» » মীরা-সৌদামিনী

বর্ণাকার

সুখের বিষয় আমার আন্দাজটা ফলিল—মিস্টার রায় পরদিন সকালেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বেড়াইবার বাতিক আছে একটু, বাহিরে গেলে তার সুযোগ ছাড়েন না; পূর্ণিয়া-ফেরত মালদহে নামিয়া গৌড়ের ভগ্নাবশেষ দেখিয়া আসিলেন! ভুটানীর মৃত্যুর কথা শুনিয়া বলিলেন, “So she is dead (তাহ’লে মারা গেল)? অপর্ণার পক্ষে ভাল কি মন্দ হ’ল ঠিক বুঝতে পারছি না, অন্তত কতকটা অন্যমনস্ক থাকত। Poor girl! We must watch and see how it re-acts on her. (ওর মনের ওপর কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়, দেখা দরকার)।”

আমি আর মীরা দুজনেই ছিলাম। মীরা প্রতিক্রিয়াটা কি রকম শুরু হইয়াছে বোধ হয় বলিতে যাইতেছিল, আমি চোখের ইসারা করিয়া বারণ করিয়া দিলাম।

বিকালে আমার ঘরের সামনে বারান্দায় বসিয়া আছি—আমি, মীরা আর তরু। তরুকে লইয়া বেড়াইতে যাইব, মোটরে একটা কি হইয়াছে; ড্রাইভার সেটা শোধরাইতেছে। নিশীথ আসিল। নুতন একটা সিডন-বডি গাড়ি কিনিয়াছে। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখের ভাবটা। ভিতর থেকে মুখ বাড়াইয়া বলিল, “গুড্ আফটারনুন মিস্ রায়।” সঙ্গে সাঙ্গে ফেল্ট টুপিটা হাতে করিয়া নামিয়া, সিঁড়ি বাহিয়া বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল এবং মুখটা একেবারে শুকুনো মত করিয়া প্রশ্ন করিল, “বাই দি বাই, মা কি রকম আছেন? সকালবেলা কোনমতেই আসতে পারলাম না। নেকস্‌ট বোটে বোধ হয় সেল্ করতে হবে। কতকগুলো প্রিলিমিনারিজ্ ঠিক করতে এমন আটকে গেলাম!”

কথা কহিতে কহিতেই হ্যাট-র‍্যাকে টুপিটা রাখিয়া উহারই মধ্যে চকিতে একবার আর্শির মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছায়াটা দেখিয়া লইয়া একটা চেয়ারে বসিল। আবার প্রশ্ন করিল, “মিসেস্ রায় আছেন কি রকম বলুন তো; রাত্তিরটা যা কেটেছে!”

লোকটা দিনকতক, কি কারণে জানি না, একটু যেন ঢিলা দিয়াছিল, আবার প্রাণপণে স্বয়ংবর-সমরে নামিয়াছে। নূতন মোটরও বোধ হয় একটা অস্ত্ৰই। বোধ হয় আমার এই কয়েক দিনের অনুপস্থিতির সুযোগে আবার নূতন স্টার্ট লইয়াছে। আমার প্রতি ভাবটা এমন দেখাইল যেন আছি কি নাই সে খবরই জানে না ও।

মীরা শান্ত কণ্ঠে বলিল, “থ্যাংক ইউ, মা অনেকটা ভালই আছেন।… শৈলেনবাবুরর একটা পরামর্শে অনেকটা সুবিধে হ’ল। সামান্য কথা অথচ আমাদের মাথায় একেবারেই আসেনি। মার ঘরটা রাত্তিরে বদলে দিলাম। এটুকুতেই অনেকটা যেন অন্যমনস্ক আছেন বলে বোধ হচ্ছে।”

আমি অন্যদিকে চাহিয়া ছিলাম, তবু অনিচ্ছাসত্ত্বেও একবার নিশীথের দিকে চোখ পড়িয়া গেল। পরামর্শ দেওয়ার অপরাধে, আমাকে যদি একবার পায় তো যেন চিবাইয়া খায়। মুখের ভাবটা পরিবর্তন করিয়া লইয়া বলিল, “দাঁড়ান, ঠিক এই কথাই আমি ভেবেছিলাম। আপনাকে বোধ হয় বলেও থাকব, বলিনি?”

মীরা বলিল, “আমার ঠিক মনে পড়ছে না। বলে থাকবেন বোধ হয়।”

“তবে কি তরুকে বললাম?”

