» » মীরা-সৌদামিনী

বর্ণাকার

নিশীথ আসিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া গেল। অবশ্য যথাপদ্ধতিই করিল, তবু—বোধ হয় ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন একটা কটাক্ষ বিচ্ছুরিত হইয়া গেল যে, মনে হইল এই সঙ্গে যদি যমালয় থেকেও একটা নিমন্ত্রণপত্র বিলি করাইরা দিতে পারিত তো খুশি হইত।

পার্টিটা মাঝারি-গোছের। স্বয়ংবর সাধনে খুব আঁটঘাট বাঁধিয়া নামিয়াছে নিশীথ। নিতান্ত একটা ছোট পার্টির কর্ত্রী করিয়া মীরাকে ফাঁকি দেয় নাই, আবার সেটা মেলা বড় করিয়া তাহাকে ভারাক্রান্তও করে নাই। জন বার-চৌদ্দ লোক হইবে সব মিলিয়া।

তরুকে বলিয়া দিয়াছিলাম সব হইয়া গেলে যেন আমার খবর দেয়। ভাবিলাম মীরা থাকিবে ব্যস্ত, নিশীথ থাকিবে বিরূপ, আগে গিয়া মিছামিছি অস্বস্তি ভোগ করা কেন।

আমি যখন পৌঁছিলাম তখন পরিবেশন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। প্রায় সকলেই চেয়ার গ্রহণ করিয়াছে। তিন-চারজন বসিবার অনাগ্রহটা ফুটাইয়া তুলিবার জন্য এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছে—অকাজের ব্যস্ততা সৃষ্টি করিয়া।

আমি আসিতেই একটি তরুণী নিজের চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া আসিল। লীলায়িত ভঙ্গি সহকারে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আসুন, শুনলাম আপনি এসেছেন, অথচ…”

প্রত্যভিবাদন করিয়া বলিলাম, “অপর্ণা দেবীর সঙ্গে গল্পে লেগে গিয়েছিলাম একটু।” টেবিলের উপর চোখ বুলাইয়া একটু হাসিয়া বলিলাম, “ঠিক সময়েই এসেছি কিন্তু।”

সহাস্য উত্তর হইল, “এত ঠিক সময়ে আসাটাই বেঠিক। কোথায় ভেবেছিলাম যে একটু গল্প-স্বল্প করব।”

এই অনিলা মিত্র। কলেজে সম্পূর্ণ অন্যরূপ—-গম্ভীর, মুখে রা নাই, ক্লাসের হাজার হাসির কথা হইলেও ঠোঁটের একটা কোণ চাপিয়া এত অল্প হাসে যে, মনে হয় ও জিনিসটা যেন শেখাই হয় নাই। মনে পড়ে না কখনও একটি কথা হইয়াছে, সিঁড়ির বারান্দায় দেখা হইলে হদ্দ একটু নমস্কার-বিনিময়।

আমায় নিজের খালি চেয়ারের কাছে লইয়া আসিল। পাশেই মীরার চেয়ার; বলিল, “শৈলেনবাবুর এই এতক্ষণে আসবার ফুরসত হ’ল মীরা-দিদি।”

একটু আগে আমায় যে ঠাট্টা করিয়াছিল, মীরা আবার সেইটেরই পুনরুক্তি করিল, একটু হাসিয়া বলিল, “তা বলে তুমি যেন মনে ক’রো না যে উনি নির্লোভ, উদাসীন মানুষ; গন্ধ পেয়ে তিন শ মাইল থেকে ছুটে আসছেন।”

“কিসের গন্ধ?” বলিয়া একটা হাসির আভাসমাত্র দিয়াই অনিলা তখনই কথাটা ঘুরাইয়া লইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা কাণ্ড করিয়া বসিল, “বাঃ দাঁড়িয়ে রইলেন যে?—বসুন!” বলিয়া চেয়ারটা আমার পিছনে একটু টানিয়া দিয়া আমায় প্রায় আটকাইয়া দিয়াই তাড়াতাড়ি সরিয়া পড়িতেছিল, মীরা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “বাঃ, আর তুমি?”

