» » মীরা-সৌদামিনী

বর্ণাকার

গল্পটার নাম দিলাম ‘আলোক’। এক কপি মীরার নিকট পাঠাইয়া দিলাম, এক কপি পাঠাইলাম একটা পত্রিকায়।

মীরা নিখিল—“গল্প পাঠানর জন্যে ধন্যবাদ, আরও ধন্যবাদ এই যে, আমাদের মূঢ় ফরমান অনুযায়ী ইমানুলকে আমাদের হাসির খোরাক ক’রে সৃষ্টি করেননি। আমরা দুজনেই আপনার দৃষ্টি আর অনুভূতিকে অভিনন্দিত করছি।”

আরও একটা খবর দিল—নিশীথের হঠাৎ বায়ু পরিবর্তনের প্রয়োজন হইয়া পড়ায় রাঁচিতে উপস্থিত হইয়াছে; একটু দূরেই ওদের আর একটা ছোট বাড়ি আছে, সেইখানেই উঠিয়াছে। ভগবান যখন মারেন এমনি করিয়াই মারেন,—শুধু ইমানুলকে সরাইয়া লইলেন না, নিশীথকে ঘাড়ে আনিয়া ফেলিলেন। এই সব অন্যায় করেন বলিয়া ভগবান মানুষের সামনে আসিতে সাহস করেন না। মীরা চেষ্টা করে নিশীথকে অনিলার ঘাড়ে চাপাইবার, কিন্তু অনিলা বড় সেয়ানা মেয়ে। যা হোক্ বাঁধা মার সয় ভাল, দুইজনে যথাসম্ভব ভাগাভাগি করিয়া সহ্য করিয়া যাইতেছে। এত বড় বাড়ির ভাড়া বলিয়াও তো একটা জিনিস আছে?—নিশীথ যদি সেটা এই আকারেই আদায় করিতে চায়?

আর একটি পরিবারের সঙ্গে সম্প্রতি পরিচয় হইয়াছে। এখানকারই বাসিন্দা। কর্তা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট্ জজ, গৃহিণী বর্তমান, তিনটি মেয়ে, একটি ডায়োসেসনে পড়ে; দুইটি ছেলে, বড়টি ডেপুটি, এখন রাঁচিতেই থাকে। চমৎকার পরিবারটি।

আমায় একবার যাইতে লিখিয়াছে মীরা। এত দেখিবার, বেড়াইবার জায়গা আছে ওখানে! আমি গেলে রাঁচি-হাজারিবাগ রোড হইয়া হাজারিবাগ যাইবে। অমন সুন্দর পথের দৃশ্য নাকি ভারতবর্ষের এ অঞ্চলে কোথাও নাই। জিজ্ঞাসা করিয়াছে—আমাদের ছোটখাট ছুটি নাই এদিকে? না থাকিলেও তিন-চার দিনের জন্য যেন যাই একবার; অত বই আর পার্সেণ্টেজ আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিলে অনেক জিনিস থেকেই বঞ্চিত হইতে হয়।

যাইবার প্রবল ইচ্ছা, নানা কারণেই; কিন্তু বাধা আছে। একটা এবং প্রধান বাধা এই যে, কোন ছুটি নাই এবং বিনা ছুটিতে বেড়াইতে যাওয়াটা বড়ই বিসদৃশ দেখায়—বেড়াইবার অতিরিক্ত যে উদ্দেশ্যটা—যেটা আসল উদ্দেশ্য—সেটা অত্যন্ত স্পষ্ট হইয়া উঠে।

রাত্রে আপনিই সুবিধা হইয়া গেল। আহারের সময় মিস্টার রায় বলিলেন, “আজ অপর্ণার চিঠি পেলাম শৈলেন। লিখেছে সে ভালই আছে, তার জন্যে তরুর আর সেখানে থাকবার দরকার নেই পড়ার ক্ষতি ক’রে—প্রায় মাস দুয়েক হ’তেও চলল। অপর্ণার নিজের ইচ্ছে আমার চিঠি পেলে রাজুকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়; কিন্তু লিখেছে মীরা তাতে মোটেই রাজি নয়, বেটাছেলে এর মধ্যে থেকে একজনও কমলে তার অত বড় বাড়িটায় থাকতে ভয় করবে। মীরার একান্ত ইচ্ছে যে আমি নিয়ে আসি তরুকে, as if that is possible, silly girl (বোকা মেয়ে, সেটা যে অসম্ভব তা বোঝে না)। আমি বলি কি, তুমি দিন চারেকের ছুটি ক’রে ঘুরে এস না…”

মেয়েটি যে তাঁহার নিতান্ত ‘সিলি’ নয় এ-কথা আর ব্যারিস্টার হইয়াও ধরিতে পারিলেন না।

আমি রাঁচি স্টেশনে নামিলাম প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি। পথে নামিয়া একবার জামসেদপুরটা দেখিয়া লইলাম।

