বর্ণাকার

লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্টে ফিরিয়াই একটা মস্ত বড় পরিবর্তনের মধ্যে পড়িয়া গেলাম।

যখন বাসায় পৌঁছিলাম, সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। জামা জুতা ছাড়িয়া বারান্দায় আসিয়া একটা ডেক্‌-চেয়ারে গা এলাইয়া দিলাম। সাঁতরার এই কয়টি দিনের অভিজ্ঞতা এত ঘনীভূত, আর আমার বর্তমান জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে এত বিভিন্ন যে, মনে হইতেছে কত দূর আর কত দীর্ঘ এক প্রবাস হইতে ফিরিলাম যেন। কোন্‌টা যে প্রবাস তাহাও ঠিক বুঝিতেছি না। মনটা স্মৃতির ভারে বিষণ্ণ হইয়া আছে — সুখের স্মৃতি, আবার সৌদামিনীর স্মৃতিও। বেশি মনে পড়িতেছে সৌদামিনীর কথাই,—আহা!

নীচে লোক কেহ নাই, বাড়িটি প্রথম করিতেছে, এসব বাড়ি করেই, আজ যেন বেশি। আমার মনের ঔদাসীন্যের জন্যই কি?

ইমানুল আসিয়া উপস্থিত হইল; সেই রকম বিরহক্লিষ্ট, হাতে একটি ফুলের তোড়া। সেলাম করিয়া দন্ত বাহির করিয়া একটু হাসিল, প্রশ্ন করিল, “ভাল থাকছিলেন মাস্টার-বাবু?”

বলিলাম, “ছিলাম একরকম। তোমার খবর কি ইমানুল? বাড়িতে কাউকে দেখি না যে?”

ইমানুল বলিল, “আপনাকে আসতে দেখে ভাবলাম একটা তোড়া দিয়ে আসি। দাঁড়ান, রেখে আসি এটা অন্দরে।”

তোড়াটা ফুলদানিতে বসাইয়া ইমানুল আমার সামনে থামে ঠেস দিয়া বসিল, বলিল, “দিদিমণিরা বাইরে গেছেন।…মদন ক্লীনার একটা কথা বললে মাস্টার-বাবু, বলে পাদ্রীকে লিখে কিছু হবে না, বলে তাকেই সোজা লেখ, সে তো সাবালিকা হয়েছে…”

একটু উদ্বিগ্নভাবেই প্রশ্ন করিলাম, “লিখেছ নাকি?”

ইমানুল লজ্জিতভাবে একবার আমার পানে চাহিয়া ঘাড়টা নীচু করিল। উত্তরটা বুঝিতে পারিয়া কহিলাম, “না, বলছিলাম—নিয়েছ লিখিয়ে কাউকে দিয়ে?”

ইমানুল লজ্জিতভাবে বলিল, “ইংরিজীতে লিখতে হবে…”

বলিলাম, “ও! তাও তো বটে, তা দোব লিখে।”

সামান্য একটু থামিয়া ইমানুল বলিল, “মদন ক্লীনার একটা পদ্য দিয়েছে মাস্টার-বাবু, সেটাও ইংরেজীতে তর্জমা ক’রে…”

ইমানুল বোধ হয় পদ্যটা বাহির করিবার জন্যই ফতুয়ার পকেটে হাতটা সাঁদ করাইয়াছে, এমন সময় গেটে মোটরের হর্ন বাজিয়া উঠিল। ইমানুল অপ্রতিভভাবে তাড়াতাড়ি উঠিয়া গেট খুলিতে ছুটিল।

গাড়ি-বারান্দায় মোটর আসিয়া দাঁড়াইলে মীরা আর তরু নামিল। আমাকে দেখিয়াই মীরা তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া প্রশ্ন করিল, “এসে গেছেন তাহ’লে আপনি? ভাবছিলাম আপনাকে গাড়ি পাঠাব। …মার সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

মীরার দৃষ্টি খানিকটা উদ্ভ্রান্ত, তরুও উৎকণ্ঠিতভাবে আমার পানে চাহিয়া আছে। আমি উত্তর করিলাম, “না, আমি এই আসছি, করিনি তো দেখা এখনও।…কেন?”

“বলেনি কেউ? ভুটানী মারা যাওয়ার পর থেকে মা বড্ড বেশি…”

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “মারা গেছে ভুটানী?”

মীরা বলিল, “ইমানুল বসে ছিল না আপনার কাছে? বলেনি? উজবুক একটা; আসতেই বুঝি পোস্টকার্ড এনে হাজির করেছে? …আসুন ভেতরে! তরু তুমি জামাকাপড় ছেড়ে মার কাছে গিয়ে বস, আমি আসছি।”

