» » মীরা-সৌদামিনী

বর্ণাকার

দেখিতেছি বিরহ জিনিসটা যতই কবিত্বময় বলিয়া মনে করিয়াছিলাম আসলে ততটা নয়, যদি বলি তাহার অর্ধেকও নয় তো নিতান্ত মিথ্যা বলা হয় না। নেহাৎ অবহমান কাল হইতে নানা লোক বলিয়া আসিয়াছে তাই, নতুবা এক বার মনে হয় ইহাতে কবিত্বের একেবারেই কিছু নাই।

রীতিমত কষ্ট হইতেছে। কলেজে যখন থাকি এক রকম চলিয়া যায়, বাকি সর্বক্ষণই মনটা হু-হু করিতেছে। এ-ধরনের অভিজ্ঞতা জীবনে কখনও ছিল না।

“মীরার কথা চিন্তা করিতে লাগে ভাল, কিন্তু এই স্মৃতি-মাত্রের উপর নির্ভর করিয়া দুই-তিনটা মাস কাটাতেই হইবে ভাবিলেও আতঙ্ক হয়। কবিতা পর্যন্ত একটাও লিখিতে পারি নাই, এবং এক সময় এই বিরহ লইয়াই কি করিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া পা লিখিয়াছি ভাবিয়া উঠিতে পারি না। এই জিনিসটাই আবার সবচেয়ে বেশি কথা যোগাইত।……একটা মজার কথা মনে হইত, এখন দেখিতেছি সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। অন্যে যখন লড়ে, বসিয়া বড় বড় মহাকাব্য বেশ সৃষ্টি করা যায়। নিজে লড়িয়া সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিতে গেলে মারিয়া রিমার্কের “অল্ কোয়াএট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রণ্ট”-এর ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই বাহির হইবে না।

অবশ্য রাঁচির খবর খুবই পাই। রাত্রে মিস্টার রায়ের নিকট প্রায়ই খবর পাওয়া যায়। তাহা ভিন্ন তরুর এ বিষয়ে একেবারেই গাফিলতি নাই। দু-তিন দিন অন্তর চিঠি পাওয়া যায়ই—কেমন জায়গা, কোথায় বেড়াইতে গিয়াছিল, নূতন কাহাদের সঙ্গে আলাপ হইল, মায়ের কথা, দিদির কথা, কিছুই বাদ যায় না। …মন কিন্তু পড়িয়া থাকে অপর একখানি চিঠির জন্য। কলিকাতা ছাড়িবার ঠিক ছয় দিন পরে পাইয়াছিলাম, এখন নিত্যই ডাক-পিয়নের পথ চাহিয়া থাকি, নিত্যই নিরাশ হই।

একদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় বসিয়া আছি। বিকালে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গেল বলিয়া বাহির হই নাই। কান্নার শেষ অশ্রুর দাগের মত তখনও আকাশে হেথায় হেথায় মেঘের ছোপ লাগিয়া আছে। ইমানুল আসিল। আমার পাশের সেটিটায় একটা বড় গোলাপ ফুল আস্তে আস্তে রাখিয়া দিয়া বলিল, “আলো জ্বালেননি বাবু? দোব জ্বেলে?”

ফিরিয়া দেখিলাম ঘরে আলো জ্বালা হয় নাই, বলিলাম, “দাও জ্বেলে।” পরক্ষণেই বলিলাম, “ছেড়ে দাও ইমানুল, এই বেশ বোধ হচ্ছে।”

ইমানুল সামনের থামে হেলান দিয়া বসিল। সত্য কথা বলিতে কি মানুষের সান্নিধ্যও ভাল লাগিতেছিল না, এর উপর যদি আবার পোস্টকার্ড বাহির করে তো ধমক খাইবে।

ইমানুল একটু চুপ থাকিয়া বলিল, “লোক না থাকলে বাড়ি-ঘর-দোর কিচ্ছু না বাবু, লোকই হ’ল বাড়ির জান্।”

আমি কোন উত্তর দিলাম না। তবুও বসিয়া ইমানুল উস্‌খুস করিতে লাগিল। নিজে থেকেই বলিলাম “তোমার চিঠিটা কাল লিখে দোব, কাল সকালে এস।”

ইমানুল বলিল, “সেই সওয়ালই করছিলাম বাবু;—চিঠিতে কিছু ফল হবে কি? চিঠি তো…”

বিস্মিত ভাবে চাহিলাম, পাগলামি যে পর্যায় গিয়া ঠেকিতেছে। বোধ হয় একটু রূঢ়ভাবেই প্রশ্ন করিলাম, “চিঠি ছেড়ে তুমি করতে চাও কি?”

