8
নিশীথ না উপকার করিয়া ছাড়িল না, একেবারে অপর্ণা দেবী পর্যন্ত ধর্না দিল, এবং রাজি করাইল। যে-ভাবেই হোক্ একটা খুব ভাল কাজ হইল। আমার কলেজ আছে, যাওয়া সম্ভব নয়; ঠিক হইল সঙ্গে যাইবে মীরা, তরু, বিলাস, রাজু বেয়ারা, ড্রাইভার; এখানে অস্থায়ীভাবে একজন ড্রাইভার রাখা হইবে। মিস্টার রায় রাখিয়া আসিবেন, তাহার পর ছুটি-ছাটা হইলে মিস্টার রায় বা আমি দেখিয়া আসিব।
একটা জিনিস লক্ষ্য করিতেছি, যাইবার দিন যতই ঘনাইয়া আসিতেছে, বালিকা সুলভ উৎফুল্লতার মাঝে মীরা যেন একটু আবার ম্রিয়মাণও হইয়া পড়িতেছে। যাইবার আগের দিনের কথা। আমরা ভ্রমণে বাহির হইব, মীরা নামিয়া আসিয়া বলিল, “তরু তোমাদের মোটরে একটু জায়গা হবে?”
তরু উল্লসিত হইয়া বলিল, “এস না দিদি, তুমি তো অনেক দিন আমাদের সঙ্গে যাওনি-ও, আজকাল নিশীথ-দা।”
মীরা রাগিয়া বলিল, “তাহ’লে যাও।”
তরু বলিল, “না এস, তোমার দুটি পায়ে পড়ি দিদি।”
মীরা আসিয়া বসিল। তরু রহিল আমাদের মাঝখানে। গেট দিয়া বাহির হইতে হইতে ড্রাইভার ঘুরিয়া আমায় প্রশ্ন করিল, “কোন্ দিকে যাব?”
আমি মীরার দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আজ ভেবেছিলাম ডায়মণ্ডহারবার রোড হয়ে যাব খানিকটা।”
মীরা গ্রীবা বাঁকাইয়া উত্তর করিল, “মন্দ কি?”
ময়দান পারাইয়া খিদিরপুর পুল উৎরাইয়া একটুপরে আমাদের গাড়ি অপেক্ষাকৃত জনবিরল রাস্তায় আসিয়া পড়িল। মীরা একেবারে নীরর; খালটা পার হইয়া একবার শুধু ড্রাইভারকে গতিবেগটা আর একটু বাড়াইতে বলিল; আর, একবার তরুকে বলিল, “দয়া ক’রে একটু চুপ করবে কি তরু?”
তরুর রসনা মুক্ত প্রকৃতি আর অবাধ গতিবেগের মধ্যে প্রগল্ভ হইয়া উঠিয়াছে। এইটুকু ব্যতীত মীরা অখণ্ড মৌনতায় আর নরম, শান্ত, দৃষ্টিতে বরাবরই সামনের দিকে চাহিয়া আছে। মীরা আজ এ রকম কেন?—মনে হইতেছে সে যেন একটি অচঞ্চল সরোবর, বুকে তাহার কিসের একটি শান্ত প্রতিচ্ছায়া পড়িয়াছে, সে চায় না সামান্য একটি শব্দের আঘাতেও এতটুকু বীচিভঙ্গ হয়, প্রতিবিম্ব এতটুকুও চঞ্চল হইয়া উঠে। আবিষ্ট মনে একটিমাত্র চিন্তাকে পরিপুষ্ট করিতে ছিলাম, সে মীরার হাত খানেক ব্যবধানের মধ্যে যে-কেহই থাকিত তাহারই মনে ঐ এক চিন্তাই উঠিত;—ভাবিতেছিলাম মীরার ধ্যান-শান্তমনে এই যে প্রতিচ্ছবি তাহা শুধু কি এই মুক প্রকৃতিই; মীরা এর মর্মস্থলে কাহাকেও বসাইয়া কি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করাইয়া লয় নাই? স্পষ্ট উত্তর কোথায় পাইব এ প্রশ্নের? তবে মীরার কেশের, বসনের সুবাস যে সমস্তই মুক্ত বায়ুতে অপচয় হইয়া যাইতেছে না, নিশ্চয়ই একজনের মর্মকে যে ব্যাকুল করিতেছে, আবিষ্ট ধ্যানের মধ্যে মীরার এ চৈতন্যটা নিশ্চয় সজাগ ছিল—সব যুবতীরই থাকে এবং এই সূত্রে আমি তাহার অন্তরের সঙ্গে একটা সুক্ষ্ম যোগ অনুভব করিতেছিলাম।