স্টেশনে তরু আসিয়াছিল। আনন্দে আমার হাতটা জড়াইয়া সমস্ত শরীরটার ভার আলগা করিয়া দিল। বলিল, “দিদিও আসতেন মাস্টারমশাই; আজ রাত্তিরে নিশীথদার ওখানে ভোজ, দিদির ওপর সব ব্যবস্থার ভার পড়েছে, তাই পারলেন না। আপনার টেলিগ্রাম আমরা কালই পেয়েছিলাম।…হাজারিবাগ রোড কবে যাবেন মাস্টারমশাই?… রণেনদাকে আপনি চেনেন না?—রণেনদা ডেপুটি! ওঃ কি ভয়ংকর ভাল লোক ওরা সবাই!…আর, আপনার রাজু এক কাণ্ড করেছে সেদিন মাস্টারমশাই!…”

মাস দুয়েকের রাশীকৃত খবর; সঙ্গে মীরাও নাই যে বাধা দিবে। সমস্ত রাস্তায় এক মুহূর্তের বিরাম দিল না।

প্রথমেই অপর্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করিলাম। মোটরের আওয়াজ শুনিয়া তিনি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিলেন, আমি গিয়া পদস্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলাম।

ওঁর শরীরটা সত্যই ভাল হইয়াছে অনেকটা, যদিও মুখের সেই ক্লান্ত উদ্বিগ্ন ভাবটা এখনও একটু লাগিয়া আছে। ওটা ওঁর চেহারার একটা অঙ্গ, যাইবার নয়। যাইলে, নিরাশও হইতাম।

বসিয়া অনেকক্ষণ গল্প হইল। মিস্টার রায়ের কুশল সংবাদ অবশ্য আমিই দিলাম। তাহার পর প্রথমেই সরমার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বুদ্ধি করিয়া সরমার সহিত দেখা করিয়াই আসিয়াছিলাম, জানি তাহার প্রশ্ন আগেই হইবে। বলিলাম “সরমা দেবী ভালই আছেন। আমি গিয়েছিলাম কাল, আপনাদের তিনজনের নামে তিনখানা চিঠি দিয়েছেন। একটু হাসিচ্ছলেই বললেন, কাকীমাকে বলবেন ‘আমার জন্যে না ভাবতে, তাঁর তাড়াতাড়ি একটু সেরে চলে আসা দরকার; একলা পড়ে গেছি বড্ড’।”

চিঠিটা বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। তরু উঠিয়া ছুটিয়া গেল, বোধ করি ওর দিদির কাছে।

অপর্ণা দেবী তখনই চিঠিটা খুলিলেন না। সামনে সূর্যাস্তের পানে চাহিয়া কতকটা আপন মনেই ধীরে ধীরে সরমার কথাটা আবৃত্তি করিলেন, “কাকীমাকে বলবেন আমার জন্যে না ভাবতে…বুড়ী হ’য়ে গেল সরমা! হবে না? বুড়ী কি বয়সেই হয়? হয় দগ্ধানিতে…”

