৯
হ্যাঁ, ওদের মধ্যে থেকে এবার বিদায় লইতে হইবে।
রাঁচির এই পার্টিতে একটা জিনিস সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল,—মীরা আমাদের উভয়ের ব্যবধানটা ভুলিতে পারে নাই। ওর দোষ দিই না, ভোলা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ধরা যাক, আজ অনিলা যেমন কৌশলে উহার পাশে আমার বসাইয়া দিল, সেইরূপ যদি ব্যারিস্টার নীরেশ লাহিড়ীকে, কিংবা রণেনকে, কিংবা এমন কি নিশীথকেও বসাইয়া দিত, তাহা হইলে অবস্থাটা কি রকম হইত?…মীরা লজ্জিত হইত, কিন্তু বিপর্যস্ত হইত না। অনিলাকে ধন্যবাদ দিই, একটা আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়া সে আমার চোখ খুলিয়া দিল।
আজ অবশ্য মীরার নাসিকার সেই ঈষৎ কুঞ্চন ফুটে নাই। না, ফুটে নাই; আমি খুব লক্ষ্য করিয়াছিলাম। হয় মীরা তাহার সেই মুদ্রাদোষটা একেবারেই দমন করিতে সমর্থ হইয়াছে; না হয় ইতিমধ্যেই আর একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে। এত কটুতার মধ্যেও সে-কথা ভাবিতে সুখ। —মীরা বোধ হয় সত্যই আমায় ভালবাসে, ব্যক্তিগতভাবে, জীবনের সেই নিভৃতে যেখানে ও একা। নিশ্চয় ভালবাসে মীরা, ডায়মণ্ডহারবার রোডের সেই সন্ধ্যা তাহার সাক্ষী। কিন্তু সমাজগতভাবে—যেখানে ও রাজার দৌহিত্রী, ব্যারিস্টার-কন্যা, যে আসরে নবীন ব্যারিস্টার, ডাক্তার, এঞ্জিনীয়ার, ডেপুটি, (অপদার্থ হইলেও) নিশীথের মত রাজরক্তের অধিকারী তাহার পাণিপ্রার্থী—সেখানে মীরা আমাকে লইয়া বিপর্যস্ত। ডেপুটি আর নিশীথের কথায় মনে পড়িয়া গেল—রাঁচি-প্রবাসে টের পাইলাম— কতক এদিক-ওদিক হইতে আর কতক নিজেই লক্ষ্য করিয়া, যে মীরা বেশ গা ঢালিয়া দিয়াই নিশীথের সঙ্গে মেলামেশা করিতেছে—গল্পসল্প, বেড়ানো, পার্টি! অবশ্য নিশীথের যা উগ্র আরাধনা, উপায়ও নাই বেচারির; একেবারে পরের জাহাজেই গ্লাসগো যাওয়া বন্ধ করিয়া ধর্না দিয়া পড়িয়া আছে!
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিলাম, ডেপুটি রণেন যথাসাধ্য মীরার দৃষ্টি নিজের দিকে ফিরাইবার চেষ্টা করিতেছে। মীরার দলের ভাবটা ঠিক বোঝা গেল না। অবশ্য আমি যতটুকু ছিলাম সে যেন চেষ্টা করিয়াই আমায় দেখাইতে লাগিল যে, রণেন তাহার কাছে উৎসাহ পাইতেছে; কিন্তু সেটা কিছু প্রমাণ নয়। আমার ঈর্ষা উদ্রেক করিয়া আমায় সতর্ক করাটাও তাহার একটা কারণ হইতে পারে। সত্যই যদি চাহিয়া থাকে মীরা আমায় তো এইটেই সম্ভব। এইটেই সম্ভব নিশ্চয়—মীরাকে কি এতই কম জানি যে, এ কথাটুকুও জোর করিয়া বলিতে পারি না?
