১৫
বাড়ি চলিয়া আসিবার প্রায় মাসখানেক পরে অনিলের একখানি পত্র পাইলাম। লিখিয়াছে—
“এতদিন সদুর একটা উৎকট শপথ দেওয়া ছিল বলে তোকে পত্র দিইনি। আজ সেই শপথের সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত হ’য়ে তোকে লিখতে বসলাম।
“সৌদামিনী মরেছে। মরে তোকে নিষ্কৃতি দিয়েছে, আমায় নিষ্কৃতি দিয়েছে, সমাজকে করেছে নিরুপদ্রব, ভাগবতকে করেছে নিরাশ।
“আমাদের পক্ষে সৌদামিনী মরলই বইকি, এ-লোক ছেড়ে সে এখন সিনেমা-লোকের জীব। এই মরা-সদু একদিন সিনেমা-স্টার হয়ে জ্যোতির্লোকে ফুটে উঠবে। সবাই থাকবে বিস্ময়ে চেয়ে। নাচে-গানে, হাস্যে-লাস্যে ওর কম্পমান দীপ্তি ঠিকরে পড়বে দেশের যত যুবার হা-হুতাশভরা দৃষ্টির ওপর। আলোকরাশ্মিতে নীল রঙের ঈর্ষা ফুটে উঠবে কুলললনার চক্ষে। ও একদিন দেবে দীপ্তিহীন ক’রে কবিকে, কর্মীকে জ্ঞানগরীয়ানকে; ধূমকেতু যেমন নিজের দীপ্তি দিয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ম্লান ক’রে তোলে। সদু হবে জ্যোতিষ্ক, উপায় নেই। রূপ আর প্রতিভার আলো দিয়ে যে ওর জন্ম। কিন্তু সদু সেই জ্যোতিষ্ক হবে, যে-জ্যোতিষ্ক-ধূমকেতু, এরও উপায় নেই আর। কেন-না ধুমকেতুর ইতিহাস আর সদুর ইতিহাস একই—অর্থাৎ সমাজ ওদের কোল দেয়নি। নিজের অসহ্য আলোকের জ্বালা নিয়ে ওরা দিকে দিকে আগুন লাগিয়ে বেড়াবেই।
“অথচ এই সদু একদিন হ’তে পারত গৃহস্থ-গৃহের তুলসীমঞ্চের প্রদীপটি। আলোয় একদিকে ফুটে উঠত ধর্ম, একদিকে ফুটে উঠত সংসার। ও করত পূজা আর সেবা, শ্রী আর কল্যাণের মধ্যে দিয়ে ও সেই সৃষ্টির উপর ভগবানের আশীবাদ নামিয়ে আনত। এই ছিল ওর মিশন, এই ছিল ওর সাধ। জলহীন তৃষ্ণার মত সাধ প্রতিদিনই তীব্র থেকে তীব্রতর হ’য়ে উঠেছিল। মনে আছে শৈল সেইদিনকার কথা— দুপুরে আমরা দু-জনে শুয়ে আছি ঘরে, সদু এল অম্বুরীর কাছে, মেয়েটাকে নিয়ে সেই আকুলি-বিকলির কথা মনে আছে? আমি তো ভুলব না কখনও। যতই দিন যাচ্ছিল, সদু ততই বুঝতে পারছিল ওর সৃজনসম্ভার দুর্বল হ’যে আসছে, ততই ওর রচনা করবার পিপাসা উগ্ৰ হ’য়ে আসছিল। কেন হবে না? —নিতান্ত কুরূপারও যদি হয় তো সদুর হবে না কেন? ঘেঁটুর যদি সাধ হয় ফুল ফোটাবার তো কমললতার বেলাই হবে যত দোষ?
