ্যাসের বশে সেই কথাটাই জানিয়ে দিয়েছি অপর্ণার প্রশ্নের উত্তরে। মনে মনে বলেছি, যে পথ দিয়ে তুমি এসেছ, তার.সাধারণ চেহারাটা আমার চেনা। বিশেষ যেটুকু, তা দিয়ে আমার প্রয়োজন নেই। সে কাহিনী তোমার শুনতে চাই না।
কিন্তু এইটাই কি আমার অন্তরের কথা? গভীর রাত্রির অন্ধকারে নিজের মনের সঙ্গে যখন মুখোমুখি হবার অবসর হল, পরম বিস্ময়ে দেখলাম, ওই মেয়েটার ক্লান্ত ম্লান চোখ দুটো কোথায় যেন একটু দাগ রেখে গেছে শুষ্ক-কঠিন অন্তস্তলের কোণে। দশ বছর আগে যে সুস্থ সুন্দর পরিবেশে তাকে প্রথম দেখেছিলাম, সেই ছবিটা আজ চোখের উপর থেকে কিছুতেই নড়তে চাইছে না।
পরদিন সকালেই আবার এলেন গুরুদাসবাবু। সঙ্গে নিয়ে এলেন অপর্ণাকে কোর্টে হাজির করবার ওয়ারেন্ট। আমদানী সেরেস্তার ডেপুটিবাবু যথারীতি তার ব্যবস্থা করলেন। অর্থাৎ যথাসময়ে সে চলে গেল কোর্টে। সঙ্গে গেল আমাদের একজন ফালতু ফিমেল ওয়ার্ডার। নারী-আসামীকে জেল থেকে কোর্টে পাঠাতে হলে পুরুষ-পুলিসের সঙ্গে নারী-পাহারার বিধান দিয়েছেন জেলকোড। সে শুধু প্রহরিণী নয়, সঙ্গিনী। কিন্তু ওই আসামী যখন প্রথম আসে জেলখানায় এবং তার আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে থানার ‘লক-আপ্’-এ কিংবা কোর্ট-হাজতের কোণে, তখন তার সঙ্গদান এবং নিরাপত্তার সবটুকু ভার নেয় পুরুষ কনেস্টবল।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, কোন জেলের ফিমেল ওয়ার্ডে একটি সদ্য-আমদানী মুখরা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম। কাহিনী যা শুনিয়েছিল, এমন কিছু নতুন নয়। বাংলা কাগজ খুললে ওই-জাতীয় ঘটনা রোজ না হলেও প্রায়ই চোখে পড়ে থাকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগিয়ে গ্রামের বাড়িতেই ওকে গ্রেপ্তার করা হয়, কী এক বাসন চুরির মামলায়। দশ- বারো মাইল দূরে থানা। জনবিরল মাঠের মধ্য দিয়ে পথ, মাঝে মাঝে জঙ্গল। বাউরীদের ঘরের কুমারী মেয়ে। বয়স পনেরে-ষোলো। কোনোদিন গ্রামের বাইরে যায় নি। ওর বাপ বা ভাই একজন কেউ সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিসের জমাদার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেন নি। ওই জমাদার এবং তার একটি সিপাইয়ের হেফাজতে পড়ন্ত বেলায় যখন সে থানায় গিয়ে পৌঁছল, তখন তার কৌমার্য আর অক্ষত নেই।
তারপর কোর্ট-হাজত। চারদিকে লালসাদীপ্ত শতচক্ষুর অভিনন্দন। একটি নিতান্ত জৈব প্রয়োজনের তাগিদ তীব্রভাবে অনুভব করলেও, মুখ ফুটে বলতে পারে এমন একখানা মুখও তার চোখে পড়ে নি। কোর্ট থেকে হাঁটিয়ে যখন তাকে জেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হল তার আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকারের সুযোগ পেয়ে সেই বিশেষ প্রয়োজনটি তাকে মাঠের মধ্যেই সেরে নিতে হয়েছিল। সঙ্গের পুলিসটিকে একটু সরে যেতে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু চুরির আসামীকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া যায় কেমন করে? তাই সরে যাওয়া দুরে থাক, একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পুরুষ রক্ষী তাঁর পৌরুষ-ধর্ম পালন করেছিলেন। বাকী রাস্তাটুকু আরও যে-সব ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কুমারী-জীবনের চরম অভিজ্ঞতা লাভ করবার পর সেগুলো সামান্য উপরি-পাওনা।
যেদিন জেলে এল, ওর সামনেই আর একটা মেয়ে-আসামী তখন কোর্টে যাবার আয়োজন করছিল। জেলখানার ফালতু জমাদারনী অপেক্ষা করছে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে। এই ব্যবস্থার উল্লেখ করে একদিন মেয়েটি আমাকে বলেছিল, আহা, এমনি একটা মেয়েছেলে যদি সেদিন আমার সঙ্গে থাকত, তাহলে বোধ হয় ওরা আমার-
কথাটা তার মুখে বেধে গিয়েছিল। বাকীটুকু আর বলতে পারে নি।
আমি বলেছিলাম, এ ব্যবস্থা তো আমরা করিনি। এটা বরাবরকার সরকারী নিয়ম।
এর পরেই জিজ্ঞসা করেছিল মেয়েটি, ওখানে কি সরকার নেই বাবু?
সে প্রশ্নের জবাব সেদিনও দিতে পারি নি, আজও পারি নি।
.
সেদিন সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে এল অপর্ণা। এবার সে দস্তুরমত confessing accused বা একরারী আসামী। ওয়ারেন্টের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা—To be kept segregated. সবার থেকে আলাদা রাখার নির্দেশ। যে স্বীকারোক্তি সে করে এসেছে হাকিমের কাছে হলপ করে, অন্য কারও প্রভাবে পড়ে পাছে সেটা প্রত্যাহার করে বসে, তাই এই হুঁশিয়ারির ব্যবস্থা। আইনমত একটি নির্জন সেল-এ তাকে বন্ধ করা হল। বেঁচে গেল অপর্ণা। সহবন্দিনীদের সরব ও নীরব কৌতূহল তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
পরদিন ছিল রবিবার। কিন্তু জেলখানার অফিসে রবিবার বলে কোন বস্তু নেই। আসতে হবেই। তবে খানিকটা বেলা করে ঢিলেঢালা বেশে ধীরে সুস্থে আসেন বাবুরা। মনে মনে একটা ছুটির মেজাজ আনতে চেষ্টা করেন। দুধের সাধ মেটাতে চান ঘোল দিয়ে। আমার বেলায় সেদিন রুটিন বদল হল। সকাল সকাল হাজিরা দিলাম এবং গিয়েই ডেকে পাঠালাম অপর্ণাকে।
কাছে এসে যখন দাঁড়াল, মুখে শুধু এক ঝলক টেনে-আনা নিষ্প্রভ হাসি। ক্লান্তির মধ্যেও উচ্ছলতা দেখেছিলাম সেই প্রথম রাতটিতে, তার জায়গায় কেমন এক গভীর অবসাদ। আমার টেবিলের পাশে একটা টুল ছিল। তার উপর বসতে বলে ফিমেল ওয়ার্ডারটিকে বিদায় করে দিলাম। অপর্ণা কয়েক মিনিট নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে, এমনি ভাবে আঁচলের খুঁট থেকে খুলে ফেলল এক টুকরো হলদে রঙের কাগজ। আমার সামনে রেখে বলল, এটা জমা দিতে ভুল হয়ে গেছে সেদিন। আপনার কাছে দিলে হবে তো?
পড়ে দেখলাম কোর্ট-পুলিসের রসিদ। পাঁচশো টাকার প্রাপ্তি-স্বীকার। টাকার অঙ্কটা দেখে বিস্ময় লাগল। বললাম, এটা কী ব্যাপার?.
তা তো দু-এক কথায় বোঝানো যাবে না। বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। চকিত দৃষ্টি মেলে আমার মুখের দিকে তাকাল অপর্ণা। বোধ হয় বুঝতে চেষ্টা করল—যা বলেছি সেটা নিছক পরিহাস, না সত্য! আমি হালকা সুরেই বললাম, কী করব বলো, তোমাদের সেই সভার সভাপতিগিরি করতে গিয়ে যে মারাত্মক ভুল করেছিলাম, তার শাস্তি না নিয়ে যাই কোথায়? তা নইলে জেলের মানুষ আমি, এসব দিকে মন দেবার সময় নেই, প্রবৃত্তিও নেই। তোমার মত মক্কেল তো আমার দুটো-চারটে নয় যে বসে বসে তাদের লম্বা কাহিনী শুনব!
অপর্ণার মুখখানা, কেমন করুণ হয়ে উঠল। আঘাত পেল কি? কিংবা হয়তো ভিতরকার কোনও অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে। আবহাওয়াটাকে হালকা করে দেবার উদ্দেশ্যে ছদ্ম আপসোসের সুরে বললাম, কী কুক্ষণেই সেদিন জেল থেকে বেরিয়েছিলাম!
নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে ম্লান হেসে বলল অপর্ণা, কিন্তু আপনার সেই কুক্ষণ আমার কাছে যে কী ক্ষণ নিয়ে এসেছিল, তা তো আপনি জানেন না! কতদিন ভেবেছি, আপনি আবার আসবেন। মাকে কত বিরক্ত করেছি, উনি আর আসছেন না কেন? মা বলত, তুই কি পাগল হয়েছিস্! কিন্তু আমি জানি, মুখে যাই বলুক, মাও আশা করত আপনি আসবেন। কতদিন অপেক্ষা করে যখন আর এলেন না, বারীনদাকে বলে-কয়ে তার সঙ্গে ভয়ে ভয়ে একদিন উঠলাম গিয়ে আপনার জেলখানার গেটে। শুনলাম আপনি বদলি হয়ে গেছেন। কী যে মনে হয়েছিল সেদিন! সত্যিই আর দেখা হল না!
মনে মনে বললাম, এ দেখা না হলেই বোধ হয় ভালো হত। অপর্ণা আমার মুখের দিকে চেয়ে বোধ হয় অনুমান করল আমার মনের কথা। তারপর আবদারের সুরে বলল, আচ্ছা সত্যি বলুন তো, আমার কথা একদিনও আপনার মনে হয় নি?
উত্তর পাবার আগেই হেসে ফেলল, শুনুন কথা! আমার মতো কত ভক্ত আছে আপনার! কত সভায় কত মেয়ে মালা আর চন্দন দিয়ে বরণ করেছে আপনাকে। সবাইকে মনে রাখা কি সম্ভব? তবু—
কথাটা তার শেষ হল না, আমি অন্য কথা তুললাম, তোমাদের বাড়ির খবর কী বলো? কী হয়েছিল তোমার মার?
ধরা গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সহজ সুরেই বলল, মা মারা যায় নি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
চমকে উঠলাম : বল কী!
চলতি কথায় যাকে খুন বলে তা কেউ করে নি। এক কোপে মারা নয়, মাসের পর মাস ধরে তিল তিল করে মারা। তার চেয়ে গলা টিপে কিংবা গুলি করে একদিন শেষ করে দিলেই অনেক ভালো হত। যেতেই যখন হল, তখন এত দিন ধরে এত দুঃখ পেয়ে যাবার কী দরকার ছিল?
এর পরে আর কোন প্রশ্ন করা যায় না। ওর মায়ের মুখের সেই পরিতৃপ্ত ভাবটি চোখের উপর ভেসে উঠল। মনে মনে আমিও সেদিন তৃপ্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে, এতদিনে একটি সুস্থমনা সুখী পরিবারের দেখা পেলাম, সংসারে যা অত্যন্ত বিরল। তবে কি সবটাই আমার ভুল?
অপর্ণার কথাতেই যেন তার উত্তর পাওয়া গেল; আপনি যখন আমাদের দেখেছিলেন, তখনকার কথা নয়। তখনও আমরা বড়লোক হই নি। কিন্তু বড় সুখ ছিল সংসারে। তার বছর দুই পরে বাবার ওকালতির পসার হঠাৎ বেড়ে গেল। অনেক টাকা পেলাম আমরা, কিন্তু বাবাকে আর পেলাম না। দিনকে দিন তাঁর নতুন রূপ। রাত করে ফেরেন। প্রায়ই তখন জ্ঞান থাকে না। মাকে দেখলেই অকথ্য গালাগালি, মাঝে মাঝে মারধোর। কোনোদিন একেবারেই ফেরেন না। যেখানে রাত কাটে, মেয়ে হয়ে সে কথা আর কেমন করে বলি! পাড়ায় কান পাতা যায় না। ইস্কুল ছেড়ে দিলাম। চেনা-শোনা কাউকে দূর থেকে আসতে দেখলেই জানলা বন্ধ করি। মার মুখে একটি কথা নেই। খাওয়া গেল, ঘুম গেল। তারপর আর চেনা যায় না। ডাক্তার দেখানো দরকার। কে দেখায়? তারপর আমিই গেলাম একদিন ডাক্তার নন্দীর কাছে। বাবার বন্ধু। সবই জানতেন উনি। ডাকতেই এলেন। দেখে- শুনে ওষুধ একটা লিখে দিলেন। কিন্তু যাবার সময় আমাকে ডেকে বলে গেলেন, “ওতে বিশেষ কাজ হবে না, বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া দরকার। দেখি তোমার বাবাকে বলে।’ কী বলেছিলেন তিনিই জানেন। বাবা ভীষণ রাগারাগি শুরু করলেন কদিন। মা বকতে লাগল আমাকে। কিন্তু বেশী দিন আর বকুনি খেতে হল না। মাসখানেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।
অপর্ণার মৃদুকণ্ঠ হঠাৎ কখন থেমে গেছে টের পাই নি। অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। …একটি বর্ষণমুখর রাত। রাস্তার ধারে একখানি প্রশস্ত ঘর। আসবাবের বাহুল্য নেই। যে কখানা আছে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। একখানা গোল টেবিলের এপাশে বসে আছি। ও-পাশটিতে পর্যন্ত ঘোমটা টানা। সুদৃশ্য ঝালর-পরানো সোফার উপর একটি সুরূপা মহিলা। কপালের উপর বাঁকা ভ্রূ দুটির মাঝখানে একটি উজ্জ্বল সিঁদুরের টিপ। স্বাস্থ্য এবং আনন্দে ঝলমল করছে মুখখানা। ডান পাশে আমার কৌচের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটি দশ-বারো বছরের ছিপছিপে মেয়ে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।….
অপর্ণার কথা কানে যেতেই মিলিয়ে গেল ছবিখানা। চমক ভাঙতেই ওর দিকে তাকালাম। আঁচলে চোখ মুছে ও আবার শুরু করল, মরবার দুদিন আগে দুপুরবেলা শিয়রে বসে হাওয়া করছিলাম। ইশারায় আমাকে কাছে এসে বসতে বলল। আমার একটা হাত বুকের উপর টেনে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। আমি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। একটু শান্ত হলে আস্তে আস্তে বলল, আমি তো চললাম, মা। তোর যে কী হবে এই ভেবেই শুধু যেতে আমার মন সরছে না। কিন্তু ভগবানের ডাক তো এড়াবার উপায় নেই।
আমি প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করলাম, মাগো তোমার পায়ে পড়ি, তুমি চুপ করো। কিন্তু গলা দিয়ে আমার স্বর ফুটল না। ওই কটা কথা বলেই মা হাঁপিয়ে পড়েছিল। একটু দম নিয়ে আবার বলল, আমার গয়নাগুলো সব তোর। ওতে আর কারো অধিকার নেই। ওইটুকু বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করিস। পারবি কিনা ভগবানই জানেন।
তারপর একটা নিঃশ্বাস পড়ল। আর কিছুই বলতে পারে নি মা। তখন থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তখন তুমি কত বড়? অপর্ণা একটু থামতেই ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলাম।
সেই বছরই আঠারোয় পা দিয়েছি। শেষের দিকটায় মার যখন খুব বাড়াবাড়ি, সারাক্ষণ প্রায় তার কাছেই কেটে যেত। এবার একেবারে ছুটি পেয়ে গেলাম। করবার কিছুই রইল না। মার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। পড়াশুনা তো আগেই ছেড়েছি। ঠাকুর চাকর দুই-ই পুরনো। সংসার তারাই দেখে। খাবার দিয়ে যখন ডেকে পাঠায়, খেয়ে এসে আবার ঢুকে পড়ি নিজের কোটরে। পারতপক্ষে বাবার সামনে বেরোই না। তাঁর রুটিন সেই আগের মতোই চলছে। সকালে মক্কেল, খেয়েদেয়ে কাছারি, ফিরে এসে কাপড়-চোপড় ছেড়ে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়া। তারপর কখন ফেরেন জানি না। মাঝে মাঝে শুনতে পাই, এটা-সেটা নিয়ে খিটখিট করছেন। ডালে নুন পড়ে নি, টাই কোথায় গেল, কলতলার সাবান নেই কেন? একদিন কোর্টে যাবার আগে ডেকে পাঠালেন। রুক্ষ মেজাজে বললেন, কী কর সারাদিন? জামা-কাপড়গুলোও একটু গুছিয়ে রাখতে পার না?
নিঃশব্দে চলে আসছিলাম, আবার ডেকে ফেরালেন। একটু নরম সুরে বললেন, মা- বাপ কি লোকের চিরদিন থাকে? চুপ করে শুয়ে-বসে না থেকে একটু-আধটু কাজকর্ম করলেই বরং ভুলে থাকা যায়। ইস্কুলে যাবি আবার?
বললাম, না। বলেই চলে এলাম নিজের ঘরে।
মাঝে মাঝে পাড়ার গিন্নীরা কেউ কেউ এসে হা-হুতাশ করতেন, বড় বড় উপদেশ দিতেন। চুপ করে শুনে যেতাম আর ভাবতাম, কখন উঠবেন এঁরা! সমবয়সী মেয়েরাও আসত। কাউকে কাউকে মন্দ লাগত না। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকলে মনটা পালাই পালাই করত। এমন সময় আর এক উৎপাত শুরু হল। মাসের মধ্যে তিন-চার দিন সেজেগুজে দাঁড়াতে হত গিয়ে বসবার ঘরে। ভাবী শ্বশুর-ভাসুরের দল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কী পড়ি, কী কী রান্না জানি, গান গাইতে পারি কিনা! যা খুশি জবাব দিতাম। তারপর কী হত জানি না! আভাসে আন্দাজে বুঝতাম, আমাকে বোধ হয় পছন্দ করেছেন; কিন্তু আমার সঙ্গে আর যা যা চাই, সেই ফদটা পছন্দ হয় নি। সেদিকে ক্রমেই মুশকিল দেখা দিল। টের পাচ্ছিলাম, আমাদের অবস্থায় ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে। বাবার বৈঠকখানায় মক্কেলের ভিড় তেমন জমছে না।
এমন সময়ে এল বারীনদা। তাকে আপনি দেখেছেন। মনে নেই নিশ্চয়ই। ও ছিল আমাদের মণিমেলার সর্দার, যাকে বলে মধ্যমণি।
আমি বললাম, মনে আছে বইকি। সেদিনকার সভায় ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছিল যে চশমা পরা ছেলেটি সেই তো? ফরসামত গাট্টা-গোট্টা চেহারা?
অপর্ণা হেসে ফেলল : ঠিক ধরেছেন। আপনার দেখছি কিছুই ভুল হয় না। খালি আমাকে চিনতে পারেন নি।
প্রতিবাদ করলাম, কে বলল চিনতে পারি নি? নামটা তো ভুল হয় নি। ওইটাই আসল পরিচয়। নাম বাদ দিয়ে মানুষের আর থাকে কী? যাক, এবার ‘বারীনদা’ কোন্ ভূমিকা নিয়ে এলেন, সেই কথা বলো।
বারীনদাকে তুচ্ছ করবেন না। আমার কাহিনীর অনেকখানি জায়গা সে জুড়ে আছে। কিন্তু আপনি যা ভাবছেন, তা নয়।
ওর সলজ্জ হাসিটির দিকে চেয়ে বললাম, কই, আমি তো কিছুই ভাবি নি।
তাই বই কি! আমি আপনার মুখ দেখেই বুঝেছি। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যিই তা নয়। বারীনদার সঙ্গে অনেক মিশেছি। আপনি যখন দেখেছেন, তখন তো বটেই, তার পরেও চার-পাঁচ বছর। শুধু আমি নই, আমার মতো আরও তিন-চারটি মেয়ে। কিন্তু নিতান্ত কাজের কথা ছাড়া আর কোন কথা ওর মুখে কেউ শোনে নি। এমন কিছু ওর চোখে কোনোদিন দেখা যায় নি, যেটা বিশেষ করে মেয়েদের চোখে পড়ে। একটি পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে আর একটি ওই বয়সী ছেলে বারীনদার কাছে একেবারে এক। শেষ পর্যন্ত দেখেছি, সংসারে মেয়ে বলে যে একটা জাত আছে সেটা যেন ও কোনোদিন টের পায় নি। সে কথা এখন থাক। যা বলছিলাম।
বারীনদা এল আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওর মাকে আমি মাসিমা বলতাম। বড্ড ভালবাসতেন আমাকে। তাঁর কাছেই সব কথা শুনেছিল। মা যখন মারা যায়, তার বছর দুই আগে থেকেই ও কলকাতা চলে গেছে। কালেভদ্রে আসত কুমিল্লায়। কী করত জানি না! জিজ্ঞেস করলে খালি হাসত, বলত না কিছুই। যারা ওর ওপরে খুশী নয় তারা বলত, কিছু করে না, আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। যাই করুক, মাসীমাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাত, যদিও টাকার দরকার তাঁর ছিল না বললেই হয়।
বারীনদা এল দুপুরবেলা। বাবা কাছারিতে। দুজনে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম। চা আর খাবার করে খাওলাম। বললাম, জান বারীনদা, মা চলে যাবার পর এই প্রথম ঢুকলাম রান্নাঘরে। তুমি এলে, তাই।
চায়ের খালি কাপটা নামিয়ে রেখে ও গম্ভীর হয়ে বলল, পড়া ছেড়ে দিয়ে ভালো করিস নি পরী। আমি বলি, আবার তুই ভর্তি হয়ে যা।
পরী আমার ডাকনাম। একটুখানি ভেবে বললাম, পড়তে আমারও ইচ্ছে করে বারীনদা। কিন্তু এখানকার স্কুলে আর হয় না।
বেশ তো, কলকাতায় গিয়ে পড়।
খরচ?
মেসোমশাই দেবেন না?
খুব সম্ভব, না। না দিলেও সে ব্যবস্থা আমি করতে পারব।
তুই কী করে করবি?
মার গয়না আছে কী করতে?
উঁহু, সেটা ঠিক হবে না।
ওগুলো দিয়ে তবে হবে কী?
বারীনদা ভাবতে লাগল। আমি বললাম, খরচটা আসল সমস্যা নয়। সমস্যা হল, থাকব কোথায়?
কেন, হস্টেলে?
না বারীনদা, মানুষ দেখলেই আমি কেমন হাঁপিয়ে উঠি। হস্টেলে আমার থাকা হবে না। তার চেয়ে এক কাজ করো না কেন? ছোট দেখে একটা বাসা নাও। তুমি থাকবে, আমিও থাকব। মাসীমাও গিয়ে থাকতে পারেন মাঝে মাঝে। খানতিনেক ঘর হলেই আমাদের চলে যাবে।
দূর, তাই কখনও হয়!
কেন হবে না?
বারীনদা যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেল। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর বলল, দ্যাখ্ পরী, আমাদের দুজনকে আমরা এত বেশী জানি যে সেদিক থেকে ভাববার কিছু নেই। তবু লোকের কথা একটু ভাবতে হয়।
তুমিও যেমন! কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি, লোকের কথায় আমাদের কী এসে যায়?
আচ্ছা, ভেবে দেখি। বলে উঠে পড়ল বারীনদা। দোর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললাম, ফিরছ কবে?
হপ্তাখানেক আছি। এর মধ্যে আর একদিন আসব।
বারীনদা এল না। চার-পাঁচ দিন পরে গেলাম ওর মায়ের কাছে। শুনলাম, আমার সঙ্গে দেখা হবার পরের দিনই টেলিগ্রাফ পেয়ে চলে গেছে কলকাতায়। মাসীমা দুঃখ করতে লাগলেন, ছেলে সংসারী হল না, কী যে করে তাও বলে না! এদিকে তিনি আর কদিন?
সেই দিন রাত্রে কী মনে করে মার ঘরে গিয়ে সিন্দুকটা খুললাম। দেয়ালে-গাঁথা লোহার সিন্দুক। দুটো মাত্র তাক। উপরের তাকে একটা ক্যাশবাক্সে মার গয়না থাকত আর নীচের তাকে থাকত বাবার কী সব দলিলপত্তর। খুলেই দেখলাম, নীচেটা সব খালি। বুকটা কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি ক্যাশবাক্সে চাবি লাগাতে গিয়ে দেখি, গা-তালাটা খোলা। ডালা তুলেই মাথা ঘুরে গেল। সেইখানেই বসে পড়লাম। অনেক গয়না ছিল মার। সবটাই প্রায় গেছে, পড়ে আছে মাত্র চার-পাঁচখানা। দু-চোখ থেকে জল ফেটে বেরিয়ে এল। আমারই দোষ। সিন্দুকের একটা চাবি যে বাবার কাছে ছিল সেটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মারও তো খেয়াল হয় নি। অথচ এই গয়না নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।
বাবা বাড়ি নেই। ফিরতে রাত হবে। তা হোক, যত দেরিই হোক, আমাকে জেগে থাকতেই হবে। ঠাকুর ভাত দিয়ে ডাকতে এল। ফিরিয়ে দিলাম। তখন কি আমার খাবার মতো অবস্থা? বাবা যখন ফিরলেন, রাত প্রায় বারোটা। শোবার ঘরেই ওঁর রাতের খাবার চাপা দেওয়া থাকত। ঢুকতেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, এ কী! এখনও শুতে যাস নি?
সে কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, আপনি গয়না নিয়েছেন? মার সিন্দুক থেকে?
চড়া সুরে জবাব এল, সে কৈফিয়ত কি তোমার কাছে দিতে হবে?
ও গয়না তো আপনার নয়।
বাবা কী যেন ভাবলেন। তারপরে একেবারে অন্য সুরে বললেন, ও-সব সেকেলে সোনার পিণ্ডি দিয়ে তো তোমাকে পার করা যাবে না। স্যাকরাকে দিয়েছি, ভেঙে হালফ্যাশানের নতুন গয়না গড়ে আসবে।
কথাটা যে নির্জলা মিথ্যা, বলবার ধরন দেখেই বুঝলাম। বললাম, আমাকে একবার জানালেন না কেন? নতুন গয়নার কোন দরকার ছিল না।
বাবা চটে উঠলেন : বড্ড জ্যাঠা হয়েছ তুমি। যাও শুতে যাও।
বড় অসহায় মনে হল নিজেকে। বারীনদাও নেই যে তার পরামর্শ নেব। এ সব তো আর কাউকে বলা যায় না। যে কখানা ছিল, আপাতত সরিয়ে রাখলাম একটা কাঠের আলমারিতে, যার মধ্যে মার কাপড় থাকত। তার চাবিটা আমার কাছেই ছিল।
সেই সময়টা বার বার করে আপনার কথা মনে হত। ভাবতাম আপনি থাকলে নিশ্চয়ই এ বিপদে আমাকে সাহায্য করতেন। সারাদিন কাটল ছট্ফট্ করে। কত সব আজগুবী প্ল্যান আসত মাথায়। তখন ওখানকার জজসাহেব ছিলেন বাঙালী। তাঁর কাছে গিয়ে যদি কেঁদে পড়ি, তিনি কি এর একটা বিহিত করবেন না? আবার ভাবতাম, কি করবেন তিনি? বাপ যার শত্রু, কে বাঁচাবে তাকে?
একদিন সকালে উঠে দেখলাম, বাবার বিছানাপত্তর বাঁধা হচ্ছে। কোলকাতা যাবেন। রওনা হবার মিনিট কয়েক আগে আমাকে ডেকে বললেন, চার-পাঁচ দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো। রাধার মাকে বলেছি, কটা রাত শোবে তোমার ঘরে।
রাধার মা আমাদের পুরনো ঝি। মা মারা যাওয়ার পর ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। চার-পাঁচ দিনের জায়গায় সাত-আট দিন কেটে গেল। তারপর ফিরলেন বাবা। রাত তখন আটটা কি সাড়ে আটটা। আমি নিজের ঘরেই ছিলাম। চাকর এসে বলল, বাবু ডাকছেন। বাবার ঘরে গিয়ে দেখলাম, উনি বসে আছেন চেয়ারে, আর ওদিকে জানলার ধারে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে একটা মহিলা। আমার সাড়া পেয়ে মুখ ফেরালেন। ব্লাউজের গলাটা অনেকখানি খোলা। তার উপর ঝলমল করছে জড়োয়া নেকলেস। দেখেই চিনলাম। সারা দেহে যেন আগুন জ্বলে উঠল। বাবা বললেন, পরী, তোমার মাকে প্ৰণাম করো।
আমার মা! সংসারে মা কি লোকের দুবার হয়? বিষিয়ে উঠল সমস্ত অন্তর। কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে শুনলাম, বলছেন আমার নতুন মা, “মেয়েটা তো বড্ড অসভ্য দেখছি। তুমি বলেছিলে ছেলেমানুষ। এ যে দেখছি হাতি।”
বাবার কথা শোনা গেল না। শোনবার প্রবৃত্তিও ছিল না।
এর পর যে দিন শুরু হল, বলতে গেলে মহাভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে। সে-সব থাক। যেটুকু না বললে নয়, তাই শুধু—
এক বাণ্ডিল ইনটারভিউ পিটিশন নিয়ে ঢুকলেন কিরণ হালদার, আমদানী-সেরেস্তার দু নম্বর ‘কেরানী। হঠাৎ খেয়াল হল আজ রবিবার। কয়েদীদের মোলাকাতের দিন। এসব দরখাস্ত এসেছে তাদেরই আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। গেটের বাইরে তারা অপেক্ষা করছে। আপাতত আমার কাজ হল ওই কাগজগুলোর উপর একটা করে ‘এম. সি.’ লিখে দেওয়া। সেটা হয়ে গেলেই সংশ্লিষ্ট কয়েদীদের নামের তালিকা তৈরি করবেন কিরণবাবু। তাই দেখে বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে খুঁজে খুঁজে লোকগুলোকে কুড়িয়ে এনে অফিসের সামনে বসিয়ে দেবে লাল ব্যাজওয়ালা রাইটারের দল। তারপর তাদের জেল-টিকেট পরীক্ষা করে দেখবেন ডেপুটি জেলর এবং আইনানুসারে যারা মোলাকাতের হকদার, তারাই শুধু দাঁড়াবে গিয়ে ইন্টারভিউ রুমের ‘খাঁচা’র পাশে।
গেটের পাশে ছোট্ট একখানা ঘর। মাঝখানে সূক্ষ্ম জালের বেড়া। তার ভিতরের দিকে দাঁড়াবে কয়েদীর লাইন, পাশাপাশি তিন চার জন, আর বাইরের দিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে তাদের স্ত্রী পুত্র ভাই বোন, মা মাসী, শ্যালক ভাগনের দল। দু প্রস্থ মিহি জালের ফাঁক দিয়ে চেনা মুখখানা দেখবার জন্যে দু তরফের কী ব্যর্থ প্রয়াস। যেটুকু দেখা গেল ঠিক চেনা গেল না। যাদের চোখের জোর কম, তাদের সার হল শুধু চোখের জল। তবু চলতে থাকে উঁকিঝুঁকি। তারপর শুরু হবে কথাবার্তা, অর্থাৎ বেপরোয়া কোরাস চিৎকার। একটি অল্পবয়সী বউ কী বলতে এসেছে তার সদ্য-জেলে-আসা স্বামীকে। বলা হল না। বললেও যাকে বলা সে শুনতে পেল না তার ভীরু কণ্ঠ। কেমন করে শুনবে? তারই ঠিক গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই হুঙ্কার ছাড়ছে কোন্ গ্রামের মোড়ল, জানিয়ে দিচ্ছে তার একদা প্রতিবেশী অধুনা জেলখাটা বন্ধুটিকে : “তোমার বাড়ি ঘর সব নিলাম হয়ে গেছে। ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে আব্বাস সরদারের ছেলেগুলো। কী করবে বলো?”