তরু মীরার মত আর সন্দেহের কিছু বাখিল না, বলিল, “না, আমায় তো বলেননি!”

নিশীথ আমার পানে আর একটা কটাক্ষ হানিল—এবার বোধ হয় আমার ছাত্রী স্পষ্ট কথা বলে এই অপরাধে। অন্যায় হইয়াছিল কি না জানি না, তবে আমি একটা লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। কতকটা উহার পানে চাহিয়া বলিলাম, “ঘর-বদলানর কথাটা আমার মাথায় প্রথমে আসেনি, এইখানেই কার মুখে যেন শুনলাম মনে হচ্ছে—এখন আপনি বলায় বুঝতে পাচ্ছি…”

মীরা আমার পানে একবার চকিতে চাহিল, যেন না চাহিয়া পারিল না। নিশীথও আমার পানে আর একবার বক্রদৃষ্টি হানিয়া সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথা পাড়িল; প্রশ্ন করিল, “মিস্টার রায় এসেছেন শুনলাম!”

মীরা বলিল, “আজ সকালে এসেছেন বাবা।”

একটা মস্ত বড় দুর্ভাবনা যেন নামিয়া গেল, নিশীথ এইভাবে বলিল, “বাঁচা গেল। I hope he was perfectly all right (আশা করি বেশ ভালই ছিলেন)।”

মীরা উত্তর করিল, “থ্যাংক্‌স। ভালই ছিলেন বাবা…ওঁর বেড়াবার ঝোঁক, ফেরার মুখে গৌড়ের রুইন্‌স্ দেখে ফিরলেন, তাইতেই দেরি হ’য়ে গেল।”

নিশীথ মুখ ভার করিয়া গাম্ভীর্যের অভিনয় করিয়া বলিল, “ওঁর সঙ্গে একচোট বোঝাপড়া আছে আমার, উনি ওদিকে মন্দির-মসজিদের রুইন্‌স দেখে বেড়ান, এদিকে মানুষের রুইন্‌স নিয়ে যে…”

সম্পূর্ণ নিজের সৃষ্ট এত বড় একটা রসিকতায় বাড়ির অবস্থা ভুলিয়াই মুক্তকণ্ঠে হাসিতে যাইবে, ড্রাইভার আসিয়া বলিল, “ঠিক হ’য়ে গেছে, গাড়িটা।”

আমি আর তরু উঠিয়া দাঁড়াইলাম। নিশীথ বলিল, “মিস রায়ের কোথাও এন্‌গেজমেণ্ট আছে নাকি?”

মীরা একটু বিলম্বিত কণ্ঠে বলিল, “কই, না!”

“তাহলে আমার গাড়িটা রয়েছে। সর্বদাই বাড়িতে বসে থাকাটা ঠিক নয় আপনার পক্ষে।”

মীরা শরীরটা একটু এলাইয়া শ্রান্তভাবে বলিল, “একেবারেই বেরুতে ইচ্ছে করছে না। কেন যেন একটা কুড়েমিতে পেয়ে বসেছে।”

নিশীথ বলিল, “সে-সব কিছু শোনা হবে না; নিন, উঠুন।”

নিমরাজি দেখিয়া এতটা উৎফুল্ল হইয়া উঠিল যে আমা হেন উপেক্ষণীয়কেও সাক্ষী মানিয়া বসিল, “কুড়েমিতে পাওয়াটা একটা দুর্লক্ষণ নয় মাস্টারমশাই?”

বলিলাম, “নিশ্চয়ই, অবশ্য নিশিতে পাওয়াকে যদি সুলক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়।”

মীরা হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। নিশীথও হাসিল, অবশ্য বুঝিলে কখনই হাসিত না। মীরা উঠিয়া গেল, বলিল, “দাঁড়ান, তাহ’লে, এক্ষুণি আসছি, নেহাতই যখন ছাড়বেন না।”

নিশীথ আমাদের একটু আটকাইয়া দিল। তরুকে বলিল, “মিস্ রায় জুনিয়ার, তোমার জন্যে একটা চমৎকার জিনিস জোগাড় ক’রে রেখেছি। আন্দাজ কর তো কি?”

তরু লুব্ধভাবে একটু চিন্তা করিল, তাহার পরে আবদারের স্বরে বলিল, “না, আপনি বলুন, আমার কিছুই আন্দাজ আসছে না। বলুন, হ্যাঁ বলুন?”

নিশীথও তারও একটু লুব্ধ করিয়া তুলিল, তাহার পর দুই হাত দেখাইয়া বলিল, “এই ইয়া বড়া এক লালমোহন!”