বেহালা পার হইয়া আমরা বাহিরে আসিয়া পড়িলাম। রাস্তার ধারে আর বাড়ি নাই, ছোট-বড় বাগান, ঘন পল্লবিত তরুলতায় পূর্ণ। প্রায় মাইল চারেক এই রকম গিয়া ফাঁকা মাঠ আসিয়া পড়িল। শুধু রাস্তাটুকু বাদ দিয়া যে সবুজের সমারোহ দুই দিকে আরম্ভ হইয়াছে সেটা শেষ হইয়াছে একেবারে দিক্রেখার নীলিমায় গিয়ে। মাঝে মাঝে ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষরাজির মধ্যে পল্লী, মেটে দেওয়ালের ওপর গোলপাতায়-ছাওয়া ধনুকাকৃতি চাল, ছোট ছোট পুকুর, বিচালির গাদা; এক-আধটা পাকা বাড়িও আছে—রং-করা চারিদিকের সবুজের গায়ে যেন ঝিকমিক করিতেছে। সবার উপর মাথা ফুঁড়িয়া উঠিয়াছে অসংখ্য নারিকেলের গাছ, হাওয়ায় দুলিয়া দুলিয়া অস্তমিত সূর্যের রশ্মি যেন সর্বাঙ্গ দিয়া মাখিয়া লইতেছে।
ড্রাইভার প্রশ্ন করিল, “ফিরব এবার? প্রায় বার-তের মাইল এসে পড়েছি।”
আমি মীরার পানে চাহিলাম। মীরা প্রশ্ন করিল, “কাজ আছে নাকি তেমন কিছু?”
উত্তর করিলাম, “কী আর কাজ?”
ড্রাইভার আগাইয়া চলিল। মীরা প্রশ্ন করিল, “বরং একটু আস্তে ক’রে দাও।” মীরার দৃষ্টিটা আজ অদ্ভুত রকম নরম অথচ কি দিয়া যেন পূর্ণ। কয়েক দিন হইতে মনে হইতেছে মীরা দীর্ঘ বিদায়ের পূর্বে কিছু বলিয়া যাইতে চায়, অথবা যেন চায় আমি কিছু বলি,—এইটেই বেশি সম্ভব। প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয় করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। মীরা আজ কি আমায় একটা চরম সুযোগের সম্মুখীন করিয়া দিতেছে? ও আজ সাজিয়াছে, সাদাসিধার উপর নিখুঁতভাবে নিজেকে মানাইয়া যেমন সাজিতে পারে ও। একটা অদ্ভুত মৃদু এসেন্স মাখিয়াছে যাহা এর চারিদিকে একটা স্বপ্নের মোহ বিস্তার করিয়াছে। মীরার আসাতেও আজ একটা সুমিষ্ট লজ্জা ছিল; আমায় প্রশ্ন নয়, তরুকে,— ‘তরু, তোমাদের মোটরে একটু জায়গা হবে?”
একটা বেশ বড় গ্রাম পার হইয়া গেলাম, নামটা উদয়পুর বা ঐ রকম একটা কিছু ফলতা-কালীঘাট ছোট লাইনের একটা স্টেশন আছে। গ্রামটা পারাইয়া খানিকটা যাইতে রাস্তার ধারে একটা মাইলস্টোনের দিকে চাহিয়া তরু বলিল, “উঃ, সতের মাইল এসে গেছি!”
মীরা ড্রাইভারকে বলিল, “এবারে তাহ’লে ফের।”
আমায় প্রশ্ন করিল, “একটু নামবেন নাকি?”
যাহা যাহা চাই সে-সব আপনিই হইয়া যাইতেছে, বলিলাম, “মন্দ হয় না, হাত-পা যেন আড়ষ্ট হ’য়ে গেছে।”
অপূর্ব জায়গা! সন্ধ্যা হইয়াছে; কিন্তু মনে হইল সন্ধ্যার আবির্ভাব হয় নাই, আমরাই যেন মায়ারথে চড়িয়া সন্ধ্যায় নিজের দেশে আসিয়া পড়িয়াছি। মীরা একবার মুগ্ধবিস্ময়ে চারিদিকে চাহিল, তাহার পর প্রশ্ন করিল, “আজকেও তরুকে পড়াবেন নাকি?”