উত্তর শোনা গেল না। ওদিকে কোণের দিকে কোনো রকমে একটু জায়গা পেয়েছে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলে। পাড়ার কার সঙ্গে এসেছিল কয়েদী বারাকে জানাতে—তিনমাস মাইনে দিতে পারে নি বলে ইস্কুলের খাতা থেকে নাম কেটে দিয়েছেন হেডমাস্টার।
তার অশ্রুভেজা কথাগুলো ডুবিয়ে দিয়ে ঠিক পাশ থেকে ফেটে পড়ল একটা মোটা ভাঙা গলা—”মজাসে রহ ভাইয়া। ইধার সব ঠিক হ্যায়।” স্বনামধন্য গ্যাঙ-সরদার। ডাকাতি মামলায় বেরিয়ে গেছে আইনের ফাঁক দিয়ে। কিন্তু জনকয়েক অনুচরকে বাঁচাতে পারে নি। তাদেরই একজনকে আশ্বাস দিয়ে গেল : ওদিকে সব ঠিক, মজাসে রহ
কয়েদী আর তাদের আত্মীয় বন্ধু –এই দুই দলের মাঝখানে ঘড়ি ধরে বসে আছেন ডেপুটি জেলর। তাঁরই নির্দেশে একজন সিপাই পাঁচ-সাত-দশ মিনিট পর পর বাইরের দিক থেকে সরিয়ে দিচ্ছে এক-এক দল দর্শনার্থী। নতুন দল এসে দখল করছে তাদের শূন্য স্থান। যারা চলে যাচ্ছে, তাদের অনেকেরই চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। তার সবটাই কি প্রিয়জন-মিলনের আনন্দাশ্রু? হয়তো তা নয়, আরও কিছু আছে। যাকে দেখতে এলাম, ভালো করে দেখা হল না, শোনা গেল না তার গলার স্বর, শোনানো গেল না আমার যা বলবার কথা।
তবু হয়ে গেল ইন্টারভিউ। রবার স্ট্যাম্পের ছাপ পড়ল কয়েদীদের টিকিটে। আবার দেখা হবে সেই দুমাস পরে যদি পরিষ্কার থাকে টিকিটের পাতা, অর্থাৎ কারা-অপরাধের কোনও শাস্তির আঁচড় না লাগে তার গায়ে।
কিরণবাবু বিদায় নেবার পর অপর্ণার দিকে যখন তাকাবার ফুরসত হল, সেও দেওয়াল-ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, দশটা বাজে। আজকের মতো উঠি। আপনারও কাজের সময়, আমারও আজ কাপড় কাচার ফাইল। আসবার সময়েই মনে করে দিয়েছেন জমাদারনী।
আমিও সায় দিলাম : বেশ তাই এসো। আমার কাজ না হয় কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা যেত, কিন্তু ওই কাপড় কাচা, মানে জেলের রুটিন ঠেকানো যাবে না।
আর একটু পরিষ্কার করে বললাম, তুমি হয়তো ভাবছ, আমি ময়লা কাপড় পরে থাকব, তাতে সরকারের কী আসে যায়? কিন্তু না, ওটা একটা অপরাধ, যাকে বলে জেল অফেন্স, তার আবার শাস্তি আছে নানা রকম।
আমাকে শাস্তি দিতে পারবেন আপনি? কৌতুকভরা সুরে জিজ্ঞাসা করল অপর্ণা।
কেন পারব না?
একদিন পরীক্ষা করে দেখতে হবে। —বলে হাসতে হাসতে উঠে পড়ল।
পরের সপ্তাহে তিনবারে, অর্থাৎ পুরো তিনটে সিটিং দিয়ে অপর্ণা তার কাহিনী শেষ করল। জেলখানার অফিস। মাঝে মাঝে খাতাপত্র-ফাইল হাতে বাবুদের আনাগোনা, যখন তখন সিপাই-সান্ত্রীদের বুটের ঠকাস। তারই মধ্যে বসে একটি মেয়ে বলে যাচ্ছে তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস। সে কাহিনী সবাইকে বলবার মত নয়। তার মধ্যে দুঃখ আছে, লজ্জা আছে, আর আছে তার তরুণ হৃদয়ের কত সাধ ও স্বপ্ন। স্থানকাল ও পরিবেশ কোনোটাই তার প্রকাশের অনুকূল নয়। তাই হয়তো সব কথা সে বলতে পারে নি। যেটুকু বলেছিল, দীর্ঘদিনের ব্যবধানে তার অনেকখানি আজ হারিয়ে গেছে আমার মন থেকে। তা ছাড়া যে ভাষায়, অন্তরের যে উত্তাপ দিয়ে সে একটার পর একটা ঘটনা * তুলে ধরেছিল আমার চোখের উপর, তার যথার্থ রূপায়ণ আমার এ লেখনীর পক্ষে ব্যর্থ প্রয়াস। তবু যে লিখছি, তার কারণ সেই চিঠি। সে কথা আসবে আরও অনেক পরে
অপর্ণার নতুন মা এসেই সংসারের ভার নিলেন, এবং তাঁর প্রথম কাজ হল অনেক কালের ঠাকুরকে জবাব দেওয়া। তিনটে লোকের সংসার, তার মধ্যে দুটো মেয়েছেলে। ঠাকুর-ঝিয়ে কী হবে? নিজেই এগিয়ে গেলেন উনুনের ধারে। অপর্ণাকে যেতে হল তাঁর সাহায্যে। এটা তোলা, ওটা নামানো, হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়া, যখন যা দরকার। না গেলে চলবে কেন? দু দিন না যেতেই চাকা উল্টে গেল। তখন ওই সাহায্যটাই পড়ল গিয়ে গৃহিণীর হাতে আর অপর্ণার হাতে উঠল হাতা বেড়ি ডেকচি আর কড়া। মা থাকতে এবং তার পরেও মাঝে মাঝে দু-একবার শখ করে ছাড়া রান্নাঘরে সে কখনও যায় নি। দরকার হয় নি, অভ্যাসও ছিল না। তাই আজ পদে পদে তার ত্রুটি, এবং তার নগদ পাওনাও হাতে হাতে : কী করেছ এতদিন! সামান্য দুটো ভাত ফোটাতেও শেখায় নি তোমার মা? বিয়ে দিলে তো তিন ছেলের মা হতে! খেতে বসে ফেটে পড়েন কোন কোন দিন, এটা কি রেঁধেছ; ডালনা, না গোরুর জাবনা?
মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করত অপর্ণা। কিন্তু সে শুধু মনে মনে। এ কথা সে জানত, একটা কিছু বলতে গেলেই অনেক কিছু বলতে হয় এবং তার পরে তার খেই থাকে না। হাতিয়ার দিয়ে যে লড়াই তার শেষ আছে, কিন্তু কথার লড়াই একবার শুরু হলে আর থামতে জানে না। সেইটাই সে প্রাণপণে এড়িয়ে চলতে চায়। মাকে দেখেছে, কথা যত তিক্ত যত রূঢ়ই হোক, উত্তরে কোনোদিন মুখ না-খোলা, এই যেন ছিল তাঁর পণ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে পণ তাঁর অটুট ছিল। কিন্তু সবাই কী সব পারে, না এড়াতে চাইলেই সব এড়ানো যায়?
একদিন সন্ধ্যার আগে নিজের ঘরে বসে চুল বাঁধছিল অপর্ণা। নতুন মা এসে বললেন, আলমারির চাবিটা একটু দাও তো।
কোন্ আলামরি?
ওই যে, ও-ঘরে যেটা আছে।
অপর্ণা বুঝল, একে একে সবটাই দখল হয়ে গেছে, এবারকার লক্ষ্য তার মায়ের কাপড়ের আলমারি, যার মধ্যে সেদিন সে সরিয়ে রেখেছে লুটের হাত থেকে বাঁচানো সেই চার-পাঁচখানা অলঙ্কার। ওটুকু যেমন করে হোক রক্ষা করতেই হবে।
নতুন মা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন: কী ভাবছ এত?
ওতে তো সংসারের কোন জিনিস নেই।
তবে কী আছে?
আছে মার খানকয়েক কাপড় আর সামান্য দু-একটা গয়না
সেইগুলোই দেখতে চাই।
অপর্ণা একটু ভেবে নিয়ে বলল, থাক না। ও দিয়ে আর কী দরকার আমাদের?
তোমার দরকার না থাক, আমার থাকতে পারে।
মাথার ভিতরটা জ্বলে উঠল অপর্ণার। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত রেখে সহজ সুরেই বলল, ওগুলো মা আমাকে দিয়ে গেছে।
এবার রুখে উঠলেন নতুন মা : তোমাকে দিয়ে গেছেন মানে! কী অধিকার ছিল তার দিয়ে যাবার? এ সংসারে যা কিছু সব এখন আমার। এইটুকু বোঝবার বয়স তোমার হয় নি তা নয়।
অপর্ণা চুল বাঁধতে লাগল। কোনো জবাব দিল না। তিনি বীরদর্পে এগিয়ে এসে বললেন, চাবি দেবে কিনা জানতে চাই।
অপর্ণা তেমনিই নিরুত্তর। নতুন মা গর্জে উঠলেন : এত সাহস তোমার! আচ্ছা আসুক ও, দেখি কোথায় থাকে তোমার তেজ। ঘাড় ধরে যদি না—
বলতে বলতে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরেই অপর্ণার কানে গেল নতুন মা’র উত্তেজিত কণ্ঠস্বর এবং সঙ্গে সঙ্গে চাপা কান্নার আওয়াজ। বুঝল বাবা অফিস থেকে ফিরেছেন। মিনিট কয়েক যেতেই তিনি এলেন তার ঘরে। বিরক্তির সুরে বললেন, গয়না কাপড় নিয়ে কী ঝঞ্ঝাট বাধিয়েছিস তোর মা’র সঙ্গে? চাবি চেয়েছিল, দিয়ে দিলেই তো পারতিস!
কোন উত্তর না পেয়ে আর একটু এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন, আহা, তোকে যা দেবার সে আমি দেব। ওই তোর সম্বল, আর কিছুই পাবি না—এ কথা মনে করিস কেন? মা নেই, আমি তো রয়েছি।
অপর্ণার চোখে জল এসে গেল। বাবার নজরে পড়তেই বলে উঠলেন, এই দেখো, কাঁদবার কী হল! বলেছি তো, আমি যখন রয়েছি, গয়না-টয়না যা তোর চাই—
কিছু চাই না আমি—অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল অপর্ণা: যা পরে আছি, সব খুলে দিচ্ছি, নিয়ে যাও। কিন্তু ওইটুকু আমার মার হাতের শেষ চিহ্ন। ও আমি কিছুতেই দেবো না। উচ্ছ্বসিত কান্নার বেগ আর রোধ করতে পারল না। তার বাবা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন বিহ্বলের মতো। তার পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন।
অপর্ণা বলেছিল, এর পর কী রকম ছট্ফট্ করে যে আমার দিনরাতগুলো কাটত, আপনাকে বোঝাতে পারব না! আমি জানতাম, বাবার এ যাওয়া শুধু দুদিনের জন্যে। ওদিকের তাড়নায় আবার তাঁকে আসতে হবে। এ তো শুধু গয়না-কাপড়ের লোভ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশী অনেক গভীর। মাকে শেষ করেই এদের আশ মেটেনি, তার সমস্ত চিহ্ন এরা মুছে ফেলতে চায়। আমাকে এরা দাসীর মতো খাটিয়ে নিচ্ছে, উঠতে বসতে লাঞ্ছনার শেষ নেই। তাও হয়তো সয়ে যেত। কিন্তু আমার মায়ের সেই চরম মৃত্যু সইব কেমন করে? কেমন করে দেখব, দু দিন আগে যেসব ছিল, সবখানে ছিল, জুড়ে ছিল এই বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি খাট-পালঙ আসবাবপত্তর, আজ সে কোনখানে নেই! এ যে আবার তাকে নতুন করে হারানো। তারপর এ বাড়িতে আমি থাকব কেমন করে? তাই স্থির করলাম, আমাকে যেতে হবে। কোথায় যাব, কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব, জানি না। এইটুকু শুধু জানি, আমাকে যেতেই হবে। যত বিপদ, যত দুঃখই আসুক, না গিয়ে আমার উপায় নেই।
`স্বীকার করতে বাধা নেই, কারণ যতই বড় হোক, অপর্ণার এই চলে যাবার সংকল্প হঠাৎ যেন ধাক্কা দিয়েছিল মনের মধ্যে। ওই বয়য়ের একটি সাধারণ গৃহস্থ ঘরের কুমারী মেয়ের মুখে এই ধরনের উক্তি আমাদের অভ্যাসে বাধে। তার মূলে হয়তো বহু যুগের সংস্কার, কিংবা আরও কিছু। ঠিক কী যে মনে হয়েছিল, বলতে পারব না। কেমন একটা অস্বস্তির মতো। বোধ হয় সেই মনোভাব থেকেই প্রশ্ন করেছিলাম, তোমার বাবা যে পাত্র দেখছিলেন তোমার জন্যে, তার কী হল?
অপর্ণা হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে বলল, আপনার মনের কথা বুঝতে পেরেছি। তারই কোন একটি যদি জুটে যেত আমার কপালে, আপনি নিশ্চিন্ত হতেন। আমিও কী হতাম না? কোন্ মেয়ে চায় নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়াতে? কিন্তু সে রাস্তা আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার নতুন মা আসবার পর ও নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায় নি। যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিল না।
কিন্তু দিন কয়েক পর একদিন গভীর রাত্রে সত্যি সত্যিই যখন বেরিয়ে পড়লাম, পা দুটো আর চলতে চায় না। বুকের মধ্যে সে কী কাঁপুনি। একবার মনে হল ফিরে যাই। যে ঘর ছেড়ে এলাম, তার মধ্যে যত কষ্ট যত লাঞ্ছনাই থাক, তবু তো নিশ্চিত আশ্রয়। যে পথে চলেছি, সেখানে যে শুধু অজানা অনিশ্চয়। বুক চেপে ধরে আড়ষ্ট পা দুটোকে আবার চালিয়ে দিলাম। মাথা নেড়ে বললাম, না, যে ঘর ছেড়েছি সেখানে আর ফিরে যাওয়া যায় না। যেতে আমাকে হবেই।
বাবা গিয়েছিলেন চাঁদপুর না নোয়াখালি, একটা কী মামলায়। আমার নতুন মাও সকাল সকাল দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলেন। সেই হল আমার সুযোগ। সঙ্গে সামান্য কটা টাকা, দু-চারখানা জামাকাপড় আর সেই কখানা গয়না। কেবলই ভয় হচ্ছিল, কেউ যদি চিনে ফেলে! মেয়েদের গাড়িতে উঠি নি। বড্ড ফাঁকা। ভিড়ের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে চলে এলাম কলকাতায়।
অনেক ঘোরাঘুরির পর বারীনদার নতুন বাসায় যখন পৌঁছলাম, সে অবাক হল নিশ্চয়ই। কিন্তু চোখে মুখে তার কোন আভাস পাওয়া গেল না। ওর স্বভাবই ছিল অমনি। সামান্য একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে এলি?
কার সঙ্গে আবার? একলা!
ঠিকানা পেলি বুঝি মা’র কাছ থেকে?
তা ছাড়া আর কোথায় পাব? তুমি তো একটা চিঠি দিয়েও খোঁজ নিলে না!
এ অনুযোগের কোন উত্তর দিল না বারীনদা। দু মিনিট কী ভাবল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, ওখানকার সব কথাই শুনেছি। তারপর থেকেই বাড়ি খুঁজছিলাম। এই কদিন হল পেয়েছি। ভাবছিলাম এবার একবার যাবো। তার চেয়ে এই ভালই হয়েছে। কিন্তু —
আবার কিন্তু কিসের?
ভাবছি, সত্যিই ভালো হল কিনা! কেমন উদাস সুরে বলল বারীনদা। তারপর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, চল, তোর ঘর দেখিয়ে দি। চান-টান কর, ভাত আসবে কিন্তু হোটেল থেকে।
কাল থেকে আর আসবে না। গম্ভীরভাবে বললাম আমি। বারীনদা হঠাৎ বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকাল। বললাম, বাঃ, এত কষ্ট করে দু বেলা হাত পুড়িয়ে রান্না শিখলাম কি হোটেলের ভাত খাবার জন্যে?
ও! হেসে উঠল বারীনদা। মনে হল, খুশীই হয়েছে প্রস্তাব শুনে। পুরুষমাত্রেই বোধ হয় হয়ে থাকে।
বাগবাজারের একটা গলির মধ্যে একতলায় তিনখানা ঘর নিয়ে বাসা। বাকী অংশে থাকে বাড়িওয়ালা। সেদিকটা একেবারে আলাদা। বারীনের ঘরখানা বড়। তার পরেরটা তালাবন্ধ। ওর কী সব জিনিসপত্র থাকে। কোণের দিকের ছোট ঘরখানা অপর্ণার। এইখানেই শুরু হল তার নতুন জীবন।
দু-তিন দিন পরে দুপুর বেলা ঘরের মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে ছিল অপর্ণা, বারীন বাইরে থেকে বলল, পরী আছিস?
না, উড়ে গেছি! এসো না!
কয়েকখানা বই নিয়ে এলাম তোর জন্যে। নতুন বছর না পড়লে তো ইস্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না। তদ্দিন বসে না থেকে একটু-আধটু পড়াশুনা কর।
পড়াবে কে?
যেখানটা না বুঝবি, আমিই না হয় চেষ্টা করে দেখবো।
চেষ্টাটা করবে কখন? সারাদিনই তো খালি বাইরে আর বাইরে। আচ্ছা বারীনদা, মাসীমাকে নিয়ে এলে হয় না?
বড্ড একলা লাগছে, না?
না, তা কেন? উনি এলে বেশ হয়। গঙ্গাস্নানটান করতে পারেন।
বারীন আগের কথার জের টেনেই বলল, বেশী দিন আর একলা লাগবে না। ভাবছি তোকেও আমাদের কাজে লাগিয়ে দেবো।
কী কাজ তোমাদের?
যখন দেবো, তখনই দেখতে পাবি।
সকালের দিকে নানা দেশের লোক আসত বারীনের ঘরে। বেশীর ভাগই ওর বয়সী ছেলে। পাজামা ধুতি কোট প্যান্ট—বিচিত্র পোশাকে ভরে যেত ঘর। দরজা বন্ধ করে কী সব কথাবার্তা হত নানা ভাষায়। অপর্ণা সে সময়টা থাকত প্রায়ই রান্নাঘরের দিকে। ওদের টুকরো টুকরো কথা কানে যেত। যাবার আসবার পথে হঠাৎ কেউ হয়তো সামনে পড়ে যেত এবং সঙ্গে সঙ্গে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াত। বেশ মজা লাগত অপর্ণার। একদিন এমনি একটা দলকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসছিল বারীন, অপর্ণা হাসিমুখে তাকিয়েছিল সেই দিকটায়। বারীনের মুখে চিন্তার রেখা। হয়তো যে আলোচনা শেষ হয়েছে, তারই জের চলছিল মনের মধ্যে। কাছে এসে অপর্ণার দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। ম্লান হেসে বলল, কী দেখছিস?
দেখছিলাম এত জাতের মানুষও আছে কোলকাতায়!
বারীন তেমনি হেসে উত্তর দিল, এত জাত কোথায় দেখলি? ওরা সব একজাত।
একজাত মানে?
মানেটা না হয় আর একদিন শুনিস।
না, এখখুনি বলতে হবে।—মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল অপর্ণা।
বলার মতো নতুন কিছু নয়। সেই পুরনো কথা। দুনিয়ায় জাত আছে দুটো, হ্যাস্ আর হ্যাভ্-নস্। যাদের আছে, আর যাদের নেই। তুই আমি আর এরা সব সেই নেই–এর জাত।
অপর্ণার মনে পড়ল, এই ধরনের কথা আগেও বলত বারীন। বলত, সব মানুষ সমান। দেশের ধল-দৌলত জমি-জমা কল-কারখানায় সক্কলের সামনে অধিকার। সমিতির ছেলেমেয়েরা চুপ করে শুনত আর আড়ালে বলত বারীনদা কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট কাকে বলে অপর্ণা জানত না (এখনও জানে না), এইটুকু শুধু বুঝত, যারা খেটে খায় অথচ অনেক খেটেও খেতে পায় না, তাদের উপর ওর গভীর টান, আর যাদের আমরা বলি বড়লোক, তাদের উপর ও খুশী নয়।
সেই দিন বিকেলের দিকে নিজের ঘরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল অপর্ণা। রাস্তার মোড়ে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ নজর পড়তেই ছুটতে ছুটতে এল বারীনের ঘরে: সর্বনাশ হয়েছে বারীনদা!
কী হল?
বাবা আসছেন। দেখে মনে হল রাস্তার নম্বর খুঁজছেন।
বারীন মুহূর্তকাল কী ভাবল! তারপর ওর মুখের উপর গভীর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমার দিকে নয়, নিজের মনের দিকে বেশ করে চেয়ে দেখ পরী, তারপর বল, থাকবি, না ফিরে যাবি!
তুমি ক্ষেপেছ! ফিরে যদি যাব, তা হলে এলাম কেন? তবে তুমি যদি তাড়িয়ে দাও বাকীটুকু আর বলতে পারল না। বড় বড় জলের ফোঁটা বেরিয়ে এল চোখ ছাপিয়ে।
বারীন হেসে ফেলল : পাগল কোথাকার! যা তোর ঘরে যা। আমি ওঁকে এখান থেকে বিদায় করে দেবো।
যদি খুঁজে দেখতে চান?
বারীনের মুখে পড়ল চিন্তার ছায়া। বিড়বিড় করে বলল, অসম্ভব নয়….আচ্ছা….বাইরে তোর কাপড়-জামা জুতো-টুতো যা কিছু সব নিয়ে আয়।
কি হবে?
নিয়ে আয়, তারপর বলছি।
দরজার উলটো দিকে ও-দিকের দেওয়ালে ছিল একটা কাঠের কপাট-দেওয়া দেওয়াল-আলমারি। বেশ খানিকটা উঁচু; গভীরও অনেকখানি। তালাটা খুলে ফেলল বারীন। জিনিসপত্র যা ছিল সব সরিয়ে ফেলল। ঘুণে ধরা দুটো তাক একটু টানতেই খুলে এল। ততক্ষণে বাইরে কে কড়া নাড়ছে। অপর্ণাও এসে গেছে তার জামা-কাপড় নিয়ে। বারীন খোলা আলমারিটা দেখিয়ে বলল, ঢুকে পড়।
ওমা! ওর মধ্যে বন্ধ করবে নাকি?
তা না হলে আর ঢুকতে বলছি কিসের জন্যে?
দম আটকে মরি যদি?
সে তখন দেখা যাবে! আর দেরী করিস না। ওদিকে শুনছিস তো কড়ানাড়ার শব্দ?
অপর্ণা জামা-কাপড় নিয়ে ভয়ে ভয়ে সেই আলমারির গর্তে ঢুকতেই বারীন আস্তে আস্তে পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিল। ছোট তালাটা সরিয়ে একটা বড় তালা লাগিয়ে দিল, যাতে করে কপাট দুখানা এঁটে না বসে।
অপর্ণার বাবা এসে বসলেন সামনের বারান্দায়। কোন রকম ভূমিকা না করেই বললেন, পরী কোথায়?
পরী!
হ্যাঁ! পরীকে চিনতে পারছ না? শ্লেষতিক্ত উত্তর।
আজ্ঞে, তা পারছি বইকি। কিন্তু পরী কোথায় তা আমি কেমন করে জানব?
তুমি বলতে চাও, সে এখানে আসে নি?
কী আশ্চর্য! এখানে এলে আমি তাকে লুকিয়ে রাখব?
তা তুমি পার। সমস্ত বাড়ি সার্চ করব।
বেশ তো, করুন না? পরী কি বাড়ি থেকে না বলে চলে গেছে?
হ্যাঁ, চলো। কখানা ঘর তোমার বাসায়?
এই তো তিনখানা।
সব ঘরগুলো দেখলেন ভদ্রলোক। রান্নাঘর, কলতলা, বাথরুম। কয়লা রাখার ছোট্ট খুপরিটাও বাদ দিলেন না। অপর্ণার ঘরে গিয়ে বললেন, এখানে কে থাকে?
আমার এক বন্ধু।
একটা মেয়েদের চিরুনি পড়ে ছিল তাকের উপর। সেটা তুলে নিয়ে বললেন, এটা কার?
আজ্ঞে তারই। বড় চুল রাখে বলে—
ও-ও! বলে চিরুনিটা রেখে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
ফিরে এসে বারান্দার সেই চেয়ারটায় যখন বসলেন, আলমারির ফাঁক দিয়ে যতটা দেখা যায়, অপর্ণার মনে হল অনেকখানি মুষড়ে পড়েছেন বাবা। বারীন দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক পাশেই। তার দিকে চেয়ে যখন বললেন, এক গ্লাস জল খাওয়াতে পার? গলাটা বড্ড ক্লান্ত শোনাল। জলের গ্লাসটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে খানিকটা যেন দম দিয়ে বললেন, কী করি বল তো বারীন? বড্ড আশা করে এসেছিলাম—তোমার এখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। দেখেছি তো, সেই ছোট থেকে তোমার ওপর বেজায় টান। বারীনদা বলতে অজ্ঞান। কোথায় গেল মেয়েটা!
অপর্ণার বুকের ভিতরটা একবার নড়ে উঠল। কিন্তু সে শুধু ওই একটি বার। পরক্ষণেই মনে পড়ল তার মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলো। স্পষ্ট অনুভব করল, মুখের পেশীগুলো যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। বারীনের গলা শোনা গেল : মামাবাড়ি যায় নি তো?
সেখানে যাবে কার কাছে! সব মরে-হেজে গেছে। ছোটমামাটা এখানেই থাকে, বেলেঘাটায়। তাকে বোধ হয় ওর মনেও নেই। তবু কথাটা যখন তুললে, ঘুরে যাই একবার।
উঠতে গিয়ে বারীনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—আচ্ছা তুমি কি বল, পুলিসে একবার–
অপর্ণা চমকে উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে কান খাড়া করে রইল উত্তরের অপেক্ষায়। বারীন যেন অনেক ভেবেচিন্তে মাথা নেড়ে বলল, সেটা কি ভালো হবে?
বাবা সায় দিলেন। আমিও তাই ভাবছিলাম। কেলেঙ্কারি তাতে বাড়বে ছাড়া কমবে না। আর বসে কী হবে? উঠি। তুমি কিছু মনে কোরো না বারীন।
না, না, আমি কী মনে করব? ভাবছি ভয়ানক কিছু একটা না ঘটলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, পরী তো সে রকম মেয়ে নয়!
অপর্ণার মনে হল, তার বাবা যেন হঠাৎ রুক্ষ চোখ তুলে বারীনকে একবার দেখে নিলেন। তারপর ছাতাটি তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন।
অপর্ণা ভেবেছিল, আলমারি খোলবার পর দুজনে মিলে খুব এক চোট হেসে নেবে। প্রাণভরে উপভোগ করবে এই প্রহসন-নাটকের সবটুকু রস। কিন্তু এ কী হল! দুজনে যেন চোখ তুলতেই পারল না দুজনের দিকে। বারীনের মুখে যে কুঞ্চনরেখা দেখা দিল, সেটা হাসি নয়, হাসির প্রয়াস। আড়চোখে একবার তাকিয়েই মাথা নিছু করে নিজের ঘরে চলে গেল অপর্ণা।
তাকের উপর রাখা ছোট আরশিটায় নজর পড়তেই চমকে উঠল, কেমন যেন থম্থম্ করছে চোখ-মুখ, সবটা জুড়ে ফেটে পড়ছে রক্ত।
সেই দিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর গয়নার পুঁটুলিটা হাতে করে বারীনের ঘরে গিয়ে বলল, এটা রাখো।
কী ওটা?
দেখোই না।
বারীন একবার উঁকি দিয়েই বুঝতে পারল এবং কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখে আর কী করব বল? গয়না পরবার ভাগ্যই যদি হবে, তবে কলিকালে না এসে জন্ম নিতাম রামায়ণের কালে। কেউ একজন এসে কেয়ূর-কুণ্ডল-কণ্ঠাভরণে সাজিয়ে দিত। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে চলে যেতাম যুদ্ধে।
তার জন্যে আপসোস কিসের? খোঁজ করলে ‘কেউ একজন’ তো এ কালেও পাওয়া যায়। কেয়ূর-কুণ্ডল নাই বা হল, এ যুগের যা সাজ—
এই যেমন ময়লা ধুতির উপর ছেঁড়া শার্ট, তার নীচের পকেটে দুখানা শুকনো রুটি আর বুক-পকেটে একটা দু-টাকা দামের ফাউন্টেন পেল, কী বলিস?
শুধু কী তাই?
তা ছাড়া আর কী? এই সাজে সাজিয়ে তো আমাদের গৃহলক্ষ্মীরা বীর পুরুষদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন প্রতিদিন বেলা দশটায়।
অপর্ণার দৃষ্টি হঠাৎ উদাস হয়ে এল। ধীরে ধীরে বলল, যারা পাঠাচ্ছে আর যাদের পাঠাচ্ছে তারা হয়তো এতেই সুখী। তুমি তার কী বুঝবে!