মীরাকে কিন্তু আমি জানাইয়া দিলাম যে ভাঙন ধরিয়াছে। নিজেই টের পাইল—যখনই আমি পাশে বসিতেই সে সংকুচিত হইয়া পড়িয়াছিল এবং বুঝিল যে আমি তাহার সংকোচের কথা ধরিয়া ফেলিয়াছি। তাহা সত্ত্বেও আমি বুঝাইয়া দিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় তরুকে লইয়া কলিকাতা যাত্রা করিলাম। হুড জোনহা-প্রপাত, রাঁচি-হাজারিবাগ রোড, জগন্নাথপুরের মন্দির—সবই রহিল পড়িয়া। অপর্ণা দেবী অত্যন্ত ব্যথিত হইলেন; চলিয়া আসিলাম বলিয়া নয় চলিয়া আসার মূলের যে রহস্য থাকা সম্ভব তাহারই আশঙ্কায়।
সে-রাত্রিটা গাড়িতে যে কি ভাবে কাটিয়াছিল অন্তর্যামীই জানেন। সেকেণ্ড ক্লাসে দুইটি মানুষ, তরু আর আমি। তরু বিমর্ষ, তবুও একটু কথা চালাইবার চেষ্টা করিল। উত্তরের মধ্যে আমার মনের সন্ধান না পাইয়া চুপ করিয়া গেল। একটু পরে নিদ্রিতও হইয়া পড়িল। জাগিয়া রহিলাম আমি আর আমার চিন্তা। সমস্ত বুকটা যেন হাহাকারে ভরিয়া উঠিতেছে। কী করিয়া বসিলাম! কেন হঠাৎ চলিয়া আসিলাম? এর দ্বারা জীবনে যে সবচেয়ে প্রিয় তাহাকে যে কি গুরু আঘাত দিয়া আসিলাম তাহা একবারও ভাবিলাম না?…দূরত্ব যতই বাড়িতে লাগিল, অন্ধকার যতই ঘনীভূত হইয়া আসিতে লাগিল, মনটা বক্ষের পিঞ্জরে ততই যেন আছাড় খাইতে লাগিল—নিজের অসহায়তায়। কাল রাত্রির পর থেকেই মীরার মুখ বিষণ্ণ; যখনই জোর করিয়া প্রফুল্ল করিতে গিয়াছি, আরও মলিন হইয়া পড়িয়াছে।…এর উপর আরও নিষ্ঠুর হইয়া তাহাকে আঘাত দিয়াছি। আজকের সকালের কথা মনে পড়ে। মীরা যেন অনেক সংকোচ কাটাইয়া কালকের রাত্রের কথাটা পাড়িল একবার, ইচ্ছা ছিল যদি সম্ভব হয় তো কালকের গ্লানিটা মুছিয়া ফেলিবে আমাদের জীবন হইতে। বলিল, “কাল শৈলেনবাবু নিশীথবাবুকে খুব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন; নেমন্তন্নয় ডেকে কি অন্যায় ওঁর!…”
আমি একটুও চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, “কি করব বলুন? নিজের মর্যাদার ওপর চারদিক থেকে আঘাত পেয়ে আমার অতিথিধর্মের কথা ভুলে নিজেই ব্যবস্থা করতে হ’ল। আশা ছিল আমার তরফে একজনও উকিল পাব, তা…”
মীরার মুখের সমস্ত রক্ত যেন নিমেষে উবিয়া গেল। একটাও কথা আর বলিতে পারিল না সে। তাহার সেই নিষ্প্রভ মুখটাই শুধু মনে পড়িতেছে; কতবার তাহার মুখখানি হাসিতে কৌতুকে দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, হাজার চেষ্টা করিয়াও কিন্তু সে মুখ মনে আনিতে পারিতেছি না। মীরা তাহার পর আর আমায় উৎকণ্ঠিত, উল্লসিত হইয়া কিছু বলে নাই। ও আমায় পাল্টা আঘাত করে নাই, ভালবাসিয়া বোধ হয় সে-ক্ষমতা হারাইয়াছে, অন্তত এখানকার মত হারাইয়াছে। ও নীরবে সহিয়া গেল, শুধু নিজের মর্যাদাকে আর আহত হইতে দিল না। সমস্ত দিনে আমাদের হাসিয়া কথাও হইয়াছে; তরুর আব্দারে সকলে মোরাবাদী পাহাড়ে বেড়াইয়াও আসিলাম, মীরাও গেল, শুধু নিজে আর কোথাও যাইতে বলিল না—হাজারিবাগ রোড, জোনহা প্রপাতে—কোথাও না। থাকিতে বলিল না, আসিয়াই চলিয়া যাইতেছি কেন, প্রশ্ন করিল না একবারও। সবই বুঝিল, কিন্তু একবার আঘাত খাইয়া ও সমস্ত দিন যেন নিজের আহত মর্যাদাকে পক্ষাবৃত করিয়া বাঁচাইয়া চলিল।
না, এত বড় অন্যায় করা চলিবে না মীরার ওপর। গিয়াই পত্র দিব মীরাকে—যে আঘাতটুকু দিয়াছি তাহার জন্য ক্ষমা চাহিয়া। আবার শীঘ্রই ফিরিয়া আসিব। কাজ নাই আমার কলেজের পার্সেণ্টেজে, পরীক্ষার কৃতিত্বে। এত সাধনায় যে-ধন লাভ করিলাম, এমনি করিয়া হেলায় হারাইব? থাক্ না মীরার একটু অবজ্ঞা, সব সহিয়া যদি ভালবাসিতে না পারিলাম তবে আমার ভালবাসা কিসের? মীরার রক্তের মধ্যে রহিয়াছে সাধারণের জন্য অবজ্ঞা, কি করিবে ও?—নিতান্ত নিরুপায় যে মীরা ওখানে। অপর্ণা দেবীর কথা মনে পড়িল— “ও মেয়ে ভাল শৈলেন…তোমাদের যেখানে সৌন্দর্য, যেখানে মহত্ত্ব—সেখানে ওর চোখ গিয়ে পড়ে, কিন্তু মায়ের বংশের কোন্ যুগের রাজামহারাজারা ওর মাথা দেন বিগড়ে মাঝে মাঝে…”
আমি ভালবাসিয়াও যদি ওর এ নিরুপায় দুর্বলতার কথা না বুঝি তো কে বুঝিবে? ভালবাসায় যদি অপরিসীম ক্ষমা রহিল না সরমার মত, যদি অন্ধতা রহিল না ইমানুলের মত, যদি ঊদ্দম আবেগ রহিল না ভূটানীর ছেলের মত, তবে কিসের ভালবাসা? হাসি পায়—আমি ইমানুলের প্রেমকে আমার গল্পে অভিনন্দিত করিয়াছি! —অপদার্থ সাহিত্যিক, জীবনে প্রেমকে করি পদে পদে অবমাননা, সাহিত্যে তাহাকে পরাই রাজমুকুট!