নিশীথ স্বয়ংবর-সংগ্রামে চারিদিক থেকেই তোড়জোড় লাগাইয়াছে। তরু উৎফুল্ল হইয়া… “আজই আনতে যাব, নিশীথদা” বলিয়া নিশীথকে জড়াইয়া ধরিয়াছে, এমন সময় মীরা নামিয়া আসিল, বলিল, “নিশীথবাবুর যদি আপত্তি না থাকে তো…”

নিশীথ ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিল, “কি, কি? বলুন, আপত্তি কিসের?”

“মাকেও নিয়ে গেলে হ’ত না আমাদের সঙ্গে?”

নিশীথের মুখের সমস্ত দীপ্তি যেন নিবিয়া গেল। স্খলিত কণ্ঠে বলিল, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…তাঁকে যদি নিয়ে যেতে পারেন তো…”

নিশীথের অলক্ষ্যে মীরা আমার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। কেন যে — স্পষ্ট বুঝা, গেল না।

অপর্ণা দেবীর অস্বাভাবিক উৎকণ্ঠার কথাটা মীরাকে বলি নাই, রাত্রে আহারাদির পর মিস্টার রায়কে একান্তে তাঁহার ঘরে বসিয়া বলিলাম। মিস্টার রায় সুরাপাত্রটা ধরিয়া তীব্র উদ্বেগের সঙ্গে কাহিনীটা শুনিতেছিলেন, শেষ হইলে ছাড়িয়া দিয়া কৌচটাতে হেলান দিয়া নিজের কোলে হাত দুইটা জড় করিয়া লইলেন। বলিলেন : “Here is a pretty piece of business (চমৎকার ব্যাপার)! ভূটানীর আসার পর থেকেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শৈলেন, যে এই রকম ব্যাপার ঘটবেই; যদিও ওকে একটু ভুলে থাকতে দেখে এক-একবার আশ্বস্তও হ’য়ে থাকব। আসল কথা—নিজের জীবনের যা ট্র্যাজেডি সেইটে অষ্টপ্রহর আবার অন্যের জীবনের মধ্যে দিয়ে দেখতে থাকা—এর ফল কখনও ভাল হয় না। আমি অপর্ণাকে দু’একবার হিণ্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু জানই she is self-willed (সে জেদী)। যাক, এখন করা যায় কি? This must not be allowed to continue (এ ব্যাপারটা কোন-মতেই স্থায়ী হ’তে দেওয়া চলে না)।”

মিস্টার রায় অনেকক্ষণ দুইটা হাতের মধ্যে মুখ রাখিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। একবার সুরাপাত্রটা তুলিয়া একচুমুক পান করিলেন। কিছুক্ষণ পরে একটু বিচলিত-ভাবে বলিয়া উঠিলেন, “O, the golden dream (হায়, সোনার স্বপ্ন)!”

বুঝিলাম মিস্টার রায় মনে মনে সমস্ত জীবনটা এমুড়ো ওমুড়ো দেখিয়া যাইতেছেন—অত স্বপ্ন দিয়া রচা জীবন! অথচ যাহাকে কেন্দ্র করিয়া রচা, বিশেষ করিয়া সে-ই জীবনটা দুর্বহ করিয়া তুলিল। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি হইবে? পাত্রের সুরাটুকু নিঃশেষ করিয়া আরও একটু ঢালিয়া রাখিলেন, চিন্তা-শক্তিকে উত্তেজিত করা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে; কিংবা দুশ্চিন্তাকে ডুবাইবার প্রয়াস এটা?

আমি বলিলাম, “একটা ব্যাপার অপর্ণা দেবীর জীবনে বড় অপকার করছে, আপনাকে কয়েকবার বলব মনে করেছি, এই সময়টা সেটা আবার খুব বেশি হানিকারক হ’য়ে উঠেছে…”

মিস্টার রায় স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, “You mean her exclusiveness (ওর এই কুনোবৃত্তির কথা বলছ)? If I have tried once, I have tried a hundred times. She is always her old obdurate self (আমি অশেষ চেষ্টা করেছি; সেই পুরানো জিদ ওর)।”