হুঁ। সে সুখের চেহারাটা যদি দেখতিস একবার? কেমন একটা করুণ ছায়া পড়ল বারীনের মুখের উপর
অপর্ণা বলল, সুখ জিনিসটা কি বাইরে থেকে দেখলেই চেনা যায় বারীনদা? থাকগে ও-সব বাজে কথা। ধরো তাড়াতাড়ি। ঘুম পেয়েছ, শুতে যাবো।
কী হবে ও দিয়ে?
বাঃ, সব প্ল্যান ভুলে গেলে। খাওয়াটা না হয় তোমার হোটেলেই চলছে, আর সব খরচপত্তর? তারপর ইস্কুলে ভর্তি হলে তো এককাঁড়ি টাকা লাগবে মাসে মাসে।
আচ্ছা সে যখন লাগবে তখন দেখা যাবে।
এখন রেখে দিতে ক্ষতি কি?
বারীন যেন মুহূর্তমধ্যে বদলে গেল। খানিকক্ষণ কী ভাবল। তার পর শুষ্ক মুখে আস্তে আস্তে বলল, ক্ষতি হতে কতক্ষণ! আমার যে প্রতি মুহূর্তেই টাকার দরকার।
অপর্ণা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এবার মেঝের উপর বসে পড়ে অন্তরঙ্গ সুরে বলল, বারীনদা, তোমার সব কথা আমাকে বলবে না?
কোন্ সব কথা? মৃদু হেসে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল বারীন।
এক নম্বর হল, কিসের জন্যে তোমার টাকার দরকার?
কিসের জন্যে? প্রশ্নটা যে নেহাত বোকার মত হল পরী। এ দরকারের কী আর শেষ আছে? যাদের অনেক আছে তাদেরই নেই, আর আমার তো একেবারে হ্যাভ-নস্।
ও-সব যা-তা বলে বুঝিয়ে দিলে আমি শুনব না। তোমাকে বলতেই হবে তুমি কী কর, কোথায় যাও, কোত্থেকে তোমার টাকা আসে, আর সে সব যায় কোথায়!
বাপ রে, তুই যে রীতিমত আমার গার্জেন হয়ে উঠলি!
ঠাট্টা রাখো। না বললে আমি উঠবই না এখান থেকে।
বলব রে বলব। এত ব্যস্ত কিসের? শুধু বলা কেন, তোকে বোধ হয় টানতেও হবে আমাদের দলে। কিন্তু
আবার গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ল বারীনের মুখের উপর। অপর্ণা অপেক্ষা করে রইল। ওর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল বারীন, কিন্তু সব কথা শুনে যখন মনে হবে, বারীনদা যা করে সে সব ভালো কাজ নয়, দেখে দেখে যখন ঘৃণা হবে আমার ওপর
ঘৃণা! বলেই বিস্ময়ে বেদনায় নির্বাক হয়ে রইল অপর্ণা। তারপর বলল, তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল না হতে পারে, কিন্তু তাই বলে ঘৃণা করব তোমাকে! আমি! এত বড় কথাটা তুমি মুখ ফুটে বলতে পারলে বারীনদা?
বলতে বলতে গলাটা তার করুণ হয়ে উঠল। বারীন কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তার মুখের পানে। তারপর তেমনি মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, আর বলব না। হল তো? যা এখন শুতে যা। রাত হয়েছে।
ডান হাতখানা দিয়ে মৃদু আঘাত করল ওর পিঠের উপর। অপর্ণা আর কিছু বলতে পারল না। চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেল।
পরদিন ঘুম ভাঙতে বেলা হল। তার আগেই যথারীতি বেরিয়ে গেছে বারীন। মুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে যাবার আগে একটু পড়াশুনা নিয়ে বসেছিল অপর্ণা। বাইরের দরজায় কড়া নড়ে উঠল। ঠিকা ঝি বাসন মাজছিল। উঠে গিয়ে খুলে দিতেই ভিতরে ঢুকল বারীনের পাঞ্জাবী বন্ধু শরণ সিং। অপর্ণা তাকে দেখেছে কয়েকবার। কিন্তু কথাবার্তা হয় নি। কী বলবে, কোন্ ভাষায় বলবে, তাই ভাবছিল। ওকে ইতস্তত করতে দেখে নিজেই এগিয়ে এল শরণ এবং পরিষ্কার বাংলায় বলল, এই সুটকেস আর এই টাকাটা বারীনকে দেবেন। বলবেন, দু-জোড়া দুল ছাড়া আর কিছু বিক্রি হয় নি।
অপর্ণা সুটকেস আর খামটা ওর হাত থেকে নিয়ে বলল, আপনি একটু বসুন না। বারীনদা এখনি আসবে।
না। আমাকে এই সাড়ে নটার ট্রেনে বাইরে যেতে হচ্ছে। দশ-বারো দিন পরে ফিরছি। তারপর এসে দেখা করব।
চাবি সঙ্গেই ছিল। নিজের ঘরে গিয়ে অপর্ণা খুলে ফেলল সুটকেসটা। একরাশ জড়োয়া গয়না ঝলমল করে উঠল। নেকলেস, আর্মলেট, টায়রা, ব্রেসলেট। একটা একটা করে তুলে ধরল জানলার সামনে। এত সুন্দর আর এরকম দামী জিনিস সে কোনদিন দেখে নি। বাক্সটার কোণের দিকে কাগজে জড়ানো এক বাণ্ডিল কার্ড। তার উপরে ইংরাজীতে লেখা—ইস্ট ইণ্ডিয়া জুয়েলারী এম্পোরিয়ম; নীচে রাস্তার নাম, নম্বর।
বারীন ফিরল এগারোটার পর। বাক্স আর টাকা বুঝিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল অপর্ণা, গয়নার দোকান আছে বুঝি তোমাদের?
গয়নার দোকান কি রে! রীতিমত জুয়েলারি এম্পোরিয়ম। জিনিস দেখলি তো?
দেখলাম।
কেমন লাগল?
খুব সুন্দর।
নিবি নাকি দু-একখানা?
রক্ষে করো বাপু।
রক্ষে করব? আচ্ছা করলাম। কিন্তু সবাইকে রক্ষে করলে আমাদের চলে না। কাউকে না কাউকে না মেরে উপায় নেই।
তার মানে?
বারীন উত্তর না দিয়ে হাসতে লাগল। অপর্ণার কৌতূহল বেড়ে গেল। তাড়া দিয়ে উঠল, কী, খালি হাসছ? বলো না কী বলছিলে?
ধরতে পারিস নি তো? ও সব নকল। সোনাটা কেমিক্যাল, আর পাথরগুলো মেকী।
অ্যাঁ, তাই নাকি!
কিন্তু তোর মতো অনেকেই বলে, খুব সুন্দর। তারপরে আর তাদের রক্ষা করি কি করে!
এই সব জোচ্চুরি ব্যবসা তোমাদের? দোকানে যেদিন পুলিস পড়বে তখন দেখো মজা।
দোকান কোথায়?
কেন, ওই যে কী একটা ঠিকানা দেখলাম!
তা একটা আছে বটে, তবে আসল দোকান হল এই সুটকেস।
তা হলে ওই কার্ডগুলোও ভুয়ো?
ভুয়ো বলি কেমন করে! একে ক্লাইভ স্ট্রীট, তার ওপর ফার্মের নামটাও জমকালো। বড় বড় খদ্দের ঘায়েল হয়ে যায়।
কিন্তু এ-সব কি ভালো হচ্ছে বারীনদা? বিপদে পড়তে কতক্ষণ!
বিপদ কোথায় নেই পরী? তোরা যাকে সৎপথ বা ন্যায়ের পথ বলিস, সেখানেও পদে পদে বিপদ। তা ছাড়া সে সব পথ তো আমাদের মত মানুষের জন্যে খোলা নেই।
খোলা নেই বলছ কেন? চাকরি-বাকরি কিংবা কোন একটা ব্যবসা-ট্যবসা করে কত লোক করে খাচ্ছে!
তা খাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশী লোক খাচ্ছে না। তার কারণ, যাকে আমরা বলি জীবন-সংগ্রাম সেখানে তোর ওই হাতিয়ারগুলো আর কাজে লাগছে না।
কেন?
সে ‘কেন’র ঠিক উত্তর আমার জানা নেই। তার চেয়ে চোখের ওপর যা দেখছি তাই বলতে পারি।
কি দেখছ চোখের ওপর? বলে গুছিয়ে বসল অপর্ণা।
বারীন বলল, একটু চোখ খুললে তুইও দেখতে পাবি, আমরা যে দেশে বাস করছি, সেটা হচ্ছে মস্ত বড় একটা তিনতলা ফ্ল্যাট-বাড়ি, যার একতলার সঙ্গে আর একতলার বিরোধ। একেবারে ওপরে যারা থাকে, তাদের অস্ত্র হল ধনবল; আর একদম নীচের তলায় যাদের বাস, তাদের সম্বল হচ্ছে বাহুবল। দুনিয়ায় টিঁকে থাকতে হলে এই দুটোই হল আসল অস্ত্র। মাঝখানে আছি আমরা। আমাদের ওর কোনোটাই নেই। থাকবার মধ্যে আছে মাথায় কিঞ্চিৎ মগজ, যাকে একদিন গর্ব করে বলতাম, বুদ্ধিবল। এতকাল তাই ভাঙিয়ে খেয়েছি। কলম আর গলার জোর দেখিয়েছি ইস্কুলে আর আদালতে; চোখ বুজে করে গেছি ডাক্তারি, মোক্তারি, মাস্টারি আর কেরানীগিরি, আর সে-সব যাদের জোটে নি, তারা করেছে—ওই, তুই যা বলছিলি, ছোটখাটো দোকানদারি। এখন তার কোনোটাতে জায়গা নেই। তাই ওই সোজা সরল প্রকাশ্য পথ ছেড়ে বুদ্ধিকে এবার নামাতে হয়েছে এই সব আঁকাবাঁকা গোপন পথে। বলে বাক্সটা দেখিয়ে দিল।
অপর্ণা নীরবে শুনে যাচ্ছিল। নীরব হয়েই রইল।
বারীন আবার বলল, লড়াই মাত্রেই তিন হাতিয়ার—ছল, বল আর কৌশল। বল যাদের নেই, তাদের সম্বল ওই বাকি দুটো—ছল আর কৌশল। এখানে যা দেখছিস, সে হচ্ছে তারই একটা নমুনা।
কিন্তু এ দিয়ে আর কতদিন চলে? এতক্ষণে সাড়া দিল অপর্ণা : ধরা একদিন পড়তেই হবে।
তা হয়তো হবে। তবু যতদিন চালানো যায়। তবে আমাদের তরফে সবচেয়ে বড় ভরসার কথা হচ্ছে এই, বলবান মাত্রেই কোনো একটা বিশেষ জায়গায় দুর্বল। অত বড় যে হাতী, তার চোখ দেখেছিস তো? তেমনি ওপরতলায় যারা থাকে, তাদের বড় বড় লোহার সিন্দুকগুলো নিরেট হলেও ঠিক নিশ্ছিদ্র নয়। খুঁজলে দেখা যাবে, কোথাও একটা দুর্বল ফাঁক রয়ে গেছে, সেখানে খোঁচা দিলে কিছু বেরিয়ে আসবে। সেইটুকু আমরা কুড়িয়ে নিই।
কিছুই বুঝলাম না তোমার কথা!
আচ্ছা এই যেমন ধর, স্বামী লাখপতি ব্যবসাদার। পয়সা কুড়িয়ে কুড়িয়ে গড়ে তুলেছে টাকার পাহাড়। ভয়ানক হুঁশিয়ার, কোন দিক দিয়ে কিছু বেরিয়ে না যায়। এদিকে স্ত্রীটিরও নেশা হল, চারটির জায়গায় পাঁচটি নেকলেশ, তিন সেটের ওপর আর এক সেট জড়োয়া ব্রেসলেট। নেশামাত্রেই গোপন পথ ধরে চলে। সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল শরণ সিং। যোগাতে লাগল নেশার উপকরণ—এই চমৎকার জড়োয়ার জোচ্চুরি।
কিন্তু সবার কাছেই কি আর জোচ্চুরি চলে? সন্দেহ প্রকাশ করল অপর্ণা, ওরা তো আমার মতো বোকা নয় যে ঠকবে!
সকলে না হলেও, অনেকেই তোর মতে ঠকে। বোকা বলতে যা বোঝায়, এ ঠিক তা নয়। কবিরা বলেন, স্ত্রীজাতির নাকি একটা তৃতীয় নয়ন আছে। হয়তো আছে। তবে এই গয়নার বেলায় তার তিনটে নয়নই অন্ধ। তাই এক টুকরো কাঁচের মধ্যে তাঁরা দেখতে পান চুনি-পান্নার ঝিলিক। ফলে আমাদের পকেটেও কিছু এসে যায়। একটা মুশকিল আছে।
কি মুশকিল?
ঢোকা বড় শক্ত। মহলটা দুর্ভেদ্য। শরণ সিং বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না।
অপর্ণা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, বাইরের দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। বারীন বেরিয়ে গেল খুলে দিতে। অপর্ণাও উঠে পড়ে বলল, ইস, অনেক বেলা হয়ে গেছে! এখন আবার যেন আড্ডা দিতে বোসো না, চান করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ও বেলা বেরোতে হবে, মনে আছে তো?
খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বেলা পড়তেই ওরা বেরিয়ে পড়ল। এর আগেও দু-তিন দিন বারীনের সঙ্গে বেরিয়েছে অপর্ণা। কিন্তু সে শুধু বেড়ানো, ঘুরে ঘুরে শহর দেখা। আজকের উদ্দেশ্য অন্যরকম। শ্যামবাজারের কাছাকাছি খাল পার হয়ে যে অঞ্চলে গিয়ে পড়ল তার নাম উল্টাডাঙ্গা। খোয়া-ওঠা ধুলোয় ভরা রাস্তা। দুধারে চওড়া খোলা ড্রেন। তার মধ্যে আলকাতরার মতো পাঁক। পাঁক বললে তাকে গৌরব দেওয়া হয়। বহুকাল থেকে সঞ্চিত বহু রকম কদর্য জিনিসের মিশ্রণে একটা আধা-তরল রাসায়নিক পদার্থ।
কোথায় নিয়ে এলে? নাকে আঁচল দিয়ে বিরক্তির সুরে বলল অপর্ণা।
বারীন হাসল তার সেই বাঁকা হাসি : আজব দেশ নয়। সেদিন যে-চৌরঙ্গী দেখে দিশেহারা হয়েছিলে–সেও যে শহর, এটাও সেই শহর। দুটোরই নাম কোলকাতা।
ময়লাগুলো সাফ করে না কেন?
মাঝে মাঝে করে বইকি। খানিকটা তুলে সাজিয়ে রাখে রাস্তার ধারে। তারপর সবাই মিলে পায়ে পায়ে সেগুলো নিয়ে তোলে রান্না আর খাবার ঘরে, সেখান থেকে—
চুপ করো তুমি—ধমকে উঠল অপর্ণা। বারীন এবার গলা ছেড়ে হেসে উঠল। ততক্ষণে তারা বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়েছে গলির মধ্যে। এখানে ওখানে আবর্জনার স্তূপ। দু-ধারে মাটির ঘর, উপরে খাপরা কিংবা টিনের ছাউনি। জাঁতার শব্দ কানে আসছে। কোন কোন বারান্দায় বসে ডাল ঝাড়ছে পশ্চিমী মেয়েরা। তারই ধূলোয় অন্ধকার হয়ে গেছে গলিপথ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। লোকগুলোর পরনে ঝুল-কালি-মাখা কাপড় অপর্ণার হঠাৎ মনে পড়ল, এই রকম কাপড় দেখেছিল ওদের বাসায় যায় যে ডালওয়ালা তার গায়ে। কী সুন্দর সোনামুগের ডাল! কিন্তু যে ন্যাকড়াটায় বেঁধে নিয়ে যায়, তার রঙও এই রকম। এইখানেই বোধ হয় থাকে সে লোকটা। বারীন বলল, এই হচ্চে উল্টোডাঙার ডালপট্টি।
এবার তারা পড়ল গিয়ে আর একটা গলির মুখে। ওরই মধ্যে একটু যেন পরিষ্কার ঘর-দোর। বাসিন্দারা প্রায় সকলেই মেয়েছেলে। সায়া-সেমিজ-ব্লাউজ-জ্যাকেটের বালাই নেই। বসন বলতে একখানা করে শাড়ি। সেটা অঙ্গাবরণ হলেও সর্বাঙ্গের আব্রুরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সেদিকে তাদের বিশেষ আগ্রহ আছে বলেও মনে হল না। অপর্ণা বুঝল, এরা সব যাকে বলে, নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোক। ফিসফিস করে বলল, এটা বোধ হয় ঝি-পাড়া!
বলে দ্যাখ না? জবাব দিল বারীন : দল বেঁধে তেড়ে আসবে। বড় বড় ধানকলে কাজ করে এরা। ঝি নয়, মজুর, মানে মজুরনী। তা ছাড়া সন্ধ্যার পরে অন্য ব্যবসা আছে।
সেটা আবার কী?
বারীন উত্তর দিল না, অন্য কথা পাড়ল। লজ্জায় মরে গেল অপর্ণা। আড়ালে জিভ কেটে মনে মনে বলল, ছি ছি, কী ভাবল বারীনদা!
একটা অপেক্ষাকৃত চওড়া গলিতে পড়তেই কানে এল তুমুল কোলাহল। নারী- পুরুষের মিলিত কণ্ঠ। তার ভাষাটা এমন স্তরের যে বারীনের সঙ্গে পাশাপাশি চলা বা তার মুখের দিকে তাকানো কঠিন হয়ে উঠল। কলহের উপলক্ষ্যটা এবার চোখে পড়ল, সামনেই একটা জলের কল। তখনও জল আসে নি। কিন্তু এরই মধ্যে নানা আকারের এবং নানা প্রকারের ভাণ্ড এসে জড়ো হয়েছে তার চারদিকে। তাদের মালিকরাও সশরীরে উপস্থিত এবং সকলেই ওই কল-সংলগ্ন জমিটুকুর প্রথম অধিকারের জন্য তৎপর। বিরোধের বিষয়টাও তাই। জনৈক বঙ্গরমণীর মাটির কলসী হটিয়ে দিয়ে কলের গায়ে বালতি বসিয়েছিল এক গামছা-সর্বস্ব বিহারী পুরুষ। বোধ হয় মনে করেছিল, যেহেতু তার গায়ের জোর বেশী, অতএব অধিকারটা বড়। কিন্তু মুখের জোর বলে যে একটা মারাত্মক অস্ত্র আছে, এবং সত্যি-সত্যি আক্রমণ না করে কেবলমাত্র আস্ফালন দেখিয়েও যে যুদ্ধ জয় করা যায়—এই কঠিন সত্যটা তার জানা ছিল না। এইবার জানল এবং অত বড় দেহটা নিয়েও একটা তীক্ষ্ণ রসনার তোড়ে শেষ পর্যন্ত হটে আসতে হল। বালতিটা কয়েক ইঞ্চি সরিয়ে দিয়ে তবে রক্ষা।
হঠাৎ কলের মুখ থেকে প্রথমে শোঁ শোঁ আওয়াজ, তার পরেই পট্পট্ শব্দে খানিকটা জল ছিটকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়ি কলসি ঘড়া বালতির দঙ্গলে এমন একটা জড়াজড়ি ঠেলাঠেলি এবং হুটোপাটি শুরু হল, যেটা অপর্ণার চোখে নতুন হলেও বস্তিবাসীদের জীবনে অতি সনাতন দৈনন্দিন ঘটনা! হঠাৎ নজরে পড়ল, এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খানিকটা দূরে বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি দশ-বারো বছরের ছেলে। দেখলেই বোঝা যায় সে তার খালি গা এবং ছেঁড়া হাফপ্যান্ট নিয়েও এদের সবার থেকে আলাদা। বারীন এগিয়ে গেল তার দিকে। চোখাচোখি হতেই ছেলেটির মুখে ফুটে উঠল একটুখানি সলজ্জ হাসি।
ইস্কুলে যাও নি হারু?
গিয়েছিলাম। ইতিহাসের স্যার আসেন নি, এক ঘণ্টা আগেই ছুটি হয়ে গেল।
এখন জল নেবে কেমন করে? আর একটু পরে এলে হত না?
দিদি বলল একটুও জল নেই।
আচ্ছা তুমি বাড়ি গিয়ে খবর দাও, আমি নিয়ে আসছি।
না না। আপনি নেবেন কেন?
বারীন ওর হাত থেকে বালতিটা নিয়ে বলল, বোকা ছেলে! তোমাকে যে এক ঘণ্টা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
হারু ছুটতে ছুটতে চলে গেল। বা রীন বালতি নিয়ে এগিয়ে যেতেই যারা একেবারে কল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করছিল, সকলেই একটুখানি সরে গিয়ে পথ করে দিল। বারীন একজনকে বলল, কিছু মনে কোরো না ভাই, আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে।
বালতিটা কলের নীচে বসিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা, তোমরা এমনি ধাক্কা-ধাক্কি না করে যদি একটা লাইন করে দাঁড়াও, তা হলে সকলেরই সুবিধে হয়।
একজন বলে উঠল, তা তো হয়, কিন্তু শোনে কে? আরও দু-চারজনের কাছ থেকেও ওই কথারই একটা অস্পষ্ট সমর্থন শোনা গেল। বারীন আর কথা বাড়াল না।
কল থেকে খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে আর-একটা গলি। দু-ধারে তেমনই খাপরা বা টিনের চালা। তার কোলে খোলা নর্দমা। এখানে সেখানে জড়ো হয়ে আছে আবর্জনার পাহাড়। বাড়ি-ঘর এবং লোকজনের চেহারা দেখলে মনে হয়, গৃহস্থ-বস্তি। বাঙালী, হিন্দুস্থানী, উড়িয়া নানা জাতের সংমিশ্রণ। খানিকক্ষণ চলবার পর একটা বাড়ির সামনে আসতেই একটি মধ্যবয়সী মহিলা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললেন ছি ছি, এ কী কাণ্ড বলো দেখি! তুমি কেন এত কষ্ট করে জল টানতে গেলে বাবা?
বারীন হেসে বলল, যা কুরুক্ষেত্র চলছে কলের গোড়ায়, হারুর সাধ্যি কি ঢোকে তার মধ্যে?
মহিলাটি আর একটা কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অপর্ণার দিকে নজর পড়তেই বললেন, এটি কে বাবা?
আমার বোন।
তোমার নিজের বোন?
নিজের বইকি। মাসীমার মেয়ে।
বাঃ, খাসা মেয়েটি তো। দাঁড়িয়ে কেন মা? এসো ভেতরে এসো। আর আসবেই বা কোথায়?—বলেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
নর্দমার উপরে একফালি তক্তা দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা। বারীনের হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে এল অপর্ণা। এক টুকরো বারান্দা, তার কোলে দুখানা ছোট ছোট ঘর। ভিতরটা রীতিমত অন্ধকার, তারই একখানার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা মোটা ভাঙা গলা : কে কথা বলছে?
আজ্ঞে আমি বারীন?
কখন এলে বাবা?
এই আসছি।
আমার জিনিসটা এনেছ?
বারীন জবাব দিল না। আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। মহিলাটি হাত নেড়ে কী একটা ইশারা করলেন। তারপর অপর্ণাকে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। মেঝের উপর ছেঁড়া একটা মাদুর পাতা। তার এক ধারে একরাশ দেশলাইয়ের কাঠি, পাশে কতকগুলো খালি খোল। দেখেই বোঝা যায়, কে একজন এখানে বসে কাজ করছিল, এইমাত্র উঠে গেছে। মহিলাটি এদিক ওদিক চেয়ে বললেন, কই, রেখা কোথায় গেলি?
পেছনের দরজায় একটা চটের পরদা। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, অপর্ণারই বয়সী একটি মেয়ে কাপড় বদলাচ্ছে। সাড়া দিল, এই যে যাচ্ছি। এবং সঙ্গে সঙ্গে পরদা সরিয়ে ঘরে এসে ঢুকল! পরনে একখানা কালোপেড়ে কোরা শাড়ি। মহিলাটি বললেন, আবার সেই ছেঁড়া কাপড়টা জড়িয়ে ছিলি! এত করে বললাম, ওটা পরিস না, ওতে গেরস্তের অকল্যাণ হয়। কেন, এই তো খাসা কাপড় এনে দিয়েছে বারীন।
রেখা মায়ের কথায় কান না দিয়ে অপর্ণার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, বসুন ভাই। আমরা কাজ করতে করতে গল্প করি। এই আপদগুলো আধ ঘণ্টার মধ্যে বিদায় করতে হবে—বলেই বসে পড়ে ক্ষিপ্রহাতে খোলের মধ্যে কাঠি পুরতে লেগে গেল। তারই ফাঁকে চোখ তুলে বলল, আপনাকে কিন্তু অনেকক্ষণ থাকতে হবে, তাড়াতাড়ি চলে গেলে চলবে না।
অপর্ণা বলল, বেশ তো। কিন্তু আমিই বা চুপ করে বসে থাকব কেন? দিন না গোটাকতক বাক্স। দেখি, পারি কিনা!
তা হলে তো ভালই হয়। গুনে গুনে ষাটটা করে কাঠি পুরবেন। কম-বেশি হলে হিসেব মিলবে না কিন্তু।
হেসে ফেলল দুজনে। মিনিট খানেক পরে রেখা জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি কোলকাতাতেই থাকেন?
না, এই মাসখানেক হল এসেছি।
মায়ের সঙ্গে?
আমার মা নেই।
দু মিনিট ছেদ পড়ল কথায়। তারপর আবার প্রশ্ন করল রেখা, এখানে আসবার আগে আপনার দাদা আমাদের কথা কিছু বলেন নি?
অপর্ণা মাথা নাড়ল; এবং এই না-বলার জন্যে মনে মনে ভারি রাগ হল বারীনের ওপর। রেখা বলল, বলবার আছেই বা কী? তা ছাড়া আমরাই তো শুধু নই, এ রকম কতো বাড়ি আছে, যেখানে ওঁকে যেতে হয়, কতো লোককে দেখতে হয়। এই পাড়াতেই, ধরুন না, তিন-চার ঘর—
পাশের ঘর থেকে একটা হুঙ্কার এসে বাকী কথাগুলো ডুবিয়ে দিয়ে গেল। শুধু হুঙ্কার নয়, তার সঙ্গে কদর্য গালাগালি। লক্ষ্যটা যে রেখার মা, সেটুকু অপর্ণারও বুঝতে অসুবিধা হল না। রেখার মুখখানা কঠিন হয়ে উঠল। হাতের কাজ থামিয়ে ওখান থেকেই গলা চড়িয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠল, বাবা!
সঙ্গে সঙ্গে ও-পক্ষের সুর নেমে গেল। অনেকটা যেন অনুযোগের ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক, অন্যায়টা কি বলেছি শুনি? তোমাদের সব হবে, আর আমার এক-ফোঁটা আফিম জুটবে না! আমি তো তোমাদের সংসার থেকে চাইছি না, বারীনের কাছে চাইছি, তাতে তোমাদের জ্বলুনি কিসের!
জ্বলুনি কি সাধে! তিক্তস্বরে বললেন রেখার মা, তোমার এক দিনের নেশায় যে পয়সা যায়, সেটা যে ভরগুষ্ঠীর দু দিনের খোরাক সে খবর রাখ? বারীন আর কত দেবে? তুমি কি কিছুই বুঝবে না?
শেষের দিকে গলাটা ভারী হয়ে উঠল। উত্তরে ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কী বললেন, ঠিক বোঝা গেল না। রেখা মাথা নীচু করে হাত চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো যেন দপ্ করে জ্বলে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অপর্ণার চোখে পড়ল, রাস্তার ওপারে দাওয়ায় বসে একজন মাঝবয়সী পশ্চিমা লোক একজোড়া কোটরগত ক্ষুধার্ত চোখ মেলে এই দিকে তাকিয়ে আছে। রেখা উঠে গিয়ে দড়াম্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার এসে বসল তার নিজের জায়গায়। অনেকটা যেন নিজের মনে বলল, এক মিনিট দোরটা খুলে রাখবার উপায় নেই!
অপর্ণা বলল, আপনারা কদ্দিন আছেন এ পাড়ায়?
তা হল বছর দুই। বাবা বিছানা নিলেন, তার পরেই চলে আসতে হল এই নরকে।
কী অসুখ ওঁর?
প্যারালিসিস। পা দুটো অচল হয়ে গেছে।
কাঠি ভরা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অপর্ণার হঠাৎ খেয়াল হল, এসে অবধি বারীনের কোনো সাড়া পায় নি। বলল, বারীনদাকে দেখছি না তো! গেল কোথায়?
আমাদের কাজেই গেছেন। মৃদু হেসে জবাব দিল রেখা, তৈরী ঠোঙাগুলো পৌঁছে দিয়ে নতুন কাগজ আনতে গেছেন। এসেই আবার এই বাক্সগুলো নিয়ে যাবেন ম্যাচ-ফ্যাক্টরীতে। আরও কিছু খোরাক আসবে আমার। যাবার সময় একবার উঁকি মেরে দেখে গেছেন, কদ্দূর হল!
তাই নাকি? কই সাড়া পেলাম না তো?
সাড়া দিলে তো পাবেন? নেহাত দরকার না হলে উনি তো কথা বলেন না! একটু ম্লান হাসি ভেসে উঠল রেখার আনত মুখের উপর। অপর্ণা বুঝতে পারল; ব্যথিত হল;
কিন্তু বিস্মিত হল না। বারীনকে আর কেউ না চিনুক তার তো চিনতে বাকি নেই। সে আসে যায়, কাজ দেয়, কাজ নেয়, একটি দুঃস্থ পরিবারের অন্নবস্ত্র যোগায়। তার ফাঁকে কখন কার গোপনমনে কিসের মেঘ জমে উঠল সে খবর সে রাখে না। হয়তো রাখবার ক্ষমতাই দেন নি তার বিধাতাপুরুষ।
খানিকক্ষণ পরে রেখা আবার একটা খাপছাড়া প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা বলুন তো ভাই, আমি কি দেখতে খুব বিচ্ছিরি?
এ কথার কোন উত্তর নেই। অসামান্য রূপসী না হলেও রেখা সুন্দরী, এবং নিজের সম্বন্ধে সে সচেতন ছিল না—এ কথা মনে করবার কারণ নেই। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে বলে উঠল, এই দেখুন, কী সব বাজে বকছি পাগলের মতো! আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, মেয়েটা কী বেহায়া! নিজের অবস্থা ভুলে যাই, মনে থাকে না, আমরা কত গরিব, শুধু গরিব নয় গলগ্রহ!
অপর্ণা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। অসংলগ্ন ভাবে শুধু বলে ফেলল, আপনি ওকে ভুল বুঝেছেন। ও একটা আস্ত পাগল।
পাগল না ভাই, পাথর! যাক গে, ওই যে উনি এসে পড়েছেন।
বারীন এসেই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার হল রেখা?