অবশ্য না পড়াইবার কোন হেতু নাই, কিন্তু উত্তর করিলাম “নাঃ, আজ আর…”
“তাহ’লে একটু বসা যাক না, কি বলেন?”
আমরা রাস্তার ধারে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখিয়া বসিলাম, যেমন মোটরে বসিয়াছিলাম,–মাঝখানে তরু শুধু; তিনজনের মধ্যে ব্যবধানটা আর একটু বেশি।
এক সময় অন্ধকার একটু গাঢ় হইলে পূর্বচক্রবালরেখা ভেদ করিয়া কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠিল।
অল্পে অল্পে মীরা হইয়া উঠিল মুখর। তরুর মাথার উপর দিয়া সোজা আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, “অন্যের কথা জানি না, কিন্তু আমার তো মনে হয় শৈলেনবাবু যে, সন্ধ্যে আর চাঁদ বলে যে দুটো জিনিস আছে, কলকাতায় থেকে সে-কথা আমি ভুলেই গিছলাম!”
মীরার মুখে উদীয়মান চন্দ্রের দীপ্তি প্রতিফলিত হইয়াছে; তাহার উপর রহস্যময় আরও একটা কিসের দীপ্তি। মীরা কালো, এই চন্দ্রালোকিত ধূসর সন্ধ্যার সঙ্গে তাহার চমৎকার একটা মিল আছে; আমার দৃষ্টি যেন স্খলিত হইয়া তাহার মুখের উপর সেকেণ্ড কয়েক পড়িয়া রহিল, তাহার পরই আত্মসংবরণ করিয়া আমি চক্ষু দুইটা সরাইয়া লইলাম, সামনে নিবদ্ধ করিয়া বলিলাম, “বলেছেন ঠিক, সন্ধ্যাকে অভ্যর্থনা ক’রে নেবার জন্যে যে স্নিগ্ধশিখা প্রদীপের দরকার তা কলকাতায় নেই; সন্ধ্যাকে দূর থেকে বিদেয় করবার জন্যেই সে যেন তার বিদ্যুৎ-আলোর চোখ রাঙিয়ে ওঠে…… আমিও যেন অনেক দিন পরে দুটো হারানো জিনিস ফিরে পেলাম… যেন…”
এক মুহূর্ত একটু থামিলাম, তারপর নিজের চিন্তাটাকে পূর্ণ মুক্তি না দিয়া পারিলাম না, বলিলাম, “সব দিক দিয়ে মনে হচ্ছে বিধি হঠাৎ বড় অনুকুল হ’য়ে উঠেছেন আজ…”
অতি পরিচিত একটা সংগীতের একটা সমস্ত পংক্তি তুলিয়া বলিয়াছি, মীরা সলজ্জ দৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল; একটা কিছু না বলিবার অস্বস্তিটা এড়াইবার জন্যই সামনের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, “কেন?”
জীবনের এইগুলি অমুল্য মুহূর্ত; কিন্তু মাঝখানে আছে তরু। আর, অনিশ্চিতের আশঙ্কাও তখন সম্পূর্ণভাবে যায় নাই, মাত্র একটি সুযোগে সব সময় যায়ও না। একটু অন্তরাল থাকুক, সবটা আর পরিষ্কার করিব না। আজ মীরা যে মন আনিয়াছে তাহাতে নিশ্চয়ই বুঝিয়াছে ওটা আমার অন্তরের সংগীতের একটা কলি– “আজু বিহি মোরে অনুকুল ভেয়ল।” বাকিটা থাক না একটু অস্পষ্ট—আজকের সন্ধ্যার মত, এই নৃতন জ্যোৎস্নার মত।
মীরার প্রশ্নে আমি একটু মুখ নীচু করিয়া রহিলাম—ও বুঝুক সত্যটা গোপন করিয়া একটা মিথ্যা রচনা করিয়া বলিতেছি; তাই কুণ্ঠা, তাই বিলম্ব। একটু পরে তরুর মাথার উপর দিয়া ওর দিকে চাহিয়া বলিলাম, “বিধি অনুকুল এইজন্য বলছি যে, এত দিন বঞ্চিত থাকবার পর একেবারেই অমন চমৎকার সূর্যাস্ত দেখলাম, আবার এমন সুন্দর চন্দ্রোদয় দেখছি!”