অন্ধকারে ভাল করিয়া মুখ দেখা যায় না ইমানুলের, বিষণ্ণ চক্ষু আর সাদা সাদা দাঁত গুলো শুধু স্পষ্ট। অপ্রতিভ ভাবে ঘাড় কাত করিয়া বলিল, “না, তাই বলছিলাম মাস্টারবাবু…”

আরও একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল।

ইমানুল মালী বাড়ীর মধ্যে এমন কিছু বিশিষ্ট নয় যে, তাহার গতিবিধির সন্ধান রাখা প্রয়োজন। পরের দিন রাত্রে আহারের সময় মিস্টার রায় বলিলেন, “জান বোধ হয়, মালীটা সটকেছে!”

আমি একটু কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিলাম, “কোথায় গেছে?”

মিস্টার রায় বলিলেন, “বলে গেছে কি? He may have lost his head, I knew he would one of these days. (তার মাথা বিগড়ে গিয়ে থাকতে পারে, জানতাম শীগগির একদিন বিগড়োবেই)। কাল বিকেলে আমায় বাগানে একলা পেয়ে একটা বাটনহোল দিয়ে কাঁচুমাচু হ’য়ে জিজ্ঞেস করছে— ‘আমার কত টাকা জমেছে হুজুর?’

“বললাম, অত হিসেব করিনি। এই ক’ বছর আছিস, কোন মাসে আট কোন মাসে দশ এই রকম জমেছে, চাই নাকি টাকাটা’?

“বললে, ‘না হুজুর, শুধু একটা লিখে দেবেন কাগজে যে…

“পাগল লোকের ওপর রাগ করা যায় না, বললাম, ‘কেন আমার ওপর মোকদ্দমা করবার জন্যে দলিল পাকা করছিস্ নাকি?’ অপ্রস্তুত হ’য়ে না হুজুর, না হুজুর, করতে করতে সরে পড়ল। আজ মদন ক্লীনার বললে—ইমানুলের কাপড় সুট কিছুই ঘরে নেই, তার কাছ থেকে পাঁচটা টাকা ধারও ক’রে নিয়ে গেছে, আমার জামিনে। …I knew he would come to this end, (জানতাম ওর শেষ পর্যন্ত এই পরিণাম)।

ভাবনায় পড়েছি টাকাগুলো নিয়ে।”

পরদিন মীরার চিঠি পাইলাম। তরুও পত্র দিয়াছে। মীরা লিখিয়াছে—‘কাল বিকেলে উঠেই কি দেখলাম যদি আন্দাজ করতে পারেন তো বুঝব লেখক আপনি। পারবেন না, কেন-না অত বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনা কোন নভেলিস্টের উর্বর মাথায়ও আসতে পারে না। বিকেলে একটু ঘুমিয়ে উঠেই পর্দা ঠেলে বাইরে এসে দেখি আমাদের মালী-পুঙ্গব, মিস্টার ইমানুয়েল বোরান, একেবারে স-শরীরে! সত্য কথা বলতে কি, প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারিনি, আর যদি সন্ধ্যের পর দেখতাম তো নিশ্চয় ভূত ভেবে মূৰ্চ্ছা যেতাম। আসার কারণ যে কি প্রথমটা তো কোনমতেই বলতে চায় না! মার কাছে নিয়ে গেলাম, সেখানে আরও নীরব। জানেন, লোকটা নির্ঝঞ্ঝাট, ভাল মানুষ আধ পাগলাটে বলে বাড়ির সবাই ওকে ভালবাসে। মা বললেন, ‘নিজে কাজ ছেড়ে দিয়ে এলি, না ছাড়িয়ে দিয়েছেন? যদি ছাড়িয়ে দিয়ে থাকেন তো বল, চিঠি লিখে দিচ্ছি, আবার কাজ করগে যা। যদি নিজে ছেড়ে এসে থাকিল তো কেন এ মতিচ্ছন্ন হ’তে গেল?—যা ফিরে যা। ফিরে যা।’ কোন উত্তর নেই। শেষে সন্ধ্যের সময় আমার সামনে আসল কথাটা বললে। আমি গিয়ে মিশনরি চাইল্ড সাহেবকে বলে যেন ওর বিয়ের বন্দোবস্ত ক’রে দিই। গিয়ে বলি লোকটা যীশু মেরীর খুব ভক্ত, প্রতি রবিবারেই চার্চে যায়, আর টাকাও বেশ মোটা রকম জমিয়েছে! এর বাড়া পাগলামী কখনও দেখেছেন আপনি?