রেখা কোন কথা না বলে দেশলাইয়ের বাক্সগুলো তুলে দিল ওর হাতে। চকিতে একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে বলল, ঠোঙার কাগজ আনেন নি?
না, ওদিকটায় এখনো যাই নি। এবার আসবার সময় নিয়ে আসব। পরী, তোরা বসে গল্প কর, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসছি।
.
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরবার পথে বারীনের পাশে চলতে চলতে অপর্ণা জিজ্ঞাসা করল, এ রকম মক্কেল তোমার আর কত আছে বারীনদা?
মক্কেল কী রে?
ওই হল। মক্কেলরা দেয়, এরা না হয় নেয়। তবে কেউ কেউ আবার দেয়ও—অনেক কিছু দেয়। অনেক সময় নিজের যা কিছু আছে সব। কিন্তু সে সব তুমি দেখেও দেখতে পাও না।
বারীন হেসে বলল, তোর কথাগুলো ঠিক বাংলা নভেলের মতো। খুব পড়েছিস বুঝি?
পড়েছি বইকি—উষ্মার সঙ্গে বলল অপর্ণা, তবে কি জান, মানুষকে দুটো খেতে- পরতে দিলেই যারা মনে করে সব হল, তার আর কোন দুঃখ, কোন অভাব থাকতে পারে না, তারাই তোমার মতো সব-কিছু নাটক নভেল বলে উড়িয়ে দিতে চায়। আসলে সেটা জীবনকে এড়িয়ে চলা কিংবা তাকে ছোট করে দেখা। ..
হয়তো তাই। তবে ওই খাওয়া-পরার অভাবটা এত বড় যে, ওর কাছে অন্য কিছু চোখেই পড়ে না। তুই যে-সব দুঃখের কথা বলছিস সে-সব উৎপাত যে নেই তা বলছি না, কিন্তু সে বিলাস তাদেরই মানায়, ওই খাওয়া-পরার প্রয়োজন যাদের মিটে গেছে।
তুমি ভুল করছ বারীনদা। ওগুলো মোটেই বিলাস নয়। সব মানুষের জীবনেই আসে। যারা খেতে পাচ্ছে তাদেরই শুধু নয়, যারা পাচ্ছে না তাদেরও। তার চাক্ষুষ প্রমাণ তো এইমাত্র দেখে এলাম।
বারীন কোন উত্তর দিল না। বোধ হয় এড়িয়ে গেল কথাটা। বুদ্ধিমান এবং চক্ষুষ্মান হয়েও এই একটি জায়গায় সে অন্ধ। বুদ্ধি দিয়ে হয়তো বোঝে, হৃদয় দিয়ে বোঝে না। কথা বলতে বলতে তারা সেই পুলের কাছে এসে পড়েছিল। সেদিকে নজর পড়তে বারীন বলে উঠল, ওই যাঃ, বুড়ীর বাড়ি তো ফেলে এলাম!
কোন্ বুড়ী?
আছে এক পৈতে-কাটা বুড়ী। গেল সপ্তাহের পৈতেগুলোও পড়ে আছে। চল, একবার ঘুরে যাই।
—বলে আবার সেই পথেই ফিরে চলল বারীন। অপর্ণা চলতে চলতে বলল, তোমার টেবিলের ওপর কাগজের ঠোঙায় কতকগুলো পৈতে পড়ে আছে দেখছিলাম, ওইগুলো বুঝি?
হ্যাঁ, ওইগুলোই। আজও বোধ হয় আর এক ঠোঙা চাপবে।
বেশ মিহি আর মাজা সুতোর পৈতে। দেখে কিন্তু হাতে-কাটা বলে মনে হয় না।
তা হলে কী হবে, বিক্রি হয় না। কলের তৈরী পবিত্র জাপানী পৈতে না হলে তো আজকালকার সদ্-ব্রাহ্মণদের মন ওঠে না। কোনদিন শুনব, নারায়ণ-পূজোর তুলসী আসছে জার্মানী থেকে!
অপর্ণা হেসে ফেলল, এত সব উদ্ভট কথাও যোগায় তোমার মাথায়!
একতলা পাকা বাড়ি। দেওয়ালে চুন-বালি খসে পড়ছে। সামনের বারান্দায় কম্বলের আসনে বসে চোখে নিকেলের চশমা লাগিয়ে একজন বর্ষীয়সী বিধবা তকলি কাটছিলেন। পরনে পরিচ্ছন্ন সাদা থান। বারান্দাটি ধবধব করছে পরিষ্কার। বেশ একটি শুচিশুদ্ধ পরিবেশ। শীর্ণ মুখখানা ম্লান, কিন্তু কেমন একটা মমতা-মাখানো। একবার তাকালেই মাথা নুয়ে আসে। ওদের দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। অপর্ণা এগিয়ে গিয়ে প্ৰণাম করল। মহিলাটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বারীনের দিকে তাকালেন এবং পরিচয় পেয়ে সস্নেহে ওর চিবুক স্পর্শ করে আঙুল চুম্বন করলেন। বললেন, বড্ড ভালো দিনে এসেছ তোমরা। কালীঘাটে গিয়েছিলাম। মায়ের প্রসাদ রয়েছে ঘরে। এসো, ভেতরে এসো।
সামনেই একখানা মাঝারি আকারের ঘর। ওরা জুতো খুলে রেখে ভিতরে গিয়ে বসল। পাথরের রেকাবিতে করে সামান্য ফলমূল আর একটু সন্দেশ ওদের সামনে ধরে দিয়ে অপর্ণাকে উদ্দেশ করে বললেন, হাতে জল দিয়ে প্রসাদটুকু খেয়ে নাও মা। বারীন কিন্তু তোমার কথা একদিনও বলে নি। ও আমার ভারী চাপা ছেলে।
বারীন প্রতিবাদ করল না, নিঃশব্দে হাসতে লাগল।
ও কি এখানেই থাকে? — প্রশ্ন করলেন মহিলাটি।
বারীন বলল, না, এই কিছু দিন হল এসেছে।
অপর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আবার যেদিন আসবে, ওকে নিয়ে এসো। এক বেলা থাকবে আমার কাছে। বড্ড ফাঁকা লাগে একা একা।
শেষের দিকে কেমন কোমল এবং করুণ শোনাল কথাগুলো। বারীন বলল, বেশ তো, আর একদিন নিয়ে আসব। আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা রাখবেন। আজ কিন্তু আর বসর না মাসীমা। হ্যাঁ, আপনার পৈতে এবার একটাও পড়ে নেই। বেশ ভালো দাম পেয়েছি। বলে পকেট থেকে দুখানা এক টাকার নোট বের করে রাখল ওঁর পায়ের কাছে। উনি মনে মনে কী সব হিসাব করে মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু এতটা তো হতে পারে না! কত করে বিক্রি করেছ?
বারীন যে রীতিমত বিপদে পড়েছে, তার মুখ দেখেই অপর্ণার বুঝতে বাকী রইল না। কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকারে উনি বোধ হয় টের পেলেন না। সেই সুযোগ নিল বারীন। আমতা আমতা করে বলল, যাকে বেচতে দিয়েছিলাম সে ওই দু টাকাই তো দিয়ে গেল। হিসেব- পত্তর এখনও হয় নি। আজ কিছু দেবেন নাকি?
মাসীমা আর কিছু বললেন না। উঠে গিয়ে তাকের উপর রাখা একটি ছোট্ট বাক্সের ভিতর থেকে কাগজে জড়ানো একটা প্যাকেট বের করে এনে ওর হাতে দিলেন। তার পর আগের জায়গায় বসে পড়ে বললেন, তোমাকে তো অনেকবার বলেছি বাবা, তুমি যা করছ, আমার পেটের ছেলের চেয়েও বেশী। যেদিন আর পারব না সেদিন তো মাসীমার বোঝা তোমাকেই টানতে হবে। সেটা যতদিন ঠেকিয়ে রাখা যায়। এ থেকে যা আসে, ঠিক তাই আমাকে দিও। তাতেই আমার স্বচ্ছন্দে চলে যাবে।—এই বলে নোট দুখানা তুলে নিয়ে আঁচলে বাঁধলেন।
বাইরে থেকে কে বলে উঠল, বারীনবাবু, এসেছেন নাকি?
মাসীমার মুখখানা হঠাৎ অপ্রসন্ন হয়ে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ওকে আর কিছু দিও না বাবা। সোজাসুজি ভিক্ষে চাইতে যার মানে বাধে, অথচ ধার বলে হাত পাততে লজ্জা করে না, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। তোমার টাকা কি ও কোনোদিন ফিরিয়ে দেবে মনে কর?
বারীন হাসতে হাসতে বলল, ভরসা খুবই কম।
তবে?
ততক্ষণে ভদ্রলোক বারান্দায় উঠে এসে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়িয়েছেন। বারীন এগিয়ে গিয়ে বলল, কী খবর আপনার?
খুব ভালো খবর ব্রাদার। ম্যাঙ্গো সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিল সেদিন। বললে—বসাক, আমি খুব দুঃখিত। হেডক্লার্কের কথা শুনে হঠাৎ তোমাকে ছাড়িয়ে দিলাম। এইবার বুঝতে পারছি কত বড় ভুল করেছিলাম। এখন তো আমার হাতে কিছু নেই। তবে রেস্ট অ্যাসিওর্ড, কোন সেকশনে জায়গা হলেই তোমাকে নিয়ে নেবো। আরে বাবা, এইবার পথে এসো। জানতুম ডাকতেই হবে। এই শর্মা না হলে সুইনবার্ন কোম্পানির একটি দিন ও চলবে না। হেঁ-হেঁ—
বারীন বলল, আমি বলছিলাম, যদ্দিন ওটা না হয়, অন্য দিকেও চেষ্টা করলে ক্ষতি কি!
আরে না না। ওখানেই হবে। আর শুধু একটা মাস। হ্যাঁ, আসল কথাই তো বলা হয় নি। আজ আবার সামান্য কিছু দিতে হবে ব্রাদার। ছোট ছেলেটা জ্বরে ভুগছে, গিন্নীর কাপড় নেই, ঘর থেকে বেরুতে পারে না। আসছে মাসেই আপনার সব টাকা শোধ করে দেবো। এই চাকরিটা হতে যা দেরি।
আজ তো কিছু নেই। তিন-চার দিন পরে আবার আসব, তখন—
তিন-চার দিন! আচ্ছা কাল সকালে যদি আপনার বাসায় যাই একবার?
বারীন একটু ভেবে নিয়ে বলল, আজ্ঞে না, কাল পেরে উঠব না।
ভদ্রলোক যখন বারীনের সঙ্গে কথা বলছিল, অপর্ণা যতবার বাইরের দিকে তাকিয়েছে, প্রতিবারই চোখে পড়েছে একজোড়া কুৎসিত চোখের চুরি-করা চাউনি। এক সময় সেটা বোধ হয় মাসীমারও নজরে পড়ে গেল। উনি তখন ওর বাড়িঘরের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। কথার মাঝখানে হঠাৎ বলে উঠলেন, চলো, আমরা রান্নাঘরে গিয়ে বসি।
ফেরবার পথে এই পাঁচ মিনিটের দেখা বিধবা মহিলাটি অপর্ণার সমস্ত মন জুড়ে রইলেন। চলতে চলতে এক ফাঁকে প্রশ্ন করল, ওঁর বোধ হয় কেউ নেই?
বারীন বলল, আছে বইকি। ছেলে আছে এবং সে যে উপযুক্ত নয়—সে কথাও কেউ বলবে না।
অপর্ণা বিস্ময়ের সুরে বলল, কী করে লোকটা?
মস্ত লোক। ক্যালকাটা পুলিসের দারোগা। অ্যাদ্দিনে হয়তো ইনস্পেক্টার হয়ে গেছে, কিংবা হবো হবো করছে।
মাকে দেখে না?
সে তো দেখতেই চায়, উনি দেখা দিতে চান না।
দোহাই তোমার, হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা ভাষায় একটা কথা বলো দিকিন!
বারীন হেসে ফেলল, ঘটনাগুলো কি সোজা রাস্তায় ঘটে যে সোজা ভাষায় বলব? এই ওঁদের বেলাতেই দেখ। দারোগা মানুষ। থানার ওপরে মস্ত বড় সরকারী বাসা। মা বউ নিয়ে সচ্ছল সংসার। একদিন দরজার আড়াল থেকে মায়ের নজর পড়ল, একটা লোক ছেলের পা জড়িয়ে ধরে কী সব বলছে, কিন্তু ছেলে মোটেই আমল দিচ্ছে না। তার পর বেরোল একটা নোটের বাণ্ডিল। চলে গেল প্যান্টের পকেটে। সঙ্গে সঙ্গে জল হয়ে গেলেন দারোগাবাবু। বাইরে আসতেই চেপে ধরলেন মা : “কিসের টাকা তোর পকেটে?” ছেলের উত্তর ঠিক জানা নেই। আমতা আমতা করে হয়তো বলে থাকবে কিছু। হুকুম হল : “ফিরিয়ে দাও টাকা।” লোকটা ততক্ষণে চলে গেছে। তা ছাড়া ফিরিয়ে দিতে গেলে ব্যাপারটা হয়তো অন্য দিক দিয়ে জটিল হয়ে দাঁড়াবে। কে শোনে সে কথা? প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, “যে ছেলে ঘুষ খায়, তার মা নই আমি, তার বাড়িতে জলগ্রহণ করব না।” দারোগার মেজাজ তো! উত্তরে হয়তো কড়া কিছু বলে থাকবে। তার সঙ্গে আবার একটু ফোড়ন মিশিয়েছিলেন রউমা! ব্যস, এক কাপড়ে উঠলেন এসে ওই স্বামীর ভিটেয়। তার পর অনেকবার এসেছে ছেলে-বউ। পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু মায়ের পণ ভাঙাতে পারে নি।
অপর্ণা একমনে শুনছিল। এবার প্রশ্ন করল, তুমি ওঁর দেখা পেলে কেমন করে?
ওই পাড়ায় আমার অন্য মক্কেল আছে তো! তাদের খোঁজে এসে। খাসা নামটা দিয়েছিস, মক্কেলই বটে।
ওই পৈতে ছাড়া কি ওঁর আর কোন সম্বল নেই?
ছিল। খান-দুই ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। কিছু কিছু আসত। এখন আর আসে না। ভাড়াটের অবস্থা তো দেখলি।
ওই ওঁর ভাড়াটে! ওই জোচ্চরটা!
আহা, গালাগালি দিচ্ছিস কেন? জোচ্চুরি আবার করল কোথায়?
জোচ্চুরি নয়! ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা নেই, ইচ্ছেও নেই, তবু বলে ধার!
ওটা জোচ্চুরি নয়, চক্ষুলজ্জা। কী করবে বল? জাতটার নাম যে মধ্যবিত্ত—যাদের আদ্য মধ্য কোন বিত্তই নেই, অথচ ভদ্রতার খোলসটা ছাড়া চলে না। বিত্ত একেবারে নেই, তাই বা বলি কেমন করে? আছে এক ঝুড়ি অভিমান আর খানিকটা ফাঁকা মর্যাদাবোধ, তাই হাতটা সোজাসুজি না বাড়িয়ে একটু ঘুরপথে বের করে, যাকে বলে দেনার আড়াল দিয়ে দান গ্রহণ। সেটা তো শুধু ওর দোষ নয়, ওর জাতের ধর্ম। লোকটা যে ভদ্দরলোক। তাই তো তোকে বলছিলাম সেদিন, এই মাঝের তলায় যারা থাকে, তাদের মতো দুঃখী আর নেই।
বারীন যখন যা কিছু বলে তারই মধ্যে থাকে একটা প্রচ্ছন্ন পরিহাসের সুর। এটা তার চিরদিনের স্বভাব। কিন্তু এই শেষের কথাটা কেমন যেন গম্ভীর শোনাল তার কণ্ঠে। মনে হল, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেলল না। অপর্ণা একবার তার মুখের দিকে তাকাল। অস্পষ্ট আলোয় বিশেষ কিছু দেখা গেল না। বাকী পথটুকু দুজনে নীরবে পার হয়ে এল।
পর পর তিন-চার দিন বারীনকে খুব ব্যস্ত দেখা গেল। সকালে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে অনেক বেলায়। স্নানাহার এবং খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর আবার একদফা ঘুরে এসে দরজা বন্ধ করে রাত দশটা এগোরাটা পর্যন্ত চলে ওদের গোপন আসর। তারই ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের আনাগোনা। সবারই মুখে গাম্ভীর্যের ছায়া। একটা কিছু ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে, যার জন্যে সবাই উদ্বিগ্ন। অপর্ণার সঙ্গে দেখাশোনা যদি বা হয়, কথাবার্তা বিশেষ কিছুই হয় না।
সেদিন সকালে খানিকটা পড়াশুনা সেরে বারীনের ঘরের সুমুখ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখল, সে চুপ করে শুয়ে আছে। অপর্ণা ঘরে ঢুকে বলল, ওমা, আমি মনে করেছি তুমি বেরিয়ে গেছ! এ রকম অসময়ে শুয়ে যে? শরীর ভালো তো?
বারীন এতগুলো প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে উঠে বসল এবং অপর্ণার দিকে একদৃষ্টে কয়েক মিনিট চেয়ে থেকে বলল, তোকে একটা কাজ করতে হবে পরী।
কী কাজ? উদ্বেগের সুরে জিজ্ঞাসা করল অপর্ণা।
মনে আছে, একদিন বলেছিলাম তোকেও আমাদের দলে আসতে হবে? সেদিনটা এতকাল ঠেকিয়ে ঠেকিয়েই এসেছি, আর বোধ হয় ঠেকানো গেল না।
কী হয়েছে, আমাকে খুলে বলো বারীনদা! —বলে অপর্ণা বসে পড়ল ওর তক্তপোশের এক পাশে।
বারীন একটু যেন ইতস্তত করে কুণ্ঠার সুরে বলল, অনেকগুলো পরিবারের ভার পড়েছে ঘাড়ের ওপর, এদিকে টানবার ক্ষমতা নেই। খবর পেলাম প্রায়-বাড়িতেই হাঁড়ি চড়ছে না। তার ওপর আর এক বিপদ। হাজার দুয়েক টাকার মাল ছিল আবদুলের কাছে, তারও কোনো খবর নেই। যদি ধরা পড়ে থাকে, তা হলেই সৰ্বনাশ!
অপর্ণা চমকে উঠল, আস্তে আস্তে বলল, কী মাল?
কোকেন।
অ্যা! একটা ভীতি-বিহ্বল অস্ফুট শব্দ শোনা গেল অপর্ণার মুখে। আর কোন কথা বলতে পারল না।
বারীন বলল, সে যাক গে। তোকে যা বলছিলাম, সেই বাক্সটা তো দেখেছিস, নিয়ে বেরোবি একবার?
অপর্ণার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, না না, ও-সব পারব না। তার চেয়ে আমার গয়নাগুলো নিয়ে যাও। ওই দিয়ে যা হয় করো। তোমার ওই বাক্স নিয়ে ঘোরা আমাকে দিয়ে হবে না।
তোর ওই জিনিস কখানার কথাও আমি ভেবেছি। কিন্তু এ সময়ে ওটা আমরা হাতছাড়া করতে পারি না। ওর দরকার হয়তো পরে আসছে। আবদুল যদি ধরা পড়ে থাকে, ছাড়াতে হবে তো? তার মানে অনেক টাকার ব্যাপার।
একটু অপেক্ষা করে আবার বলল বারীন, তোকে আমি বলতাম না পরী। আমি নিজেই বেরোতাম সুটকেসটা নিয়ে। কিন্তু আমাকে আজ সারাদিন ওই আবদুলের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কখন কী খবর আসে! তা ছাড়া তুই যা ভাবছিস, তেমন কিছু অন্যায় তো আমরা করছি না। লোক ঠকাতে হবে তা ঠিক, কিন্তু ভেবে দেখেছিস ঠকছে কারা? যাদের অনেক আছে, অঢেল আছে। আর কাদের জন্য ঠকাচ্ছি? যাদের কিছুই নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে ছট্ফট্ করছে, তাদের দুটো মুড়ি কি করে জুটবে সেইটাই ভাববার কথা, না কোন রাজার নন্দিনী পাঁচ টাকার জিনিস পঁচিশ টাকায় কিনে একটু ঠকলেন, তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে! এর মধ্যে দোষটা কোথায় দেখলি?
অপর্ণা অনুনয়ের সুরে বলল, আমাকে ভুল বুঝো না বারীনদা। দোষ-গুণ বা ন্যায়- অন্যায়ের কথা আমি তুলি নি। ওসব আমি কী জানি? তুমি বলছ, এই আমার যথেষ্ট—সেই এতটুকু যখন ছিলাম, তখন থেকে এই কথাই তো জেনে এসেছি। তোমার সেই পরীকে আজ ভুলে গেলে?
স্বরটা কেমন বদলে গেল। শেষের দিকে রয়ে গেল বোধ হয় একটু অভিমানের রেশ। বারীন জবাব দিল না, হয়তো এটা প্রশ্ন নয় বলেই। ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আবার বলল অপর্ণা, আমি ভাবছিলাম, কী বলতে কী বলব! কেউ যদি ধরে ফেলে? এমন কিছু জিজ্ঞেস করে, যা আমি জানি না? কী মুশকিল হবে তা হলে! না লক্ষ্মীটি, ওসব তুমি আর কাউকে দাও।
বারীন হেসে ফেলল, আচ্ছা ভীতু দেখছি! ধরবে আবার কে? আমরা তো আর জোর করে চাপাতে যাচ্ছি না। যার খুশি কিনবে, না হয় কিনবে না। ওর পিঠের উপর হাত বুলিয়ে বলল, কিচ্ছু ভয় নেই। যা বলতে হবে না-হবে, সব আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। বালিগঞ্জের দিকে বরং না গেলি। হঠাৎ-বড়লোক বাঙালী মহিলারা একটু বেশি সেয়ানা। তা ছাড়া নজরও ছোট। দু’শো টাকার জিনিস কিনতে হলে দু-টাকা থেকে দর করতে শুরু করবে। তার চেয়ে বড়বাজারে যা। মাড়োয়ারী-গিন্নীদের পটানো অনেকখানি সোজা।
কিন্তু আমি যে কোনো দিকই চিনি না।—নিরুপায় ভাবে বলল অপর্ণা।
চেনাবার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি। অমল যাবে তোর সঙ্গে।
বারীনকে যাই বলুক, ওর নির্দেশে একটু বিশেষ রকম সাজগোজ করে অমলের সঙ্গে যখন বেরিয়ে পড়ল অপর্ণা, যে কথাটা তার মনের মধ্যে তোলপাড় করে ফিরতে লাগল তা হচ্ছে ওই ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব। একজন তার সরল মনের বিশ্বাস এগিয়ে দিচ্ছে তোমার কাছে, তুমি জেনেশুনে তার ওপরে ছুরি চালাচ্ছ। এ শুধু অন্যায় নয়, পাপ। সে লোকটা অনেক টাকার মালিক বলেই তোমার সব দোষ কেটে গেল, সব অন্যায় ঢেকে গেল—এ কথা কেমন করে মানবে সে? যা অন্যায় তা সব ক্ষেত্রে, সকলের বেলাতেই অন্যায়। পাত্র-বদল হলেই তার রূপ বদলায় না। গুরুত্বের হয়তো কিছু তারতম্য ঘটে, কিন্তু দোষ দোষই থেকে যায়।
অমল চলেছিল আগে আগে। তার হাতে সেই সুটকেস। সেই দিকে চেয়ে অপর্ণা একবার থমকে দাঁড়াল, তীব্র ইচ্ছা হল ফিরে যায়। মুখ থেকে বেরিয়ে গেল : শুনুন! অমল ফিরে তাকাল। কাছে এসে বলল, একটা রিকশা ডাকব? লজ্জিত হল অপর্ণা; না না, রিকশা কী হবে? চলুন। সেই মুহূর্তে চোখের উপর ভেসে উঠল, আজই সকালে দেখা বারীনের সেই চিন্তাকুল মুখ, কপালের ওপর স্পষ্ট হয়ে ওঠা উদ্বেগের রেখা; থেমে থেমে বলছে : অনেকগুলো পরিবারের ভার পড়েছে ঘাড়ের ওপর…খবর পেলাম প্রায়-বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে না।
ফিরে যাওয়া হল না। ততক্ষণে ট্রাম-লাইনে এসে গেছে। একটা স্টপেজের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল অমলকে, এরপর আবার হ্যারিসন রোডে অন্য ট্রামে উঠতে হবে, তাই না?
অমল বলল, হ্যাঁ।
গেট-ওয়ালা চারতলা বাড়ি। বাইরে দাঁড়িয়ে দারোয়ান খইনি টিপছে আর কার সঙ্গে গল্প করছে। পিঠের ওপর ঝুলছে চামড়ার ফিতেয় বাঁধা বন্দুক। খানিকটা দূর থেকে অমল বলল, ওখানে একবার দেখলে হয়, বেশ বড়লোক বলে মনে হচ্ছে।
অপর্ণার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল—এইবার শুরু হবে তার পরীক্ষা। কিন্তু বাইরে কোন দুর্বলতা প্রকাশ পেতে দিল না। সহজভাবেই বলল, বেশ তো, বাক্সটা দিন তা হলে। ঘুরে আসি একবার—বলেই কোনো দিকে না তাকিয়ে গম্ভীরভাবে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দারোয়ান এল ছুটতে ছুটতে! অপর্ণা তার সদ্যলব্ধ হিন্দী ভাষায় জানাল, সে জুয়েলারী এম্পোরিয়মের প্রতিনিধি, খোদ ‘মালিকিনী’র সঙ্গে ভেট করতে চায়। গয়নার ‘ফরমাশ আছে।
দারোয়ান একজন চাকরকে ডেকে হাত পা নেড়ে কী সব নির্দেশ দিল। চাকর ওকে সসম্ভ্রমে নিয়ে গেল তেতলায় এবং ঝিয়ের জিম্মায় রেখে সরে পড়ল। ঝিয়ের প্রশ্নের উত্তরে ওই একই কথা জানাল অপর্ণা, এবং তাকে অনুসরণ করে অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে অন্দর-মহলে গিয়ে পৌঁছল।
সেটা বোধ হয় গৃহিণীর বিশ্রামকক্ষ। মাঝখানে অনেকটা জায়গা মূল্যবান পুরু কার্পেটে ঢাকা। দু-তিনটা বিশাল তাকিয়া গড়াগড়ি যাচ্ছে। তারই একটার গায়ে ততোধিক বিশাল দেহ এলিয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন মারোয়াড়-মহিষী। একজন দাসী পদসেবায় নিযুক্ত। আর একজন দাঁড়িয়ে আছে শিয়রের কাছে, বোধ হয় হঠাৎ কোন হুকুমের প্রতীক্ষায়! পা দুটো টেনে নিয়ে ওরই মধ্যে একটু সোজা হয়ে বসবার চেষ্টা করলেন এবং অপর্ণাকেও বসবার ইঙ্গিত করলেন। তারপর জানতে চাইলেন ওর আসবার উদ্দেশ্য। দু-চার কথায় তারই একটু আভাস দিয়ে অপর্ণা সুটকেসটা খুলে ধরল। গিন্নী সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মাথার কাছে দাঁড়ানো ঝিটাকে কী বললেন, এবং সে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুটি তরুণী এক রকম ছুটতে ছুটতে এসে বসে পড়ল সেই কার্পেটের উপর। চেহারা এবং বেশভূষা দেখে অপর্ণা অনুমান করল এরা এ-বাড়ির বউ। এসেই একজন তুলে নিল একটা নেকলেস, আর একজন আর্মলেট। দুজনেরই চোখে-মুখে ফুটে উঠল খুশির ঝলক। তার পর গিন্নীর সঙ্গে চলল তাদের কথাবার্তা, যার প্রায় সবটুকুই অপর্ণার কাছে একেবারে দুর্বোধ্য। গিন্নী গয়না দুখানা ওদের হাত থেকে নিয়ে নেড়েচেড়ে, আলোর দিকে ধরে গম্ভীরভাবে পরখ করতে লাগলেন। তারই ফাঁকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, দোকানটা কোথায় এবং সেখানে গেলে আরও জিনিস দেখতে পাওয়া যাবে কিনা। দোকানের উল্লেখে অপর্ণা একবার চমকে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কার্ডগুলো দেখিয়ে জবাব দিল, ওঁদের কষ্ট করে যাবার দূকার কী, যে যে জিনিস চাই, বলে দিলে সে নিজেই আর একদিন নিয়ে আসতে পারে।
আরও কিছুক্ষণ কী সব আলোচনা হল বউদের সঙ্গে। কথাগুলো না বুঝলেও মোটামুটি ধরতে পারল অপর্ণা, গিন্নীর ইচ্ছা জিনিসগুলো সরকার মশাইকে দিয়ে যাচাই করে দেখা। কিন্তু বউ দুটির ধারণা, এ ব্যাপারে সরকার যদি নাক গলায়, তারপর কর্তাদের কান এড়ানো যাবে না এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত হয়তো সবটাই ফেঁসে যাবে। মহিলাটি তা সত্ত্বেও জিদ করতে লাগলেন এবং ঝিকে দিয়ে সরকারকেই বোধ হয় ডেকে পাঠালেন। বউরা ক্ষুণ্ণ-মনে উঠে চলে গেল।
মাড়োয়াড়-গৃহিণী এবার অপর্ণার দিকে নজর দিলেন। জানতে চাইলেন কোথায় দেশ, কে কে আছে তার, বিয়ে হয়েছে কিনা? তার পর যোগ করলেন, তার বয়সী একটি মেয়ের পক্ষে এতগুলো দামী গয়না নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ক্যানভাসিং করতে বেরুনো একেবারেই ঠিক হয় নি। এই কলকাতা শহরে রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে আছে গুণ্ডা আর বদমাশ বিপদ ঘটতে কতক্ষণ!
