মীরা

আমার প্রশ্ন বোধ হয় একটু জটিল।—ভালবাসা কি সব সময়েই তাহার সেই চিরন্তন-রূপেই দেখা দিবে? সেই আবেগবিহ্বল কিংবা অশ্রুসজল? ঘৃণা কি সব সময়েই ঘৃণা? ভালবাসা কি একটা অভিনয়?—না, সত্য থেকে অভিন্ন একটা কিছু? …যদি তাহাই হয় তো সত্যের সেই অন্তর্বহ্নিতে সে কি, যাহা খাদ, যাহা অবান্তর, সেই, সবকিছুকেই দগ্ধ, ভস্মীভূত করিয়া দিতে সমর্থ নয়? …বেশ গুছাইয়া মনের কথাটি বলিতে পারিতেছি না; কিন্তু এও বলি—হাজার গুছাইয়া বলিলেও কি অর্থাগম হইবার সম্ভাবনা আছে আপনাদের নিকট?

আপনাদের মস্তিষ্কের উপর কটাক্ষ করিতেছি না, দোহাই। বলিতেছি অভিজ্ঞতার কথা।—আপনারা ভালবাসেন নাই, ভালবাসা কত রূপ তাহা দেখেন নাই, ভালবাসা পাওয়া তো দূরের কথা। প্রমাণ দিবেন বিবাহের। কিন্তু এটা আমার তরফের প্রমাণ, অর্থাৎ বিবাহিত বলিয়াই ভালবাসার কিছু জানিলেন না। আপনাদের বিবাহ তো? আপনি তখন বোধ হয় প্রাণপণে পাশের পড়া লইয়া ব্যস্ত, ঘটকিনী হাঁটাহাঁটি করিতেছে, আপনার পিতা আর বাড়ির অন্যান্য পুরুষেরা কুটুম এবং গহনা যাচাই করিতেছেন, মেয়েরা পাত্রীর নাক, চোখ, কান, চুলের হ্রস্ব-দীর্ঘতা লইয়া ব্যস্ত। পাশের পড়া থেকে ফুরসত হইলে টোপর এবং পরীক্ষার ফলাফলের দুশ্চিন্তা মাথায় করিয়া আপনি সুড়সুড় করিয়া গিয়া গোটাকতক মন্ত্ৰ আওড়াইয়া আসিলেন, সংস্কৃতে যতটুকু জ্ঞান তাহাতে সেগুলি আপনার পক্ষে বিবাহের মন্ত্রও হইতে পারে, ভূতঝাড়ার মন্ত্রও হইতে পারে; এবং বাসরঘরে অশ্রাব্য বিদ্রূপ এবং অসহ্য কর্ণতাড়নায় আপনার নিজের ভূতঝাড়ার যদি ব্যবস্থা না থাকিত তো বোধহয়, কি জন্য আপনার কষ্ট করিয়া-আসা সেটা বেমালুম ভুলিয়া বসিয়া থাকিতেন।—বাঙালী ব্যবস্থাপকেরা দূরদর্শী ছিলেন,—বধু আনিবার ব্যবস্থাটা করিয়া গিয়াছেন ধুতি শাড়িতে গাঁটছড়া বাঁধিয়া। বুঝিয়াছিলেন এই সব পরীক্ষা-পাগল বরেরা উদম পাগল হইয়া নিতান্ত যদি বস্ত্র-উত্তরীয় ফেলিয়া না পালায় তো কনেকে কোনরকমে বাড়িতে আনিয়া পৌঁছাইয়া দিতে পারিবে। এই আপনাদের বিবাহ, এর মধ্যে ভালবাসার স্থান কোথায়? …হদ্দ আছে একটা নিশ্চিত্ত আরাম; চোখ কান মুদ্রিত করিয়া একটা…

কথায় কথায় অনিলের কথা মনে পড়িয়া গেল। জীবনকে যদি কেহ দেখিয়া থাকে তো সে অনিল। তাহার দেখিবারও একটা বিশেষত্ব আছে, আপনার-আমার মত করিয়া দেখে না। বলে “ভাই, খাসা আছি। বাপ-মা, ঘটক-পুরুত, আত্মীয়-স্বজনে মিলে সমস্ত বাজার উট্‌কে অবস্থামত সেরা অম্বরী তামাক জোগাড় করে, সেজেটেজে নল্‌চেটা হাতে তুলে দিয়েছে, ভুডুক ভুডুক করে টেনে যাচ্ছি গড়া গড়া; এসা আমেজ যে প্রতি টানেই যে বুক খালি করে দিয়ে যাচ্ছে সেটুকু পর্যন্ত হুঁশ হবার ভয় নেই। এ-ধাতে, মানে এই তাকিয়া-জাপটান জাতের পক্ষে, এই ভাল; থাকুক উডঞ্চুডে ডানপিটেরা লাভ, ডিভোর্স, কোর্টশিপ ইলোপমেল্ট আরও যতসব আদাড়ে রোমান্স নিয়ে…”

আপনাদের বিবাহ এই গড়গড়ার মাথায় অম্বুরী তামাক, অনায়াসলব্ধ একটা মিষ্টাম্বাদ, সঙ্গে একটা নেশার আমেজ। তাহাতে ভালবাসার অম্ল-তিক্ত-কটু-কষায় কোথায়? ঝোলা গুডে গলা মাতাইয়া বলা, অমৃতপান করিয়া উঠিলাম।

তাই বলিতেছিলাম—বিবাহটাই প্রমাণ যে ভালবাসা কি তাহা জানেন না। যাহাতে না জানিতে পান সেই জন্যই আপনার শুভার্থীরা—অথবা দুইপক্ষই ধরিয়া বলা যাক—আপনাদের শুভার্থীরা আপনাদের বিবাহ দিয়া দিয়াছেন—ভালবাসার প্রতিষেধ হিসাবে। কেন এরূপ করা হয় জানি না, তবে এইটুকু জানা আছে যে, ভালবাসা গরল থাকিতে পারে। অন্তত আমার বেলা তো ছিল;—আরও কত সবার বেলা জীবনে চলতি পথে এক সময়ে যাহাদের সঙ্গে হইয়াছিল দিন কয়েকের সাক্ষাৎ।

কণ্ঠে গরল ধারণ করা কি সবার কাজ?—সেই জন্যই বোধ হয় আপনাদের অঙ্গে বিবাহের রক্ষাকবচ আঁটা,—মন্ত্রপূত কবচ।

ভগবান আপনাদের নিরাপদ রাখুন। আমি কিন্তু যেন জন্ম-জন্মান্তর ধরিয়া এই গরলামৃত পান করিতে পাই।