‘নীলাঙ্গুরীয়’ বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৫৭ সালের মাঘ মাসে। প্রকাশক শ্রীশচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশ ভবন, ১৫, বঙ্কিম চাটুজ্যে ষ্ট্রীট, কলকাতা ৭৩। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন শ্রীমনোজ বিশ্বাস। মুদ্রাকর শ্রীঅশোককুমার পাঁজা, শিবদুর্গা প্রিণ্টার্স, ১৫১ রামদুলাল সরকার ষ্ট্রীট, কলকাতা ৭০০ ০০৬। উপন্যাসটির উৎসর্গ লেখা হয়েছিল— “আমার স্নেহভাজন কনিষ্ট শ্রীহরিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে”। এই উপন্যাস সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ‘আনিসুজ্জামান’ লেখেন—
“হাস্যরসের ছোটগল্পের পশরা নিয়ে ১৯৩০-এর দশকে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৬-১৯৮৭)। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গিয়েছিল যে, হাস্যরস তাঁর রচনার মূল উপাদান হলেও তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কারুণ্য। জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। মানুষের স্বভাবজ খেয়ালিপনা ও আচরণগত অসংগতিতে যেমন তিনি হাসির খোরাক পেয়েছেন, তেমনি জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিচিত্র দ্বন্ধ-সন্ধি থেকে উচ্ছ্বসিত বেদনারও সন্ধানলাভ করেছেন। তাঁর রচনায় তাই হাস্য ও করুণের এমন মেশামেশি। তাঁর অবিস্মরণীয় চরিত্র রাণু যেমন পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার নিত্যনতুন ফন্দি এঁটে আমাদের হাসির উদ্রেক করে, তেমনি তার বাল্যবিবাহের কালে শৈলেনকাকার কাছে আত্মশুদ্ধির অঙ্গীকার করে আমাদের চোখ অশ্রুসজল করে দেয়।
নীলাঙ্গুরীয় (১৯৪২) বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস। এর রচনাপ্রণালি কিন্তু সম্পূর্ণতই ভিন্ন। উপন্যাসটির উপজীব্য প্রেম। কিন্তু উপন্যাসের প্রথমেই নায়কের জবানিতে লেখক প্রশ্ন উত্থাপন করেন : ‘ভালবাসা কি সব সময়েই তাহার সেই চিরন্তন রূপেই দেখা দিবে?—সেই আবেগ-বিহ্বল কিংবা অশ্রুসজল? ঘৃণা কি সব সময়েই ঘৃণা?’ তারপর কাহিনির কথক জানিয়ে দেন : ‘ভালবাসায় গরল থাকিতে পারে। অন্তত আমার বেলা তো ছিল।’ উপন্যাসটি এই গরলামৃতের কাহিনি। বস্তুত অন্যত্রও বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় প্রেমকে দেখেছেন একটি জটিল বৃত্তিরূপে। তার সঙ্গে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, পীড়নস্পৃহা—সবই জড়িয়ে থাকতে পারে।
প্রায় সকল বিষয়ে উদাসীন ব্যারিস্টার রায়ের কনিষ্ঠ কন্যা তরুর গৃহশিক্ষকরূপে এই অভিজাত পরিবারে শৈলেনের আশ্রয়লাভ ঘটে। তরুর দিদি মীরার তত্ত্বাবধানের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক আভাসিত হলে শৈলেনের মন বিদ্রোহ করে। কিন্তু অচিরেই সে মীরার রহস্যপরায়ণ আচরণের মধ্যে প্রেমের দ্যোতনা উপলব্ধি করে এবং মীরার প্রতি নিজের আকর্ষণও সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে। দুজনের সামাজিক অসমকক্ষতা সম্পর্কে দুজনেই সচেতন। তার উপরে