বলিলাম, “বলেন তো আমি একটু চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি। ওঁর প্রাণ বোধ হয় একটা পরিবর্তন চাইছে এই আঘাতটা পাওয়ার পর থেকে, — এক কথাতেই উনি যেমন ঘরটা বদলাতে রাজি হলেন। আমার মনে হয় ওঁর দিনকতক অন্য জায়গায় গিয়ে থাকা দরকার—দার্জিলিং, শিলং, পুরী—একটা চেঞ্জ্ অব সীন্ বিশেষ দরকার। যদি খুব রাজি নাও থাকেন, একবার গিয়ে পড়লে নিশ্চয় ভাল লাগবে। উনি এই খানটায় নিজের মনকে বুঝতে পারছেন না।”

মিস্টার রায় অর্ধ-অন্যমনস্ক ভাবে কথাটা শুনিতেছিলেন, ভিতরে ভিতরে ওঁর একটা চিন্তাধারা চলিতেছিল। বলিলেন, “দেখ বলে…By the bye, Sailen, I also have been maturing a plan all the time. It is a lovely plan, only somewhat of a fraud (ইতিমধ্যে আমিও বরাবর একটা ছক পাকা ক’রে আনছি। ছকটা চমৎকার; তবে খানিকটা প্রবঞ্চনা আছে তার মধ্যে)।”

আমি মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসু নেত্রে তাঁহার পানে চাহিলাম। মিস্টার রায় বলিলেন, “তুমিও তার মধ্যে আছ, rather you are the hero of the pioce (বরং তোমারই প্রধান ভূমিকা)।”

কৌতূহলটা আরও উদ্রিক্ত করিয়া মিস্টার রায় আবার খানিকটা চুপ করিয়া রহিলেন। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন, “তোমাদের প্রোফেসার মিস্টার সরকার আমার একজন বন্ধু, শৈলেন। তাঁর কাছে তোমার কথা প্রায়ই শুনতে পাই, he has high hopes about you (তিনি তোমার সম্বন্ধে উচ্চ আশা পোষণ করেন)। তোমার ভবিষ্যৎ কেরিয়ার নিয়ে আমাদের কিছু কিছু আলোচনা হয় মাঝে মাঝে। তোমায় বোধ হয় এর হিণ্ট্ দিয়েছি। আমার ইচ্ছে তুমি এম্‌-এ-টা দিয়ে ইংলণ্ডে চলে যাও, যদিও এম-এ দেওয়াটা আমি অত প্রয়োজন দেখি না sheer waste of time (নিছক সময় নষ্ট)। সেখানে গিয়ে তুমি গ্রেজ্ ইন বা ইনার টেম্পলে ঢোক, আমি ঢুকেছিলাম ইনার টেম্পলে। এ পর্যন্ত আগেকার প্ল্যান ছিল, সম্প্রতি—মানে আজ এই মাত্র একটু বাড়ান গেল।”

মিস্টার রায় পাত্রে একটি চুমুক দিয়া আবার বলিতে লাগিলেন, “তোমার প্রিন্‌সিপল কি? To remain scrupulously honest and clean (একেবারে সাধু আর নিদাগ হ’য়ে থাকা), না, এটা বিশ্বাস কর যে, জীবনে মিথ্যা প্রবঞ্চনার ও একটা ন্যায্য স্থান আছে?”

বলিলাম, “ আলো-ছায়ার জগৎ—এ তো নিত্যই দেখতে পাচ্ছি।”

“বেশ, অপর্ণাকে বাঁচাতে হ’লে ঐ ছায়ার সাহায্য একটু নিতে হবে। অবশ্য আশা করা যাক নাও হ’তে পারে, তবে মনে হয়, we ought to be prepared for the worst (খারাপটুকুর জন্যেই তোয়ের থাকা ভাল)। ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই, তুমি গিয়ে একটু ভাল করে নিতীশের সন্ধান নেবে। এ পর্যন্ত কেউ আপন জেনে এটা করেনি। খুঁজে বের করতে পার, ভালই, আমাদের মনের অবস্থা বুঝিয়ে, বিশেষ ক’রে তার মায়ের অবস্থার কথা বলে তার মতিগতি একটু ফেরাতে পার, আরও ভাল, না পার—ঐ যে বললে ছায়ার কথা, প্রবঞ্চনার কথা তারই আশ্রয় নিতে হবে। You shall have to pretend—he has been found out, he has been re-claimed and write (তোমাকে মিথ্যে ক’রে লিখতে হবে যে দেখা পেয়েছ, সে শুধরে গেছে)।

শোনার সঙ্গে বুকটা ছাঁত করিয়া উঠিল। অপর্ণা দেবীর সেদিনের সেই কুশবৎসের কথা মনে পড়িয়া গেল! কলিকাতার গয়লাদের নীচ ফন্দি—ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছেন অপর্ণা দেবী—বলিতেছেন— “উঃ কি ক’রে পারলাম বল তো শৈলেন!”