অপর্ণা ওঁর ভাষাটি বুঝল না। কিন্তু একটি অনাত্মীয়া বিদেশিনী মহিলার এই আন্তরিক উৎকণ্ঠার সুর তার অন্তর স্পর্শ করল। জবাব দেবার মতো বিশেষ কিছুই ছিল না। মাথা নিচু করে শুনে গেল। একবার শুধু বলল, সে একা আসে নি, সঙ্গে লোক আছে এবং সে বাইরে অপেক্ষা করছে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই সরকার-জাতীয় একটি মারোয়াড়ী ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে এসে পড়লেন এবং মনিবপত্নীর সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে গয়না দুখানা নিয়ে চলে গেলেন। অপর্ণার বুক ঢিপ্ টিপ্ করতে লাগল। গিন্নী আবার গল্প জুড়ে দিলেন তার সঙ্গে। আধ ঘণ্টা পরে সরকার এসে বললেন, বিলকুল ঝুটা ও রুক্ষভাবে তাকালেন অপর্ণার দিকে। মনিব-জায়াকে বোঝালেন, এই রকম একদল লোক ব্যবসার নাম করে লোক ঠকিয়ে বেড়ায়, মোটা মাইনে দিয়ে মেয়েছেলে ক্যানভাসার রাখে, যাতে করে অন্দর-মহলে জাল ফেলবার সুবিধা হয়। একে পুলিসে দিলেই গোটা দলটা ধরা পড়বে এবং এই মুহূর্তে সেইটাই ওদের একমাত্র কর্তব্য।
অপর্ণা প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু মনে হল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গিন্নী সরকারের প্রস্তাবে সায় দিলেন না। বললেন, ওর দোষ কী? ছেলেমানুষ, দোকান থেকে যা দিয়েছে, তুলে নিয়ে এসেছে।
গয়না দুটো ফিরিয়ে দিয়ে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে সস্নেহে বললেন, তুমি এবার এসো বাছা। এসব জিনিস এখানে চলবে না।
নতুন করে আর কোথাও ভাগ্য পরীক্ষার উৎসাহ অপর্ণার চলে গিয়েছিল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মনে মনে স্থির করে ফেলল, সোজা বাসায় ফিরে বাক্সটা বারীনদার সামনে ফেলে দিয়ে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবে—এসব কাজ আমাকে দিয়ে হবে না, আর এ পথও তোমাকে ছাড়তে হবে। কিন্তু রাস্তায় বেরুতেই অমল যখন তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সাগ্রহে প্রশ্ন করল, নিলে কিছু ওরা? তখন শুধু মাথা নেড়ে জবাব দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলা হল না।
এই ছেলেটি বারীনের দলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। অপর্ণার বয়সীই হবে বোধ হয়। ভারি লাজুক। কখনও ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। এবারেও তেমনি মাটির দিকে চেয়ে চিন্তিত মুখে বলল, একেবারে খালিহাতে ফিরে গেলে…বারীনদা বার বার করে বলে দিয়েছেন, কিছু টাকা অন্তত…তারপর যেন হঠাৎ আবিষ্কার করেছে এমনভাবে মাথা তুলে বলল, আমরা বোধ হয় ভুল করেছি। মারোয়াড়ী-পাড়ায় এসব জিনিসের আদর নেই। ওদের গয়না মানে তো ভারী ভারী সোনার তাল। তার চেয়ে এক কাজ করলে হয়। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে একটা বাড়ি দেখে এলাম। মস্ত বড় মোটর দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় পারসী। বেশ সৌখিন বলে মনে হল। ওখানে হয়তো কিছু সুবিধে হতে পারে
বেশ, তাই চলুন—শুষ্ক স্বরে বলল অপর্ণা।
রেলিং-ঘেরা কম্পাউণ্ডওয়ালা আধুনিক গড়নের বাড়ি। গেটে ঢুকেই লাল কাঁকর- ছড়ানো রাস্তা। দু’ধারে ফুল এবং পাম গাছের টব। লোকজন কেউ নেই। কার্পেটমোড়া সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উপরে উঠে গেল অপর্ণা। হলের সামনে পড়তেই একজন উর্দিপরা চাপরাসী বেরিয়ে এসে হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই? অপর্ণা জানতে চাইল, অন্দরমহলে যাবার রাস্তা কোন্ দিকে? চাপরাসী উত্তর দেবার আগেই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন নিখুঁত সাহেবী পোশাক-পরা একটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। খানিকক্ষণ বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে, তারপর নমস্কার করে ইংরেজীতে বললেন, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে আসুন।
অপর্ণার ইংরেজী-বিদ্যার দৌড় বেশী নয়। তারই সাহায্যে সে কোনোমতে জানাল, আমি একটা জুয়েলারি ফার্ম থেকে আসছি। মেয়েদের সঙ্গে দেখা করে দু-একটা নমুনা দেখাতে চাই।
জুয়েলারি!–বলে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক : বেশ তো, আমাকে দেখাতে আপত্তি আছে কিছু?
না, আপত্তি আর কি!
বারান্দা পার হয়ে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর। সেখানে নিয়ে গিয়ে একটা সোফা দেখিয়ে অপর্ণাকে বসতে বললেন ভদ্রলোক, এবং নিজেও বসলেন তার পাশের কৌচটিতে। এস্কিউজ মী।—বলে সুটকেসটা ওর হাত থেকে নিয়ে রাখলেন একটা সুদৃশ্য টিপয়ের উপর। তারপর ভাঙা-ভাঙা বাংলায় বললেন, আপনাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে, একটু চা আনতে বলি?
না না, আমি চা খাই না কুণ্ঠা-জড়ানো লজ্জার সুরে বলল অপর্ণা।
তা হলে একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক?
কিচ্ছু দরকার নেই।
দরকার আছে বইকি! —বলে একটা কী নাম ধরে হাঁক দিলেন এবং চাকর গোছের একজন লোক আসতেই দুটো আইসক্রীমের অর্ডার দিলেন। অপর্ণার দিকে ফিরে বললেন, কোন্ ফার্ম থেকে আসছেন আপনি?
অপর্ণা সুটকেস খুলে একখানা কার্ড বের করে দিল ওঁর হাতে। উনি তার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না, এদের সঙ্গে আপনার টার্মস্ কি রকম? মানে কতটা মাইনে-টাইনে দেয়?
অপর্ণা মহা সমস্যায় পড়ল। একবার ভাবল, বলে দেয়—এটা আমাদের নিজেদের ফার্ম, কাজেই মাইনের কথা ওঠে না। তার পরেই মনে হল, এই রকম একটা সম্ভ্রান্ত জুয়েলারি দোকানের যারা মালিক, তাদের বাড়ির কোন মেয়ের পক্ষে ফেরি করতে আসাটা শুধু অস্বাভাবিক নয়, অশোভন। অথচ উত্তর একটা দিতেই হবে। তাই কোনোরকমে বলে ফেলল, আপাতত একশো টাকা করে দিচ্ছে।
একশো টাকা! কপাল কুঞ্চিত করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন ভদ্রলোক, আই শুড সে, মিস—, আপনার নামটা জানতে পারি?
অপর্ণা চ্যাটার্জি।
আই মাস্ট সে মিস চ্যাটার্জি, ওরা আপনাকে ভয়ানক ঠকাচ্ছে। সার্টেনলি ইউ ডিসার্ভ মাচ মোর। অন্য যে কোন জায়গায় আপনি এর চেয়ে বেশী রোজগার করতে পারেন। এই ধরুন, আমার আপিসে! আপনার মতো এই রকম একজন স্মার্ট প্রাইভেট সেক্রেটারির জন্যে আমি অনায়াসে দুশো টাকা দিতে পারি। কাজ বিশেষ কিছুই নয়, আমার যেসব ভিজিটর আসেন, বেশীর ভাগই বড় বড় ব্যবসায়ী, তাঁদের রিসিভ করা, আর আমার পার্সোনাল ডায়রী রাখা। মানে এনগেজমেন্টগুলো লিখে রেখে ঠিক সময়ে মনে করিয়ে দেওয়া।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার অপর্ণার দিকে চেয়ে আবার বললেন ভদ্রলোক, আপনি যাই বলুন মিস চ্যাটার্জি, এ কাজ আপনার নয়। সুটকেস হাতে করে দোরে দোরে গয়না ফেরি করে বেড়ানো আপনাকে একেবারেই মানায় না। বলুন, রাজী আছেন আমার প্রস্তাবে?
এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবের আকর্ষণে না হলেও, এর আকস্মিক নূতনত্বে খানিকটা অভিভূত হয়ে পড়েছিল অপর্ণা, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। ভদ্রলোক কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বললেন, ঠিক এই মুহূর্তেই আপনার জবাব চাইছি না। আপনি ভেবে দেখুন। দরকার হলে আপনার অভিভাবকদের সঙ্গেও পরামর্শ করে দেখতে পারেন। কাল পরশু যখন হোক জানিয়ে দেবেন। এই নিন আমার কার্ড।
ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে কার্ডখানা এগিয়ে ধরলেন ভদ্রলোক। অপর্ণার নাকে গেল একটা পরিচিত গন্ধ, অনেক রাতে কোন কোন দিন দরজা খুলে দিতে গিয়ে যেটা পাওয়া যেত তার বাবার মুখ থেকে। সমস্ত শরীরটা ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল। কার্ডখানা নিতে গিয়ে হঠাৎ নজর পড়ল ওঁর চোখের দিকে। আপনার অজ্ঞাতে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল অপর্ণার। আর কোন কথা না বলে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে ট্রের উপরে আইসক্রীমের গ্লাস সাজিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল সেই বেয়ারাটা। ভদ্রলোক নিজেকে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, নিন, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিন। যা গরম!
অপর্ণা আর ‘না’ বলল না। নিঃশব্দে গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক লাগাল। সেই মুহূর্তে যে কোন একটা পানীয়ের সত্যিই দরকার ছিল তার। বুকের মধ্যে যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল খানিকটা যেন শান্ত হল। গেলাসটা নিঃশেষ হবার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কবে নাগাদ আপনার জবাব আশা করতে পারি?
অপর্ণা রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে বলল, মাপ করবেন। চাকরির আমার দরকার নেই। এবার আমাকে উঠতে হবে।
উঠতে হবে কী বলছেন! ওই সুটকেসে কী আছে, তাই তো এখনো দেখা হয় নি!
দেখাবার মতো উৎসাহ তার একেবারেই ছিল না। কিন্তু না দেখিয়ে চলে যাওয়াও মুশকিল। তাই নিতান্ত অনিচ্ছাভরে বাক্সটা খুলে ডালাটা তুলে ধরল। ভদ্রলোক যেন চিৎকার করে উঠলেন, বাঃ!
একটা নেকলেস তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এর দাম কত?
চারশো টাকা।
নেকলেসটা চোখের সামনে রেখে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বললেন, টু টেল ইউ দি টুথ, মিস চ্যাটার্জি, নেকলেস পরাবার মতো নিজের লোক আমার কেউ নেই। তবে উপযুক্ত পাত্র পেলে এ রকম একটা জিনিস প্রেজেন্ট দেওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ আর কী আছে! তাই বলছিলাম—
একটু থেমে গভীর দৃষ্টিতে অপর্ণার মুখের দিকে আর-একবার তাকিয়ে বললেন, আসুন না, দেখি কী রকম মানায় আপনার গলায়!
দু-হাতে হারটা ধরে উঠে দাঁড়াতেই খানিকটা ছিটকে পিছিয়ে গেল অপর্ণা, দু-চোখে আগুন ছড়িয়ে দৃপ্ত-কণ্ঠে বলল, রেখে দিন ওখানে!
ভদ্রলোক প্রথমটা হঠাৎ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, না না, রেখে দেব কেন? এটা আমি নিলাম। আপনি বসুন, আমি চেকবইটা নিয়ে আসছি।
ভদ্রলোক বাইরে যেতেই অপর্ণা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে চলল সিঁড়ির দিকে। কয়েকটা ধাপ নামতেই পেছনে শুনতে পেল : এ কী! চলে যাচ্ছেন যে? চেকটা নিয়ে যান!
অপর্ণা আর দাঁড়াল না, ফিরেও তাকাল না। রাস্তায় পড়তেই এগিয়ে এল অমল। ওর চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল, ভয়ে ভয়ে বলল, কী হয়েছে?
কিছু না, বাড়ি চলুন-
একটা গাড়ি ডাকব?
ডাকুন।
ট্যাক্সি থেকে নেমে দরজার কড়া নাড়তেই খুলে দিল ঝি। অপর্ণা ঝড়ের মতো ঢুকল বারীনের ঘরে। উত্তেজিত স্বরে ডাকল, বারীনদা!
বারীন নেই, তার জায়গায় বসে রয়েছে শরণ সিং। ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে বলল, কী হয়েছে বহিন?
এই সস্নেহ সম্বোধনে অপর্ণার চোখে জল এসে পড়ল। কোন উত্তর না দিয়ে বাক্সটা মাটিতে ফেলে ছুটে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। দুর্জয় ক্ষোভ আর অভিমানে ভরে উঠল সমস্ত মন। ওই বারীনদা আর তার বন্ধুরাই তো তাকে ঠেলে দিয়েছে অপমান আর অমর্যাদার মুখে! ওরা সব জানত, এ শুধু না-জানার ভান।
আস্তে আস্তে যখন ভাঁটা দেখা দিল উত্তেজনায়, তখন আবার লজ্জিত হল। এ রকম একটা নাটক না করলেই হত। ছি ছি, কী ভাবছে শরণ সিং, কী ভাবল অমল! বারীনদাই বা গেল কোথায়? চোখ মুখ ভালো করে মুছে বাইরে এসে দেখল, শরণ গালে হাত দিয়ে বসে আছে বারীনের ঘরের সামনে। বলল, ওদিকের সব খবর কী শরণদা?
খবর ভালো নয়। ওর দিকে না চেয়ে তেমনই শুষ্ক কণ্ঠে বলল শরণ সিং। অপর্ণার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। কী সেই অমঙ্গল সংবাদ, মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে পারল না। শরণ নিজেই জানিয়ে দিল, আবদুল ধরা পড়েছে। বারীন গেছে তার জামিনের ব্যবস্থা করতে। আমি তোমার জন্যেই বসে ছিলাম। কিন্তু অমলের কাছে যা শুনলাম, এদিকে বোধ হয় কোনো সুবিধে হয় নি। আমি তা হলে উঠি। বারীন আবার আশা করে বসে আছে। খবরটা একবার—
এক মিনিট দাঁড়ান, আমি আসছি। ঘরে এসেই অপর্ণা বাক্স খুলে বের করল সেই গয়নার পুঁটলি। তারই থেকে দুটো জিনিস তুলে নিয়ে শরণের কাছে গিয়ে বলল, আজকের কাজ বোধ হয় এতেই হয়ে যাবে। যদি না কুলোয় কাউকে পাঠিয়ে দেবেন।
শরণ হতভম্বের মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এসব কী করছ তুমি? এ তো আমি নিতে পারি না!
কী মুশকিল, বারীনদার সঙ্গে কথা হয়েছে যে!
কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
ঠিক তো?
বাঃ, তবে কি মিছে কথা বলছি! আপনি এবার আসুন, আর দেরি করবেন না।
বারীন যখন ফিরল, রাত এগারোটা বেজে গেছে! জামা খুলতে খুলতে বলল, তুই খেয়ে নিয়েছিস তো?
অপর্ণা হেসে মাথা নাড়তেই বিরক্ত হয়ে উঠল, এ তোর ভারি অন্যায়। কতদিন বলেছি না, নটা বাজলেই আমার ভাতটা ঢাকা দিয়ে রেখে খেয়ে নিবি?
আচ্ছা, এখন থেকে তাই না হয় করা যাবে। তুমি এবার চট্ করে হাত মুখ ধুয়ে এসো তো। শুধু বকুনি খেলে পেট ভরবে না। বড্ড খিদে পেয়েছে।
আমারও।—বলে হেসে ফেলল বারীন। তার সঙ্গে যোগ দিল অপর্ণা।
রান্নাঘরে পাশাপাশি খেতে বসে অপর্ণা জিজ্ঞাসা করল, তারপর? কদ্দূর কী করে এলে বলো।
বারীন ভাত মাখছিল। হাত দুটো থামিয়ে হঠাৎ যেন নিশ্চল হয়ে গেল।
কী হল আবার! সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল অপর্ণা।
কিছু না। ভাবছিলাম, মাসীমার ওই শেষ সম্বলটুকু হাত করতে না পেরে তোর নতুন মা নিশ্চয়ই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন!
তুমি এখানে বসেই শুনতে পেয়েছিলে বুঝি? —কৌতুকের সুরে বলল অপর্ণা।
না, তা ঠিক পাই নি, তবে এখন বুঝলাম। ওঁর নাগালের বাইরে এসেও কিছু বাঁচানো গেল না।
বারীনের সেই স্বাভাবিক হালকা সুর; কিন্তু তার মধ্যে একটু যেন প্রচ্ছন্ন বেদনার আভাস, অপর্ণার মনেও যার স্পর্শ লাগল। তাই একটা কোন সহজ পরিহাসের দোলা দিয়ে বিষয়টাকে উড়িয়ে দেবার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হল না। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী মনে হচ্ছে?
মা যেখানে আছে, সেখান থেকে যদি আমাদের দেখতে পায়, জানতে পায় আমাদের সব কথা, তা হলে নিশ্চয়ই খুব খুশী হয়েছে। আমার চেয়েও খুশী।
বারীন কোন উত্তর দিল না। বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল শুধু তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। তারপর আবার ভাত মাখতে শুরু করল।
পরদিন সকাল হতেই বারীন বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। কাজের অন্ত নেই। আবদুল এখনও পুলিসহাজতে। এবার গিয়ে উকিল-মোক্তার লাগিয়ে তার জামিনের বন্দোবস্ত করতে হবে। হাতে হাতে মোটা রকম নগদ ব্যবস্থা না পেলে পুলিস-কোর্টের উকিল কখনও মাথা তোলেন না। কাল রাতেই অপর্ণা এবং স্যাকরা মিলে তার সুরাহা করে দিয়েছে। বেরুতে যাবে এমন সময় শরণ সিং এসে উপস্থিত। দোরগোড়া থেকেই বলল, কোথায় যাচ্ছ?
বারীন চোখের ইঙ্গিতেই গন্তব্যস্থানটা বুঝিয়ে দিল। শরণ জুতো খুলতে খুলতে বলল, যা করবার আমিই করব। তোমার গিয়ে কাজ নেই।
কেন?-–কপাল কুঞ্চিত করে বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করল বারীন।
কেন আবার! আবদুলের জন্যে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। তোমার যাওয়া তো হবেই না, এ বাড়িটাও আমাদের এখনই ছেড়ে দিতে হবে।
কী ব্যাপার বলো তো? হঠাৎ খেপে গেলে নাকি?
হ্যাঁ, খেপে যাবার কারণ হলেই খেপতে হয়। ঘরে চলো, বলছি।
বারীনের ঘরে তিনজনে মিলে বসল ওদের পরামর্শসভা। শরণ সিং আগের কথার সূত্র ধরেই জানাল, সে খবর পেয়েছে, ওদের এই কোকেন ব্যবসায়ের উপর পুলিসের নজর পড়েছে। শুধু নজর দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয় নি, কাজের দিক দিয়েও বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে! নানা কারণে এ বাড়িটা আর এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়।
এক অজানা আশঙ্কায় অপর্ণার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। শুষ্ক মুখে বলল, ভাগ্যিস তুমি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলে শরণদা। আর দু মিনিট দেরি হলেই ও বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু এত শীগগির বাড়ি পাওয়া যাবে কোথায়?
সে ব্যবস্থা আমি করে এসেছি। আমাদের পাড়ায় এই রকম একটা ছোট বাড়ি খালি আছে। গেলেই পাওয়া যাবে।
বাড়ির প্রসঙ্গে বারীন এতক্ষণ কোন কথা বলে নি, এবার মৃদু হেসে বলল, দু মাসের ভাড়া বাকি আছে, তা জান তো?
শরণ বলল, তোমার হাতে যে টাকা আছে, তার থেকে দিয়ে দাও।
আর ওই লোকটা জেলে পচতে থাক! শ্লেষ-তীব্র-কণ্ঠে বলল বারীন, তোমার বন্ধুপ্রীতি দেখে মুগ্ধ হলাম শরণ সিং!
শরণ কিছুমাত্র দমে না গিয়ে বলল, বন্ধুর আসল পরিচয়টা যদি জানতে, তা হলে মার ও কথা বলতে না। পরীর সামনে বলতে চাই নি এতক্ষণ, কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্য করলে।
আসল পরিচয় মানে?
মানে, আবদুল বিট্রে করেছে। আমাদের সব খবর এখন পুলিসের খাতায়।
শরণ সিংয়ের উত্তেজিত গম্ভীর কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অপর্ণার গলা থেকে বেরিয়ে এল একটা ভীতিবিহ্বল ক্ষীণ শব্দ। পর-মুহূর্তে মনে হল, সকলেই যেন নিশ্চল পাথর হয়ে গেছে।
মিনিট কয়েক পরে শরণই শুরু করল, তোমার নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেছে। আমাদের এই বাড়ির নম্বরটা ও জানে না, তাই পুলিস এখনও এসে পড়ে নি। কিন্তু বেশীক্ষণ আর দেরি হবে না।
বারীনের আনত মুখখানা থমথম করতে লাগল কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে তার মনোরাজ্যের কোনও খবর পাওয়া গেল না। অপর্ণা ছুটে গিয়ে নিয়ে এল ওর শেষ পুঁজি। শরণের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, বাড়ি-ভাড়াটা যত তাড়াতাড়ি পার মিটিয়ে দিয়ে এসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে সব গুছিয়ে নিচ্ছি।
ও সব রেখে দে পরী। মৃদুগম্ভীর সুরে বলল বারীন, বাড়িভাড়া না দিলেও চলবে। শরণ, একটা গাড়ি ডেকে আনো।
অপর্ণা বলল, ছি-ছি, সেটা ভারি অন্যায় হবে।
বারীনের মুখে ফুটে উঠল সেই বক্র হাসি। বলল, তা একটু হবে। তবে তার জন্যে চিন্তার কারণ নেই। পঞ্চাশ টাকা গেলে ওরা টেরও পাবে না। তোদের কবিদের ভাষায়, এটা হচ্ছে সাগরের কাছে গোষ্পদ।
একটা ঘোড়ার গাড়িতে টুকিটাকি খুচরো জিনিস সব ধরানো গেল না, শুধু বাক্স বিছানা বাসনপত্র কোনও রকমে তুলে নিয়ে চারদিকের খড়খড়ি বন্ধ করে ওরা বেরিয়ে পড়ল ভবানীপুরের দিকে।
বাড়িওয়ালার একটি মেয়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসত অপর্ণার কাছে। বেশ মেয়েটি। তার বাবা-মাও যে খারাপ লোক, এ রকম কোনও পরিচয় তাঁরা দেন নি। তাঁদের ন্যায্য পাওনাটুকু শোধ না করে এই যে পালিয়ে যাওয়া, এর পেছনে অর্থনীতিক যুক্তি যদি কিছু থেকেও থাকে, অপর্ণার সাধারণ নীতিবোধ তাকে কোনোমতেই মেনে নিতে পারল না। কেবলই মনে হতে লাগল, এ শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ। দীর্ঘ পথ সেই অপরাধের লজ্জাটাই তাকে নানা দিক থেকে বিধতে লাগল। অথচ বলবার বা করবার তার কিছুই নেই। এই যে মানুষটি তার পাশে নিঃশব্দে বসে আছে, মুখে যাই বলুক, তার মনের কোনও কোণে এজন্যে এতটুকু বিকার দেখা দিয়েছে কি? তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করল অপর্ণা। কিন্তু বদ্ধ গাড়ির অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করা গেল না। এই মুহূর্তে একটি কথাই শুধু মনে হল, সংসারের এক পরম বিস্ময় এই বারীন মানুষের জন্যে তার দরদের অন্ত নেই, আবার সেই মানুষের উপরেই সে যেমনি কঠোর তেমনি নির্মম।
আবদুলের ব্যাপারে অনেকখানি মুষড়ে পড়লেও বারীন শরণ সিংয়ের মতো শেষ পর্যন্ত সায় দিতে পারল না। নিজে রইল নেপথ্যে, কিন্তু তদ্বিরের কোনও ত্রুটি হতে দিল না। পুলিসের কাছে জামিন না-মঞ্জুর হবার পর কোর্টের শরণ নেওয়া হল। সেখানে জন দুই উকিল মিলে দীর্ঘ বাক্যজল বিস্তার করলেন, কিন্তু তাতে করে হাজতের দরিয়া থেকে মক্কেলকে টেনে তুলতে পারলেন না। এদিকে পুলিসের জাল ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল, এবং কয়েক দিনের মধ্যে এমন দু-চারজন তার মধ্যে জড়িয়ে গেল, যারা রুই-কাতলা না হলেও ঠিক চুনোপুঁটির দলে পড়ে না। জালের মুখটা যে এবার বারীনের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে, সেটা তার কাছেও অস্পষ্ট রইল না। সুতরাং নতুন বাসায় গা-ঢাকা দিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখা গেল না।
গা-ঢাকা দেবার অন্য প্রয়োজনও ছিল। কালো-বাজারের সুড়ঙ্গ পথে কোকেন নামক পরম নেশার বস্তু পাচার করে যে অর্থাগম হত, বারীনের বাজেটে আয়ের ঘরে সেইটাই ছিল প্রধান অঙ্ক। সেই দরজাটা যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন যে-সব পরিবারের অন্ন যোগাবার ভার সে হাতে নিয়েছিল, তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবার আর মুখ রইল না। দৈবাৎ পাছে কারও সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, এই ভয়ে রাস্তায় বেরুবার পথও তাকে ত্যাগ করতে হল।
কিন্তু ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে কতদিন চলে? বিশেষ করে বারীনের মতো যাদের জীবিকার পথ সহজ নয়, সরলও নয়। দু-তিন দিন পরে এক সকালবেলা অপর্ণা কলতলায় মুখ ধুচ্ছিল, বারীন কাছে গিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি একটু চা কর দিকিন, এখুনি বেরুতে হবে।
বেরুতে হবে? —বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল অপর্ণা।
বারীন হেসে বলল, ভয় নেই, পুলিসের আরও অনেক কাজ আছে। সব ফেলে কেবল বারীন বোসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাদের চলে না।
ও-সব বাজে কথা রাখো। পরের বোঝা বইতে গিয়ে লাভ তো হল নিজের বিপদ টেনে আনা। এখনও শখ মেটে নি? না, বেরুনো হবে না তোমার।
খুব তো জ্যাঠাইমার মতো রায় দিয়ে বসলি! পরের বোঝা না হয় না বইলাম, নিজেদের বোঝাটাও তো চালিয়ে নিতে হবে!
এর পরে অপর্ণার মুখে আর কথা যোগাল না। সংসারের অবস্থা সত্যিই অচল হয়ে উঠেছিল। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে বলল, বেশ, বেরুতেই যদি হয়, এখন না গিয়ে সন্ধ্যার পরে যেয়ো।
তাতে কোনও কাজ হবে না। দে, চা-টা দে; আর দেরি করিস নে।
খাবার সময় ফিরবে বলেছিল। সারাটা দিন কেটে গেল। দারুণ উৎকণ্ঠায় ঘর-বার করে অপর্ণা অস্থির হয়ে পড়ল। অথচ করবার কিছু নেই। শরণ সিংয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে কিনা ভাবছে, এমন সময় ফিরল বারীন। রাত নটা বেজে গেছে।
কোথায় ছিলে সারাদিন?
দরজা খুলেই ঝাঁজিয়ে উঠল অপর্ণা। নিতান্ত সহজ এবং নিরুত্তাপ সুরে জবাব এল, বলছি। তার আগে খেতে দিবি চল্।
খেতে বসে ওই সম্বন্ধে দু-একটা প্রশ্নোত্তর ছাড়া আর কোনও কথা হল না। অপর্ণা আগাগোড়া গম্ভীর হয়ে রইল। সেদিকে দু-একবার আড়চোখে চেয়ে বারীনও মুখ বুজে হাত চালিয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া মিটে গেলে হেঁসেলের পাট সেরে নিজের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল অপর্ণা, বারীন এসে দাঁড়াল ঠিক দরজার সামনে।
সরো, ঘুম পেয়েছে।—নীরস গম্ভীর সুর অপর্ণার।
পেলে কী হয়, ঘুম হবে না।
কেন?
রাগের সঙ্গে ঘুমের চিরকালের বিরোধ।
রাগের কথা এল কিসে?
আমিও তো তাই বলি—রাগের কথা এল কিসে? চল ছাতে যাই। হাওয়া লাগলে মাথা ঠাণ্ডা হবে।
বারীন তার ডান হাতখানা রাখল ওর কাঁধের উপর। অপর্ণা আর আপত্তি করল না। যেতে যেতে বলল, মাথা আমার ঠাণ্ডাই আছে।
ওদের এই গলিটা সদর-রাস্তা থেকে অনেকখানি দূরে। বড় শহরের যে দুটি বৃহৎ অবদান—চোখ-ধাঁধানো আলো আর কান-ফাটানো কোলাহল, এ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারে না। সমস্ত পাড়াটা এরই মধ্যে নিঝুম হয়ে গেছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত। আদিগন্ত কালো পর্দার উপর এক-আকাশ তারা। চারিদিকের ওই উঁচুনীচু অসংখ্য বাড়ি, দিনের আলোয় যাদের দেখে মনে হয় একটা শ্রীহীন শৃঙ্খলাহীন ইট-কাঠের জঙ্গল, চন্দ্রহীন রাত্রির এই আধ-আলো আধ-অন্ধকারে কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অপর্ণা। আকাশ বলে যে এক পরম বিস্ময় আছে পৃথিবীতে, সে কথা আজ হঠাৎ মনে পড়ল। খেয়াল ছিল না, হাতখানেক দূরে একই রেলিঙের পাশে আর-একজন মানুষ তারই মতো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চমকে উঠল, যখন কানে গেল তার মৃদু কণ্ঠ : আমাদের সেই ছেলেবেলার কথা তোর মনে আছে পরী?
অন্তরের একটা একান্ত কোমল স্থানে যেন হাত পড়ল অপর্ণার। মানুষ তার জীবনের সব-কিছু ভুলে যেতে পারে, ভুলতে পারে না কৈশোরের সাধ আর প্রথম যৌবনের স্বপ্ন। তাদের বিগত দিনের মধ্যে এই দুটি বস্তুই যে জড়িয়ে আছে, শুধু জড়িয়ে নয়, সিঞ্চিত হয়ে আছে আনন্দ-বেদনার মধুর রসে, সে কথা কি জানে না বারীনদা! অন্য দিন হলে হয়তো সে বলে উঠত, মনে নেই আবার! কিন্তু আজ তার বুক ভরে গেল অভিমানে। অন্তরের উচ্ছ্বাস চেপে রেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, কী জানি বাপু, ও-সব আর ভাববার সময় নেই।
ভাবতে বলছি না। অনেক যত্ন করে তোকে আমরা নাচ-গান শিখিয়েছিলাম, সে-সব ভুলে যাস নি তো?
কেন? এই বুড়োবয়সে আবার তার পরীক্ষা দিতে হবে নাকি?
যদি বলি, হ্যাঁ!
রক্ষে করো। স্টেজে ওঠবার দিন চলে গেছে।
স্টেজে না হয় না উঠলি, ঘরে বসে মাস্টারি করতে পারবি তো?
অপর্ণা হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে উঠল : তা মন্দ বলনি। দাও না জুটিয়ে দু-একটা টিউশানি। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছি, তবু দু-চার পয়সা রোজগার হয়।
টিউশানি করে আর কত রোজগার হবে। গলা ভাঙবে, পেট ভরবে না। আমি যে মাস্টারির কথা বলছি সেটা একটু অন্য রকম।
অন্যরকম! যথা?