ভিতরে গিয়া ফ্যানটা খুলিয়া দিয়া মীরা একটা সোফায় বসিল। আমি সামনে একটা চেয়ারে বসিলাম। মীরা বলিতে লাগিল, “ভুটানী এক রকম হঠাৎই কাল বিকেলে মারা গেল, যদিও ও যে আর বেশি দিন নয় এটা ক্রমেই স্পষ্ট হ’য়ে আসছিল। মারা যেতে মা একেবারে আশ্চর্য রকম উতলা হ’য়ে উঠলেন, শৈলেনবাবু! ঠিক যে শোকের ভাব তা নয়; অদ্ভুত রকম একটা নার্ভাসনেস্। বাড়িতে বাবা নেই—এখনও আসেননি তিনি, পূর্ণিয়ার কেসটা নিয়ে আটকা পড়ে গেছেন—আমি যে কী অবস্থায় পড়ে গেলাম বলতে পারি না। আপনি থাকলেও একটা পরামর্শ করবার লোক পেতাম—ফোন ক’রে সরমাদি আর নিশীথবাবুকে ডেকে আনলাম। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে ডাক্তার রায়কে ফোন করা হ’ল। তিনি সব শুনে বললেন তাঁর আসাটাই ভুল হবে, কেন-না মার তো হয়নি কিছু, শুধু একটা ভয়ানক নার্ভাস শক্‌ পেয়েছেন, বরং এ অবস্থায় ডাক্তারকে দেখলে উটোই ফল হওয়ার সম্ভাবনা। বললেন, বরং যদি কাঁদবার ঝোঁক থাকে তো কাঁদতে দেওয়া ভাল। কিন্তু কাঁদবার ঝোঁক নয় তো, একটা যেন ভয়ংকর ভয়ের ভাব। বেশির ভাগই চুপ করে থাকেন, মাঝে মাঝে শুধু বলেন, ‘তাহ’লে আমার কি হবে?’ সে যে কী অবস্থায় কেটেছে আমাদের বলতে পারি না, শৈলেনবাবু। বাবাকে আজ সকালেই টেলিগ্রাম করেছিলাম, এখনও উত্তর পাইনি। তিনিও যে কেমন আছেন…”

মীরা তাহার বাবার সম্বন্ধে সভয়ে উল্লেখ করিতে গিয়া হঠাৎ যেন ভাঙিয়া পড়িল। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া গেল, চোখ একবার একটু ছলছল করিয়া উঠিয়াই স্বরবিগলিত ধারায় অশ্রু নামিল। মীরা সোফার হাতলে মুখ গুঁজিয়া কচি মেয়ের মত কাঁদিয়া উঠিল।

ওর চব্বিশ ঘণ্টাব্যাপী নিঃসহায় ভাব, ক্লান্তি, উদ্বেগ, আর বাবার উত্তর না পাওয়ায় এই আশঙ্কা ও অভিমান সব একসঙ্গে ওকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। কারণটা নিশ্চয়ই এই যে, এমন একজনকে কাছে পাইয়াছে যাহার উপর ওর একটা আন্তরিক নির্ভর আছে। সমবেদনায় আমার সমস্ত অন্তঃকরণ ব্যথিত হইয়া উঠিল, কিন্তু কি করি আমি?

ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল মীরা। আমি নিরুপায়ভাবে খানিকটা চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম, তাহার পর নিজের চিন্তাধারা খানিকটা গুছাইয়া লইয়া বলিলাম, “মীরা দেবী, আপনি শান্ত হন। বিপদের সময় অতটা ব্যাকুল হ’লে চলে কি? মিস্টার রায়ের সম্বন্ধে কোন ভাবনা নেই; তিনি নিশ্চয়ই কাজ নিয়ে ওখান থেকে আবার অন্য কোথাও গেছেন, কাল সকাল নাগাদ খবর পাওয়া যাবে। কিংবা এও হতে পারে আপনার টেলিগ্রাম পৌঁছবার আগেই উনি বেরিয়ে পড়েছেন। আপনি স্থির হন। আর মার সম্বন্ধে আপনি একটু বেশি নার্ভাস হ’য়ে পড়েছেন। ওঁর শরীরটা দুর্বল নিশ্চয়, কিন্তু ওঁর মাথা বেশ পরিষ্কার আছে, এই আঘাতে অন্য কোন রকম ভয়ের সম্ভাবনা নেই। ওঁর সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা খুব দরকারী—জানি না সেটা করা হয়েছে কি না—আপনি যে রকম বিচলিত হ’য়ে পড়েছেন।”

মীরা অনেকটা সংযত করিয়া লইয়াছে নিজেকে। আমি থামিতেই মুখটা একটু তুলিয়া সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল। বলিলাম, “ওঁকে ও-ঘরটা বদলে অন্ত ঘরে আনা দরকার কয়েক দিনের জন্যে। অষ্টপ্রহর ভুটানীর সঙ্গে যে রকম ছিলেন ওখানে, তাতে…”

ব্যাপার সামান্যই, কিন্তু মীরা যেন একটা আলোকরশ্মি দেখিতে পাইল। কৃতজ্ঞতাপূর্ণ মিনতির দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া বলিল, “আপনি বলুন ওঁকে। সত্যিই বড় ভাল হয় তাহলে।”

বলিলাম, “আমি বলছি গিয়ে, রাজিও করাব। আপনি আসবেন কি?”

মীরা চোখ মুছিয়া সোজা হইয়া বসিল। বলিল, “আপনি একলাই যান। যে নিজে অভিভূত হ’য়ে পড়েনি এমন লোকই থাকা দরকার ওঁর কাছে। আমার মুখে একটা আতঙ্কের ছায়া আছে, মা আমায় দেখে আরও যেন ব্যাকুল হ’য়ে ওঠেন, শৈলেনবাবু। আমি বুঝছি, অথচ…”

নিরুপায় করুণ দৃষ্টিতে মীরা আমার পানে চাহিল। চক্ষু আবার ডবডব করিয়া উঠিতেছে! দেখিলে কষ্ট হয়, ইচ্ছা হয় নিজের হাতে মুছাইয়া দিই অশ্রুবিন্দু দুইটি।

সেই মীরা আজ আমার কাছে এত দুর্বল হইয়া পড়িল? গভীর দুঃখই কি আসল সম্বন্ধের কষ্টিপাথর?

বলিলাম, “তাহলে আমি একাই যাচ্ছি, সেই ভাল হবে বরং। আপনি আর ভাববেন না।”

যে ছোট, আর স্বীয় অন্তরের খুব নিকট, তাহাকে সান্ত্বনা দিবার সময় যেমন একটা মৃদু তিরস্কারের মিশ্রণ থাকে, সেইভাবে বলিলাম, “অত উতলা হয় কখনও মানুষে? দেখুন তো!―ছিঃ!”