গাড়ির গতিবেগে বাতাসে একটানা হুঁ হু শব্দ। জানালা দিয়া বাহিরে অন্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া আছে। অনুভব করিতেছি —প্রতি মুহূর্তেই মীরা হইয়া যাইতেছে সুদূর।…এ-ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নাই? ধরো যদি মীরার অভিমান না ঘোচে! মীরাকে যদি আর ফিরিয়া পাওয়া না-ই যায়! তাহার পরেও তো দিনের পর দিন জুড়িয়া কাটাইতে হইবে এই জীবনটাকে!
বাসায় আসিয়াই তরুকে মিস্টার রায়ের নিকট লইয়া গেলাম। তরু তাঁহাকে উৎফুল্লভাবে জড়াইয়া বলিল, “কি চমৎকার জায়গা বাবা, কি বলব তোমায়! আমি কিন্তু শীগগিরই আবার চলে যাব বাবা তা বলে দিচ্ছি… কী রোগা হ’য়ে গেছ বাবা তুমি!”
মিস্টার রায় তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “ভেবেছিলাম, এইবার মোটা হব, মা এসেছে। তা তুমি তো আবার চলেই যাচ্ছ।”
তরু হাসিয়া বলিল, “তোমায় আবার মোটা ক’রে দিয়ে তবে যাব।”
মিস্টার রায়ও হাসিয়া বলিলেন, “বাঁচলাম, তাহ’লে বেশ দেরী ক’রে মোটা হব’খন, না হওয়া পর্যন্ত তো আর যেতে পারবে না?”
আমায় বলিলেন, “তুমি হঠাৎ ফিরে এলে শৈলেন?”
উত্তর করিলাম, “ভাবলাম মিছিমিছি পার্সেণ্টেজ নষ্ট ক’রে”…
মিস্টার রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মুখের পানে চাহিলেন, তাহার পর হঠাৎ চকিত হইয়া বলিলেন, “Well, I clean forgot it (একেবারেই ভুলে বসে আছি); তোমার এক বন্ধু এসেছিল কাল। Let me see, ক্লীনারের হাতে একটা চিঠি দিয়ে যাচ্ছিল, কোথায় রেখেছি দেখি দাঁড়াও।”
চিঠিটা বাহির করিয়া দিয়া বলিলেন, “এবার যাও তোমরা।… আর তরু, তুমি একটু জোর ক’রে লাগো; you must soon decide whether it should be Loreto or লক্ষ্মী-পাঠশালা। (লরেটাতে পড়বে কি লক্ষ্মী পাঠশালায়, শীগগির এবার ঠিক করে ফেলতে হবে)।”
ওদের বাপে মেয়েতে ইংরেজী চলে মাঝে মাঝে। তরু যাইবার জন্য পা বাড়াইয়াছিল, ঘুরিয়া দাঁড়াইল। হাসিয়া বলিল, “I have already decided Daddy, if you come to that। (যদি তাই-ই বলো তো আমি মনস্থির ক’রেই ফেলেছি বাবা)।”
মিস্টার রায় কৌতুহলের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করিলেন, “Well (অর্থাৎ)?”
তরু হাসিয়া বলিল, “I would prefer লক্ষ্মী-পাঠশালা। (লক্ষ্মী-পাঠশালাই পছন্দ আমার)।”
মিস্টার রায় বিস্ময়ের ভঙ্গিতে মুখটা লম্বা করিয়া লইলেন, বলিলেন, “As much as to say you prefer your mummy to your poor old dad (তার মানে তুমি বুড়ো বাপ-বেচারির চেয়ে মাকেই চাও বেশি)? না, কখনো তোমার হাতে আর আমি মোটা হতে চাইব না, আড়ি তোমার সঙ্গে।”
পিঠে দুইটা আদরের চাপড় মারিয়া হাসিয়া বলিলেন, “Go and have a bath, look sharp, I will have it out with your mother (শীগগির গিয়ে এবার হাত-পা ধুয়ে ফেল, আমি তোমার মায়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করব)।”
ঘরে আসিয়া চিঠিটা খুলিলাম। অনিলের চিঠি। লিখিয়াছে—
“নিতান্ত জরুরী কাজ বলে ছুটে এসেছিলাম। চিঠিতে লেখবার নয় বলে কোন ইঙ্গিতও দিলাম না। রাঁচি থেকে এসেই চলে আসবি একবার; নিশ্চয়। —অনিল।
তখনই গিয়া মিস্টার রায়ের নিকট হইতে ছুটি লইয়া আসিলাম।