অনিলা ফিরিয়া আসিল। মীরার কাঁধের উপর দুইটা হাত দিয়া একটু ঝুঁকিয়া চাপা গলায় বলিল, “আহা, মীরা-দিদি যেন কিছু জানেন না! মিস্টার দত্ত তখন থেকে আমার ওপর কি রকম অ্যাটেনশন দিচ্ছে বলো দিকিন। দু-কুড়ি বয়েস আর দোজবর বলে যেন মানুষ নয় বেচারী!’

আমি যে শুনিলাম সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া তাড়াতাড়ি টেবিলের ওদিকে একজন মাঝবয়সী খুব ফ্যাসান-দুরন্ত ভদ্রলোকের পাশে গিয়া বসিয়া পড়িল।

মীরা আমায় বলিল, “দাঁড়িয়ে রইলেন? বসুন।”

উপবেশন করিলে বলিল, “আপনাদের কলেজের অনিলা মিত্র, চেনেন নিশ্চয়!”

বলিলাম, “চেনা শক্ত, কলেজে একেবারে অন্যরূপ।”

মীরা হাসিয়া বলিল, “তাই নাকি? কিন্তু চমৎকার মেয়ে। আর সর্বদাই একটা-না-একটা মতলব…”

হঠাৎ থামিয়া গেল; নিশ্চয় এই ‘মতলব’ করিয়া আমায় তাহার পাশে বসাইয়া দিয়া যাইবার কথাটা মনে পড়িয়া গেল।

কাটা-চামচের টুংটাং শুরু হইয়া গেল।

দেখিতে পাইলাম এবং তাহার চেয়ে বেশি অনুভব করিলাম, আমি সকলেরই যেন মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছি। অনিলার অভ্যর্থনা—পদ্ধতি, তাহার পর আবার মীরার পাশে স্থান পাওয়া—তাহাও এই-ভাবে—সকলেই মনে করিল আমি বিশিষ্ট কেউ একজন।

আর একটা জিনিস অনুভব করিলাম, মীরা ভিতরে ভিতরে যেন একটা অস্বস্তি বোধ করিতেছে! দোষ দেওয়া যায় না মীরাকে, কিন্তু আমিও যেন একটু জড়ভরত হইয়া পড়িতে লাগিলাম।

নিশীথ ব্যাপারটাকে ফুটাইয়া তুলিল।—

ছ-একবার নিশীথের পানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাহিয়া দেখিয়াছি; নিমন্ত্রণ করিয়া এমন মৃত্যুযন্ত্রণা কাহাকেও কখনও ভোগ করিতে দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। তরুর কাছে শুনিলাম, আমার টেলিগ্রাম পাইয়াই নিশীথ ভোজের বন্দোবস্ত করিয়াছিল, নিশ্চয় উদ্দেশ্যটা মীরাকে যতটা সম্ভব অন্যদিকে ব্যস্ত রাখা।…পরিণাম এই। দুইবার চাহিলাম, দুইবারই ওর সঙ্গে চোখোচোখি হইল! অন্যদিকে আর মন দিতে পারিতেছি না। আহা, বেচারী! কষ্টও হয়, কিন্তু ইচ্ছাকৃত তো নয় এটা আমার; এমন কি পছন্দসইও নয়।

হঠাৎ একবার নিশীথ অভ্যাগতদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়া উঠিল, “বাঃ, একজনকে তো আপনাদের সঙ্গে ইনট্রোডিউসই করা হ’ল না!”

তাহার পর কায়দামাফিক হাতের চেটো দিয়ে নামার দিকে নির্দেশ করিয়া বলিল, “ইনি হচ্ছেন মিস্টার শৈলেন্দ্রনাথ…শৈলেন্দ্রনাথ…ডিয়ার মি! —দেখুন, এতদিন রয়েছেন মীরা দেবীদের বাড়ীতে, অথচ আপনার পদবীটা!”

মনে মনে বাহাদুরী দিলাম নিশীথকে। উপেক্ষার ভাবটা বেশ ফুটাইয়া আনিতেছে, বুদ্ধি খুলিতেছে ওর। মিস্টারের সঙ্গে না খাপ খায় এই জন্য সহজভাবে হাসিয়া বলিলাম, “মুখোপাধ্যায়।”

“হ্যাঁ, শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মীরা দেবীর বোন তরুকে পড়ান। মিসেস রায় আর মিস্টার রায়ও প্রায়ই আমার কাছে সুখ্যাতি করেন ওঁর,—খুব ভাল মাস্টার। খুব বিশ্বাসযোগ্য…আর কি সব কোয়ালিফিকেশন আছে ওঁর মীরা দেবী?”