‘অনিলা মিত্রকে বোধ হয় চেনেন, আপনাদের ক্লাসেরই ছাত্রী! অনেকটা আমারই মত অবস্থা—মায়ের অসুস্থতার জন্যে ছুটি নিয়ে এসেছে এখানে। ইমানুলের ব্যাপার নিয়ে, তাকে ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে খুব উপভোগ করি আমরা। খুব ভাব হয়েছে আমার সঙ্গে। আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ একেবারে। দু-জনে কাটছে মন্দ নয়। গোড়ায় মিশনরি যে ওর মাথায় সাঁদ করিয়ে দিয়েছিল যীশুর ধর্মে কোন ভেদাভেদ নাই—এই হয়েছে কাল। চাইল্ড সাহেবের ভাইঝিটিকে দেখবার বড় ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় সন্ধান নিয়ে খবর পেলাম চাইল্ড সাহেব অনেক দিনই সি-পি’র কোন পাহাড় অঞ্চলে বদলি হ’য়ে গেছেন। সাধটা অপূর্ণ রয়ে গেল।। ইমানুলকে বলেছি— ‘তুই ঠিকানাটা ঠিকমত জোগাড় কর, না হয় আমরা ধরব সবাই মিলে গিয়ে, এই সব পাহাড়ে অঞ্চলেই তো চাইল্ড সাহেব কাজ করেছেন।…… বিশ্বাস করেছে ঠিকানার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে।

“হ্যা, একটা ফরমান আছে—ইমানুলের ব্যাপার নিয়ে আপনাকে একটা গল্প লিখতে হবে, অনিলারও এই ফরমাস, সুতরাং অব্যাহতি নেই। আমার কথা না রাখেন, আশা করি কলেজ-সঙ্গিনীর কথা ঠেলতে পারবেন না।

“মার জায়গাটা লাগছে ভাল, আমাদেরও; খুব বেড়াচ্ছি তাঁকে নিয়ে।

“ইমানুলের গল্প চাই-ই। ওর কমিক (হাস্যরসের) দিকটা ভাল ক’রে ফোটাতে হবে।”

আমি চিঠিটা পড়িয়া নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিলাম—কি সর্বনাশা মোহ। বাতুলতার সঙ্গে আর কতটুকু ব্যবধান আছে? নিশ্চয় প্রেম নয়, রূপোন্মত্ততা, তবুও প্রশংসা করিতে হয়, অন্তত এই হিসেবে যে এটা একটা ব্যাপারের চরমোৎকর্ষ। যদি এ মোহই হয় তো এ পরিশুদ্ধ মোহের রূপ, বিচারের দ্বিধা আর পরিণামের শঙ্কা-হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত, নগ্ন মোহ। আর এই মোহই যে প্রেয় নয়, তাহাই বা কি করিয়া বলি?

আমি বুঝি; মীরা আর মীরার সঙ্গিনীরা বুঝিবে না। কবে কোথায় যেন দেখা একটা ছবির কথা মনে পড়িয়া গেল। এক তরুণী একটা প্রস্ফুট কমল দুই হাতে লইয়া একটা ভ্রমরকে বিপর্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে, নীচে লেখা আছে “খেলা”।

কমলদের জ্ঞানে হোক অজ্ঞানে হোক এই মর্মান্তিক খেলা নিতাই চলিয়াছে; কমলরা এর বেদনা কি বুঝিবে?

