১৩
একটা কিছু হোক্, আর যেন সয় না। হয় একেবারে ভাঙনই, নয় ত্রুটি-বিচ্যুতি ভুলিয়া সুনিবিড় বাঁধন চিরদিনের জন্য। মীরা কি বলিবে বলুক, দিব সুযোগ।
কিন্তু কি করিয়া?
মীরা নিজেই আবার সুযোগের উদ্যোগ করিল।
সেদিন বিকাল বেলায় আমার ঘরের সামনে বারান্দায় বসিয়া আছি। হেমন্ত-দিন-শেষের তামাটে রোদ সামনের গাছপালা রাস্তা-বাড়ির উপর পড়িয়াছে, বেশ একটা সুস্থ ভাব জাগায় না মনে। কতকগুলো এলোমেলো চিন্তা যাওয়া-আসা করিতেছে, কোনটাই স্থায়ী হইতে পারিতেছে না।
নিশীথ তাহার নূতন মোটরে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। আমায় দেখিয়া কি ভাবিল বলিতে পারি না, তবে বাহিরে বাহিরে রাঁচিতে সেই বিদায়ের সময়ের ভাবটা বজায় রাখিল। “হ্যাল্লো, মিস্টার মুখার্জী, কি রকম আছেন?”—বলিয়া হাতটা বাড়াইয়া ডানদিকে একটু ঝুঁকিয়া বিলাতী কায়দায় অগ্রসর হইয়া আসিল। আমিও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলাম, ভালই, ধন্যবাদ, আপনি কি রকম ছিলেন? আপনিও হঠাৎ চলে এলেন দেখছি!”
নিশীথ টুপিটা হ্যাটস্ট্যাণ্ডে টাঙাইয়া দিয়া একটু কুশন-চেয়ারে বসিয়া পড়িল। বলিল, “থেকেই যেতাম, কিন্তু ভেবে দেখলাম ওদিকে আবার বেজায় দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
‘ওদিকে’ মানে অবশ্য ওর সেই ‘পরের জাহাজেই গ্লাসগো যাত্রা’। বলিলাম, “হ্যাঁ, তা হ’য়ে যাচ্ছে বটে।”
নিশীথ বলিল, “মিস্ রায় বাড়িতে আছেন নাকি?”
কব্জিটা উল্টাইয়া হাতঘড়িটা দেখিয়া বলিল, “বাই জোভ্, সাড়ে পাঁচটা হ’য়ে গেল!”
বলিলাম, “বাড়িতেই আছেন বোধ হয়, বাইরে তো কই যেতে দেখিনি!”
রাজু বেয়ারা যাইতেছিল, ডাকিয়া মীরাকে খবর দিতে বলিলাম।
খুব প্রফুল্ল নিশীথ।—সেই লোকের মত, যে নিজের মনে বিশ্বাস করে যে সমস্ত বাধা-বিপত্তি কাটাইয়া বিজয় লাভ করিবেই। সত্য হোক, মিথ্যা হোক্ এই আত্ম-প্রত্যয়ের জোরেই ও আমায় ক্ষমার চক্ষে দেখিতেছে। বিজয় যখন প্রত্যক্ষ —অন্তত যখন ভাবা যায় যে প্রত্যক্ষ—তখন উদারতা আসে না খানিকটা?
কেমন একটা ছেলেমানুষি লোভ হইল—একবার রণেন চৌধুরীর আসিবার কথাটা জানাইয়া দিই। দিলাম না কিন্তু, ভাবিলাম, যে যতটুকু নিজের মনগড়া স্বর্গে কাটাইতে পারে কাটাক।…বেচারি নিশীথ!
একটু চঞ্চলভাবে পা নাড়িতে নাড়িতে নিশীথ বলিল, “বিশেষ কাজ রয়েছে, একটা foreign travels-এর (বিদেশ যাত্রার) হাংগাম তো আন্দাজ করতেই পারেন; কিন্তু রাঁচি থেকে চলে এসেছি অথচ যদি দেখা না করি…এ বিষয়ে মহিলারা কি রকম sensitive (অভিমানী) জানেনই তো!”