কিন্তু এই জীবন, আরোগ্যের জন্য বিষ প্রয়োগের ব্যবস্থা এখানে,—সব সময়েই অমৃতের নয়। পাছে মিস্টার রায় আমার কুণ্ঠা ধরিয়া ফেলেন এই জন্য তাড়াতাড়ি নিজেকে সংবৃত করিয়া লইয়া বলিলাম, “প্ল্যানটা ভালই, আশা করি ভাল ক’রে চেষ্টা করলে ভগবান সহায়ও হ’তে পারেন! কিন্তু ধরুন যদি মিথ্যাই রচনা করতে হয় তো। শেষকালে—”

মিস্টার রায়ের মুখটা হঠাৎ রূঢ় হইয়া উঠিল। আমার মুখের কথাটা কাড়িয়া লইলেন, “তা হ’লে শেষকালে অপর্ণাকে বলতে হবে—The boy is dead, the rascal! We shall have to risk this and see what happens. The poor girl shall not be killed by inches like this (তা হ’লে বলতে হবে হতভাগা ছেলেটা মরেছে। অপর্ণাকে এ চরম আঘাতটা দিয়ে একবার দেখতেই হবে কি ফল হয়। এভাবে তুষানলে দগ্ধ হয়ে মরতে দেওয়া হবে না ওকে)।”

পেগে ধীরে আর একটা চুমুক দিয়া মিস্টার রায় শান্ত কণ্ঠে বলিলেন, “যাও শৈলেন, রাত হ’য়ে গেছে, Good Night!”

পরদিন সন্ধ্যার সময় আমরা কয়েকজন বাগানের লনে বসিয়া আছি। আজকাল সহানুভূতি দর্শাইতে এই সময়টা রোজই কয়েকজন করিয়া আসে, আজ এ, কাল ও,—অবশ্য নিশীথ বাঁধা আগন্তুক। আজ ছিল নীরেশ, শোভন, আলোক আর সরমা। সরমা আসিলে অপর্ণা দেবীর কাছেই বেশি থাকে, আজ মিস্টার রায়—তাঁহাকে লইয়া বেড়াইতে গেলেন। সরমা আসিয়া আমাদের মধ্যে বসিল। রাজু চা দিয়া গেল।

প্রসঙ্গটা শেষ পর্যন্ত অপর্ণা দেবীর কথাতেই আসিয়া পড়িল। —মনের কথা বাদ দিলেও, বেশ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে ভুটানীর মৃত্যুর পর ওর শরীর হঠাৎ খুব দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে।—লক্ষণটা ভাল নয়। নীরেশ বলিল, “মনটা দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু আমার মনে হয় চিকিৎসাটা ওঁর মনের দিক থেকে হওয়া উচিত।” আমিও আমার মতটা বলিলাম —অর্থাৎ স্থান পরিবর্তনের কথা। মনের দিক থেকে যাঁহারা চিকিৎসার পদ্ধতি প্রচলন করিতেছেন তাঁহারা এই চেঞ্জ্ অব্ সীন, অর্থাৎ আবেষ্টনীর পরিবর্তনের উপর খুব জোর দিতেছেন। বলিলাম—association (সাহচর্য) জিনিসটার প্রভাব আমাদের প্রতিদিনের জীবনের উপর খুব বেশি। উহারা বলিতেছেন মানসিক উদ্বেলতা যে-ব্যাধির মূল তাহার সব চেয়ে ভাল চিকিৎসা পুরাতন, হানিকারক এসোসিয়েশন থেকে মনটা বিচ্ছিন্ন করিয়া নূতন স্থানে নূতন সুস্থ এসোসিয়েশনের সৃষ্টি।

আলোচনায় সবাই যোগ দিল অল্পবিস্তর; দিল না শুধু সরমা আর নিশীথ। সরমা চিরদিনই কম কথা কয়, কয়েকদিন থেকে যেন আরও বেশি করিয়া দগ্ধ হইতেছে বলিয়া আরও স্বল্পবাক। নিশীথ ঠিক বিপরীত, আজ কিন্তু যেন মুখে ছিপি আঁটিয়া গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে আলোচনা আগাগোড়া শুনিয়া গেল,—যেন মনের কোথায় পাতা খুলিয়া প্রত্যেকটি কথা লিপিবদ্ধ করিয়া লইতেছে। খুব সতর্ক, যেন একটিও বাদ না পড়িতে পায়।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে মিস্টার রায় অপর্ণা দেবীকে লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। উভয়েই আসিয়া আমাদের সহিত একটু গল্পগুজব করিলেন। মিস্টার রায় বেশ প্রফুল্ল, যেন একটা প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছেন। এবং কতকটা সফলও হইয়াছেন। রাজু ডিশ, প্লেট সরাইয়া টেবিলটা পরিষ্কার করিতেছিল, মিস্টার রায় একটা বিদ্রূপও করিলেন, “রাজু, লাটসাহেবের বাড়ির লেটেস্ট নিউজটা এদের শুনিয়ে দিয়েছিস?”