মীরার প্রকৃতির মধ্যে আছে আভিজাত্যের অভিমান আর শৈলেনের চারপাশে রয়েছে নিজের অবস্থাবৈগুণ্যজনিত আত্মরক্ষা প্রবৃত্তির স্বরচিত দেওয়াল। ফলে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের জায়গা প্রায়ই নিয়ে নেয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। নায়ক-নায়িকার অসাধারণ সংযম ও আত্মদমন উভয়ের মধ্যে চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে উপন্যাসকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ দান করে। মীরার সঙ্গে তার সম্পর্ককে শৈলেন বারংবার ‘ঘৃণায়-মেশানো ভালবাসা’ বলে উল্লেখ করেছে—তা নীলকান্তমণির মতোই নীল, তার মতোই খাঁটি। সে এই গরলামৃত পান করেছে, জন্মজন্মান্তর ধরে সেই গরলামৃত পান করার কামনাই ব্যক্ত করেছে—মীরার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেনি।
মীরার চরিত্র-প্রসঙ্গে শৈলেন বলেছে :
ওর এই খুবই কাছে আসাটাকে আমি যেমন প্রার্থনা করি, তেমনি আবার সন্দেহের চক্ষেও দেখি,—লক্ষ্য করিয়াছি মীরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যখন খুব কাছে আসিয়া পড়ে তাহার পর হইতে অতি সামান্য একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করিয়া—কখন বা উপলক্ষ না থাকিলেও—ঝপ করিয়া দূরে সরিয়া যায়। এই সময় জাগে তাহার সেই নাসিকার কুঞ্চন। আমাদের দু-জনের দূরত্বটা—যাহা মীরাই মিটাইয়া আনে—আবার স্পষ্ট হইয়া উঠে ৷
মীরার আচরণের ব্যাখ্যায় তার মা বংশগতির প্রভাবের কথা বারবার বলেছেন। সেটাই হয়তো সব নয়। তার হৃদয়াবেগ ও ঔচিত্যবোধের স্পষ্ট দ্বন্দ্বের মধ্যে অনেকখানি দুর্জ্ঞেয়তা রয়ে গেছে। শৈলেনকে সে কেমনভাবে দেখেছে, তা আমরা জানতে পারি না। কেননা গোটা উপাখ্যানই শৈলেনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।
উপন্যাসটির তিনটি ভাগ : ‘মীরা’, ‘মীরা-সৌদামিনী’ ও ‘সৌদামিনী’। সৌদামিনী অনিল ও শৈলেনের বাল্যবন্ধু। দুজনের একজনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা গভীরতর হতে পারত। অনিল যে তাকে কামনা করেছিল, তা বোঝা যায়। শৈলেন বরঞ্চ ছিল কিছুটা উদাসীন। কিন্তু উদাসীনের প্রতিই সৌদামিনীর আকর্ষণ ছিল অধিক। একমাত্র অভিভাবক দিদিমার মৃত্যুর পরে ভাগবত হালদার উপযাচক হয়ে সৌদামিনীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে—তা কেবল পরোপকারবৃত্তির বশবর্তী হয়ে নয়। পরে সে সৌদামিনীর বিয়ে দিয়ে দেয় তার বৃদ্ধ কুটুমের সঙ্গে। অনিল তখন স্ত্রীপুত্র নিয়ে সংসারী, কিন্তু সৌদামিনীকে ভোলেনি। সে তার বৈধব্য কামনা করে এবং — মীরার প্রতি শৈলেনের ভালোবাসা নিষ্ফল হবে ধরে নিয়েই—সে শৈলেনকে বলে বিধবা সৌদামিনীকে বিয়ে করতে, নইলে তাকে আবার ভাগবতের নরকেই ঢুকতে হবে। সৌদামিনীর সঙ্গে আলাপে শৈলেন টের পায় যে, তার প্রতি সৌদামিনীর আকর্ষণ এখনো অটুট। সৌদামিনী যথার্থই বিধবা হয়, ভাগবতের আশ্রয় থেকে তার উদ্ধার হয় না, পরে সে চলে যায় সিনেমার জগতে—অনিলের কাছে তা মরণসমান। শৈলেন বলেছে, সৌদামিনী তাকে খাঁটি সোনা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তা নিতে পারেনি, কেননা নিখাদ সোনা নিতে হয় নিখাদ সোনা দিয়েই, শৈলেনের সুবর্ণ তো আগেই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল—মীরাকে। মীরার ভালোবাসা যে কী, সে-ব্যাখ্যা তো আগেই দেওয়া হয়েছে। মীরা শৈলেনের কাছে অনুযোগ করেছিল : ‘বলুন… আমার সর্বনাশের মধ্যে থেকে আমায় কেন জোর ক’রে টেনে নিলেন না?… কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো শৈলেন আগেই দিয়েছিল : ‘আমি তোমায় সুখী করতে পারতাম না, কিন্তু আমি দুর্বল, মন স্থির করে উঠতে পারছিলাম না।’ সৌদামিনীও হয়তো একই প্রশ্ন করতে পারতো শৈলেনকে। শৈলেন হয়তো তাকে রক্ষা করার চেষ্টা না করার অপরাধ স্বীকার করে।
নীলাঙ্গুরীয় তবু ত্রিভুজ প্রেমের উপন্যাস নয়, একান্তই মীরা-শৈলেনের প্রেমের কাহিনি। সৌদামিনীর মধ্য দিয়ে প্রেমের অন্য একটি রূপ প্রকাশিত হয়েছে মাত্র। নায়ক-নায়িকা ছাড়াও সৌদামিনী, অনিল, অম্বুরী, সরমা, তরুর চরিত্রাঙ্কনে সিদ্ধহস্তের ছাপ বিদ্যমান। মিস্টার রায় কতকটা ছাঁচে ঢালা, তবে সর্বত্র অসাধারণত্বের পরিচয় পাওয়া যায় অপর্ণা রায়ের চরিত্রে। উপন্যাসের বর্ণনা আগাগোড়াই সংযত। তবে আবেগের যথাযথ স্থানও আছে এতে। প্রায় নিরুদ্দিষ্ট পুত্রকে নিয়ে অপর্ণা দেবীর আবেগ, বৃদ্ধা ভুটানির মর্মন্তুদ হাহাকার, শৈলেনের অন্তর্জগতের কোলাহল অনিলের অসহায়ত্ববোধ—এসব তার উদাহরণ। শৈলেনের মর্মভেদী কৌতুক উপন্যাসের ট্রাজেডিকে গভীরতা দিতে সাহায্য করেছে।
নীলাঙ্গুরীয় কেবল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নয়, বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
উৎসর্গ
আমার স্নেহভাজন কনিষ্ঠ
শ্রীহরিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
‘নীলাঙ্গুরীয়’ বইখানির একটু ইতিহাস আছে। শ্রাবণ, ১৩৪৬-এর শনিবারের চিঠিতে “কশ্চিৎ প্রৌঢ়” ‘ভালবাসা’ শীর্ষক একটি রচনা প্রকাশিত করেন। লেখক তাহাতে ভালবাসার নানা বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া শেষে তাঁহার পাঠকের নিজের নিজের অভিমত জানাইবার জন্য আহ্বান করেন।
সকলেই স্বীকার করিবেন যে, মানুষের এই মনোবৃত্তিটি উপরে উপরে মোটামুটি সবল এবং নিরীহ মনে হইলেও আসলে অত্যন্ত জটিল। ‘কশ্চিৎ প্রৌঢ়ে’র আহ্বানে আমি ‘ভালবাসা’ নামক একখানি গল্প ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশিত করি; যাহা পরে ‘বসন্ত’ নামক গল্প সংগ্রহে বাহির হইয়াছে। তাহাতে দেখিয়াছি ভালবাসার সঙ্গে মার খাওয়াইবার ইচ্ছা থাকাও বিচিত্র নয়।
বৃত্তিটির জটিলতার আরও একটা দিক দেখাইবার ইচ্ছা থাকায় এই বইখানির অবতারণা। কতদূর সফল হইলাম বিদগ্ধ পাঠক বিচার করিবেন। আর একটা কথা,—‘নীলাঙ্গুরীয়’ কৌতুক রসের লেখা নয়। গোড়া থেকেই একটা অন্যবিধ প্রত্যাশায় থাকিয়া পাঠে বাধা জন্মাইতে পারে বলিয়া এটুকু বলিয়া দেওয়া প্রয়োজন মনে করিলাম।
বইখানির প্রুফ দেখিয়া দিয়া সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমার চিরঋণী করিয়াছেন।
(১৩৪১)