তাহার পর আমার পানে চাহিয়া বলিলেন, “শৈলেন, ও ঠিকই ধরেছে, আমি ওর কথাই আজকাল বেশি ভাবি। ভুটানীর মৃত্যুতে অবশ্য মনটা আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে খোকার জন্যে উতলা হ’য়ে উঠেছিল, কিন্তু সেটা সাময়িক, আজকাল সরমার জন্যেই মনটা বেশি আকুল হ’য়ে থাকে। আমি মা হবার অপরাধ করেছি, নিরুপায়; কিন্তু সরমা কি দুঃখে নিজেকে অমন তিল তিল ক’রে দগ্ধাচ্ছে বল তো?… বাগদত্তা?–ঠিক যে আনুষ্ঠানিকভাবে বাগদত্তা কখনও হয়েছিল তাও নয়; তবে?… বুক ফেটে যায় শৈলেন, ও আজ আমায় গিন্নীর মত উপদেশ দিয়ে পাঠালে, আমার জন্যে ভাবতে বারণ করবেন!… খোকা গিয়ে পর্যন্ত মেয়েটার মুখে একদিনও যাকে হাসি বলে সে হাসি ফোটেনি। হাসতে হয় হাসে। পাঁচজনের সঙ্গে মিশতে হয় মেশে, কথা বলতে হয় কথা বলে, কিন্তু কিছুতেই প্রাণ নেই দেখতেই তো পাও। এমনও লোক আছে শৈলেন, যারা বলে—সরমার এটা অভিনয়। তা বলবে—ওকে বোঝবার ক্ষমতা ক’টা মানুষের আছে বল তো শৈলেন? দেখতে তো পাচ্ছ আমাদের অবস্থা? চলা-বসা, হাসা-গাওয়া, সামাজিক শিষ্টাচার—সবই যেখানে অভিনয় হ’য়ে উঠেছে, যেখানে যা আসল, যা খাঁটি তাকে চেনবার চোখ কোথায়? সরমা কি ওদের যুগের? সরমা কি ওদের সমাজের—যে চিনবে ওরা?—আমার এক-একবার কি মনে হয় জান? —মনে হয় সরমা উমার তপস্যা করছে। উমা কার জন্যে তপস্যা করেছিলেন আর সরমা কার জন্যে করছে সেইটেই বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তপের উগ্রতা নিয়ে। কী সংযত উদাসীনতা! রাজার ছেলে পর্যন্ত পাণিপ্রার্থী হ’য়ে নিরাশ হয়েছে শৈলেন এখন দেখছ তো? —ওর দিকে কেউ আর চোখ তুলে চাইতে সাহস করে না। যাদের চরিত্রে একটুও মনুষ্যত্ব আছে তারা ওকে অতিরিক্ত সম্ভ্রম ক’রে এড়িয়ে চলে; যাদের একবারেই নেই, তারা ওর প্রতি উদাসীন, —তারা এই বলে আনন্দ পায় যে, সরমা অভিনয় করছে। …সরমা সত্যিই উমার তপস্যা করছে। আমি স্ত্রীলোক, তা ভিন্ন আমার বংশে দুই দিক দিয়ে সতীর রক্তের ধারা আছে, আমি এ-তপস্যা চিনি। তোমার কাছে লুকোব না শৈলেন,—আমার কি আশা জান?—আমার আশা, আমার বিশ্বাস—সরমার এই তপস্যাই আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনবে, সে যেমন ছিল তেমনি ক’রে বরং তার চেয়েও ঢের ভাল ক’রে—সরমার উপযোগী করে।…আমি রাঁচিতে এসে যে ভাল আছি, তার কারণ রাঁচির জল-হাওয়াও নয়, নতুন নতুন দৃশ্যও নয়, নতুন নতুন পরিচয়ের আনন্দ নয়, তার কারণ শুধু এই যে, আমি এখানে এসে—বোধ হয় খুব কাছে থেকে কয়েক দিনের জন্যে সরে আসবার ফলেই তপস্যার মূর্তিটি খুব স্পষ্ট ক’রে দেখতে পেয়েছি, এই বিশ্বাসটা আমার মনে হঠাৎ উদয় হয়েছে আর যতই দিন যাচ্ছে ততই দৃঢ় হ’য়ে উঠছে…”

সেদিনকার ছবিটা আমার মনে গাঁথিয়া বসিয়া আছে। অপর্ণা দেবীর নতুন স্বাস্থ্যোজ্জল মুখটা অস্তরাগরঞ্জিত আকাশের দিকে ফেরানো, আয়ত চক্ষে দুই বিন্দু অশ্রু টলমল করিতেছে; তাহার উপর একটা অলৌকিক আভা। সতীর তপস্যা-কাহিনী বলিতে বলিতে ওঁর ধমনীর সতী-রক্তের ধারা যেন তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিয়াছে তপস্যার বিশ্বাসে কী একটা অনির্বচনীয় ভাব! হিন্দু, তাই নিজের ধমনীতেও সে রক্তোচ্ছ্বাসের আমন্দ্র শোনা যায়। মনে হইল এই সার্থক সন্ধ্যাটির জন্যই যেন আসা আজ রাঁচিতে। কোন্ অদৃশ্য শক্তি আমায় আজ এ পুণ্যের ভাগী করিয়াছে—তাহাকে মনে মনে প্রণাম জানাইলাম।

ক্রমে অপর্ণা দেবীর মুখমণ্ডল সন্ধ্যার ছায়ার সঙ্গেই আবার ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া আসিল। আমার দিকে চাহিয়া শান্তকণ্ঠে বলিলেন, “এক-একবার আবার এও মনে হয়—নিজের স্বার্থটাকেই বড় ক’রে দেখছি না তো? ভাল হয়েছে কি মন্দ হয়েছে জানি না, তবে সরমাকে বুঝিয়ে বলেওছি অনেকবার, উনিও বলেছেন, কিন্তু…”

মীরা আসিল, সঙ্গে তরু। সবচেয়ে স্বাস্থ্য ওরই ফিরিয়াছে, অবশ্য ফিরিবার কথাও। চেহারাটা অবিন্যস্ত, রাঁধিতেছিল তাহারও প্রমাণ আছে। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া বলিল, “ভয়ানক ব্যস্ত, রাঁধতে রাঁধতে শুধু দেখা করতে এলাম একটু। আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি—কোথায় তিন শ মাইল দূরে পাহাড় জঙ্গলের এদিকে একটা নেমতন্ন পেকেছে, কি ক’রে টের পেলেন বলুন তো?…এই ক’রেই তো আপনারা আমাদের ব্রাহ্মণদের বদনাম করেছেন…”

আমি একটু ভয়ের অভিনয় করিয়া মীরার হাতের দিকে একবার চাহিয়া বলিলাম, “ভাগ্যিস আপনি যুক্তিটা হাতে ক’রে নিয়ে আসেননি! …”

সকলেই উচ্চরোলে হাসিয়া উঠিলাম।