সৌদামিনী

কেন যে এমনটা হইল ঠিক বলিতে পারি না, তবে খামের উপর অনিলের হস্তাক্ষর দেখিয়াই আমার সমস্ত মনে যেন একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। হইতে পারে আমার মনটা বর্তমান অবস্থা থেকে কোন দিকে মুক্তির জন্য উন্মুখ, উদগ্র হইয়াছিল বলিয়াই এমনটা হইল।—হঠাৎ অতীতের মধ্যে থেকে একটা স্মৃতির জোয়ার আসিয়া বর্তমানটাকে যেন ঠেলিয়া কোথায় লইয়া গেল। সেটা এতই অভিভূতকার, যে চিঠিটাও খুলিয়া পড়িতে এক রকম বোধ হয় ভুলিয়াই গেলাম। সিঁড়িটা যেখানে উপরে আসিয়া শেষ হইয়াছে তাহার সামনেই ছোট্ট একটি বারান্দা, বাহিরের দিকটা খোলা, নীচে প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢালাই করা লোহার রেলিং।

আমি মীরার ঘরের সামনে দাঁড়াইয়াছিলাম, সরিয়া গিয়া রেলিঙে ভর দিয়া সেইখানে, বাহিরে দৃষ্টি মেলিয়া দিয়া দাঁড়াইলাম।

নীচে, বাঁ-দিকে বাগানটা দেখা যাইতেছে। কাল বিকাল থেকে এ পর্যন্ত এমন একটা অবস্থার মধ্য দিয়া কাটিয়াছে, মনে হইতেছে কত দিন বাগানটাকে দেখি নাই, যেন কত যুগ! নূতন হইয়া আজ হঠাৎ আমার সামনে আসিয়াছে। … বাগান ছাড়াইয়া রাস্তা ছাড়াইয়া রাস্তার ওপারে বাড়ি ছাড়াইয়া দৃষ্টি উর্ধ্বে উঠিল; মনটাকে লইয়া উঠিতেছে—বাড়ির পিছনে কতকগুলো গাছের জটলা, তাহারই মাঝখান থেকে গোটাতিনেক নারিকেল গাছ মাথা ঠেলিয়া উঠিয়াছে, দীর্ঘ পত্রদল সঞ্চারিত করিয়া আকাশের স্বচ্ছ নীলের গায়ে যেন সবুজের তুলি টানিয়া চলিয়াছে।

আরও দূরে—কালের ও-প্রান্তে জাগিয়া ওঠে সাঁতরা, আমাদের কৈশোরের জীবন লইয়া—বেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি—বেনে বৌয়েদের দোতলা বাড়ির সামনে তামাটে রঙের পানফলের লতা-বিছান পুকুর—নারিকেলের কাটা গুঁড়ি দিয়া তৈয়ারি পিচ্ছিল ঘাট। আমি, অনিল ভালমানুষের মত বসিয়া আছি—একটু দূরে একটা মোটা সজিনা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া একটি মেয়ে, খাটো কাপড় পরা, মাথায় বেড়াবেণী, মুখের ভাবটা আমাদের চেয়েও নির্বিকার। … সদ্‌গোপদের ছোট বৌ ঘাটে বাসন মাজিতেছে—ওর উঠিয়া যাওয়ার অপেক্ষা—তাহা হইলেই আমরা পানফল-অভিযানে অগ্রসর হই। …পচা পাঁকের একটা গন্ধ উঠিয়া আসিতেছে, কেমন যেন দেশ-দেশ মাথানো গন্ধটা … ঝক্‌ঝকে বাসনের গোছাটা বাঁ-হাতে করিয়া ঘোমটার রাঙা পাড়টা নাকের ওপর পর্যন্ত টানিয়া দিয়া, বঙ্কিম ভঙ্গিতে সদ্‌গোপদের বউ উঠিয়া আসিল। কচি বউ, হদ্দ বছর তের। কি চোদ্দ বয়স। … “বামুন ঠাকুরেরা এখানে বসে যে?…” অনিলই উত্তর দিল, “এমনই বসে আছি, পুকুরের ধারটা একটু ঠাণ্ডা কিনা।”…বেলা দুপুরের রোধে মাথার চাঁদি ফাটিতেছে ওদিকে! সদ্‌গোপদের বউ ঠোঁট চাটিয়া হাসিতেছে।—“ঠাণ্ডা, না পানফল?—আমি বলে দিতে চল্‌নু জেলেগিন্নিকে।” দুই পা আগাইয়া গিয়া আবার ঘুবিয়া বলিল, “যাই?– আচ্ছা, যাব না যদি এক কাজ কর।”—আমরা উৎসুকভাবে চাহিয়া আছি … “কাজ কর মানে যদি আমার জন্যেও খানকতক ঐখানটায় ঐ পাকের মধ্যে পুঁতে রাখ—আমার জন্যে মানে ঠাকুরঝির জন্যে—আমি আবার বাসন মাজতে এসবো এক্ষুনি!”