যথাটা এখন নয়, ক্রমশ প্রকাশ্য।
পরের সপ্তাহটা বারীন প্রায় বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দিল। তার পর একদিন সন্ধ্যাবেলা অপর্ণাকে নিয়ে তুলল চিৎপুর অঞ্চলে কোনও গলির মধ্যে একটা পুরনো বাড়ির দোতলায়। বেশ বড়গোছের ঘর। আধময়লা ফরাশের উপর কয়েকটা তাকিয়া। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে নানারকম বাদ্যযন্ত্র। অ্যাশট্রের উপর পোড়া সিগারেটের টুকরো, মাঝখানে একটা লম্বা-নলওয়ালা গড়গড়া। দেখেই মনে হবে, গানের আসর চলছিল, এই কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে, শিল্পীরা হয়তো পাশেই কোথাও বিশ্রাম করছে। অপর্ণা চারদিকটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, এ আবার কোথায় নিয়ে এলে?
কেন, দেখে বুঝতে পারছিস না কী হয় এখানে?
তা তো পারছি। কিন্তু কাদের বাড়ি এটা? তারা সব গেলই বা কোথায়?
সে খবরে আমাদের দরকার নেই। যাদের নিয়ে দরকার তারা এখনই এসে পড়বে। তার আগে কী করতে হবে মোটামুটি শুনে রাহ্
বলো।—ফরাসের একধারে বসে পড়ল অপর্ণা। বারীন তার মুখোমুখি বসে বলল, একটা বড় রকমের জলসার আয়োজন করেছি। চ্যারিটি শো। তাতে নামছেন—মানে তোদের ভাষায়, অংশগ্রহণ করছেন দুটি মেয়ে। তোর কাজ হল খানকয়েক বাজার-চলতি গান আর গোটা দুই নাচ ওদের শিখিয়ে দেওয়া। ভয় নেই, একেবারে আনাড়ী নয়। কাঠামোটা বোধ হয় তৈরী আছে, দরকার শুধু খড়-জড়ানো থেকে রঙ-ধরানো।
অর্থাৎ কিছুই নয়! বেশ, তা না হয় হল। কিন্তু এই চ্যারিটি শো-টা কাদের জন্যে, জানতে পারি?
বারীন নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম—ইস্কুলের বইতে পড়েছিলে মনে নেই?
অপর্ণা হেসে উঠল। বারীন সে হাসিতে যোগ না দিয়ে উঠে পড়ল। খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ যাদের আনতে যাচ্ছি, তাদের সামনে আমরা কিন্তু পরী আর বারীনদা নই।
তবে?
আমি মিস্টার বোস, আর তুমি আমার পরমশ্রদ্ধেয়া সঙ্গীত-শিক্ষয়িত্রী মিস চ্যাটার্জি।
মিনিট পনেরো পরেই ফিরে এল বারীন। সঙ্গে দুটি মেয়ে। বয়স বোধ হয় অপর্ণার চেয়ে সামান্য কিছু বেশী। দেহে যৌবনের লাবণ্য নেই, আছে তাকে ধরে রাখবার ব্যর্থ প্রয়াসের চিহ্ন। হাবভাব এবং সাজপোশাকে শালীনতার অভাব। চোখে মুখে অহেতুক চাপল্যের কেমন একটা কৃত্রিম চাপা হাসি ফুটিয়ে তুলে তারা যখন কাছে এসে বসল, অপর্ণার দৃষ্টি অপ্রসন্ন হয়ে উঠল। বারীন আড়চোখে একবার সেদিকটায় দেখে নিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলল, আপনার ছাত্রীদের পৌঁছে দিলাম মিস চ্যাটার্জি। নতুন করে আমার আর কিছু বলবার সময় নেই। একটু কষ্ট করে গড়ে-পিটে নিতে হবে, শোটা যাতে · ভালোয় ভালোয় উতরে যায়। আচ্ছা, আপনি তা হলে কাজ শুরু করুন। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘুরে আসছি।
অপর্ণা ততক্ষণে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। হঠাৎ এই ‘আপনি’ এবং ‘মিস চ্যাটার্জি’ হয়ে উঠবার কারণটাও খুব অস্পষ্ট নেই। ওই সম্মানটুকু না দেখালে এই মেয়ে দুটো বোধ হয় প্রথম থেকেই তাকে নিজেদের স্তরে টেনে নামাত। এখনও যে বিশেষ দূরত্ব ছিল তা নয়। একজন মুখ টিপে হেসে বলল, আপনি বুঝি আমাদের মাস্টারনী!
অপর্ণা মনে মনে উত্তপ্ত হয়ে উঠল, কিন্তু কথায় বা ব্যবহারে কোনও তাপ প্রকাশ না করে প্রশ্নটা শুনতে পায় নি এমন ভাবে বলল, আপনারা কে কোন্টা করবেন?
উত্তরের বদলে ছাত্রী দুটি একজন আর-একজনের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। এবারে আর ওর পক্ষে বিরক্তি প্রকাশ না-করা সম্ভব হল না। একটু রুক্ষ স্বরেই বলল, এতে হাসবার কী আছে? গান আর নাচ, কার কোন্টায় অভ্যাস আছে, জানতে চাইছি।
এবারও একজন হাসতে শুরু করেছিল। আর-একজন তাকে একটা ধমক দিয়ে ছদ্ম গাম্ভীর্যের সুরে বলল, চুপ কর্ পোড়ারমুখী, উনি চটে গেছেন, দেখছিস না? তার পর অপর্ণার দিকে চেয়ে বলল, অভ্যাস আমাদের সবই আছে, সবই রাখতে হয়। কিন্তু তা দিয়ে কদ্দূর কী কাজ হবে, সেটা আপনিই ঠিক করে দিন।
এর পর আর কথা না বাড়িয়ে দুজনেরই একটা মোটামুটি পরীক্ষা নিয়ে অপর্ণাকে স্থির করতে হল কে গান করবে আর কে নাচ দেখাবে। বুঝতে পারল, শেখাবার আগে যেটা শিখেছে তাই ভোলানোই হল আসল কাজ। ঘণ্টাখানেক পরে যখন হারমোনিয়াম বন্ধ করল অপর্ণা, একটি মেয়ে তার ডিবে থেকে একখিলি পান বের করে এগিয়ে ধরে বলল, একটা পান খান দিদি।
পান খাই না আমি।
আর-একজন বলল, সেটা আপনার দাঁত দেখেই ধরা যায়। আচ্ছা, ওই বাবুটি আপনার কে হয়?
কেন বলুন তো?
তা হলে ঠিক ধরেছি।—বলে আর-এক দফা হাসির রোল তুলে সখীর গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল।
ফাঁকা ট্রামে বাড়ি ফিরবার পথে অপর্ণা প্রায় সমস্ত রাস্তাটা গম্ভীর হয়ে রইল। বারীন কয়েকবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে এক ফাকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলি? হবে?
অপর্ণা উষ্মার সঙ্গে জবাব দিল, জানি না। আমি ও-সব পারব না।
বারীনের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল। বলল, একেবারে কাঁচা বুঝি? কোনও রকমে দাঁড় করানো যাবে না?
অপর্ণা সে কথার উত্তর না দিয়ে কঠিন সুরে বলল, ওই দুটো জংলী কোত্থেকে জোটালে বলো দিকিন! সভ্যতা দূরে থাক, ভদ্রভাবে কথা বলতেও শেখে নি!
বারীন তেমনি মৃদু হেসেই বলল, ও, এই কথা! তা কী করবি বল? যেখানে ওরা থাকে, সেটা সভ্যতা বা ভদ্রতা শেখবার জায়গা নয়।
কোথায় থাকে ওরা? কী করে?
থাকে একটা বিশেষ পল্লীতে। কী করে, অর্থাৎ ওদের জাত-ব্যবসার চলতি নামটা শুনলে তুই শক্ পাবি। তাই সাধু ভাষায় বলছি, ওরা হচ্ছে পতিতা।
কী বললে! চমকে উঠল অপর্ণা।
বারীন অনেকটা যেন অসহায় কণ্ঠে বলল, উপায় কী বল? ভদ্রঘরের মেয়ে পাই কোথায়? তাই ওদের দিয়েই কাজ চালাতে হয়, জংলীকেই ঘষে-মেজে ভদ্র বানাতে হয়। তা না হলে উপরতলার দর্শকদের রুচিবোধে আটকে যাবে। ভেতরে ভেতরে যে সম্পর্কই থাক, বাইরে নাক সেঁটকাবে, সস্ত্রীক বা সকন্যা আসতে চাইবে না। আমাদের টিকিট বিক্রি হবে না। তাছাড়া অশাস্ত্রীয় কাজ কিছু করি নি। মনু বলে গেছেন, স্ত্রীরত্নং দুষ্কৃলাদপি।
রত্নই বটে! কিন্তু তুমি ওদের পেলে কেমন করে?
ভয় নেই। সরাসরি যোগাযোগ করবার দরকার হয় নি, মাঝখানে দালাল আছে। এই রে, লোকটা যে একখানা হ্যাণ্ডবিল চেয়েছিল! নামকরণটা মনের মতো না হলে বিগড়ে যেতে পারে। দ্যাখ তো, তোর পছন্দ হয় কিনা, মানে ঠিক আর্টিস্টিক হল কিনা নাম দুটো!
নামও বুঝি বানাতে হয়েছে?
পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক বাণ্ডিল কাগজ বের করে একখানা বিজ্ঞাপন অপর্ণার হাতে দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। ওদের আসল নাম হয়তো মিছরিবালা আর বেদানাসুন্দরী। তা হলেই হয়েছে আর কী! নাম শুনে গেট থেকেই সব লোক পালিয়ে যাবে।
অপর্ণা ততক্ষণে হ্যাণ্ডবিল পড়তে শুরু করেছে। কয়েক লাইন পরেই রয়েছে আর্টিস্টদের নাম এবং পরিচয়। চোখে পড়তেই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে সরবে হেসে উঠল।
হাসছিস যে?–প্রশ্ন করল বারীন।
হাসব না! এ কী কাণ্ড করেছ? নৃত্য প্রদর্শন করবে থার্ড ইয়ারের ছাত্রী লিপিকা মজুমদার, এবং সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করবেন নবনীতা ঘোষ, বি.এ.। সর্বনাশ! শুধু কবিত্বভরা নাম নয়, তার সঙ্গে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী!
তার মানে, একাধারে ত্র্যহস্পর্শযোগ। একে তরুণী, উঁচুমহলের বাসিন্দা, তার ওপর উচ্চশিক্ষিতা। এর পরেও যদি পঁচিশ টাকার সব টিকিটগুলো উড়ে না যায়, তা হলে বুঝব, আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার।
কিন্তু আসল জায়গায় যে গোল রয়ে গেল!
আসল জায়গা আবার কোটা?
ওই নৃত্য এবং গীত। প্রথমটায় তাল কাটবে, আর শেষেরটায় সুর।
তা কাটুক। তার আগে আমাদের টিকিটগুলো কাটলেই হল।
কিন্তু মোটা টাকার টিকিট কেটে হল-এ গিয়ে যখন দেখবেন তোমার দর্শকেরা যে গানের সুর নেই আর নাচের তাল নেই, ভঙ্গি নেই, তখন দলসুদ্ধ খেপে গিয়ে তোমাদের মাথা কাটতে চাইবেন না তো?
তুই ভুলে যাচ্ছিস পরী, যে মহলটার উপর আমাদের প্রধান ভরসা, অর্থাৎ যারা পয়সা দেয় এবং দিতে পারে, তারা ও-সব বাজে জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা গান শোনে না, দেখে। কী গাইছে তা তারা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। কে গাইছে, সেইখানেই তাদের আগ্রহ। নাচের বেলাতেও তাই। এটা মণিপুরী, না উদয়শঙ্করী—সে-সব সূক্ষ্ম- বিচারে তাদের দরকার নেই, খানিকটা হাত-পা-ছোঁড়া থাকলেই যথেষ্ট। তার ওপরে যেটা আসল প্রয়োজন সে হচ্ছে নর্তকীটির বয়স, রূপ আর পরিচয়।
দর্শক-মনস্তত্ত্বের এই অভিনব বিশ্লেষণ কৌতুক-মেশানো আগ্রহ নিয়ে শুনে যাচ্ছিল অপর্ণা। বারীন বলে চলল, একটা পয়সাওয়ালা পাড়া আছে এই কোলকাতায়, শিক্ষিতা মেয়ে সম্বন্ধে যাদের দুর্বলতা একটু বেশী। কলেজে পড়া বাঙালী মেয়ে নাচছে, এই খবর পেলেই তারা ছুটে আসবে। সামনের লাইনে বসে মস্ত বড় হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। তাল, মান, লয় রইল কি না রইল, জানতে চাইবে না।
কিন্তু অন্য পাড়ার লোকও তো আসতে পারে, বেতাল লাফঝাঁপ আর বেসুরো চিৎকার দিয়ে যাদের ভোলানো যায় না?
মুশকিল তো এইখানে। অনেকটা যেন নৈরাশ্যের সুরে বলল বারীন, ওই সব নিয়ে মাথা ঘামায় এ রকম একটা বেরসিক সমাজও আছে। তারা হচ্ছে ওই দু-টাকা চার-টাকার দল। পয়সার বেলায় ঢনঢন, এদিকে দাবি করবে ষোলো আনা, আর সেটা না মিটলেই গণ্ডগোল। আমি ইচ্ছা করেই ওই সব ক্লাসের বেশী টিকিট রাখি নি। কিন্তু যারা আসবে তাদের নিয়েই ভাবনা। কী আর করবি বল? ক’দিন একটু খেটেখুটে চলনসই-মতো কিছু একটা দাঁড় করাতেই হবে।
সুতরাং অপর্ণাকে খাটতে হল। ক’দিন নয়, বেশ কিছুদিন; এবং একটু-আধটু নয়, অনেকখানি। কিন্তু তার ছাত্রীদের বিদ্যাবুদ্ধি বা স্বভাবচরিত্রের দিক থেকে যতখানি বাধা বা অসুবিধা সে আশঙ্কা করেছিল, ক্রমশ দেখা গেল তার অনেকটাই অমূলক। বেশ সহজ এবং সুশৃঙ্খল ভাবে কাজ এগিয়ে গেল। অবাধ্যতা দূরে থাক, শ্রদ্ধাই বরং পাওয়া গেল ওদের কাছে। সেই সঙ্গে একটা সরল আন্তরিকতা।
দিন চারেক তালিম দেবার পর একদিন যেমন কাজ সেরে উঠে দাঁড়িয়েছে অপর্ণা, মেয়ে দুটি হঠাৎ ওর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসল। সে বাধা দিয়ে বলল, এ কী করছেন! ওদের একজন বলল, বয়সে ছোট হলেও আপনি আমাদের গুরুজন। আর একজন বলল, এখন থেকে কিন্তু ওই ‘আপনি-টাপনি’ বলতে পারবেন না। আমরা তো আপনার ছাত্রী।
পরদিন দেখা গেল অপর্ণা কিছু বলবার আগে ওরাই এগিয়ে আসছে বিনীত আগ্রহ নিয়ে। জানতে চাইছে, এখানটা কেমন হবে, ওখানটায় কী করবে? ‘দিদি’ বলছে না, বলছে ‘দিদিমণি’।
নির্দিষ্ট দিনে একটা নামকরা থিয়েটার হল ভাড়া নিয়ে শুরু হল জলসা। দেখা গেল বারীনের হিসাবে ভুল হয় নি, অনুমানও মিথ্যা হয় নি। সামনেকার সারিগুলো ভরে গেছে দামী স্যুট সিল্ক বা আদ্দির পাঞ্জাবি এবং জমকালো শাড়ি-গয়নায়। তার মধ্যে একটা বড় অংশে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের পাগড়ি এবং টুপির বাহার। গান এবং বাজনায় যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কজন ছিলেন খ্যাতনামা শিল্পী। কিন্তু সবাইকে ম্লান করে দিল ওই লিপিকা মজুমদার আর নবনীতা ঘোষ। তাদেরই উপরে সমস্ত হলের সহর্ষ দৃষ্টি, আগমন-নির্গমনে বিপুল হাততালির অভ্যর্থনা।
স্টেজের পেছনে নানা কাজের ফাঁকে যখনই তাকিয়েছে অপর্ণা, বারীনের চোখে দেখেছে অর্থপূর্ণ হাসি, অর্থাৎ দেখলি তো? অপর্ণা কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সে তো জানে তার এই মহাবিদূষী ছাত্রী দুটির বিদ্যার দৌড় কতখানি। মারাত্মক ভুল দেখে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে সে ঘেমে উঠেছে, কিন্তু দর্শকদের চোখে কোনও ভাবান্তর লক্ষ্য করে নি। সব একেবারে তন্ময়। অথচ অতবড় সেতারী আফসার খাঁর মালকোষ আলাপ থেমে গেছে অন্তরায়, শ্রোতাদের গোলমাল ভেদ করে এগোতে পারে নি।
কিন্তু এর চেয়েও কত বড় বিস্ময় যে তার জন্যে অপেক্ষা করেছিল, ভাবতেও পারে নি। সেটা হল জলসা শেষ হবার পর। পিছনে একটা ছোট ঘরে বসে সে বিশ্রাম করছিল। আর অপেক্ষা করছিল, ওদিকের কাজ মিটিয়ে বারীন কখন ছাড়া পাবে। এমন সময় তার ছাত্রীরা এসে বসল তার পায়ের কাছে। ওদের মধ্যে যে বড় এবং একটু-আধটু লেখাপড়া জানে, সে বলল, কেমন দিদিমণি?
বেশ ভালই হয়েছে।—উত্তর দিল অপর্ণা।
ভালো হলেই ভালো। এত কষ্ট করে শেখালেন আমাদের।
আমার আর কী কষ্ট! তার চেয়ে অনেক বেশী খাটতে হয়েছে তোমাদের।
মেয়েটি একবার তাকাল তার সঙ্গিনীর মুখের দিকে! চোখের ইশারায় কী কথা হল দুজনের। তারপর আঁচলের আড়াল থেকে একটা কাগজে মোড়া বাণ্ডিল অপর্ণার পায়ের কাছে রেখে দুজনে একসঙ্গে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। অপর্ণা ব্যস্ত হয়ে উঠল, এ-সব আবার কী!
ও কিছু না, সামান্য একখানা কাপড়। কুণ্ঠিত মৃদু কণ্ঠে বলল মেয়েটি, আর কীই বা দিতে পারি আমরা!
কাপড়ই বা তোমরা দেবে কেন? না না, ও আমি নিতে পারব না।
কথাটা নিজের কানেই বড় রূঢ় শোনাল অপর্ণার। ওদের অপ্রস্তুত ভাব লক্ষ্য করে একটু নরম সুরে বলল, তোমাদের কাছ থেকে উপহার পাবার মতো কিছুই তো আমি করি নি।
উপহার! কপালে হাত রেখে বিস্ময়ের সুরে বলল মেয়েটি, হ্যায় কপাল, তোমাকে উপহার দেবো আমরা? জান না, আমরা কোথাকার মেয়ে।
‘কোথাকার মেয়ে’ এই সামান্য ছোট্ট কথাটার মধ্যে এমন একটা কুণ্ঠাময় বেদনার সুর ছিল, যা অপর্ণাকে স্পর্শ না করে পারল না। এতদিন পরে এই বোধ হয় প্রথম পূর্ণ দৃষ্টি মেলে সে ওই পতিতা মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল। সে আরও কুণ্ঠিত হয়ে উঠল এবং মুখ নীচু করে থেমে থেমে বলল, তোমার সঙ্গে আর তো আমাদের দেখা হবে না। তাই ভাবলাম, দুজনে মিলে একখানা কাপড় দিই দিদিমণিকে। কোনোদিন যদি পরো, হয়তো আমাদের কথাটা একবার মনে পড়বে
বলতে বলতে চোখ দুটো হঠাৎ ছলছল করে উঠল মেয়েটির। ঠিক পাশেই মাটির দিকে চেয়ে বসে ছিল তার সঙ্গিনী। ক্ষণিকের তরে মুখখানা তুলে আবার নামিয়ে নিল। গুছিয়ে কথা বলতে শেখে নি। সখীর কথায় জানিয়ে দিল তার নীরব সমর্থন। দুজনের দিকে আর-একবার চেয়ে দেখল অপর্ণা। তারপর কাপড়খানা তুলে নিল কোলের উপর। কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ঢুকল বারীন। মেয়ে দুটিকে লক্ষ্য করে বলল, ও তোমরা এখানে? দুলালবাবু খোঁজ করছিলেন। তোমাদের টাকাকড়ি সব মিটিয়ে দিয়েছি।
নেপথ্যে দুলালবাবুর হাঁকডাকও শোনা গেল। মেয়ে দুটি বারীনকে ছোট্ট একটা নমস্কার করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
দু সপ্তাহ অতিরিক্ত পরিশ্রমের পর সকালের দিকে নিজের ঘরে তক্তপোশের উপর একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল অপর্ণা, দরজার বাইরে বারীনের সাড়া পাওয়া গেল : পরী, ঘুমোচ্ছিস নাকি?
নিশ্চয়ই। আজ সারাদিন ঘুমোব। তুমি আবার কোথায় চললে এই সাতসকালে? বারীন সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘরে ঢুকল, এবং একটা সাদা খাম ওর বিছানার এক পাশে রেখে বলল, এটা তুলে রাখ্
কী ওটা? বলে উঠে বসল অপর্ণা, এবং বারীনের মুখে মৃদু হাসি ছাড়া আর কোন উত্তর না পেয়ে মাথা দুলিয়ে বলল, বুঝেছি, মাস্টারনীর ফী-টা একেবারে হাতে হাতে মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে
ভুল করলি। ফী তো আমার দেবার কথা নয়, পাবার কথা।
কিসের জন্যে, শুনি?
কেন, মাস্টারনীর মাস্টার বলে!
অপর্ণা হেসে উঠল, বটে! তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ তুমি। ফী কেন, কিছুই আমার দেওয়া হয় নি। হয়তো এ জীবনে কোনোদিনই হবে না।
কথাটা হালকা সুরে শুরু করলেও, শেষদিকটা ঠিক হালকা রইল না। বারীন যেন সেটা লক্ষ্য করে নি এমনই ভাবে বলল, সে সব দেনা-পাওনার হিসেব-নিকেশ এখন না করলেও চলবে। আসলে এটা তোরও নয়, আমারও নয়। মাসীমার যে জিনিস কখানা আমরা খুইয়েছি, এ তারই খানিকটা ক্ষতিপূরণ। মনে করেছিলাম সবটাই পুরিয়ে রাখা যাবে, কিন্তু ওদিকে আবার অনেকগুলো মুখ হাঁ করে বসে আছে।—বলে পকেটে হাত দিয়ে আর একখানা খাম স্পর্শ করল।
অপর্ণা মৃদু আপত্তির সুরে বলল, আমি বলছিলাম, এটাও এখন থাক। পরে আবার সুযোগমত—
বারীন তাড়া দিয়ে বলে উঠল, যা বলছি তাই শুনবি, না খালি বকবক করবি কাজের সময়?
আঃ, বকছ কেন? শুনছি তো!
তা হলে ওটা বাক্সে তুলে রাখ। আমি চলি। এ বেলা আর ফিরতে পারব না।
কোন্ দিকে যাচ্ছ?
হাওড়ার দিকে?
উল্টোডাঙ্গায় যাবে না?
কেন, যাবি নাকি তুই?
হ্যাঁ, পৈতে-কাটা মাসীমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে।
তিনি তো নেই।
নেই?
না, দিন দশেক আগে মারা গেছেন।
অপর্ণার মুখে খানিকক্ষণ কোনও কথা সরল না। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছিল?
হয়েছিল একটু জ্বরের মতন। আসল অসুখ তো বুঝতেই পারছিস। বাড়িভাড়া বন্ধ। তারপর পৈতের দাম বলে দু-চার আনা যা নিতেন, তাও অনেকদিন দেওয়া হয় নি। যেতেই পারি নি ওদিকটায়।
ছেলে বা বউ কেউ আসে নি শেষ সময়ে?
বউয়ের কথা জানি না, তবে ছেলে প্রায়ই আসত। মরবার আগের দিনও নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল নিজের বাসায়। উনি যান নি, ওদের দেওয়া কোনও জিনিসও নেন নি।
অপর্ণা আর কোন প্রশ্ন করল না। বুকের ভিতর থেকে শুধু একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। এই মহিলাটি তার কেউ নন। জীবনে মাত্র একটিবার কয়েক মিনিটের জন্যে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর সেই ছোট্ট শুচি ঘরখানিতে বসে সামান্য দু-চারটি মামুলী কথা তবু মনে হল, তাঁর এই শোচনীয় মৃত্যু এমন একটা শূন্য রেখে গেল ওর অন্তরের মাঝখানে, যা হয়তো কোনোদিন পূর্ণ হবে না।
বারীন চলে যাচ্ছিল, অপর্ণা জিজ্ঞাসা করল, রেখাদের খবর কী?
নতুন খবর কিছু নেই। দেশলাই-কারখানাটা শুনছি উঠব-উঠব করছে। তা হলেই মুশকিল হবে। কাল আর হয়ে উঠবে না, পরশু ভাবছি ঘুরে আসব এদিকটায়, তখন যাস্!
কিন্তু সে পরশু আর এল না। তার আগে এল এক অভাবনীয় বিপর্যয়।
তখনও ভোর হয়নি। হঠাৎ একটা তীব্র আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল অপর্ণার। কানে এল বারান্দায় অনেক লোকের পায়ের শব্দ। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই সামনে পড়ল পুলিস। উঠোনেও লাল পাগড়ির ভিড়। খানিকক্ষণ লাগল আচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে উঠতে। তারপর বারীনের ঘরের সামনে গিয়ে দেখল, বিছানাপত্র বাক্স-প্যাঁটরা তছনছ করে চলছে তালাশি। একজন অফিসার জন-দুই সিপাই নিয়ে এগিয়ে এলেন তার ঘরের দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কে থাকে?
অপর্ণা বলল, আমি
কী নাম আপনার?
অপর্ণা।
পুরো নাম বলুন।
অপর্ণা চ্যাটার্জি।
বারীন বোস আপনার কে হয়?
দাদা হন।
অফিসারটি একটু হেসে বললেন, ঠিক বোঝা গেল না। উনি হলেন বোস, আর আপনি চ্যাটার্জি—
অপর্ণা একটু ইতস্তত করে বলল, আপন দাদা নন। এক জায়গায় বাড়ি, ছেলেবেলা থেকে দাদা বলে ডাকি।
আর কিছু নয় তো? —বাঁকা চোখে তাকিয়ে যেন আপনমনে বললেন ভদ্রলোক।
কী বলছেন?
না, কিছু বলছি না। এ বাক্স কি আপনার?
হ্যাঁ।
সার্চ করব?
করুন।
বেশ স্পষ্ট করেই বোঝা গেল, সেই কোকেন-ঘটিত ব্যাপারটা এ তরফ ভুলে থাকতে চাইলেও, পুলিসের তরফ একদিনের তরেও ভোলে নি। আরও দেখা গেল, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলে বাড়িওয়ালাকে ফাঁকি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগের হাত এড়ানো যায় না। এতদিন পরে যেমন করেই হোক ওরা নতুন ঠিকানা খুঁজে বের করেছে, এবং দ্বিতীয়বার পালাবার সুযোগ দেয় নি। কোকেনের গোপন ব্যবসা ছাড়া আরও গোটাকয়েক চার্জও উদ্যত হয়েছিল বারীন বোসের নামে। তার মধ্যে একটা হল—এই সদ্য-সম্পন্ন চ্যারিটি শো। যে প্রতিষ্ঠানের নামে এর লাইসেন্স চাওয়া হয়েছিল, তার কোনও অস্তিত্বই নাকি খুঁজে পাওয়া যায় নি।
তল্লাশি চলল অনেকক্ষণ। কোকেন পাওয়া গেল না। সে রকম কোনও আশা নিয়ে বোধ হয় ওঁরা আসেন নি। দু-একখানা চিঠিপত্র যা পাওয়া গেল তারই সূত্র ধরে আবদুলের সঙ্গে বারীন বোসকেও জড়ানো যাবে, আপাতত এই আশাতেই সেগুলো হস্তগত করলেন। অপর্ণার কাছে যে খামখানা ছিল, তাও চলে গেল পুলিসের ঝোলায়। বারীন তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু ভারপ্রাপ্ত পুলিস-অফিসার বেশ মোলায়েম করে বুঝিয়ে দিলেন, টাকাটা ওদের উপার্জিত এবং সৎপথে উপার্জিত, সে কথা প্রমাণ হলে তৎক্ষণাৎ ফেরত দেওয়া হবে। সার্চলিস্ট অর্থাৎ তল্লাশি-লব্ধ জিনিসের ফর্দে অন্যান্য সব কিছুর সঙ্গে টাকাটারও উল্লেখ রইল এবং তার জন্যে একটা রসিদও কেটে দিলেন ইনস্পেক্টর সাহেব।
প্রথমে আসামী বারীন বোসের সঙ্গে অপর্ণাকে থানায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব উঠেছিল। তার বিবৃতি নেবার পর শেষ পর্যন্ত অত দূর আর ওঁরা অগ্রসর হলেন না। যাবার আগে মিনিট দুয়েকের জন্য বারীন এল ওর ঘরে। স্বাভাবিক সুরেই বলল, চললাম পরী, মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিনের জন্যে। তুই আর কদ্দিন থাকবি এখানে? তার চেয়ে কুমিল্লায় ফিরে যা। আমি বরং তোর বাবাকে একখানা চিঠি লিখে দেবো।
অপর্ণা চমকে উঠল : না, না। তাঁকে কিছু লিখতে যেয়ো না তুমি।
তুই তা হলে কী করবি? কী করে চলবে?
সেই ভাবনাটাই বড় হল? আর এদিকে যে তোমার—। বলতে বলতে অপর্ণার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। বারীনকে আর সময় দেওয়া হল না, পরমুহূর্তে চোর-ডাকাতের মতো হাতকড়া পরিয়ে তাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে গেল, অপর্ণাও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল বিছানার ওপর। চোখের জল আর বাধা মানল না।
কিছুক্ষণ পরেই এল শরণ সিং, যেমন রোজ একবার করে আসে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বারান্দার কোণে। অপর্ণাও যেন বলবার মতো কোনও কথা খুঁজে পেল না। শুধু একবার জানতে চাইল, তাদের তরফ থেকে করবার মতো কিছুই কি নেই? শরণ হতাশ সুরে বলল, কিছুই নেই। তবু একবার যেতে হবে উকিলের কাছে। তার আগে, দাঁড়াও, বাজারটা করে আনি।
না না, বাজার-টাজারে আজ দরকার নেই। একার জন্যে আর রাঁধতে চাই না। খাবার ইচ্ছেও নেই একেবারে।
একা কেন, আমি যে আজ তোমার এখানেই দুটো খাব বলে এসেছিলাম।
সত্যি?