“সদু ওর স্বামীকে—জীবনের সব রকম সফলতার প্রতিবন্ধককে—একদিনের জন্যেও ভালবাসেনি। ভেতরে ভেতরে ছিল ঘৃণা, ওপরে ছিল ঔদাসীন্য–এমন একটা নির্বিকার ঔদাসীন্য যা ভেদ ক’রে কারুর নজর ওর নিদারুণ ঘৃণার স্তরে পৌঁছতে পারত না। কিন্তু আমি জানতাম ওর ঘৃণা অধৈর্য দিন-দিন কতই না উৎকট হ’য়ে উঠছিল, কেন-না আমার মনের বিদ্রোহের একটা সাড়া পাচ্ছিলাম ওর মধ্যে। তার পর ওর মুক্তি, যা একদিন আসবেই বলে ওর একমাত্র ভরসা ছিল জীবনে। শৈল, দূরেই হোক বা অদূরেই হোক্, ভবিষ্যৎ জীবনে একটা আলোর রেখা না থাকলে আমরা কেউই বাঁচি না, যাকে বলা চলে একটা ফিউচার প্রস্পেক্ট। সদুর এই রকম একটা ফিউচার প্রস্পেক্ট ছিল, — অর্থাৎ স্বামী বলে যে অস্থিচর্মের বেড়াটা ভাগবত ওর সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেটা একদিন খসে পড়বেই। ওর তখন হবে মুক্তি। খসল বেড়া, এল মুক্তি; শুধু তাই নয়, সদু যা কখনও বোধ হয় কল্পনার মধ্যে আনতে পারেনি, ওর এই মহামুক্তির সঙ্গে তাও এসে দাঁড়াল সামনে—অর্থাৎ তুই এলি।
“গত এই দুই মাসের মধ্যে অন্তত একটা মাস ধরে আমি একটা জিনিস দেখছিলাম শৈল,—অপূর্ব একটা জিনিস—একটা স্ফুটমান শতদল। তোকে পাবে এই বিশ্বাসে সদু দিন দিন যে কী অপরূপ হ’য়ে উঠেছিল, যে না দেখেছে যার চোখ নেই তাকে বোঝানো যাবে না। ও খুব চাপা মেয়ে, অর্থাৎ মনের প্রধান চিন্তাটাকে ও বেশ করে মুক্ত ব্যবহারের মধ্যে ঢেকে রাখতে পারে; কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতাম—কেন্দ্ৰগত পিঠের চারিদিকে চারিদিকে শতদল কমলের পাপড়ি একটি একটি ক’রে বিকশিত হ’য়ে উঠছে; শুধু তার আনন্দলোকে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে।
“তারপর প্রতিদিনে আশাভঙ্গের পর এল শ্রান্তি। তোর আসা নেই, চিঠি নেই, কোন খবর নেই। দেখছি সেই শতদলের রক্তাভা ম্লান হ’য়ে আসছে, পাপড়ি আসছে যেন কুঁকড়ে। তোকে ইঙ্গিত দিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলাম। পেয়েছিলি কিনা জানি না, আমি কোন উত্তরপাইনি। ঠিক করলাম—কলকাতায় যাব তোর কাছে। একটা যে করব কিছু এইটুকু সন্দেহের ওপরই নির্ভর করে সদু একদিন আমার সঙ্গে দেখা করলে। প্রসঙ্গটা আমাকে দিয়েই তোলালে পাকেচক্রে। তারপর হঠাৎ উৎকট শপথ দিয়ে আমার চিঠি দেওয়া যাওয়া—সব কিছুরই পথ বন্ধ করে দিলে।
“কিন্তু তারপরও রইল প্রতীক্ষা ক’রে, শুধু আরও সংগোপনে। সে যে আরও কত করুণ দৃশ্য শৈল, নিজের অভিমানের কাছেও হার মেনে আবার পথের পানে দৃষ্টি ফেলে রাখা!
“তারপর টের পেলাম তুই পশ্চিমে চলে গেছিস। লিণ্ড্সে ক্রেসেণ্টের আরও সব কথা টের পেলাম।
“শৈল, তোকেই বা কি ক’রে দোষ দেব? জানি প্রেম অসপত্ন—তার সামনে সমাজ নেই, উপকার নেই, এমন কি ধর্মও নেই; সে স্বরাট্। নিজের কেতন উড়িয়েই চলে আর সবকেই দলিত করে। জানি মীরাকে পাওয়া আর না-পাওয়া এই দুয়েরই সামনে সদুর উপকার করা তোর পক্ষে অসম্ভব ছিল। বরং—অদ্ভুত শোনালেও এটা খুব সত্যি যে মীরা যতক্ষণ তোর সামনে ছিল ততক্ষণ মান-অভিমান, দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে সদুর উপকারের কথা ভাবতে পারতিস্—সেই জন্যেই দিয়েছিলি আশা—এখন তোর মীরা-হীন জগতে সবই অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। জানি যখন একথা, তখন তোকে না ক্ষমা ক’রে উপায় কি?