তাহার পর সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলিল, “But this is between you and me, mind you (কিন্তু মনে রাখবেন, কথাটা নিজেদের মধ্যে বলছি)।”
বলিয়া, সামনে পিছনে দুলিয়া দুলিয়া হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
রাজু বেয়ারা আসিয়া বলিল, “দিদিমণি বললেন ওঁর মাথাটা বড্ড ধরেছে।”
একটা ঝড়ে দোদুল্যমান বৃক্ষ মচকাইয়া গেলে যেমন হয়, নিশীথ যেন ঠিক সেই রকম হইয়া গেল। কিন্তু এ-সব ব্যাপারে খুব পোক্ত হইয়া উঠিয়াছে সে, চক্ষু দুইটা কপালে তুলিয়া বলিল, “বাই জোভ্! আপনি তো আমায় বলেননি মিস্টার মুখার্জি।”
বলিলাম, “আমি নিজেই জানতাম না। ভালই তো ছিলেন, বোধ হয় এইমাত্র আরম্ভ হয়েছে।”
মুঠায় মুখটা চাপিয়া নিশীথ একটু চিন্তা করিল। তাহার পর যাহা করিল তাহা ওদের মধ্যেও একা ওই পারে। বলিল, “একবার বল তো গিয়ে রাজু, মিস্টার চৌধুরী বড্ড ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছেন, যদি আপত্তি না থাকে তো ওপরে গিয়েই দেখা করি। যদি ডাক্তার দেখাবার দরকার হয় তো…বলবে—বড্ডই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শুনে, বুঝলে তো?”
আমার সঙ্গে আর কোন কথা হইল না, নিশীথ সেইভাবেই মুঠায় মুখ চাপিয়া পা নাড়িতে নাড়িতে বার-দুই “বাই জোভ্! বাই জোভ্!” করিল।
চঞ্চল হইয়াছে সন্দেহ নাই, তা সে যে কারণেই হোক।
রাজু আসিয়া বলিল, “ধন্যবাদ জানালেন আর বললেন—না, ডাক্তারের দরকার নেই, একটুখানি একলা থাকলেই সেরে উঠবেন।”—এমন সতর্কভাবে বলিল যেন যাহা শুনিয়া আসিয়াছে তাহার একটি অক্ষরও বাদ না পড়ে।
তাহার পর সে গ্যারেজের দিকে চলিয়া গেল।
নিশীথের মোটর চলিয়া যাইবার একটু পরেই বাড়ির গাড়িটা ধীরে ধীরে আসিয়া গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়াইল। কে যায় দেখিবার জন্য উগ্র রকম একটা কৌতূহল হইতেছে।
তরু আসিয়া বলিল, “দিদি বেড়াতে যেতে বললেন মাস্টারমশাই!” আজ বেড়াইতে যাইবার ইচ্ছা করিতেছিল না বলিয়াই বসিয়াছিলাম। তাহাই বলিতে যাইতেছিলাম, কিন্তু আর বলিলাম না, “বেশ চল” বলিয়া জামাটা পরিয়া লইবার জন্য ঘরের দিকে গেলাম। তরু বলিল, “আমি যাব না।”
একটু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলাম, “তবে? একলা কি করতে যাব আমি?”
তরু ঘরের দুয়ারের কাছে আসিয়া বলিল, “একলা নয়, আপনি আর দিদি।”
আমি পাঞ্জাবিটা গায়ে দিতেছিলাম, সেই অবস্থাতেই ঘরের মাঝে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। মীরার আচরণ কয়েকদিন হইতে খুবই অদ্ভুত, সামঞ্জস্যহীন, কিন্তু এতবড় একটা বেমানান ব্যাপার করিয়া বসিবে, তাহাও এত স্পষ্টভাবে—স্বপ্নেও ভাবিতে পারি নাই। খানিকক্ষণ আমার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না। তাহার পর বলিলাম, “বল’গে আমায় একটু অন্যত্র যেতে হবে, তিনি একলাই যান।”
তরু ফিরিয়া বলিতে যাইবে, এমন সময় সিঁড়ির মোড়ের কাছে চাপা রাগের একটা বিকৃত স্বরে মীরার কণ্ঠ শোনা গেল, “তরু বলো মাস্টারমশাইকে, এটা আমার হুকুম, ওঁর অনুগ্রহের কিছু নেই এতে।”
আমি প্রায় সংযম হারাইয়াছিলাম, কিন্তু ঠিক সময়ে নিজেকে সংবৃত করিয়া লইলাম। একটি আত্মসংযম হারান মেয়েছেলের সঙ্গে এখনই কি একটা বিসদৃশ ব্যাপার ঘটিয়া যাইত ভাবিয়া মনে মনে শিহরিয়া উঠিলাম। তবে মনে মনেই স্থির করিয়া ফেলিলাম বন্ধনের যাহা একটু অবশেষ আছে এইবার শেষ করিয়া দিতে হইবে; সুযোগ আসিয়াছে। খুব সহজ ধৈর্যের সঙ্গে জামাটা পরিয়া লইয়া বাহির হইয়া আসিলাম।
সিঁড়ির মোড়ের দুইটা ধাপ নীচে মীরা অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া আছে, বাম দিকের নাসিকাটা কুঞ্চিত, চোখের কোণে যেটুকু দেখা যায় যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ একটা, চাপা উত্তেজনায় বুকটা দীর্ঘচ্ছন্দে উঠানামা করিতেছে।
আমি শান্তকণ্ঠে বলিলাম, “চলুন।”
দু-জনে গিয়া মোটরে উঠিলাম।
মোটর স্টার্ট দিতে দৃষ্টিটা আমার আপনা-আপনিই একবার তরুর উপর গিয়া পড়িল। উগ্র আশঙ্কায় যেন কিম্ভুতকিমাকার হইয়া সে চৌকাঠে ঠেস দিয়া আমার পানে চাহিয়া আছে।
গেটের কাছে আসিয়া ড্রাইভার প্রশ্ন করিল, “কোন দিকে যাব?”