হ্যাঁ। এখান থেকেই সোজা কোর্টে যেতাম—এই বলে একটু এগিয়ে গেল গেটের দিকে। তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি কিছু ভেবো না পরী বহিন। বারীন যদ্দিন না আসে, তোমার শরণদা তো রইল।
ঠিক এই সুরে কোনোদিন কথা বলে নি শরণ সিং। বারীনের একান্ত অনুগত ও অন্তরঙ্গ এই মিষ্টস্বভাবী পাঞ্জাবী যুবকটির কাছে অপর্ণার কোনো সঙ্কোচ ছিল না। ‘পরী বহিন’-এর উত্তরে সেও ডেকেছে ‘শরণদা’, এটা ওটা আনতে দিয়েছে, যখন-তখন ফাই- ফরমাশ খাটিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবে নি, এরই উপরে কোনোদিন নির্ভর করতে হবে। তাই আজ যখন এ অনাত্মীয় বিদেশী মানুষটি অত্যন্ত সহজে কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে জানাল—তোমার কোনও ভাবনা নেই, আমি তো রইলাম, অপর্ণা বিস্মিত হল যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশী হল অভিভূত। কোন কথা না বলে সে শুধু তাকিয়ে রইল শরণদার মুখের পাণে। শরণ একটু এগিয়ে এসে বলল, আমরা গরিব মানুষ। সামান্য একটু কারবার আছে কোলকাতায়। কোনো রকমে দিন চলে। আমাদের যদি এক বেলা জোটে, তোমারও জুটবে। তারপরে যদি দেখি, আর চলছে না, তোমাকে নিয়ে যাব আমার দেশে। কত খুশী হবে আমার বুড়ো বাপ আর আমার মা। একটা মেয়ে নেই বলে ওদের ভারি আপসোস, সে দুঃখ আর থাকবে না।
হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, যাই চট্ করে বাজারটা করে আনি। নটা বেজে গেছে। থলেটা কোথায় পরীবহিন?
শুনতে শুনতে অপর্ণা কেমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল। নামটা কানে যেতেই যেন জ্ঞান ফিরে এল। রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি বাজারের থলেটা নিয়ে এসে তুলে দিল ওর হাতে।
.
দিন কয়েক ঘোরাঘুরি করে উকিলের কাছ থেকে যেটুকু ভরসা পাওয়া গেল, তারই জোরে অনেকখানি এগিয়ে গেল শরণ সিং। তারপর এমন একটা জায়গায় এসে থেমে যেতে হল, যেখানে তার ক্ষুদ্র সঙ্গতির পক্ষে আর তল পাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে অপর্ণার বাক্সে যে সোনাটুকু ছিল, আগেই গেছে। দু-গাছা সরু চুড়ি ছাড়া গায়েও কিছু নেই। সেই শেষ সম্বল যখন সে খুলে দিতে গেল, শরণের কাছ থেকে এল প্রবল বাধা। সোজাসুজি বলে বসল, মেয়েছেলে হয়ে তুমি গায়ের গয়না খুলে দেবে, আর মরদ হয়ে তাই আমি হাত পেতে নেব, সেটা আমাকে দিয়ে হবে না পরী বহিন।
অপর্ণা শুষ্ক কণ্ঠে বলল, কিন্তু তা ছাড়া আর উপায় কী?
উপায় একটা হবেই। দাঁড়াও, একবার বারীনের সঙ্গে দেখা করে আসি। সে নিশ্চয়ই একটা কিছু বাতলে দিতে পারবে।
আমাকেও নিয়ে চলুন না।
তুমি যাবে?
কত দিন হয়ে গেল! একবার দেখতে ইচ্ছে করে কেমন আছে!
সেখানে তুমি নাই বা গেলে বহিন। নীচু ক্লাসের আসামী, তাদের সঙ্গে যারা দেখা করতে যায়, জেলখানার চোখে তারাও ওই নীচু ক্লাস। ভিখিরীর মতো দাঁড় করিয়ে দেয় ভিড়ের মধ্যে। তার ভেতরে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই না। আমি একাই ঘুরে আসি।
নীচু ক্লাসের আসামী! কথাটা কানে যেতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল অপর্ণার। তারপর ভাবল, অস্বীকার বা অভিযোগ করবার সত্যিই কিছু নেই। আইনের চোখে বারীন নিশ্চয়ই আসামী, সমাজের চোখেও অপরাধী। আর উঁচু ক্লাসের লোকও সে নয়। কিন্তু সেইটুকুই কি সব? কার জন্যে কিসের জন্যে সে অপরাধী? গায়ে একটা নিজের-হাতে- কাচা টুইলের শার্ট, আর দু-বেলা দু-মুঠো ডাল-ভাত, এর বেশী তো সে নিজের জন্যে রাখে নি, কোনোদিন কামনাও করে নি। কিন্তু আদালতের কাছে সে প্রশ্ন অবান্তর। সূক্ষ্মদর্শী বিচারক শুধু জানতে চাইবেন, কী করেছে সে? কেন করেছে, সে কথা তাঁর নথিপত্রের কোনও জায়গায় স্থান পাবে না।
বিকালের দিকে এক সময়ে ওদিককার সব খবর জানিয়ে যাবে, এই কথাই বলে গিয়েছিল শরণ সিং। কিন্তু রাত আটটা বেজে যাবার পরেও তার দেখা নেই। বড়ই ভাবনায় পড়ল অপর্ণা! এদিকে কালুর মাও এসে গেল তার ছেলেকে নিয়ে। বরাবরকার পুরনো ঝি। আগে ছিল ঠিকে, দু-বেলা শুধু বাসন মেজে ঘর নিকিয়ে যেত। বারীন চলে যাবার পর অপর্ণা যখন একা পড়ল, ছেলেকে নিয়ে এখানেই শোয় কালুর মা। ব্যবস্থাটা শরণ সিংয়ের। দু-তরফেরই সুবিধে। বস্তির বাসা তুলে দিয়ে ঝি পেয়েছে ভদ্র আশ্রয়, আর অপর্ণা পেয়েছে খানিকটা নিরাপদ সঙ্গ, আর সেই সঙ্গে একটি মনের মতো বন্ধু—ওই কালু। পাঁচ-ছ বছরের ছেলে, আগে আগে ওকে নিয়েই কাজে বেরুত কালুর মা। আজকাল প্রায়ই রেখে যায় দিদিমণির কাছে। সেও বাঁচে ওই দস্যি ছেলের হাত থেকে, অপর্ণাও বাঁচে একজন কথা বলার সঙ্গী পেয়ে। সে কথার না আছে শেষ, না আছে বিষয়বস্তুর অভাব। উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অপর্ণা। কিন্তু ও যখন ঘুমিয়ে পড়ে, কিংবা মায়ের সঙ্গে বাইরে যায়, নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন আর থাকে না, তখনকার ক্লান্তি বোধ হয় আরও বেশী।
শরণ যখন এল, রাত প্রায় সাড়ে নটা। অপর্ণা ছুটে বেরিয়ে এল বারান্দায় : আপনার এত দেরি যে? আমি সেই বিকেল থেকে ঘর-বার করছি! ভালো আছে তো বারীনদা? ভালো আছে বইকি। ও হচ্ছে সেই জাতের মানুষ যারা কোনো অবস্থাতেই খারাপ থাকে না।
খুব রোগা হয়ে গেছে, না?
না তো। আগের মতোই যেন দেখলাম।
অপর্ণা ক্ষণকাল মৌন থেকে বলল, আপনি যে এত রাত করলেন? কোথাও কোনও বিভ্রাট ঘটে নি তো?
না, একটু গঙ্গার ঘাটে বসেছিলাম।
গঙ্গার ঘাটে!
হ্যাঁ, আমার একটা বিশেষ ঘাট আছে। মানে সেই ঘাট নয়, ধারে-কাছে বড়-একটা কেউ আসে না। যখন কোনো ভাবনায় পড়ি, যার কূলকিনারা পাওয়া যায় না, তখন ওইখানটায় গিয়ে বসি।
কথাটা এমনভাবে বলল শরণ, এতখানি উদ্বেগের মধ্যেও হেসে ফেলল অপর্ণা। বলল, তা বেশ। কিন্তু ফল কী হল? নদীর কূলে বসে ভাবনার কূল পেলেন কিছু?
নাঃ, পেলাম না বলেই এলাম তোমার কাছে।
আমার কাছে!
হ্যাঁ, কারণ তার মধ্যে তুমিও আছ, আমিও আছি। তবে তোমার জায়গাটাই বড়। ভূমিকার পরের অংশ শোনবার জন্যে অপর্ণা অপেক্ষা করে রইল। শরণ একবার তার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, বারীনের কাছে পথ জানতে গিয়েছিলাম, তার যতটুকু দেখিয়ে দেবার সে দিয়েছে। বাকিটুকু তোমার হাতে। সেখানে সে জোর করতে চায় না। বার বার করে বলেছে, পরীর মনে যদি এতটুকু দ্বিধা থাকে, সে যেন না এগোয়।
কিছুই অনুমান করতে না পেরে অজ্ঞাত আশঙ্কায় অপর্ণার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কী বলতে চায় শরণদা? এসব কিসের ইঙ্গিত? নিজেকে আর চেপে রাখতে না পেরে সোজাসুজি বলে ফেলল : আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না শরণদা যা বলবার খুলে বলুন।
নিশ্চয়ই। খুলে বলবার জন্যেই তো তৈরী হচ্ছিলাম এতক্ষণ। তার আগে আবার বলছি, এ শুধু একটা প্রস্তাব। নেওয়া না-নেওয়া নির্ভর করছে তোমার ওপর।
ভূমিকা যত বড়ই হোক, আসল কথাটা সামান্য। মিনিট কয়েকের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল অপর্ণা। তার পর মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, আপনারা আমাকে মাপ করবেন শরণদা, এ আমি পারব না।
আমি জানতাম পরী বহিন। বারীনকেও সেটা আগেই বলে এসেছি।
অপর্ণা অধীর হয়ে উঠল : বারীনদার কথা ছেড়ে দিন। মেয়েদের জীবনের কতগুলো দিক আছে, যেখানে সে চিরদিন অন্ধ। কিন্তু আপনিও কি আমাকে—
না, না। আমি তোমাকে কিছুই বলব না। তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ, আমরা আজ সত্যিই নিরুপায়। চারদিক থেকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। পালাবার রাস্তা নেই। ওইটুকুই ছিল একটু সরু পথের মতো। কিন্তু তোমার মন যদি সায় না দেয়, সেখানে তোমাকে কিছুতেই টেনে নামাব না। একটা কথা শুধু আমার মনে হয়েছিল, বলবো?
বলুন।
শুনেছি দেশে যখন ছিলে, তোমরা মাঝে মাঝে থিয়েটার করতে। সেখানে তোমাকে অনেক কিছু সাজতে হত, আউড়ে যেতে হত মুখস্থ-করা পার্ট। তার সবটাই মুখের কথা, মনের কথা নয়। সবটুকুই ছিল অভিনয়। এইমাত্র তোমাকে যা বললাম সেও ঠিক তাই। তফাত শুধু এই যে, এখানে স্টেজে দাঁড়াতে হবে না।
আপনি ভুলে যাচ্ছেন শরণদা, থিয়েটার করতে গিয়ে যা করেছি, অভিনয় বলে জেনে-শুনেই করেছি; যাদের সামনে করেছি, তারাও জানত এটা অভিনয়। তার মধ্যে না ছিল কারও স্বার্থ, না ছিল কারও ভালোমন্দ, লাভক্ষতির তাগিদ। আপনারা যা করতে বলছেন, সেখানে কি তাই? আমার পক্ষে সেটা অভিনয় হতে পারে, কিন্তু আর-একজনের কাছে? সে তো একে সত্যি বলেই নেবে। আমি তাকে ঠকাব, আর ঠকাতে গিয়ে ছোট হয়ে যাব। নিজের কাছে হারিয়ে আসব আমার যা-কিছু আছে সব—আমার মান-সম্ভ্রম, মর্যাদা। তার পরে মেয়েমানুষের আর রইল কী? না শরণদা, আর যা করতে বলেন করব, কিন্তু একজন পুরুষের কাছে নিজেকে পণ্যের মতো তুলে ধরতে পারব না, কোনোমতেই না।
বলতে বলতে মনের মধ্যে সঞ্চিত উত্তেজনার আবেগ তাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিল। হঠাৎ মনে হল, ঘরের ভিতরটা বড় তেতে উঠেছে। তাড়াতাড়ি সে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল একটু হাওয়ার প্রত্যাশায়। শরণ সিং মিনিট কয়েক বসে রইল নিস্পন্দের মতো। তারপর এক সময়ে নিঃসাড়ে বেরিয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল ঝিয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে, দরজাটা বন্ধ করে দাও, কালুর মা।
অনেকক্ষণ পরে কী একটা বলতে গিয়ে অপর্ণার হঠাৎ খেয়াল হল, শরণ চলে গেছে। ঘরে গিয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু একটু পরেই বোঝা গেল সে শুধু পড়ে থাকা আর বিনিদ্র রাত্রির প্রহর গোনা। ঘুমের কোনো সম্ভাবনাই রেখে যায় নি শরণ সিং। অন্তরের উত্তাপ যখন একটুখানি শান্ত হয়ে এসেছে, ওদের দিকটাও মনের সামনে খুলে দেখল অপর্ণা। ওরা দুজনেই যে তার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, সে কথা তার চেয়ে কে বেশী জানে? ঘোর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে তা থেকে রক্ষা পাবার কোনও পথ যখন চোখে পড়ে নি, তখনই বহু দ্বিধা-সঙ্কোচের সঙ্গে এই প্রস্তাব তারা পাঠিয়ে দিয়েছে তার কাছে। সে বিপদ ওদের একার নয়, তার নিজেরও। আজ যদি বারীনকে দীর্ঘদিনের জন্য জেলে যেতে হয়, সংসারে এতটুকু আশ্রয় পাবার মতো স্থানও তার অবশিষ্ট নেই। শরণ সিং শেষ পর্যন্ত তাকে দেশে নিয়ে যাবার ভরসা দিয়েছে। তার মধ্যে তার উদার মনের পরিচয় যাই থাক, সেটা সম্ভব নয়, শোভনও নয়। ঘটনাচক্রে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ আজ বারীনের শুভাশুভের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। শুধু কি তাই? এই স্বার্থের যোগ আর প্রয়োজনের তাগিদ ছাড়া আর কিছুই নেই? নিজের অন্তরকে জিজ্ঞাসা করল অপর্ণা। উত্তরও এল সঙ্গে সঙ্গে। আর কোনও কারণে নয়, বারীনদা বলেই। সে জন্যে, প্রয়োজন হলে সে সব দিতে পারে, দিতে পারে নিজেকেও
পরক্ষণেই মনে হল, এ তো সে দেওয়া নয়। নিজেকে দেওয়ার মধ্যে গৌরব আছে, তার চেয়ে বেশী আছে তৃপ্তির আনন্দ। তার বুকের মধ্যে কোথায় সে অনুভূতি। যে পথ দিয়ে ওরা তাকে নিয়ে যেতে চাইছে, সেখানে পা বাড়ানো দূরে থাক, তার কথা ভাবতে গিয়েই মন যে ভেঙে পড়ছে, ভরে উঠছে লজ্জায়, ঘৃণায়, গ্লানিতে। ছিঃ ছিঃ, এ যে তার নারীজীবনের অপমান! এর পরে সে নিজের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে?
কখনও তন্দ্রায়, কখনও অতন্দ্র জাগরণে সমস্ত রাত কাটিয়ে ভোরে উঠেই অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে এল অপর্ণা। অনেকখানি জুড়িয়ে গেল স্নায়ুর তাপ, মনে ফিরে এল প্রশান্তি। তার সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ ছিল ‘গীতবিতান’। তাই খুলে বসল। গান সে শুধু গাইত না, পড়ত। আজ কিন্তু কবিগুরু তার মন টেনে নিতে পারলেন না। সেখানে ভরা শুধু অবসাদ শুধু ক্লান্তি। তাকেই বোধ হয় সে প্রশান্তি বলে ভুল করেছিল।
একটু পরেই পিওন এসে দিয়ে গেল একটা খামের চিঠি। উপরে টাইপ করা শরণ সিংয়ের নাম। পাঠিয়েছেন ওদের উকিল। তাঁর নাম-ঠিকানাও ছিল লেপাফার বাঁ দিকটায়। মামলার খবর মনে করে সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলল অপর্ণা। তিনশো টাকার মতো একটা হিসাব দিয়ে উকিলবাবু জানিয়েছেন, তিন-চার দিনের মধ্যে দেনাটা মিটিয়ে না দিলে তাঁর পক্ষে এ মোকদ্দমা হাতে রাখা সম্ভব হবে না। আরও লিখেছেন, আগামী তারিখেই বারীনের পক্ষে একজন সিনিয়র উকিল নিযুক্ত করতে হবে। তার জন্যে আরও শ’দুই টাকার প্রয়োজন। সবচেয়ে দরকারী খবর, মামলার অবস্থা আসামীর পক্ষে অনুকূল। খরচপত্র চালিয়ে যেতে পারলে ছাড়া পাবার প্রচুর সম্ভাবনা।
চিঠিখানা দুবার পড়ল অপর্ণা, বিশেষ করে ওই শেষদিকের আশ্বাস। তারপর তাকাল তার ক্ষয়ে-যাওয়া চুড়ি দু-গাছার পানে। গয়না বলতে ওইটুকুই তার অবশিষ্ট সম্বল, খুব বেশী করে ধরলেও যার দাম পঞ্চাশ-ষাট টাকার উপরে নয়।
ঘণ্টাখানেক পরে বাজার করবার তাগিদ নিয়ে যথারীতি হাজির হল শরণ সিং। কোনও কথা না বলে অপর্ণা চিঠিখানা তার হাতে তুলে দিল। শরণের চোখে মুখে বিশেষ কোন আগ্রহ বা কৌতূহলের চিহ্ন দেখা গেল না। মনে হল ভিতরে কী আছে, সেটা তার আগে থেকেই জানা। ধীরে-সুস্থে পড়ে হাসল একটু ম্লান হাসি। তারপর খামখানা পকেটে পুরে বলল, থলেটা দাও।
অকস্মাৎ যেন কোন্ ধ্যান থেকে জেগে উঠল অপর্ণা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শরণের মুখের দিকে আয়ত চোখ মেলে বলল, আমি রাজী আছি শরণদা। আপনি ওদিকের সব ব্যবস্থা করুন।
কিসের! ও-ও! না বহিন, যে-কাজের পেছনে তোমার মনের সাড়া নেই, তার মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। তাতে বারীনের অদৃষ্টে যাই থাক।
না না, আপনি আর বাধা দেবেন না শরণদা। নিয়ে চলুন কোথায় যেতে হবে। যা বলবেন আমি সব করব, সব পারব।
বলেই এগিয়ে এসে শরণের হাত দুটো জড়িয়ে ধরল। ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল চোখের জল।
শরণ সিং নির্বাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে অশ্রুআপ্লুত চোখদুটির দিকে। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ওর পিঠের ওপর হাত রেখে বলল, বেশ, তাই হবে বহিন।
লালদীঘির পূবদিকে বাগানের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মোটর গাড়ির দীর্ঘ লাইন। নানা রঙের এবং নানা আকারের; কিন্তু সবগুলোই বাড়ির গাড়ি। কোনোটাতে ড্রাইভার আছে, কোনোটাতে নেই—মালিক নিজেই চালক। অপর্ণাকে সঙ্গে করে তারই একধারে ফুটপাথের উপর এসে দাঁড়াল শরণ সিং। তখনও পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। চুপিচুপি বলল, চলো আর একটু এগিয়ে যাই। বেশ করে চিনে রাখতে হবে, এর মধ্যে কোন্খানা আমাদের কাজে লাগবে। অপর্ণা নিঃশব্দে অনুসরণ করল। গাড়ির সারির পেছনে ছোট ছোট দলে ড্রাইভারদের জটলা। ক্ষুধার্ত দৃষ্টি মেলে অনেকেই তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। অপর্ণার দৃষ্টি এড়াল না, কিন্তু মনে হল যেন অস্বস্তি বোধ করবার মতো মনের জোরটুকুও হারিয়ে গেছে।
পাঁচটা বাজবার পরেই দামী-স্যুটপরা মালিকের দল আসতে শুরু করলেন। একবার তাকালেই বোঝা যায়, পদে ও অর্থে তাঁরা সব উপরতলার বাসিন্দা। চার অঙ্কের সরকারী কর্মচারী কিংবা রোজগারের দিক দিয়ে তার চেয়েও উঁচু স্তরের—অর্থাৎ বণিকমণ্ডলীর ছোট-বড় তারকার দল। একখানা দুখানা করে গাড়িগুলো সগর্জন ধোঁয়াকুণ্ডলী পেছনে রেখে দ্রুতবেগে ছুটে চলে গেল। একটি বিশেষ ব্যক্তির দিকে নজর দিল শরণ সিং। সুদর্শন যুবক। বেশভূষায় নিখুঁত এবং মার্জিত রুচি। একটু ব্যস্তভাবে এগিয়ে গিয়ে দখল করলেন একখানি ড্রাইভারহীন টু-সীটার। গাড়িতে ওঠবার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন, যখন চোখ পড়ল অপর্ণার দিকে। বুকের ভেতরটা নড়ে উঠল অপর্ণার। চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার একবার না তুলে পারল না। তখনও তাকিয়ে আছে পুরু চশমার পেছনে দুটি চোখ। তার মধ্যে কৌতূহল যতখানি, তার চেয়ে বেশী ছিল বিস্ময়। আর যে কী ছিল জানে না অপর্ণা। কিন্তু ভালো লেগেছিল একখানি বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর মুখের সেই শান্ত উজ্জ্বল দৃষ্টি। শুধু চোখের ভালোলাগা নয়, অন্তরের কোন্ অলক্ষ্য কোণেও বোধ হয় লেগেছিল তার মৃদু স্পর্শ, জেগেছিল ভীরু শিহরণ। ক্ষণেকের তরে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল অপর্ণা। সংবিৎ ফিরে এল শরণের ডাকে। একটা ছোট্ট নোটবুকে কী যেন টুকে নিয়ে সে বলছিল, চলো বাড়ি যাই।
দিন তিনেক পর ইংরাজী মাসের পয়লা তারিখ, যখন পকেটের ওজন বেড়ে যায় এ পাড়ায় ছোট-বড় সকলেরই। এই দিনটির কথা আগেই বলে গিয়েছিল শরণ। আজ সকালে বাজার পৌঁছে দেবার সময় স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল : চারটার সময় তৈরি থেকো। অপর্ণা মাথা নেড়ে জানিয়েছিল, আচ্ছা।
পাঁচটার আগেই আবার এসে দাঁড়াল সেই মোটর-লাইনের সামনে। সেই টু-সীটারখানা আজও ছিল প্রায় একই জায়গায়। মালিককে দূর থেকে আসতে দেখে চুপিচুপি বলল শরণ সিং, যা যা বলতে হবে, সব মনে আছে তো? অপর্ণা এবারেও মাথা নাড়ল কলের পুতুলের মতো। সঙ্গে সঙ্গে শরণ মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
কোন দিকে না চেয়ে একটু জোরে জোরে পা চালিয়ে সেই ভদ্রলোক গাড়ির কাছে এসে পড়লেন। দরজা খুলে ডান দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল, ঠিক পাশেই কেমন কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপর্ণা। যেন কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
মাপ করবেন, আপনি কাউকে খুঁজছেন কি? —গম্ভীর মৃদু কণ্ঠের সহজ প্রশ্ন। অপর্ণার বুকটা আবার কেঁপে উঠল সেদিনের মতো। তখনই মনে পড়ল শরণ সিংয়ের হুঁশিয়ারি—সব মনে আছে তো? একটু কাষ্ঠ-হাসির চেষ্টা করে বলল, না, মানে, আমি এসেছিলাম আমার এক আত্মীয়ের কাছে, ওই আপিসে। এসে দেখলাম তিনি নেই—
তার পর?
ওঁর সঙ্গেই ফিরব বলে বেশী পয়সা নিয়ে বেরোই নি! তাই—
ও-ও। কোথায় যাবেন আপনি?
সে অনেক দূর। বেহালা।
বেশ তো, আমি পৌঁছে দিচ্ছি। অবিশ্যি আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে।
না, আপত্তি আর কী? কিন্তু অতটা পথ খালি-খালি আপনাকে —
তাতে আর কী হয়েছে! ঠিক খালি-খালি নয়, আমার পথও ওই দিকে। একটু শুধু এগিয়ে যেতে হবে! আসুন।—
দরজাটা খুলে ধরলেন ভদ্রলোক। অপর্ণা সসঙ্কোচে উঠে বসল পাশের সীটে।
হাইকোর্ট ছাড়িয়ে মাঠের পথ ধরতেই গাড়ির বেগ বেড়ে গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে অপর্ণার মনের গহনে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, তার বেগ আরও অনেক বেশী। যে পথে তাকে নামতে হয়েছে, যে কাজের ভার মাথায় নিয়ে আজকের এই অভিযান, তার ভিতরকার শঙ্কা, লজ্জা ও চাঞ্চল্য তো ছিলই, তার উপরে ছিল এই গতির নেশা, একজন অজানা পুরুষের এই মোহ-সঞ্চারী সান্নিধ্য, যার আস্বাদ এই প্রথম এল তার কুমারীজীবনে। তার একান্ত পাশটিতে বসে যে ব্যক্তিটি উদ্দামবেগে গাড়ি ছুটিয়ে চলেছেন, এবং মাঝে মাঝে বিস্ময় ও আনন্দ-ভরা সুন্দর চোখ দুটি বুলিয়ে নিচ্ছেন তার মুখের উপরে, কয়েক মুহূর্ত পূর্বেও তিনি ছিলেন তার কল্পনাজগতের বাইরে। এখনও তাঁর কোনও পরিচয় সে জানে না। তবু এ কথা সে নিজের কাছে লুকোবে কেমন করে, তার বুকের রক্তে ঢেউ তুলেছে ওই দৃষ্টিস্পর্শ এবং তারই সঙ্গে মেশানো তাঁর মৃদু নিঃশ্বাসের দোলা। চঞ্চল বাতাসে দু-চারটি চূর্ণ কুন্তল, অবাধ্য আঁচলের একটা কোণ উড়ে গিয়ে পড়েছে তাঁর কাঁধের উপর। মোড় ঘোরাতে গিয়ে ওই নিপুণ বলিষ্ঠ হাতখানি কখন একবার ছুঁয়ে যাচ্ছে তার আড়ষ্ট বাহুপাশ। অন্তরগহনে জাগিয়ে তুলছে মধুর শিহরণ। দুলে উঠছে বুকের রক্তস্রোত।
এমন সময় গাড়ির গতি একটু মন্থর হয়ে এল। হাওয়ার শব্দ কমে গেল। হঠাৎ কানে এল—আচ্ছা আপনি কখনো কুমিল্লায় ছিলেন?
চমকে উঠল অপর্ণা। কোনও কিছু ভাববার আগেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল : হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, তা হলে ঠিক ধরেছি। আপনাকে আমি চিনি। মানে আগে দেখেছি।
আমাকে!
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি তা জানেন না।
গাড়ির বেগ আরো খানিকটা সংযত করে বললেন, আমার বাবা ছিলেন ওখানকার সাব-জজ। বছর তিনেক আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম কদিনের জন্যে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে এ. ডি.-এম. এর বাড়িতে যে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল, সেখানে আপনার গান শুনেছিলাম। আজও কানে লেগে আছে। আর আপনার সেই আরতি-নৃত্য! এখনও যেন চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি। আপনার নামটিও আমার মনে আছে। অপর্ণা দেবী—কেমন তাই না? তার পরেও আপনার খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি—
গাড়িটা একটু রাখুন
সহজ অনুরোধের সুরেই বলতে চেয়েছিল অপর্ণা। তার মধ্যে একটি কেমন ভয় ও ব্যস্ততার উত্তেজনা ফুটে উঠল। ভদ্রলোক বিস্মিত হলেন। বললেন, কেন?
আমি নেমে যাবো।
সে কি! এখানে কোথায় নামবেন এই মাঠের মধ্যে?
তা হোক, আমাকে নামিয়ে দিন। দু-চোখে কাতর অনুনয়।
গাড়ির গতি অনেকখানি কমিয়ে দিলেন ভদ্রলোক, কিন্তু একেবারে থামালেন না। অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, আমাকে আপনি ভুল বুঝেছেন, অপর্ণা দেবী। অনেক দিন আপনার কথা মনে হয়েছে। আজ দৈবক্রমে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায় সত্যিই ভারি আনন্দ পেলাম। তাই হয়তো ঝোঁকের মাথায় এমন কিছু বলে ফেলেছি, যা আমার বলা উচিত ছিল না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যা বলেছি সবটুকু নেহাত সরল মনে না-ভেবে বলা। এর মধ্যে কোনও মতলব বা অভিসন্ধি আমার নেই।
না না, সে কথা আমি বলি নি। সেজন্যে নয়—
তবে?
সে আপনি বুঝবেন না; আমিও বোঝাতে পারব না—প্রায় অবরূদ্ধকণ্ঠে বলল অপর্ণা, দয়া করে এইখানেই আমাকে নেমে যেতে দিন।
কিন্তু আপনি যে বললেন, বেহালায় আপনার বাসা?
মিথ্যে বলেছি।
মিথ্যে বলেছেন!
হ্যাঁ। কিন্তু কেন, তা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। —বলতে বলতে চোখ দুটো জলে ভরে গেল।
এ কী, আপনি কাঁদছেন!
ওঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছে ফেলল অপর্ণা। গাড়ি তখন মাঠ পার হয়ে সবে বসতি অঞ্চলে মোড় নিয়েছে। সেইখানে একটা রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড় করাতেই নেমে পড়ছিল অপর্ণা, ভদ্রলোক অনুনয়ের সুরে বললেন, আমি এখনও বলছি অপর্ণা দেবী, আপনি নেমে যাবেন না। কী হয়েছে, আমাকে খুলে বলুন। আমার যদি কিছু করবার থাকে আমি নিশ্চয়ই করব। এইটুকু বিশ্বাস রাখুন আমার ওপর। আমার কাছ থেকে আপনার কোনাও বিপদ বা অসম্মানের ভয় নেই।
আগ্রহাকুল দৃষ্টিতে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে রইলেন তিনি। কিন্তু অপর্ণা কোনও কথাই বলতে পারল না। শুধু যে অশ্রু সে এতক্ষণ কোনোরকমে ধরে রেখেছিল চোখের কোণে, তাই এবার অবিরল ধারায় গড়িয়ে পড়তে লাগল।
ভদ্রলোক আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে আর একখানা গাড়ি এসে দাঁড়াল তাদের পাশে। তার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ল শরণ সিং আর তারই বয়সী আর-একটি লোক। অপর্ণা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে রূদ্ধশ্বাসে বলল, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলুন শরণদা।
কাজ হল? —চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল শরণ সিং। অপর্ণা যেন বুঝতে পারে নি এমনি বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
টাকা পেয়েছ?—ব্যগ্রকণ্ঠে সোজাসুজি জানতে চাইল শরণ।
না না, ও আমি পারব না, কিছুতেই না। আমাকে নিয়ে চলুন শীগগির!
