১৪
নিশীথ আর বিলম্ব করিল না। কি জানি, নারীর মন, ‘শুভানি বহু-বিঘ্নানি’…কতকটা পৌরাণিক, কতকটা আধুনিক মতে বাগদানের একটা পাকারকম বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিল। আধুনিকতার দিকে থাকিবে একটা বড় রকম পার্টি, অবশ্য নিশীথের বাড়িতেই।
যেদিন পার্টি তাহার আগের দিন একটা টেলিগ্রাম হাতে করিয়া অপর্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করিলাম, “বাড়ি থেকে হঠাৎ টেলিগ্রাম পেলাম, যেতে লিখেছেন।”
টেলিগ্রামটা ঠিকই তবে ফরমাসী, আমিই বাড়িতে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলাম। আর থাকাও চলে না, অথচ এই সব ব্যাপাবের মধ্যে হঠাৎ কর্মত্যাগ করিয়া চলিয়া আসাও বড় কটূ দেখায়। সেখানে গিয়া একটা চিঠি লিখিয়া দিলেই চলিবে।
অপর্ণা দেবী স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে একটু চাহিলেন। প্রথমটা একটা শঙ্কার ভাব ছিল সে দৃষ্টিতে, কিন্তু অচিরেই সেটা মিলাইয়া গেল। ওঁকে এত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায় না। বলিলেন “টেলিগ্রাম! তাহ’লে তোমার আজই তো যাওয়া উচিত…”
কালকের পার্টি থেকে অব্যাহতি পাইয়াছি দেখিয়া যেন বাঁচিলেন উনি। মহীয়সী রমণী, ওঁর সহানুভূতির স্পর্শে আমার সমস্ত মন ওঁর চরণে যেন লুটাইয়া পড়িল।
মিস্টার রায় শুনিয়া একটু চিন্তিত হইলেন। কয়েকটা প্রশ্নও করিলেন, “বাড়ি থেকে মানে,—শ্রীরামপুর থেকে?—না, তোমাদের সেই…”
বলিলাম, “আজ্ঞে না, শ্রীরামপুর আমার বন্ধুর বাড়ি, টেলিগ্রাম এসেছে পশ্চিমে আমাদের বাড়ি থেকে।”
“Hope it is nothing serious” (আশা করি কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়)?
বলিলাম, “বোধ হয় নয়। প্রায় বছর খানেক যাইনি, কয়েকবার যেতে লিখেছিলেনও…”
“কবে যাচ্ছ?”
বলিলাম, “আজই রাত্রের গাড়িতে যাব ভাবছি।”
মিস্টার রায় একটু অধীরতার সঙ্গেই বলিয়া উঠিলেন, “How unfortunato! কাল মীরার উপলক্ষ্যে পার্টি, আর…”
অন্যমনস্ক ধাতের মানুষ, এক-এক সময় আবার খুবই অন্যমনস্ক থাকেন। একেবারে মোক্ষম স্থানটিতে আসিয়া তাহার হুঁশ হইল। চুপ করিয়া গেলেন।
“I see, I see; বেশ তা যাবে।” বলিয়া উপরে চলিয়া গেলেন।
বাকি থাকে মীরা। দেখা করিব কিনা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আজ সমস্ত দিন বাহির হয় নাই।
যাত্রার প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পূর্বে মীরার ঘরের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। চোরের মত অনেকক্ষণ দরজার পাশে অপেক্ষা করিয়া ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিলাম, “মীরা দেবী আছেন কি?”
সেকেণ্ড দুই-তিন বিলম্ব করিয়া উত্তর হইল, “আসুন।”
মীরা বিছানায় নিশ্চয় শুইয়া ছিল। বোধ হয় নিজেকে সামলাইয়া লইয়া পাশের শোফায় নামিয়া বসিতে যাইবে, তাহার পূর্বেই আমি প্রবেশ করায় হইয়া উঠিল না; বিছানাতেই বসিয়া রহিল।
কিন্তু এ মীরা নাকি? চোখের কোলে কালি, মুখটা লম্বা হইয়া গিয়াছে যেন একটা শ্রান্ত, আচ্ছন্ন, উৎকণ্ঠিত ভাবের সঙ্গে আমার মুখের পানে চাহিল।
বলিলাম, “বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম এল….”
মীরা’ খুব দূর থেকে যেন আওয়াজ টানিয়া আনিয়া বলিল, “বাবাকে, মাকে বুঝিয়েছেন ঐ কথা, আমাকেও…?”
আর বলিতে পারিল না। বুকে অসহ্য বেদনা হইলে যেমন একটা অব্যক্ত আওয়াজ হয়, সেই রকম করিয়া থামিয়া গেল; এবং সঙ্গে সঙ্গেই যেন মুষড়াইয়া বিছানার লুটাইয়া পড়িল।
তাহার পর কান্না। সে-রকম নীরবে গুমরাইয়া কাঁদিতে আমি আর কাহাকেও কখনও দেখি নাই। মাঝে মাঝে দ্রুতনিঃসৃত ফোঁপানির শব্দ, সমস্ত শরীরটা থরথরিয়া উঠিতেছে; একটা নিরুদ্ধ ঢেউ যেন তাহার দেহ-সরসীর তটে আছড়াইয়া পড়িতেছে।
আমি রচনা শুনাইতেছি না, যাহা ঘটিয়াছিল তাহাই বলিতেছি—আমি সংযত থাকিতে পারি নাই। দু-দিন পরে মীরার সঙ্গে সম্বন্ধচ্ছেদের কথা, কি উচিত, কি অনুচিত—এসব কিছুই ভাবিয়া দেখিতে পারি নাই। তখন শুধু একটি অনুভূতি মাত্র ছিল—মীরার বুকে একই বেদনা!… আমি খাটের পাশে দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে মীরার পিঠে দক্ষিণ হাতটা রাখিয়া ডাকিলাম, “মীরা।”
শুধু কান্নার আওয়াজ আরও উন্নত হইয়া উঠিল।
আমার মনটা অতিরিক্ত চঞ্চল; কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে একটা গোটা জীবনের স্বপ্ন যেন একসঙ্গেই ভাঙা-গড়া দুই-ই হইয়া গেল। নিজের উচ্ছ্বসিত শোক যথাসাধ্য দমন করিয়া মুখটা আরও নামাইয়া বলিলাম, “মীরা, কেঁদ না। আমি তোমায় সুখী করতে পারতাম না, কিন্তু আমি দুর্বল, মন স্থির ক’রে উঠতে পারছিলাম না; এ-ই ঠিক হয়েছে।”
মীরা তেমনি উবুড় হইয়া ক্রন্দনের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলিয়া চলিল – “না, না, এই ক’রেই আপনি আমার সর্বনাশ করলেন, আর বলবেন না…আমি নিজেকে ঠিক ক’রে ধরতে পারিনি আপনার সামনে, কিন্তু আপনি কেন চিনে নিলেন না? বাইরে যা পেলেন সত্যিই কি মীরা তাই? বলুন…আমার সর্বনাশের মধ্যে থেকে আমায় কেন জোর ক’রে টেনে নিলেন না?—কেন?…আমি কি এটুকুও আপনার কাছে আশা করতে পারতাম না? বলুন…বলুন…”
সেদিনকার প্রত্যেকটি কথা আমার মনে গাঁথা আছে, ভুলি নাই। মীরা এর অতিরিক্ত আর কিছুই বলিতে পারে নাই।