“তবুও মনে হচ্ছে—আমি কি হারালাম, তুই কি হারালি, সমাজ কতটা বঞ্চিত হ’ল! অসহ্য বেদনায় মনটা টন্টনিয়ে ওঠে যখন ভাবি—সদুর নাচে, গানে, অভিনয়ে সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ হাততালির চোটে ভেঙ্গে পড়ছে, সদুর ওপর শত শত দৃষ্টি লালসার ক্লেদ নিয়ে মুর্ছিত হয়ে পড়ছে, স্থানে অস্থানে সদুর নানা ভঙ্গিমার ছবি পথিকের পথ-বিভ্রম ঘটাচ্ছে, ছোট-বড় সব কাগজগুলো সদুর অভিনয় ভাঙ্গিয়ে সস্তা পয়সা লুটতে মেতে উঠেছে। আমাদের ছেলেবেলার সেই এত আদরের সদুর!
“খুকীর ভাত হবে আসছে সোমবার, আসবি না জেনেও নেমন্তন্ন দেওয়া রইল। থোকা আমার পাশে দাঁড়িয়ে; বলতে এসেছে ভাতের পরেই নিশ্চিন্দি হ’য়ে খুকীর বিয়ে দিয়ে দিতে; ও তোর দেওয়া বন্দুকটা নিয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে খুকীকে শ্বশুরবাড়ি দিয়ে আসবে।
“বললাম, ‘তাহলে তো মস্তবড় একটা ভাবনা যায় সানু।’
“অম্বুরী দু-জনকেই খোঁচা দিলে, বললে, ‘তা না হ’লে আর বলে পুরুষমানুষ সেয়ানা জাত! —বোনের ভাতটি মুখে দেওয়ার কথা হয়েছে কি বাপ-বেটায় মিলে তাকে বিদেয় করবার পরামর্শ আরম্ভ হ’ল!’
“অম্বুরী হাসছে, যোগ দিতে পারলাম না কিন্তু।—সত্যিই তো, মেয়ে হ’লেই নিত্য বিদায়ের চিন্তা… বাড়ির থেকে, কাউকে সমাজ থেকে, কাউকে একেবারে ধর্ম থেকে। কোথাও না হয় সুখের বিদায় মালাচন্দনের, কোথাও আবার ললাটে গ্লানি প্রলেপ দিয়ে। বিদায়ের অশ্রু নিয়েই ওদের জন্ম।”
এই আমার ঘৃণায়-মেশানো ভালবাসা! এরই মধ্যে অপর দিক থেকে সৌদামিনী আসিয়া আমায় দিতে চাহিয়াছিল খাঁটি সোনা। তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমার অপরাধের কথাটা স্বীকার করিয়া রাখিলাম। লইতে পারি নাই, তাহার কারণ ভালবাসার নিখাদ সোনা দিয়াই লইতে হয়। আমার সুবর্ণ আগেই দেওয়া হইয়া গিয়াছিল—মীরাকে। এ অদ্ভুত দান-প্রতিদানকে কোন্ দেবতা অলক্ষ্যে থাকিয়া নিয়ন্ত্রিত করেন? —তাঁহাকে কোটি নমস্কার।
ঘৃণায়-মেশানো এই আমার ভালবাসা। অসম্ভব বলিয়া মনে হইতেছে? আমারও হয় এক-এক সময় সন্দেহ—এত বিরুদ্ধ দুইটি জিনিস সত্যই কি জীবনে একদিন হাত-ধরাধরি করিয়া আসিয়াছিল?
সন্দেহ হইলে আমার দক্ষিণ হস্তের অনামিকার পানে চাহিয়া দেখি।—
বহুদিন পরে আমি অনামধেয়া এক কাহারও নিকট হইতে একটি চিঠি পাই। রেজেস্টারী করা; খাম খুলিয়া দেখি ভিতরে কাগজে মোড়া একটি নীলা পাথর। চিঠি বলিয়া বিশেষ কিছু নাই, ছোট্ট একটি কাগজের টুকরায় লেখা… “এইটি বাঁধিয়ে প’রো।”
আংটি করিয়া অনামিকায় ধারণ করিয়াছি। যখনই সন্দেহ হয়, এই বিষের রং-মেশানো হীরার দিকে চাই…মনে পড়ে, সত্যই একদিন ঘৃণার সঙ্গে মেশানো ভালবাসা পাইয়াছিলাম,—এই হীরার মতই নীল, এই হীরার মতই খাঁটি।