মনে মনে একটু হাসিলাম, এতেও এতটুকু মৌলিকতা দেখাইতে পারিল না নিশীথ?—সেই মীরার অস্ত্র!

একটু সময় দিলাম মীরাকে, দেখিলাম মীরা যেন বিপর্যন্ত, একটু সহজভাবে মুখ তুলিয়া চাহিবার চেষ্টা করিল বটে, কিন্তু উত্তর কিছু জোগাইল না ওর। আমিই হাসিয়া বলিলাম “এর চেয়ে আর বড় কোয়ালিফিকেশন কি হ’তে পারে নিশীথবাবু?—মাস্টারি করি, তাতে দু-জন মনিবই খুব সন্তুষ্ট বলছেন আপনি। ওঁদের বাড়িতে অত পুরনো চাকর; অল্প দিন হ’লেও আমাকে খুব বিশ্বাস করেন, একজন প্রাইভেট টিউটরের এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হ’তে পারে বলুন?”

জড়ভরতের ভাবটা অনেকক্ষণ কাটাইয়া উঠিয়াছি, নিশীথ যেটাকে আমার গ্লানি বলিয়া ইঙ্গিতে জাহির করিতে চাহিয়াছিল, সেটাকে বেশ ভাল করিয়াই স্পষ্ট করিয়া দিয়া, সমর্থনের জন্য সপ্রতিভ ভাবেই হাসিয়া একবার চারিদিক চাহিয়া লইলাম।

অনিলার মুখটা গম্ভীর। নিশীথের কাঁটা-চামচে আর মটন-চপে জড়াজড়ি হইয়া গেল। রণেন মীরার দুই সীট ওদিকে বসিয়াছিল, ঘাড়টা বাড়াইয়া কতকটা যেন নিশ্চিন্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “তরুর টিউটর উনি?”

মীরা জড়িত কণ্ঠে বলিল, “হ্যাঁ, কিন্তু ওঁর…”

সূত্রটা অনিলা খুঁটিয়া লইল, বলিল, “কিন্তু ওঁর আসল পরিচয় বোধ হয় এই যে, উনি একজন উদীয়মান লেখক, বাংলার অনেক বড় বড় কাগজেই…”

মীরাও এতক্ষণে অনেক সামলাইয়া লইয়াছে, অনিলাকে বলিল, “আর ওঁর কলেজ কেরিয়ারের কথা বললে না? তুমিই তো বলেছিলে—শৈলেনবাবু নেক্‌স্ট ইয়ারে নিশ্চয় একটা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত কিংবা জার্মানীতে…”

মীরা যে ব্যাপারটা এতটা বিসদৃশ করিয়া ফেলিবে আশঙ্কা করি নাই। তবে কারণটা বুঝিলাম, ও যে মাস্টারের সঙ্গে মেলামেশা করে, পাশে বসিলেও আপত্তি করে না, এই অভিজাত সমাজে প্রথম সুযোগেই তাহার জবাবদিহি করিতেছে ও।

অর্থাৎ বাড়ির মাস্টার হইলেও নিতান্ত অযোগ্য নই আমি। —নামি একজন সাহিত্যিক, একজন বিশিষ্ট ছাত্র, অবিলম্বেই বিলাত কিংবা জাৰ্মানী গিয়া খেতাব আনিব; আজ না হয় অন্তত দু-বছর চার বছর পরে এই সমাজের উপযোগী যে হইবেই তাহাকে একটু প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখিলে নিতান্ত অশোভন হয় না, ভাবটা ওর নিশ্চয় এই।