মীরাও একটু মুখ নীচু করিয়া রহিল, তাহার পর স্মিত হাস্যের সহিত একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “আপনি কবি…”
আমি বলিলাম “কবির যশ ততটা কবির প্রাপ্য নয় মীরা দেবী, যতটা প্ৰাপ্য সেই মানুষের বা অবস্থার যা তাকে কবি ক’রে তোলে।”
মীরা আর মুখ তুলিতে পারিল না। একটু সময় দিয়া আমিও কথাটা বদলাইয়া দিলাম, বলিলাম, “আর বিশেষ ক’রে আজ তো কবি-যশে আমার মোটেই অধিকার নেই; ভুললে চলবে কেন যে আজকের মূলকাব্য আপনার—আপনিই সন্ধ্যে আর চাঁদের কথা তুললেন, আমি যা বলেছি তা তারই ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছি মাত্র, আমায় হদ্দ আপনার কাব্যের টীকাকার বলতে পারেন।”
মীরা ঘাসের উপর পা দুইটা ছড়াইয়া দিল। শরীরে একটা ছোট আন্দোলন দিয়া হাসিয়া বলিল, “নিন, কবি চুপ করলে, কে অমন টীকাকারের সঙ্গে কথা এঁটে উঠবে বলুন?”
এইটুকুর মধ্যে কী যে একটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে—মীরাকে কত যেন ছেলে-মানুষের মত দেখাইতেছে, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা আর স্বভাবের গাম্ভীর্যের জন্য যে মীরাকে বয়সের অনুপাতে একটু বড়ই দেখায়। —চাঁদ আরও অনেকটা উপরে উঠিল, জ্যোস্না হইয়াছে আরও স্বচ্ছ।… খানিকটা দূরে মোটরটা দাঁড়াইয়া আছে, ড্রাইভার ফুরফুরে হাওয়ায় গা এলাইয়া সীটের উপর লম্বালম্বি শুইয়া পড়িয়াছে, পা দুইটা বাহির হইয়া আছে। তরু একটু আবিষ্ট, স্পষ্ট বুঝিতেছে না, কিন্তু বেশ উপভোগ করিতেছে আমাদের কথাগুলা, কথা-বার্তার মধ্যে হাসি থাকিলেও বেশ নিশ্চিন্ত হইয়া উপভোগ করে, গাম্ভীর্য আসিলেই শঙ্কিত হইয়া ওঠে। একবার হঠাৎ কি ভাবিয়া বলিয়া উঠিল, “মেজগুরুমার বরকে দেখলাম দিদি, এত আমুদে লোক?”
বাহ্যত কথাটা এতই অপ্রাসঙ্গিক যে আমরা উভয়েই হাসিয়া উঠিলাম। মীরা বলিল, “এর মধ্যে তোমার মেজগুরুমা আর মেজগুরুমশাই কোথা থেকে এলেন তরু?”
তাহার পর তরুর উচ্ছ্বাসের উৎসটা কোথায় বোধ হয় সন্ধান পাইয়া একটু লজ্জিত হইয়া পড়িল এবং একটা ঘাসের শীশ তুলিয়া দাঁতে খুঁটিতে লাগিল।
……কী চমৎকার একটা রজনী যে আসিয়াছিল জীবনে!…
যেন আরও ছেলেমানুষ হইয়া গিয়াছে মীরা। ওর সঙ্গে কথা কহিতে আর ভয়-ভরসার কথা মনেই আসে না; ছেলেমানুষকে যেমন না বলিলে চলে না সেই ভাবে কতটা হুকুমের ভঙ্গিতেই বলিলাম, “যেখান-সেখান থেকে যা-তা তুলে নিয়ে দাঁতে দেবেন না; ওতে…”
মীরা সঙ্গে সঙ্গে আমার পানে চোখের কোণ দিয়া লজ্জিত ভাবে চাহিল, তাহার পর অবাধ্য বালিকা যেমন ভাবে বলে কতকটা সেইভাবে ঈষৎ হাসিয়া এবং চিবুকটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, “আমি দোব; আপনি তরুর টিউটর, তরুকে শাসাবেন।”—বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই তাহার অবাধ্যতার একটা নমুনা দাখিল করিবার জন্যই যেন হাতের খণ্ডিত শীষটা ফেলিয়া দিয়া আর একটা বড় শীষ খুঁটিয়া দাঁতে দিল। তরু হাসিয়া একবার বোনের মুখের পানে চাহিয়া আমার দিকে চাহিল। বলিলাম, “দিদির মত কখনও অবাধ্য হয়ো না তরু।”
মীরা গম্ভীর হইয়া বলিল, “হ্যাঁ, সবাইকে গুরুজন বলে মনে করবে, আর…”
গাম্ভীর্য রক্ষা করিতে পারিল না, হাসিয়া মুখটা ওদিকে ফিরাইয়া লইল।
এ-সুযোগের সৃষ্টি করিয়াছিল মীরা, যতটা পারিলাম সদ্ব্যবহার করিলাম। এর পরে বিধাতা সুযোগ সৃষ্টি করিলেন। —
কতকগুলি চাষাভুষা লোক আমাদের পিছনের মাঠ দিয়া আসিয়া রাস্তা পার হইয়া বোধ হয় সামনের কোন এক গ্রামে যাইতেছিল, রাস্তায় মোটর দেখিয়া কৌতুহলবশে একটু ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ জমাইয়া মোটরের রহস্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ লাগাইয়াছে।
তরু প্রশ্ন করিল, “কারা ওরা দিদি? কি অত জিজ্ঞেস করছে? মোটর দেখেনি কখনও?”