অনিল বলিতেছে, “তুমি আর দুপুরের তাতে আসবে কেন? সদী লুকিয়ে দিয়ে আসবেখ’ন।” সদ্‌গোপদের বৌয়ের সমস্ত মুখটা কৌতুকে আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে, চোখ ঘুরাইয়া বলিতেছে, “ও, সদুঠাকরুণ বুঝি এর মধ্যে আছেন? কোথায় তিনি? তাই তো বলি দুপুরের এমন কড়া তাত, এত ঠাণ্ডা লাগে কিসে! –”

হাসিটা আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে—“না, না; এইখানেই পুঁতে রেখো; আমি বলবুনি জেলেগিন্নিকে…”

রাজু বেয়ারা আবার উপরে উঠিয়া ওদিকে কোথায় চলিয়া গেল। পায়ের গতি খুব নিয়ন্ত্রিত—যেন একটা ফৌজী সেপাই। মনটা লিণ্ড্‌সে ক্রেসেণ্টে ফিরিয়া আসিল। তাহার পর আবার স্মৃতির বন্যা! … অনেক দিন পরের এক দৃশ্য। আকাশ ঘিরিয়া বর্ষা নামিয়াছে, সন্ধ্যায় অনিলদের বাড়ি আটক হইয়া গেলাম। অনিলের বাবা ছাতার নীচে ভিজিতে ভিজিতে আসিয়া উঠিলেন। ছাতা মুড়িতে মুড়িতে বলিতেছেন, “আরম্ভ হ’ল—শনিতে সাত মঙ্গলে তিন, এখন সাত দিন নিশ্চিন্দি থাক।” … মজা নদীতে বাঁশের পুল এখনও বাঁধা হয় নাই, বোধ হয় কাল থেকেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইবে, অনিলের বাবার “নিশ্চিন্দি” কথাটা আগামী ছয়-সাতটা দিনের একটা স্পষ্ট ছবি যেন ফুটাইয়া তুলিল—ওপারে স্কুল, এপারে আমাদের স্কুল-মুক্ত নিরুদ্বেগ দিনগুলো—মাঝে বর্ষার জলে টইটম্বুর মজা নদী, আর, সমস্তকে আচ্ছন্ন করিয়া অবিরাম বর্ষা—চারিদিকে কুল্ কুল্, ঝরঝর একটা সিক্ত মর্মরধ্বনি—সমস্ত দিনটা সন্ধ্যার মত একাকার, তারপরেই একেবারে অন্ধকার রাত্রি…

অনিলের বাবা বলিলেন, “শৈল আটকে গেল বুঝি?”

একটু একটু শীত করিতেছে, কোঁচার খুঁটটা গায়ে জড়াইয়াছি। অনিল বলিল, “ও বলছে বাড়ি যাবে।” অনিলের মা একটু যেন শিহরিয়া বলিলেন, “রক্ষে কর! কেন? খোলা মাঠে পড়ে আছে নাকি?”