সমস্ত শরীরটা যেন আমার অস্বস্তিতে সির্ সির্ করিয়া উঠিল। একটা উত্তর দিব যাহা একদিকে কাটিবে মীরাকে আর একদিকে আঘাত দিবে নিশীথের অক্ষর-লাঙ্গুলে। সুযোগ একটা এই ছিল যে, পার্টিতে সমীহ করিবার মত কেহ ছিল না। বয়স্থ যাঁহারা—রণেনের পিতা, মাতা, অপর্ণা দেবী, অনিলার মা—এরা পূর্বেই একবার আসিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। বেশ একটু প্রাণখোলা হাসিতে ব্যাপারটা পরিষ্কার করিয়া দিয়া বলিলাম, অযোগ্যকে তার অনাগত যোগ্যতা দিয়ে বাড়িয়ে দেখবার জন্যে আপনারা ব্যস্ত হ’য়ে উঠেছেন দেখে আমার হাসি সংবরণ করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে, মীরা দেবী। চার বছর পরের ভাবী শৈলেনকে অভিনন্দিত ক’রে আজকের দীন, অযোগ্য শৈলেন-মাস্টারকে লজ্জিতই করছেন—বিলেত, জার্মানী, কি অন্য কোন বিদেশী খেতাবের উপর আপনাদের যতটা টান আছে আমার নিজের ততটা নেই কিন্তু, থাকলে গোটাকতক অক্ষর জাহাজে আনিয়ে নিতে কতক্ষণ?

হাসির সঙ্গী বাড়াইবার জন্য বলিলাম, “আমার কি মনে হয় জানেন?—ও অক্ষর-গুলো নিতান্ত ভূয়ো, যদিও হয়তো বিবাহের একটা প্রয়োজনীয় অঙ্গ। অনেকে বোধ হয় ভাবেন মাথায় আকাশচুম্বী টোপর লাগিয়ে অনুরূপ দীর্ঘতার একটা অক্ষরের লাঙ্গুল না পরে নিলে একটা ভদ্রোচিত বিবাহের আসরে ব্যালান্স (ভারসাম্য) রক্ষা হয় না, তাই…”

পেট ভরিয়া আসিলে অল্পই হাসি পায়; আমি শেষ করিবার পূর্বে সকলেই উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, সকলে মানে অবশ্য নিশীথ সেন এস্কোয়ার, এম-আর-এ-এস, এফ-টি-এস, পি-আর-এ-এস-এ ছাড়া। তাহার কাঁটা-চামচ আর চপ-কাটলেট একেবারে তালগোল পাকাইয়া গিয়াছে। অবশ্য হাসিবার চেষ্টা যে একেবারেই না আছে এমন নয়।

অতিথিধর্মের ব্যত্যয় হইয়া যাইতেছে বলিয়া চুপ করিলাম। অবশ্য আমার সান্ত্বনা এই যে, আমি আরম্ভ করি নাই, আগে হইয়াছে আতিথ্যধর্মেরই লঙ্ঘন। তবে আমি এত সাধারণ ভাবেই এবং এমন হাসিচ্ছলে বলিয়াছি যে, এক মীরা আর নিশীথ ভিন্ন এর হুলের সন্ধান বিশেষ কেহ একটা পায় নাই, অনিলা কিছু কিছু বুঝিয়া থাকিতে পারে, আরও বোধ হয় দু-একজন যাহারা নিশীথের অসার টাইটেল-প্রীতির সন্ধানটা পাইয়াছে।…যাক অত ভাবিয়া কথা বলিলে তো চলে না। অযথা আঘাতই বা মাথা পাতিয়া লইব কেন? আমার আজ যাহা উপজীবিকা সে সম্বন্ধে আমার কোন লজ্জাই নাই; কেনই বা থাকিবে?—যদি সেইটাকে উপলক্ষ্য করিয়া কেহ আমায় চোট দিতে চায় বা এড়াইয়া চলিতে চায় তো তাহাকে আমার মনের ভাবটা জানাইয়া দিতে হইবে বৈকি!

হাওয়াটা যে অস্বস্তিকর হইয়া পড়িয়াছে এটা অস্বীকার করা যায় না। আমার মনের অবস্থাটা নিমন্ত্রণ খাওয়ার একেবারেই অনুকূল নয়। সাধ্য থাকিলে উঠিয়া নিজেও বাঁচিতাম, অনভিজাতদের সঙ্গ থেকে এদেরও অব্যাহতি দিতাম, কিন্তু তাহার উপায়ই ছিল না কোন। সুতরাং সাধ্যমত হাওয়ার গতিটা ফিরাইয়া দিবার চেষ্টায় রহিলাম।

একটা নিতান্ত চলতি ঠাট্টার সুযোগ আসিল, কিন্তু চলতি হইলেও হাতছাড়া করিলাম না। ওয়েটার দইয়ের প্লেট বিলি করিতে করিতে অনিলার কাছে যাইতেই বলিলাম, “দেখো, ওঁকে যেন দিয়ে ব’সো না!”