মীরা কোন উত্তর করিল না। বাহিরের দিকে মুখ করিয়া বসিয়া ছিল, সেইভাবেই চুপ করিয়া রহিল। আমি বলিলাম, “ডায়মণ্ড হারবার রোডের দিকে চলো না হয়।”
যেখানে একদিন মিলন হইয়াছিল স্পষ্ট, সেখানে আজ বিচ্ছেদকে স্পষ্ট করিয়া দিতে হইবে।
গাড়ি সার্কুলার রোড হইয়া চৌরঙ্গী পার হইয়া পশ্চিমে ছুটিল। খিদিরপুরের পুল পার হইয়া বায়ে ঘুরিয়া ডায়মণ্ড হারবার রোড ধরিল। কোন কথা নাই। শুধু শেভ্রোলে গাড়ির মসৃণ আওয়াজ। খালের পুলটা যখন পার হইলাম মীরা হাওয়া লাগাইবার জন্য মোটরের কিনারায় মাথাটা পাতিয়া দিল, কপালের চারিদিকে চুলগুলা আল্গা হইয়া চোখে-মুখে উড়িয়া পড়িতে লাগিল।
বেহালা-বড়িষা পার হইয়া মোটর সবে একটু ফাঁকায় আসিয়াছে, মীরা ড্রাইভারকে বলিল, “ফেরো।”
ফিরিবার সময়ও কোন কথা হইল না। দুইজনের মাঝখানে বীচিহীন জলরাশির মত অটুট স্তব্ধতা থমথম করিতে লাগিল।
বাড়িতে আসিয়া মীরা তেমনি অভঙ্গ নিস্তব্ধতায় সিঁড়ি বাহিয়া ঋজু গতিতে উপরে উঠিয়া গেল।
কি বলিত মীরা?—কেন বলিল না? ডায়মণ্ড হারবার রোডের যেখানটিতে আসিলে দু-জনের জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম সন্ধ্যাটিকে বোধ হয় পাওয়া যাইত অতটা যাইয়া মীরা তাহার সম্মুখীন হইল না কেন?—তাহার ভয় হইল দুর্মদ অভিমানের মধ্যে যে কঠোর সংকল্প তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছিল, সেই আমাদের তীর্থভূমিতে যাইলেই সেটা চূর্ণ হইয়া যাইবে?
হ্যাঁ, একটা অতি কঠোর সংকল্পকেই মীরা সেদিন প্রাণের সমস্ত উত্তাপ দিয়া লালন করিয়া তুলিতেছিল,—আত্মহত্যার সংকল্প।
কেন, কি করিয়া বলিব? নারীহৃদয়ের গভীরতম প্রদেশের সংবাদ কি করিয়া জানিব?—অভিমান, নৈরাশ্য—না, তাহার ধমনীর সেই রহস্যময় রাজরক্তের কণিকা? পরদিন সন্ধ্যার সময় সকলেই জানিতে পারিল মীরা নিশীথকেই বরমাল্য দিবে।
আত্মহত্যাই বইকি। আত্মহত্যার কি একটিই রূপ আছে?—আরও ভয়ংকর রূপ নাই?—তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া? —সমস্ত জীবনকে একটা দীর্ঘীকৃত মৃত্যুতে পরিণত করা?
মীরা এই আত্মহত্যাই বাছিয়া লইল। কেন?—তাহাই বা কি করিয়া বলি?—হয়তো যে আভিজাত্যকে ইচ্ছামত নোয়াইতে পারিল না তাহার উপর প্রতিশোধ।