সকলে হাসিয়া উঠিতে রাজু বাসন কয়টা তাতাতাড়ি সংগ্রহ করিয়া সরিয়া পড়িল। অপর্ণা দেবী উপরে চলিয়া গেলেন।

নিশীথ আর বিলম্ব করিল না—কি জানি পৃথিবীতে সুযোগ তো প্রতি মুহূর্তেই নষ্ট হইয়া যাইতেছে! মিস্টার রায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, “ক’দিন থেকে ভয়ানক একটা দরকারী কথা ভাবছি—আপনার যদি কাজ না থাকে তো’…”

“কি, বল, এখানে বলা চলবে?”

নিশীথ একটু যেন কিন্তু হইয়া চকিতে চারিদিকে একবার চাহিয়া লইল, বলিল, “হ্যাঁ, তা…কথাটা হচ্ছে ক’দিন মিসেস্ রায়ের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কযেকজন বড় বড় সাইকলজিস্ট্ এ সম্বন্ধে কি বলছেন তাই মনে পড়ে গেল। তাঁদের লেটেস্ট থিয়োরি হচ্ছে যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসোসিয়েশনের প্রভাব খুব বেশি, সেই জন্যে মানসিক উদ্বেলতা যার মূল সেরকম অসুখের সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা এই যে, পুরনো হানিকারক এসোসিয়েশন থেকে মনটা বিচ্ছিন্ন ক’রে…বিচ্ছিন্ন ক’রে… মনটা বিচ্ছিন্ন ক’রে…”

সবাই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে। নীরেশ নিশীথের নামই দিয়াছে গ্রীক-দেবতা Echo অর্থাৎ প্রতিধ্বনি; আজ কিন্তু চরম হইল। নীরেশ গম্ভীরভাবে যোগাইয়া দিল, “আপনি বোধ হয় বলতে চান—নূতন সুস্থ এসোসিয়েশনের সৃষ্টি করা…”

একবার আমার পানে দৃষ্টিপাত করিয়া লইল।

বেশ সপ্রতিভ ভাবেই নিশীথ বলিল, “Just it (ঠিক তাই) নুতন সুস্থ এসোসিয়েশনের সৃষ্টি করা। যেদিন থেকে কথাটা আমার স্ট্রাইক করেছে, সেইদিন থেকেই আমি সব ঠিক ক’রে ফেলেছি, মিস্টার রায়; এখন শুধু আপনার অনুমতির অপেক্ষা—অবশ্য অনুমতি না দিলে ছাড়ানও নেই…রাচিতে আমাদের একটা বাড়ি আছে, the best place in Ranchi (রাঁচির মধ্যে সবচেয়ে ভাল জায়গা), চারিদিক খোলা, কিছু দূরে মোরাবাদী পাহাড়, simply superb (অতি চমৎকার)। আমি আপনার অনুমতি পাবার আগেই বাড়ির চুনটুন ফিরিয়ে ঠিকঠাক ক’রে রাখতে লিখে দিয়েছি…মানে ওঁর একটা change of scene নেহাতই দরকার—মানে—”

তাড়াতাড়ি বলিয়া ফেলিবাব উত্তেজনায় একটু হাঁপাইয়াও উঠিয়াছে।

মিস্টার রায় বোধ হয় একটু অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিলেন, নিশীথের বাক্যস্রোতে বাধা পড়িতে বলিলেন, Many thanks for your gracious offer (তোমার উদার প্রস্তাবের জন্য বহু ধন্যবাদ), নিশীথ। শৈলেনও কাল রাত্তিরে আমায় এই কথা বলছিল অর্থাৎ এই change of scene-এর কথা। তা মিসেস রায়কে রাজি করাতে পারি, আর ডাক্তাররা যদি অন্য জায়গায় যেতে না বলে তো তোমার কথাই হবে; and thanks for that (আর তার জন্যে ধন্যবাদ)!”