অনিলা কাঁটা-চামচ থামাইয়া বিস্মিত ভাবে আমার পানে চাহিয়া বলিল, “বাঃ, কেন দেবে না?”

অন্য সকলেও বিস্মিত হইয়া একবার তাহার পানে, একবার আমার পানে চাহিতে লাগিল। আমি অনিলার কথার উত্তর না দিয়া মীরার পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলাম, “আজ আপনাদের গানের ব্যবস্থা হয়নি?”

মীরা আমার পানে চাহিল, পরে অনিলার পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “অনিলা গাইতে জানে নাকি? কৈ আমাকে তো বলেনি কখনও! তাহ’লে কাজ নেই দই দিয়ে, গলা বসে যেতে পারে।”

অনিলা অত্যন্ত ভীত হইয়া বলিল, “না না মীরা-দিদি, আমি মোটেই গান জানি না—আমার একেবারে আসে না!…”

তাহার ভাবগতিক দেখিয়া অনেকে হাস্য সংবরণ করিতে পারিল না। সৌভাগ্য-ক্রমে খুব উপযুক্ত প্রসঙ্গই আরম্ভ করিয়াছিলাম; এই সব উপলক্ষ্যে এই ধরনের কথা একেবারে জমিয়া উঠে, আর বিশেষ করিয়া—দু-একজন ছাড়া যে ধরনের মানুষ লইয়া পাৰ্টিটা—বড় কোন আলোচনা বা সুক্ষ্ম কোন রসিকতা জমিতও না।

আমি অনিলার আপত্তির দিকে একেবারেই কান দিলাম না। মীরার পানে চাহিয়া তাহারই কথার উত্তর দিলাম; হাসিয়া বলিলাম, “বাঃ একটা মানুষ কষ্ট ক’রে গান শিখবে, তার ওপর আবার কষ্ট ক’রে বলবে, তবে আপনারা টের পাবেন?”

অনিলা ওদিকে পরিত্রাহি আপত্তি করিয়া যাইতেছে, “বাঃ, না—কি মুশকিল!…দইয়ের প্লেট দাও আমায়, চলে যাচ্ছ যে? অথচ দই আমি ভালবাসি। কি ফ্যাসাদ দেখ তো?…আচ্ছা, আপনি কি ক’রে জানলেন যে গাইতে জানি? —মীরা-দি’কে যে বলতে গেলেন?

আমি নিরীহের মত মুখের ভাব করিয়া বলিলাম, “বাঃ, এক কলেজে পড়ি—এক ক্লাসে! আপনি কি ক’রে জানলেন যে স্টেট-স্কালরশিপ, নিয়ে জার্মানী যাব?—মীরা দেবীকে যে বলতে গেলেন?”

হাসির আর একটা তোড় উঠিল। কেহ হাসিচ্ছলে, কেহ বা বিশ্বাসভরেই অনিলাকে আহারের শেষে গানের জন্য ধরিয়া বসিল।

রণেন বলিল, “এদের চেনা দায়। এই থেকে আমার আরও একটা সন্দেহ হচ্ছে…”

বেটাছেলে প্রায় সকলেই বলিয়া উঠিল, “কি সন্দেহ? বলুন।”

রণেন গলাটা একটু সামনে বাড়াইয়া মীরার দিকে চাহিয়া বলিল, “তাহ’লে মীরা দেবীও আমাদের এত দিন ধরে যে প্রবঞ্চনা না ক’রে এসেছেন…”

মীরা দারুণ বিস্ময়ে কাঁটা-চামচ একেবারে ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিল, বলিল, “মাফ করবেন, আমি একেবারেই জানি না, দোহাই। শৈলেনবাবুর কথাতেই তার প্রমাণ রয়েছে—গান জানলে আমি অনিলাকে নিশ্চয় চিনে নিতে পারতাম।”

রণেন বলিল, “ওটা কাজের কথা নয়, বেশ, শৈলেনবাবুকেই সাক্ষী মানা যাক্‌, উনি তো একসঙ্গেই থাকেন?…কি মশাই?”