বেশ মনে পড়িতেছে অনিলের মাকে—আধবয়সী মানুষটি, প্রদীপটা বাঁ-হাতে ধরিয়া কথাটা বলিতেছেন—মুখে নথের সোনায় আর পান্না দুইটিতে, শাড়ির চওড়া রাঙা পাড়ে প্রদীপের কম্পমান আলো পড়িয়া ঝলমল করিতেছে…

মজা নদীর ধারে বৈরাগী বাবাজীর আখড়ায় আরতির কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল—সঙ্গে তানপুরার একঘেয়ে সুরের মত বর্ষার আওয়াজটা … ব্যাঙেদের ঐকতানে গায়কদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতেছে। সন্ধ্যার অল্প পরেই রাত্রি নিশুতি হইয়া উঠিল।

একই ভাবে আছি দাঁড়াইয়া। এক-একবার নিজেকে অনুভব করিতেছি, আবার স্মৃতির আলোড়নে যাইতেছি তলাইয়া; কত ছোট-বড় ঘটনার টুকরা-টাকরা স্রোতের মুখে ভাসিয়া আসিতেছে।—

সাঁতরার বসত একরকম তুলিয়া আমরা পশ্চিমে চলিয়া গিয়াছি। আবার আসিয়াছি অনিলের বিবাহের বছর দেড়েক পরে, ওর বৌ যখন ঘর করিতে আসিয়াছে! বিবাহের সময়টা আমার পরীক্ষা ছিল, তখন আসিতে পারি নাই, অর্থাৎ সাঁতরাকে দেখিতেছি আবার ঠিক সাত বছর পরে। দেশটাকে নূতন বলিয়া বোধ হইতেছে, কতকটা প্রবাসের বিরহের জন্যও, আর কতকটা কি বলিব?—যৌবনের নবীভূত দৃষ্টিভঙ্গি?—রাস্তা, ঘাট, পুকুর, মাঠের সঙ্গে পুরানো স্মৃতির ছোপছাপ লাগিয়া আছে।

সতের বছরও পূর্ণ হইবার আগেই অনিলের বিবাহ হয়। দুই বৎসর হইল এণ্টান্স পাস করিয়া জেলা কোর্টে চাকরি করিতেছে। দশ টাকা জলপানি পাইয়াছিল, বাপ পক্ষাঘাতে বিকলাঙ্গ হইয়া পড়ায় জলপানিটা কাজে আসিল না। পত্র লিখিয়াছিল, “শৈলেন, বিধাতা একটু রসিকতাপ্রিয় বলে আমাদের শাস্ত্রে তাঁকে পিতামহ বলে কল্পনা করা হয়েছে—আমার পড়া বন্ধ করার বন্দোবস্ত ক’রে দশ টাকা জলপানি পাইয়ে দিলেন।”

ষোল-সতের বছরে বিবাহ আমরা—পশ্চিমের দিকের বাঙালীরা—কল্পনায়ও আনিতে পারি না, আমার বন্ধু সেই অনিলকে বিবাহিত দেখিয়া আশ্চর্য বোধ হইতেছে। কিন্তু দেখিতেছি বয়সের অনুপাতে ও ঢের বেশি উপযোগী। বৈবাহিক রহস্য লইয়া এমন অনেক কথা বলিল যাহা শুনিতে প্রথমটা আমায় রাঙিয়া উঠিতে হইল! অনিল হাসিয়া বলিল, “তুই জেণ্টলম্যান হ’য়ে গেছিস শৈল, বিপদে ফেললি দেখছি, তোকে আবার মানুষ ক’রে নিতে সময় নেবে। পশ্চিমের শুকনো হাওয়ায় তোরা সব বোদা হ’য়ে যাস…”