মীরা বলিল, “ওরা চাষা।”
তরু ব্যগ্রকণ্ঠে বলিল, “চাষা কখনও দেখিনি দিদি, যাব দেখতে?”
দু-জনেই হাসিয়া উঠিলাম। মীরা বলিল, “মন্দ নয়, চাষারা মোটর দেখেনি, তুমি চাষা দেখনি— অবস্থা প্রায় একই দাঁড়াল। যাও।”
তরুর কৌতূহল মিটাইতে অনেকক্ষণ লাগিল। জোৎস্না আরও স্পষ্ট হইয়া ওঠিতে লাগিল। হাওয়াটা আর একটু জোর হইয়া উঠিয়াছে, মীরার কানের দুল চঞ্চল হইয়াছে, বাঁকা সিঁথির রেখা চূর্ণ কুন্তলে এক-একবার অবলুপ্ত হইয়া আবার বেশি করিয়া দীপ্ত হইয়া উঠিতেছে,—একখানি মুক্ত অসির ঝলমলানি।…দু-জনেই সামনে চাহিয়া আছি, খুব বেশি কথা বলিবার সময় একেবারে হইয়া গেছি নীরব। দেখিতেছি চক্ষের সামনে বিশ্ব-প্রকৃতি আমূল পরিবর্তিত হইয়া যাইতেছে—বাস্তব হইয়া পড়িতেছে যেন স্বপ্ন, আর জীবনের যাহা কিছু এতদিন ছিল স্বপ্ন হইয়া, এইবার যেন বাস্তব হইয়া মূর্তি পরিগ্রহ করিবে …
ঘাসের উপর মীরার ডান হাতটা আলগাভাবে পড়িয়া আছে, আঙুল কয়টি হালকা মুঠির মধ্যে গুটাইয়া লইয়া ডাকিলাম, “মীরা…”
“কি বলছেন?”—বলিয়া মীরা স্বপ্নালু দৃষ্টি আমার পানে ফিরাইল।
কি বলি?—কি ভাবেই বা বলি?—মীরার হাতটা বুকের আরও কাছে টানিয়া কি একটা বলিব—এখন ঠিক মনে পড়িতেছে না তরু ছুটিয়া বলিল, “দিদি, ড্রাইভার, বলছে মেঘ উঠেছে দক্ষিণ দিকে।”
দেখি সত্যই মেঘ উঠিয়াছে। ধীরে ধীরে উঠিয়া আমরা মোটর আশ্রয় করিলাম। বাসায় আসিয়া ঘরে ঢুকিতে রাজু বেয়ারা আসিয়া চেয়ার-টেবিলগুলা ঝাড়িতে আরম্ভ করিয়া দিল। যেন সহসা মনে পড়িয়া গিয়াছে এইভাবে বলিল, “ব্লটিং প্যাডের নীচে একটা চিঠি রেখেছিলাম, পেয়েছেন মাস্টার-মশা?”
দিতে ভুলিয়া গিয়া সামলাইতেছি। আমি প্যাড দেখিবার পূর্বে নিজেই বাহির করিয়া দিল।
অনিলের চিঠি। লিখিয়াছে—একটা সুখবর আছে, সৌদামিনী বিধবা হইয়াছে।