মীরা মিনতির দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া বলিল, “দোহাই শৈলেনবাবু আপনি আবার ‘নয়’কে ‘হয়’ করতে পারেন…”

মীরার গানের কথা বোধ হয় পূর্বে একবার বলিয়া থাকিব—গলা খুব মিষ্ট তবে সুরজ্ঞানটা একটু কম। অথচ সেজন্য এসব ক্ষেত্রে ওকে বাঁচাইতে যাওয়াটাও ভাল দেখায় না। কি করিয়া সামলাইব ভাবিতেছি, মীরা নিজেই বলিল, “বা, ওঁর সাক্ষী চলবে না,–অনিলা ওঁর সুখ্যেৎ করছে, সঙ্গে সঙ্গে উনি ওর সুখ্যেৎ করলেন, আমি করেছি, আমায়ও নিশ্চয় উনি বাড়াবেন।”

অনিলা বলিল, “বাঁচালে মীরা-দিদি।…এবার আপনারা মানুষটির স্বভাব টের পেলেন তো? যদি সুখ্যেৎ করলেন, অন্যায় সুখ্যেৎ ক’রে ফাঁপরে ফেলবেন…”

পাশের ভদ্রলোকটির অন্য কোন দিকে মন ছিল না, অনিলার আহারের দিকেই তিনি কায়মনোবাক্যে নিজেকে নিয়োজিত করিয়া দিয়াছিলেন। ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া বলিলেন, “তাহ’লে আপনাকে আর এক প্লেট দই দিয়ে যাক্‌, ভালবাসেন বললেন ওটা…এই ওয়েটার!”

চাপা হাসিতে অনিলার মুখটা সিন্দুরবর্ণ হইয়া উঠিল। কয়েকজন প্রশ্ন করিয়া উঠিল, “কি হল?”

চাপা হাসিতেই অনিলার শরীরটা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতে লাগিল কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু বলিল না। আমি ব্যাপারটা বুঝিয়াছিলাম, ভদ্রলোকের পানে চাহিয়া বলিলাম, “গানের কণ্ঠের দরকার নেই বলে ওঁর কথা কওয়ার কণ্ঠও যেন অতিরিক্ত দই খাইয়ে রোধ করিয়ে দেবেন না!”

সকলের উচ্চকিত হাসিতে ভদ্রলোক একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন, বলিলেন, “না, না, উনি বললেন দইটা ভালবাসেন, তাই…”

বলিলাম, “ভালবাসাটাই বজায় থাকতে দিন না; একরাশ দই খাইয়ে গলা ভাঙিয়ে দইয়ের প্রতি জন্মের মত একটা আতঙ্ক দাঁড় করিয়ে দিয়ে কি হবে?”

হাসিটা গড়াইয়া চলিল।

ওয়েটার ট্রেতে কতকগুলো প্লেট লইয়া বাহির হইতেই ভদ্রলোক মোটা চশমার ভিতর দিয়া তাহার দিকে চাহিয়া ব্যস্তভাবে হাত নাড়িয়া বলিলেন, “থাক্, থাক, দরকার নাই…”

বলিলাম, “এ যে আরও নিদারুণ হ’য়ে উঠল মশায়!—সন্দেশের প্লেট নিয়ে আসছে—সবার জন্যে!”

আবার হাসি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।

আমার এইটুকুই দরকার ছিল। আত্মসম্মান বাঁচাইতে বাধ্য হইয়া যে অপ্রীতিকর ব্যাপারটুকু আনিয়া ফেলিতে হইয়াছিল, সেটাকে বেশ ধুইয়া মুছিয়া অপসারিত করিয়া দিলাম।

আহারের শেষে গানও হইল কিছু কিছু। আমি খানিকটা এস্রাজ বাজাইলাম এবং শেষ পর্যন্ত নিশীথকে এতটা সন্তুষ্ট করিতে সমর্থ হইলাম যে, যাইবায় সময় সেও শেক্‌হ্যাণ্ড করিয়া বলিল, “আজকে আমার পার্টির সাক্‌সেস্ অনেকটাই আপনার উপর নির্ভর করল শৈলেনবাবু; থ্যাঙ্কস্।”

ভালই হইল। ওদের থেকে বিদায় লইতেছি, মুখে তবুও যে একটু মিষ্টস্বাদ লাগিয়া রহিল, এই ভাল।