সেই প্রথম দিনের কথা। সকালে গল্পচ্ছলে একটু ইতস্ততঃ করিয়া সৌদামিনীর কথা তুলিলাম। ওদের বাড়ির বাহিরে রকে বসিয়া আমাদের কথা হইতেছে। অনিল কেমন একটা মলিন হাসি হাসিল, বলিল, “ভাই সদুর কথা না তুলে পারলিনি? আমাদের বিয়ের কথা তো বলেইছি তোকে কয়েকবার যে, আমাদের মত তাকিয়ায় হেলান-দেওয়া জাতের পক্ষে বৌ জিনিসটা, গড়গড়ার মাথায় অম্বুরী তামাকের মত, সেজে দেয় অভিভাবকেরা। নিজের পছন্দয় রোমান্স ক’রে সংগ্রহ করা নয়…”

সামনের রাস্তায় দুইটা মোটরে আর একটু হইলেই ধাক্কা লাগিত; খানিকটা বচসা, খানিকটা কথা-কাটাকাটি হইতে স্মৃতিসূত্র আবার ছিন্ন হইয়া গেল। কিন্তু আজ কি হইয়াছে, কলিকাতা আমায় ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না।

একটু চুপ করিয়া আছি আমরা দু-জনে, তারপর অনিল আমার ডান হাতটা চাপিয়া ধরিল—চোখে একটা আতুর দৃষ্টি, বলিল, “শৈল, সৌদামিনী পড়ে রইল, তুই তুলে নে তাকে, তুই তো, ভালোবাসতিস, একটু লাজুক ছিলি এই যা…”

রাত্রের ছবিটা খুব স্পষ্ট এখনও। নিশুতি রাত, অনিল নীচের দুয়ার খুলিয়া আমায় ওপরে তাহার ঘরে লইয়া আসিয়াছে, দিনের বেলায় বৌ দেখাইয়া আশ মেটে নাই ওর। বৌয়ের সামনেই প্রশ্ন করিল, “মুখদেখানি কি দিলি—হৃদয় নাকি?”

ওর বৌ বেচারি জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। বলিলাম, “রাসকেল, আড় নেই মুখে তোর! দিলুম একটা জিনিস, একটা নতুন নাম।”

অনিল প্রশ্ন করিল, “কি?—রাস্‌কেলের গিন্নী রাস্‌কেলী? হিংসে হয়, গালাগালটা ওর ভাগ্যে দিব্যি কাব্য হয়ে গেল।”

বলিলাম, “না, অম্বুরী।”

দু-জনে হাসিয়া উঠিলাম। হাসির ছোঁয়াচ লগিয়া ওর বৌও হাসিয়া আরও সঙ্কুচিত হইয়া গেল।

বাহিরে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া দাঁড়াইয়া আছি, হঠাৎ দূর ভবিষ্যৎ হইতে দৃষ্টি আসিয়া পড়িল সন্নিহিত বর্তমানে। —

সংসার পরিবর্তিত ওদের। অনিল এখন বাড়ির কর্তা। তেইশ-চব্বিশ বছরের একজন যুবার যদি সংসারের কর্তা হইতে হয় তো তাহার ব্যক্তিগত জীবনেও একটা মস্ত বড় পরিবর্তন আসে, কতকটা মেঘভারাক্রান্ত দ্বিপ্রহরের মত। এই কর্তামি আর ডেলিপ্যাসেঞ্জারি মিলাইয়া অনিল যেন অনেকটা বুড়ো হইয়া গিয়াছে। তবুও অনিল, অনিলই। বিশেষ করিয়া আমি গেলে সে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে।—সেই কথায়, ভাবে উচ্ছ্বসিত অনিলকে যেন সামনে দেখিতেছি। আমি গেলে আমাদের যা বাঁধা প্রোগ্রাম, সমস্ত গ্রাম আর গ্রামের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি,—বেনে বৌয়েদের বাড়ির সামনে পুকুরধারটায়, মজা নদীর ধারে ধারে অনন্তপুরের রাস্তা, স্কুলের ধার। একদিনেও ভালবাসি নাই স্কুলটাকে, কিন্তু এখন যে কী চমৎকার লাগিতেছে। ঠিক যেমন পুরানো মাস্টার মশাইদের কাহাকেও দেখিলে প্রীতি আর ভক্তিতে মনটা ভরিয়া উঠে আজকাল, আগে যাদের যমের মত দেখিতাম।…গা-ঢাকা হইয়া আসিল—আমরা লোক-চক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া অন্ধকারের মধ্যে, অতীতের অন্ধকারে ডুব দিয়া কি সব জিনিস খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। সব প্রগল্‌ভতা মৌন হইয়া গিয়াছে, দু-জনেই বুঝিতেছি দু-জনো কোথায় আছে, সেখান থেকে ডাক দিয়া—একে অন্যকে ফিরাইয়া আনিতে মন সরিতেছে না। অথচ ভিতরে সঞ্চয় তখন খুব বেশি হইয়া উঠিতেছে, এক একবার কথাবার্তাও আবেগময় হইয়া উঠিতেছে। অনিল কি ভাবিয়া একবার প্রশ্ন করিয়া বসিল, “ছেলেবেলাকার বইগুলো এদিকে আর পড়েছিস শৈল?”