টাকা! কিসের টাকা? –এগিয়ে এসে বললেন ভদ্রলোক : আপনারা কে, জানতে পারি?
সেটা স্যর, আপনার না জানলেও চলবে। ব্যঙ্গের সুরে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল শরণের সঙ্গীটি। তবে কিসের টাকা, সেটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধি আপনার থাকা উচিত ছিল। মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে গেলে ট্যাঁক থেকে কিঞ্চিৎ—
ওকে থামতে বলুন শরণদা। চিৎকার করে বলতে গেল অপর্ণা, কিন্তু সামান্য একটু ক্ষীণ স্বর শুধু বেরোল তার গলা থেকে
ও, এই ব্যাপার! অনেকটা যেন আপন মনে বললেন ভদ্রলোক : এইজন্য দলবল জুটিয়ে পেছু নিয়েছিলে! আর আমি কী ভেবে কার জন্যে—ইশ! বলে সামনেকার লম্বা চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন ভদ্রলোক। পরমুহূর্তেই যেন একটা রূঢ় ঝাঁকানি দিয়ে টেনে তুললেন নিজেকে। অপর্ণার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, টাকা চাই তোমার? আগে বল নি কেন? তার জন্যে আমার এতদিনের স্বপ্ন ভেঙে দেবার কী দরকার ছিল?
এটা প্রশ্ন নয়। হলেও অপর্ণার কাছে তার উত্তর ছিল না। তার জন্যে তিনি অপেক্ষাও করলেন না। অস্ফুটকণ্ঠে বললেন তিনি, সেই তুমি! আজ এত নেমে গেছ! ছি!
হঠাৎ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করলেন একটা নোটের তাড়া। ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, এই নাও টাকা! আরও চাই?
প্যাকেটটা সজোরে বুকের উপর গিয়ে পড়তেই একটা ক্ষীণ শব্দ করে চোখ তুলল অপর্ণা। ঠিক সামনে কয়েক হাত দূরে তারই দিকে তাকিয়ে আছে দুটি জ্বলন্ত চোখ, তার ভিতর থেকে ঠিকরে পড়ছে শুধু জ্বালাময়ী ঘৃণা। সে দৃষ্টি অসহ্য হল অপর্ণার! আপনার অজ্ঞাতে দু-হাতে চেপে ধরল চোখ দুটো। বুকের উপরটা তখনও জ্বলে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভিতরে সমস্ত অস্থিমজ্জা পুড়িয়ে দিচ্ছিল যে যন্ত্রণা, তার কাছে বাইরেকার এই জ্বালা অতি তুচ্ছ।
একদল লোক—সম্ভবত সিনেমা কিংবা চিড়িয়াখানা-ফেরত, ––কলরব করে চলেছিল ওই পথ দিয়ে। তামাশার গন্ধ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একজন হিন্দীতে জানতে চাইল, ব্যাপার কী?
কুছ নেহি ভাইয়া। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল শরণ সিং : আপলোক যাইয়ে।
কিন্তু ‘যাইয়ে’ বললেই এ রকম একটা লোভনীয় দৃশ্যের মজা ছেড়ে চলে যাবার মতো বেরসিক লোক তারা মোটেই নয়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন দিয়ে ওদের দুজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তাদের কৌতূহলের প্রধান কেন্দ্র ওই ‘জেনানা’। কে সে? এ হেন জায়গায় কী সূত্রে তার আবির্ভাব? শরণের বন্ধুটি, বোধ হয় তাদের হাত থেকে সহজে মুক্তি পাবার আশায় বলে ফেলল, বিশেষ কিছুই নয় ভাই। বাবুটি ওকে নিয়ে ফুর্তি করতে বেরিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত সুবিধে হয় নি।
কৌন বাবু? বলে গর্জে উঠল পাঁচ-সাত জন। একজন ঘুষি বাগিয়ে গেল ভদ্রলোকের দিকে। তিনি তখন গাড়িতে উঠবার আয়োজন করছিলেন। দু-তিন জন দাঁড়াল গিয়ে গাড়ির সামনে। আর-একজন কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিয়ে উঠতেই তিনি প্রতিবাদ করলেন, চোপ রও। সঙ্গে সঙ্গে ঘুষিটা পড়ল গিয়ে তাঁর মুখের উপর। অপর্ণা চিৎকার করে উঠল। শরণ এবং তার বন্ধু এগিয়ে গেল ঠেকাতে। জটলার এক ফাঁকে দেখা গেল, কাঁচভাঙা চশমাটা ঝুলে পড়েছে ওঁর গালের উপর, আর নাকের ভিতর থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। সমস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ দুলে উঠল অপর্ণার চোখের উপর। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দুটো হাত বাড়িয়ে দিল, যেন কোনও আশ্রয়ের খোঁজে। তার পরে কী হল, আর মনে নেই।
অপর্ণার যখন জ্ঞান ফিরল চারদিকটা অন্ধকার। তারই মধ্যে আবছায়ার মতো কে যেন শিয়রে বসে আস্তে আস্তে হাওয়া করছে। জিজ্ঞাসা করল, কে?
আমি, দিদিমণি।
কালুর মা? আমি কোথায়?
তোমার নিজের বিছানায় শুয়ে আছ দিদিমণি। আলো জ্বালব?
জ্বালো। শরণদা কোথায় গেল?
বলতে বলতেই শরণ এসে ঘরে ঢুকল। উৎকণ্ঠার সুরে বলল, এখন কেমন আছ পরী বহিন?
ভালো আছি। আপনি এখনও বাড়ি যান নি?
বাড়ি! সে এক সময়ে গেলেই হবে। রাত বেশি হয় নি। যাও তো কালুর মা, দিদিমণির দুধটা এবার নিয়ে এসো। বেশ গরম আছে তো—
দেখি, যদি না থাকে দুখানা কাগজ জ্বেলে চট্ করে তাতিয়ে নিয়ে আসছি। বলতে বলতে কালুর মা তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল।
এখন আবার দুধ কেন? অনুযোগের সুরে বলল অপর্ণা।
একটু খেতে হবে বইকি। বলে তাকের উপর থেকে নামিয়ে নিয়ে এল একটা কাগজে- মোড়া শিশি।
ওটা কী?
কিছু না, একটু ওষুধ। দুধের সঙ্গে খেতে বলে গেছেন ডাক্তারবাবু।
ছি ছি, এ সব কি ছেলেমানুষি বলুন তো? এই সামান্য ব্যাপারে আবার ডাক্তার ডাকতে গেলেন কেন? কী হয়েছে আমার?
শরণ এ অভিযোগের কোনও উত্তর দিল না। মৃদু হেসে শিশির মোড়কটা খুলে ফেলল। অপর্ণা দু-এক মিনিট কী ভাবল। তারপর বলল, ওঁর কী হল শরণদা? খবর পেয়েছেন কিছু?
কার? ও হ্যাঁ, উনি তখনই বাড়ি চলে গেছেন। গোলমাল দেখে পুলিস এসে পড়েছিল। পরিচয় পেয়ে তারাই ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
একটু থেমে, বোধ হয় ওর উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে লক্ষ্য করে বলল, বেশী কিছু লাগে নি। দু-এক দিনেই ভালো হয়ে যাবেন।
সে টাকাটা?
তোমার বালিশের নীচে আছে।
শরণদা!
কী বহিন?
আমাকে একবার তাঁর কাছে নিয়ে যেতে পারেন?
তাঁর কাছে!
হ্যাঁ, এই নোটের তাড়াটা আমি ফিরিয়ে দিয়ে আসবো।
শরণ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। গভীর দৃষ্টিতে একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে চোখ ফেরালো জানলার বাইরে। খানিকক্ষণ পরে স্নেহার্দ্র কন্ঠে বলল, পরী, তোমার শরীর মন কোনোটাই আজ ঠিক নেই। এই অবস্থায় ঝোঁকের উপর কিছু করতে যেয়ো না। রাতটা কেটে যাক। সকালে উঠে মন সুস্থ হলে ভেবে-চিন্তে যা ভালো বুঝবে তাই কোরো। কেউ বাধা দেবে না।
কালুর মা দুধ নিয়ে এল। তার হাত থেকে প্যানটা নিয়ে পেয়ালায় ঢেলে কয়েক ফোঁটা ওষুধ মিশিয়ে শরণই ধরে দিল ওর সামনে। তারপর বলল, দুধটা খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। ওইটাই এখন তোমার সবচেয়ে বেশী দরকার।
অপর্ণা নতমুখে পেয়ালায় চামচে নাড়তে নাড়তে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয়, মন আমার ঠিক আছে। শুধু ঠিক নয়, স্থির করেও ফেলেছি।
কিন্তু অপর্ণা বোধ হয় তখনও জানে না, ‘স্থির’ কথাটা আর যেখানেই চলুক মন নামক যে বিচিত্র বস্তু বাস করে মানুষের বুকের মধ্যে, তার বেলায় খাটে না। এই মুহূর্তে সে যা স্থির করে, পর-মুহূর্তেই তার সেই সংকল্প যে কোথায় ভেসে যায় সে রহস্য আজও ভেদ করা যায় নি, হয়তো কোনোদিনই যাবে না।
শরণ চলে যাবার পর কালুর মাকেও শুতে পাঠিয়ে দিয়ে বালিশের তলা থেকে নোটের বাণ্ডিলটা বের করল অপর্ণা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল লোহার তার-দিয়ে গাঁথা সেই কাগজগুলোর দিকে। ধীরে ধীরে অনেকদূর চলে গেল তার দৃষ্টি, যেখানে লোহার- গরাদে-ঘেরা জেল-হাজতের অন্ধকারে একদল চোর-ডাকাতের মধ্যে পড়ে আছে বারীনদা, দিন গুনছে হয়তো তারই মুখ চেয়ে—কবে কেমন করে আসবে তার মুক্তি! এই তো সেই মুক্তির দূত! এই পাঁচশো টাকার বিনিময়ে আবার তারা ফিরে পাবে সেই পুরনো দিন। তারপর নতুন করে শুরু হবে তাদের নবজীবনের যাত্রা। এই পথ দিয়ে নয়, এই কুটিল পঙ্কিল গোপন গলিপথ থেকে প্রকাশ্য সরল রাজপথে ফিরিয়ে আনতে হবে বারীনদাকে। সেখানে যা জোটে তাতেই স্বচ্ছন্দে মিটে যাবে তাদের সামান্য প্রয়োজন। যে সংকল্প নিয়ে সে ঘর ছেড়েছিল, এইবার এতদিনে দেখা দিয়েছে তাকে পরিপূর্ণ রূপ দেবার শুভক্ষণ। বড় হবে, মানুষ হবে অপর্ণা। তারপর হয়তো একদিন পূর্ণ হবে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তার মায়ের মনে, যে আশীর্বাদ সেদিন করেছিলেন জেলর সাহেব, যে ভীরু আশা সে নিভৃত মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছে আকৈশোর-
অকস্মাৎ কিসের রূঢ় আঘাতে ছিন্ন হয়ে গেল কল্পনার তার। এ কী ভাবছে সে! যে কাগজগুলোকে আশ্রয় করে মূঢ়ের মতো এই স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে অপর্ণা, তারই আর-একটা রূপ ফুটে উঠল তার চোখের উপর। সেখানে এর পাতায় পাতায় জড়িয়ে গেছে এক দিকে হীন প্রতারণার কালি, আর এক দিকে সুতীব্র ঘৃণার বিষ। শুধু প্রতারণা নয়, নিজেকে হেয়, হীন, বিকৃত করে তুলে ধরা এমন একজনের কাছে, যার চোখে সেই একদিন এনেছিল স্বপ্নের ঘোর, ছায়া ফেলেছিল মনের পাতায়। সে পরমবার্তা কোনোদিন জানতে পারে নি অপর্ণা। আজ যখন জানল, তার পর-মুহূর্তেই দেখল, সে ছায়া মিলিয়ে গেছে। নারী-জীবনের এই সহসা-লব্ধ প্রথম সম্পদ আজ নিজের দোষেই হারিয়ে এল। তার জায়গায় নিয়ে এল দুঃসহ ঘৃণা আর দুস্তর লাঞ্ছনা।
এই কথা মনে হতেই নোটগুলোর স্পর্শে হাত দুখানা যেন জ্বালা করে উঠল। যেখানে ছিল সেইখানেই আবার লুকিয়ে ফেলল প্যাকেটটা। তারপর বিছানার উপর বসে মনে মনে শপথ গ্রহণ করল—যা হারিয়ে এলাম, সে পরম বস্তু আর ফিরে পাব না জানি, তবু যেমন করে হোক, ফিরিয়ে দিতে হবে এই অবজ্ঞালাঞ্ছিত ভিক্ষার দান। কোনও মায়া, কোনও স্বার্থ, রঙিন ভবিষ্যতের কোনও মোহ কখনও যেন সে-পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
বিরুদ্ধমুখী ভাবনার দোলায় দোল খেতে খেতে কখন যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিল, শেষ পর্যন্ত জানতে পারে নি। ভোরের দিকে দেখা দিল এক অদ্ভুত স্বপ্ন। কোন্ এক পাহাড়ী দেশে বেড়াতে গেছে সে আর বারীনদা। চলতে চলতে সামনে পড়ল এক বিরাট গহ্বর। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেল তারই মধ্যে। বারীন হাত বাড়িয়ে দিল কিন্তু সে-হাত সে ধরতে পারল না, তলিয়ে গেল অন্তহীন অন্ধকারে। কেউ কোথাও নেই, শুধু উপর থেকে ভেসে আসছে বারীনের ব্যাকুল ডাক—পরী! পরী! সাড়া দিতে গেল, কিন্তু গলায় স্বর ফুটল না।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে থেকে শোনা গেল শরণ সিংয়ের গলা : পরী বহিন! ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জানলার বাইরে ঝলমল করছে রোদ। ইশ, এত বেলা হয়ে গেছে! ভারি লজ্জিত হল অপর্ণা। তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়ে বলল, যাই শরণদা।
আজ বেশ ভালো বোধ করছ তো? —বাইরে থেকেই জিজ্ঞাসা করল শরণ।
হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। আপনার দেখছি বেজায় ভাবনা হয়েছে আমাকে নিয়ে! বলে দরজা খুলে দিল।
ভাবনা হবে না! কাল তো রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আজ এত বেলা পর্যন্ত ওঠ নি দেখে—
ভাবলেন বুঝি মরে গেলাম!
ছি:, ওসব কথা কখনও বলতে আছে? বলে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকাল ওর সদ্য-ঘুম- ভাঙা প্রফুল্ল মুখের পানে। বলল, এবার চোখে মুখে জল দিয়ে একটু চা খেয়ে নাও। আজ আর রান্নার দিকে গিয়ে কাজ নেই। কালুর মা ওদিকের কাজ সেরে এখনই আসছে। ওই দুটো চাল ফুটিয়ে দেবে। বাজার-টাজার সব করে রেখে গেলাম।
আপনি এখন যাচ্ছেন কোথায়?
বাবা আসছে নটার গাড়িতে। স্টেশনে আমাকে না দেখলে বুড়ো ওইখানেই বসে পড়বে। এবেলা আর আসা হয়ে উঠবে না। বিকেলে আসব। তারপর যেতে হবে উকিলের বাড়ি।
উকিলের উল্লেখে গতরাত্রির চিন্তাস্রোত আবার নতুন করে ফিরে এল। বিশেষ করে সেই শপথের কথা। মনে হল, শরণ সিংহের বাবা অসছেন, সকালে সে থাকতে পারল না, যেতে পারল না উকিলের কাছে—এটা যেন বিধাতার ইঙ্গিত। এমনি করে তিনিই যেন ঘটিয়ে দিলেন তার সংকল্পসিদ্ধির সুযোগ। সকালেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে।
নোটের প্যাকেটটা আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে কোনো একটা থানায় গিয়ে পৌঁছল অপর্ণা। থানা-অফিসারের কাছে কালকের ঘটনার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে বলল, টাকাগুলো সেই ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিতে চাই। তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন, তাঁর নাম-ঠিকানা বলতে পারেন?
না।
তা হলে তাঁকে খুঁজে পাব কোথায়?
গাড়ির নম্বর আছে; তাঁর নিজের মোটর। তা থেকে খোঁজ পাওয়া যাবে না?
তা হয়তো যায়। কিন্তু তার আগে আপনার আসল উদ্দেশ্যটা কী, খুলে বলুন তো?
সেকথা আপনাকে আগেই বলেছি। এই টাকাগুলো তাঁর হাতে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।
কিন্তু আপনি নিজে যে পুলিস কেসে জড়িয়ে পড়বেন, তা বুঝতে পারছেন?
পারছি, তবু এ ছাড়া উপায় নেই।
আপনার বয়স অল্প। দেখে বুঝতে পারছি, ভদ্রঘরের মেয়ে। সাধ করে এসব কেলেঙ্কারি মাথায় তুলে নিচ্ছেন কেন?
তার উত্তর আমি দিতে পারব না। দিলেও হয়তো আপনি মানতে চাইবেন না। আমি যা করতে যাচ্ছি, তার সব ফলাফল জেনে-শুনে তার জন্যে তৈরী হয়েই করছি। আপনি শুধু আমাকে একটু সাহায্য করুন। হয় ওঁকে এখানে ডেকে পাঠান, নয়তো আমাকেই পাঠিয়ে দিন তাঁর কাছে।
দাঁড়ান দাঁড়ান, একটু ভাবতে দিন। মহা ফ্যাসাদে ফেললেন দেখছি! হয় তিনি এখানে আসবেন, না হয় আপনি সেখানে যাবেন—এই তো? আচ্ছা বসুন আপনি।
অফিসারটি উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে টেলিফোনে কী সব আলোচনা করলেন, বোধ হয় কোনও উপরওয়ালার সঙ্গে। তারপর ফিরে এসে বললেন, আপনি যা চাইছেন তার কোনোটাই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপাতত আপনাকে কনফেসিং অ্যাকিউজ্ড্—মানে একরারী আসামী হিসেবে কোর্টে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানে হাকিমের কাছে আপনার সব কথা খুলে বলবেন।
তারপর?
তারপর আপনার নামে মামলা দায়ের হবে। যে ভদ্রলোককে আপনি ঠকিয়েছেন, কোর্ট থেকে সমন যাবে তাঁর কাছে। ওখানেই তাঁকে দেখতে পাবেন।
কোর্টে নেবার পর এস. ডি ও.-র সামনে যখন ওকে হাজির করা হল, তিনি ওকে ভেবে দেখবার সময় দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন নিজের খাস কামরায়। অনেকক্ষণ পরে নিজেই এলেন সেখানে। বারংবার জানতে চাইলেন, তার এই স্বীকারোক্তির পেছনে পুলিস বা. অন্য কারও কোনও জুলুম বা প্ররোচনা আছে কিনা। অপর্ণা জানাল, না।
এমনও তো হতে পারে—প্রশ্ন করলেন হাকিম, আমার কাছে এই যা বলছেন, তেমন কোনও ঘটনাই ঘটে নি, এ সব কিছুই করেন নি আপনি, শুধু কারও ভয়ে, কারও ওপর কৃতজ্ঞতা দেখাতে কিংবা কাউকে বাঁচাতে গিয়ে এই মিথ্যা অপবাদ আপনি নিজে ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন?
অপর্ণা তেমনি দৃঢ়স্বরে জানাল, না।
তবু হাকিমের সন্দেহ দূর হল না। তাই কোর্ট-ইনস্পেক্টরকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁরই হেফাজতে ওঁকে পাঠিয়ে দিলেন জেলখানায়। চাপা গলায় ইংরেজিতে তাঁকে কী সব নির্দেশ দিয়ে অপর্ণার দিকে ফিরে বললেন, জেলে পাঠাচ্ছি বলে মনে করবেন না, আপনি কোন অপরাধ করেছেন। কী বলছেন, কেন বলছেন, যা বলতে যাচ্ছেন সে সব সত্যি না মিথ্যা, কী লাভ বলে, ক্ষতিই বা কতখানি—নির্জনে বসে সব আর-একবার তলিয়ে ভেবে দেখুন। তারই সুযোগ দিলাম। ওখানে আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।
দীর্ঘ কাহিনী শেষ করে যেন একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল অপর্ণা। তারপর মুখে একটু মৃদু হাসি টেনে এনে আমার দিকে চেয়ে বলল, জেলের নাম শুনে বুকটা একবার কেঁপে উঠেছিল বইকি। তখন তো জানি না, কত বড় সৌভাগ্য আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে!
হেসে ফেললাম : সৌভাগ্য!
সৌভাগ্য নয়? কতকাল পরে আপনাকে দেখলাম। এ যে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবি নি।
মোকদ্দমার প্রথম তারিখে হাকিমের এজলাসে অপর্ণার ডাক পড়ল না। কোর্ট-হাজতে কয়েক ঘণ্টা বসে থেকে সন্ধ্যাবেলা ফিরে এল জেলখানায়। আবার তারিখ পড়ল পনেরো দিন পরে। এদিন আর ফিরে এল না। তার বদলে এল একটা স্লিপ। সমাদ্দার সাহেব লিখেছেন, হাজতী আসামী অপর্ণা চ্যাটার্জির নামে কোর্টে যে পাঁচশো টাকার ক্যাশ ডিপোজিট আছে, তার রসিদখানা দয়া করে লোক-মারফত পাঠিয়ে দেবেন। অপর্ণা ওঁর আঁচল থেকে খুলে সেই হলদে কাগজখানা আমারই কাছে রাখতে দিয়েছিল। পাঠিয়ে দিলাম।
দিন চারেক পরে সমাদ্দার সাহেব আবার এলেন কী কাজে। বললেন, তাজ্জব ব্যাপার মশাই! ছাব্বিশ বছর চাকরি হল, তার মধ্যে এরকমটা কখনও দেখি নি, শুনিও নি কোনোদিন। আপনি তো শুনি গল্প-টল্প লিখে থাকেন। শুনে রাখুন। চমৎকার প্লট। হয়তো একদিন কাজে লাগবে।
প্লটের লোভে না হলেও কৌতূহলের বশে উৎকর্ণ হলাম। সমাদ্দার সাহেব তাঁর তাজ্জব কাহিনীর একটা সরস বর্ণনা দিয়ে শেষের দিকে যোগ করলেন, আসামীকে জিজ্ঞেস করলাম—এই কি সেই বাবু যাকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা নিয়েছিলে? স্পষ্ট ভাষায় উত্তর এল—হ্যাঁ। তার পর স্টেটমেন্টে যা কিছু বলেছে, আমার প্রশ্নের জবাবে একে একে কনফার্ম করল। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই স্রেফ অস্বীকার। সোজা বলে দিল, ‘আমি ওকে চিনি না, কখনও দেখিও নি। যে ঘটনা শুনলাম, সে রকম কোনো উপন্যাস আমার জীবনে ঘটে নি।’ আসামী রুখে উঠল। ডকে দাঁড়িয়ে সে কী চিৎকার : ‘মিথ্যা কথা বলছেন উনি। এ টাকা ওঁর। আমি ঠকিয়ে নিয়েছিলাম। সাক্ষী কিছুতেই স্বীকার করল না। হাকিম আর কী করবেন, প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিলেন মেয়েটিকে, সেই সঙ্গে টাকা ফেরত দেবার অর্ডার।
তারপর?
তারপর আর কী, টাকার প্যাকেটটা আনিয়ে তুলে দিলাম ওর হাতে। চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
***
এ কাহিনী যেদিন শুনেছিলাম, তারপর সাত-আট বছর চলে গেছে। অপর্ণার কথা ঝাপসা হতে হতে কখন মিলিয়ে গেছে মনের কোণে। মনের আর দোষ কী? প্রতিদিন নতুন নতুন অপর্ণার ছায়া পড়ছে তার দপর্ণের গায়ে। একজনকে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে গেলে তার চলে না। কিংবা দর্পণ না বলে বলতে পারেন, স্লেট। এই মুহূর্তে যা লেখা হয়, পর-মুহূর্তে মুছে যায়। তার পর ক্রমাগত চলতে থাকে ওই লেখা, আছে মুছে ফেলার পালা। তাই তো করে চলেছি জীবনভোর। জানি না, এর শেষ কোথায়
একদিন সকালের ডাকে অন্য সব চিঠিপত্রের সঙ্গে এল একটা খাম। অচেনা হাতের লেখা। সর্বাঙ্গে পোস্ট-অফিসের ছাপ। নামটা আমারই, ঠিকানাটা সাত বছরের পুরনো। তার উপরে লাল কালির কলম চালিয়ে কোনও পরিচিত বন্ধু কী মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমার বর্তমান ঠিকানায়। খাম খুলতেই বেরিয়ে এল সেই চিঠি, যার উল্লেখ করেছি এই দীর্ঘ আখ্যায়িকার সূচনায়। রুল-টানা খাতা থেকে ছিঁড়ে-নেওয়া একটু কাগজ। তার উপরে কয়েকটা মেয়েলী হাতের লাইন।
শ্রীচরণকমলেষু,
আপনার আশ্রয় ছেড়ে যেদিন চলে এলাম, তার পর এই আমার প্রথম চিঠি। জানি না, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন। এতদিন পর যে আবদার নিয়ে এলাম আপনার কাছে, পৌঁছে দিতে পেরেছি কিনা, তাও আমার অজানাই থেকে যাবে। এইটুকু শুধু জানি, সারাজীবন পথ চেয়ে থাকলেও এ চিঠির কোনও উত্তর আমার আসবে না, কোনোদিন পাব না আপনার হাতের একটু চিহ্ন, স্নেহমণ্ডিত দুটি লাইন, তার নীচে একটি অম্লান স্বাক্ষর। সে পথ আমাকে নিজের হাতেই বন্ধ করতে হল। আমি কোথায় আছি, সে কথা আপনাকে জানাবার উপায় নেই। কেন? সে জবাবটাও মুখ ফুটে বলতে পারব না।
জীবনে দুটিবার মাত্র আপনার সঙ্গে দেখা। যা পেয়েছি অন্তরভরে আছে। আমি আর কী দিতে পারি! আপনার পায়ের তলায় রইল আমার ঠিকানাহীন চিঠি।
আমার মামলার ফল সেদিন না হলেও, তার কদিন পরে নিশ্চয় জানতে পেরেছিলেন। একবার মনে হয়েছিল, আপনার কাছেই ফিরে যাই। দাঁড়াবার মতো একটা জায়গা, বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবার মতো একটা কোনও আশ্রয় হয়তো আপনি জুটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু কোন্ মুখে যাব? আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের কানে যখন শুনলাম—তিনি আমাকে চেনেন না, কোনোদিন দেখেন নি, যা বলেছি সব মিথ্যা, সেই লজ্জার বোঝা মাথায় নিয়ে কী বলে কেমন করে দাঁড়াব আপনার চোখের সামনে! তাই যাওয়া হল না। এত কাণ্ডের পর শরণদার কাছে গিয়েও উঠতে পারি নি। ওরা যা চেয়েছিল তা যখন দিতে পারলুম না, কথা দিয়েও তা রাখা গেল না, তখন আর ওকে বিব্রত করি কিসের জোরে? তার পর কোথায়, কেমন করে আমার দিন কেটেছে, সে কথা আমার বলবার নয়।
এক দিন নয়, দু দিন নয়, কতগুলো বছর! মন যখনই ভেঙে পড়তে চেয়েছে, এই বলে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছি, তিনি তো দিয়েছিলেন—আমার অজ্ঞাতে আমারই জন্যে অঞ্জলি ভরে রেখেছিলেন। আমি হাত পাততে পারি নি। তাই পেলাম না। কিন্তু একেবারে যে পাই নি তা নয়। অমৃতের বদলে পেয়েছি বিষ। তবু তো পেয়েছি। আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক সেই ঘৃণার দান। এই কথা ভেবেই, বহু দুঃখে বহু অভাবে পড়েও সেই বাণ্ডিলের একখানা নোটও আমি নষ্ট করি নি। আজও সব তেমনই তোলা আছে।
তার পর মনে হল, ওটা সান্ত্বনা নয়, প্রতারণা। নিজের মনকে মিথ্যা দিয়ে ঠকানো। ঘৃণা নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকা যায় না।
একদিন যখন নিতান্ত অসহ্য হল, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলুম না। লজ্জার মাথা খেয়ে অনেক খুঁজে খুঁজে গেলাম তাঁর বাড়ি। কিন্তু এবারেও আমার হার হল। দেখা পর্যন্ত করলেন না। দরজা থেকে ফিরে এলাম।
যাক সে কথা। যা বলতে বসেছি, তাই এবার বলি।
সেদিন আপনার ‘লৌহকপাট’ পড়লাম। ছদ্মনামে লিখলে কী হয়, আমার কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেন নি। ওই হাত, ওই মন, ওই দরদ, ওর সবটাই যে আমার চেনা। এতটুকু থেকে যার স্বাদ পেয়েছি, তা কি কখনও ভোলা যায়? যে প্রাণ একদিন ধরা দিয়েছিল শ্যামল বাংলার কিশোর মনের কাছে, তারই স্পর্শ পেয়ে অমর হয়ে রইল জেলখানার মানুষ। ওইখানে গিয়েই তো আপনাকে আবার নতুন করে পেলাম। যা কাউকে বলবার নয়, এ বিড়ম্বিত জীবনের সেই তুচ্ছ কাহিনী নামিয়ে দিয়ে এলাম আপনার পায়ের কাছে। আশা আছে, যত তুচ্ছই হোক, আপনার স্নেহবর্ষী লেখনীর মুখে সে একদিন রূপ নেবে। শুধু আশা নয়, এটা আমার শেষ আবেদন।
আপনি হাসছেন? না, অমর হবার সাধ নেই। শুধু একটি বারের জন্য চোখের সামনে দাঁড়াতে চাই। সেদিন দেখে এলাম তাঁর লাইব্রেরি, পরিজনহীন শূন্য গৃহের যে কোণটিতে বসে তাঁর অবসর কাটে। আপনার লেখা কোনদিন নিশ্চয়ই তাঁর হাতে পড়বে। যদি পড়ে, হয়তো একবার চোখ মেলে দেখবেন সেই লজ্জাহীনা অপর্ণাকে, একদিন যার দিক থেকে কঠোর ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তারপর শত অনুনয়েও যাকে চোখের দেখা পর্যন্ত দেন নি। সেদিন হয়তো ক্ষণেকের তরেও মনে হবে, যতখানি হেয় বলে তার মুখদর্শন করেন নি, ঠিক ততখানি হেয় বোধ হয় সে নয়।
শতকোটি প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
আপনার স্নেহের অপর্ণা।