খুব আশ্চর্য হইয়া ওর দিকে চাহিয়া আছি। অনিল বলিতেছে, “প’ড়ে দেখিস। দেয়াল-আলমারির পুরনো বইগুলো গুছোতে গিয়ে সেদিন আমার হাতে একটা “মনোহর পাঠ’ বলে বই পড়ল। অদ্ভুত রে! এমন মিষ্টি লাগছিল! কোথায় লাগে একটা ভাল কাব্য তার কাছে! লেখাগুলোর চারদিকে সমস্ত ছেলেবেলাটা এসে ঘিরে দাঁড়ায় কিনা। বইটাও অদ্ভুত বোধ হচ্ছিল—কোণগুলোতে আঙুলের দাগ—যেখানে-সেখানে কাঁচা হাতের নাম লেখা। হ্যাঁ, একটা পদ্য—‘পুষি আর আমি’।—একটা মেয়ে একটা বিড়ালকে বুকে চেপে রয়েছে, বেশ ছবিটা—বেশ মোটাসোটা গোলগাল মেয়েটা। নীচে পেন্সিলে কি লেখা আন্দাজ কর দিকিন।”

আমি একটু ভাবিয়া হাসিয়া বলিলাম, “সৌদামিনী।”

অনিল বলিল, “অনেকটা আন্দাজ করেছিল, তবে অনিল চৌধুরী চিরকালই সেয়ানা কিনা, অত ধরা-ছোঁয়া দেওগার পাত্র নয়। লাল পেন্সিলে লেখা আছে ‘সু-দা-ম’। কেউ ধরতে বা ধরিয়ে দিতে পারবে না, নামটা আইনের প্যাচ বাঁচিয়ে লিখেছি, এমন কি জাত পর্যন্ত বদলে দিয়েছি—আমাদের সখী সৌদামিনী নয়, একেবারে কৃষ্ণসখা সুদামা!”

মজা নদীর ইউনিয়ন বোর্ডের তৈয়ারী-করা পুলের উপর বসিয়া আমাদের অনেক খানি রাত হইয়া গেল, কিন্তু ঐটুকু কথার পর অনেকক্ষণ আর কোন কথা নাই।… আবার অনিলের উচ্ছ্বাস আসিয়াছে, কি রকম একটা স্বপ্নালু দৃষ্টিতে সামনে চাহিয়া বলিতেছে, “তোর অম্বুরীকে আমাদের এই অংশের জীবনের মধ্যে টেনে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করে শৈল। এক-একবার মনে হয় সায়েব হতাম তো বেশ হ’ত–তুই, আমি, অম্বুরী —একসঙ্গে পাশাপাশি ছেলেবেলাকার জীবনের টুকরো-টাকরা জড় ক’রে বেড়াচ্ছি!…এক-এক সময় মনে হয় ক্রীশ্চান হ’য়ে যাই; কিন্তু তাহ’লে গ্রামছাড়াই করবে সবাই মিলে, আর এ-গ্রাম দিলেও প্রাণ ধরে আমি ছাড়তে পারব না এই তোকে বলে দিলাম শৈল। একে ছেড়ে যে মরতে হবে একদিন এইটুকু মনে হ’য়ে এক-এক সময়ে মনটা উদাস ক’রে দেয়… অম্বুরীটা বেশ শৈল, কিন্তু বড় আদিম। আমাকে, অর্থাৎ ওর পুরুষটিকে কি ক’রে ঠাণ্ডা রাখবে অষ্টপ্রহর ওর এই চিন্তা; সকালে উনুন ধরান থেকে রাত্রে মশারি ফেলার মধ্যে যা কিছু ওর কাজ সবগুলোরই মুখ আমার দিকে। কষ্ট হয়, কি অসহ্য আদাম-ইভের জীবন বল দিকিনি! —ও বসে বসে আমার স্কুল ভোগের জোগাড় করে যাচ্ছে—রান্না থেকে আরম্ভ করে—আর আমি সপৌরুষে ভোগ ক’রে যাচ্চি! …”

সাঁতরা আবার মিলাইয়া গেল। মীরা গুন্‌ গুন্‌ করিয়া গান করিতেছে, তাহারই রণন স্পষ্ট হইয়া উঠিল। মীরার সুর কানে এই প্রথম গেল। মীরার গলা খুব মিষ্ট, তবে সুরের জ্ঞান নিখুঁত নয়; কিন্তু আশ্চর্য, ভুল সুরে এমন একটা ছেলেমানুষি ভাব ফুটিয়া উঠিতেছে—লাগিতেছে ভারি মিষ্ট।

রকে মাদুরের উপর অনিল, আমি বসিয়া, আমার কোলে অনিলের ছেলেটা, তাহার ঝাঁকড়া মাথার উপর আমার চিবুকটা চাপিয়া বসিয়া আছি। অম্বুরী আমাদের কাপড় কোঁচাইতেছে, আলনায় তুলিয়া রাখিবে। অনিল বলিতেছে, “ওগো, তুমি একেবারেই ‘আমি’, নয় যে ‘আমি-ধ্যান’ ‘আমি-জ্ঞান’ হ’য়ে রয়েছ, একটু নিজের জীবনটাও আলাদা ক’রে দেখ দিকিন। নারী পুরুষের একখানা পাঁজর খসিয়ে তোয়ের করা জানি; কিন্তু তোমার শোচনীয় অবস্থা দেখে দুঃখে আমার সব পাঁজরগুলোই খসে পড়তে চাইছে … আহা, বেচারি!… দেখ, তোমার স্বামী-দেবতার বাইরেও জগৎ আছে, গাড়ু মাজা আর কাপড় কোঁচানোর অতিরিক্তও কাজ আছে পৃথিবীতে…”

অম্বুরী হাঁটুতে চাপিয়া কোঁচান কাপড়টা পাকাইতেছে। হাসিয়া বলিল, “আচ্ছা, তোমার ব্যাখ্যানায় কাজ নেই, আমার জন্ম জন্ম এইটকুই বজায় থাক।”

অনিল শিহরিয়া উঠিল, বলিল, “মাফ কর, তাহ’লে এর পরের জন্মেই তুমি দয়া ক’রে অন্য পুরুষ দেখো বাপু, আমায় রেহাই দিও; আমায় আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে যে তুমি শুধু…জন্মের পর জন্ম…না বাপু, আমি এর মধ্যে নেই, ক্ষ্যামা দাও—”

আমরা তিনজনেই হাসিয়া উঠিয়াছি, ছোট ছেলেটাও আমার মুখের দিকে ঘুরিয়া চাহিয়া যোগ দিয়াছে, অম্বুরী হাসিয়া উপর গাম্ভীর্য চাপাইয়া আমায় সাক্ষী মানিয়া অনুযোগ করিতেছে, “শুনলে ঠাকুরপো? হিঁদুর ঘরে এ রকম আদাড়ে কথা শুনেছ কখন! কি মানুষ বাপু!—আমি তো বুঝি না…”