এর কয়েক দিন পরে তরুর একখানি চিঠিতে জানিতে পারিলাম, ইমানুল হঠাৎ রাঁচি ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

ইমাম্বুল সম্বন্ধে এইটুকু জানি। বাকিটুকু নিজের মনে পূর্ণ করিয়া লইয়া একটা গল্প লিখিলাম। শেষের দিকটা এইরূপ হইল।

রাঁচিতে ইমানুল সেই সখীর অবসর বিনোদনের মস্ত একটা সম্বল হইল। পাগল ঢের দেখা যায় কিন্তু বিয়ে-পাগলার দর্শন অত সুলভ নয়। কলিকাতায় ইমানুলের শুধু মাঝে মাঝে চিঠি লিখাইবার বাই ছিল, রাঁচিতে চাঁদ একেবারে হাতের কাছে মনে করিয়া তাহার আরও কিছু উপসর্গ জুটিয়াছিল— তাহার একটা বাহ্যিক দৃষ্টান্ত এই ছিল যে, ইমানুল যখনই বাহির হইত তাহার সুটটি পরিয়া লইত।

তারপর ক্রমে ঐ পোষাকী লুটই আটপৌরে হইয়া দাঁড়াইল।

একদিন দুই বান্ধবীতে ইমানুলের সুটটা ভাল করিয়া ইস্ত্রী কারাইয়া দিল, বলিল, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ইমানুল? বাড়িতে কাপড় পরে থাক, ধর যদি তোমার খুড়শ্বশুর কিংবা ধর যদি মিস্ চাইল্ড নিজেই কোনদিন হঠাৎ এখান দিয়ে যায় আর দেখে ফেলে তোমায়? বলা যায় না তো। তারা কাছে-পিঠেই কোথাও আছে—শহরে দরকার পড়ল, হঠাৎ একদিন এসে পড়ল, এসেই দেখে জামাই কাপড় পরে…।”

অনিলা একটু বেশি উচ্ছল, তাহা ভিন্ন পাগলের কাছে তো লজ্জার বালাই নাই তত, বলে—“আর, তা ভিন্ন তুমি সর্বদা একটু কামিয়ে-কুমিয়ে ফিটফাট হ’য়ে থেক ইমানুল—কথায় বলে, ‘কামালে-কুমুলেই বর, নিকুলে-পুতুলেই ঘর’…”

গাম্ভীর্য রক্ষা করা দুষ্কর হইয়া উঠে, ইমানুলকে কোন একটা অজুহাতে তাড়াতাড়ি সরাইয়া দিয়া দুই সখীতে নিরুদ্ধ হাসিকে মুক্তি দিয়া বাঁচে।

ইমানুল চলিয়া যাইতে দিন দুই-তিন অভাবটা দু-জনেই একটু অনুভব করিল। তাহার পর আবার বেড়ানোয়, পরিচয়ে, পার্টিতে ভুলিয়া গেল; একটা বিয়ে-পাগলার কথা মানুষে কতদিন মনে করিয়া বসিয়া থাকিবে?

এক বৎসর পথের কথা। সি-পি’র দূর পার্বত্য অঞ্চলে একটা ছোট ক্রিশ্চান পল্লী। সকাল থেকেই পল্লীটি উৎসবমুখর হইয়া উঠিয়াছে। ওদের পাদ্রীর আজ বিবাহ। এই রকম বিবাহে ক্রিশ্চান-প্রথার আড়ম্বরহীনতার সঙ্গে স্থানীয় প্রথার জাঁকজমক প্রায় খানিকটা মিশিয়া যায়, পাদ্রীরা অত কাড়াকড়ি করে না, বোধহয় ফলও হয় না।

এই পল্লীতে সেই দিন সকালে একজন আগন্তুক আসিয়া উপস্থিত হইল। মাথায় অবিন্যস্ত বড় বড় চুল, একমুখ গোঁফদাড়ি, চোয়ালের হাড় অস্বাভাবিক রকম ঠেলিয়া আসিয়াছে, কোটরগত চক্ষুর দৃষ্টি উদ্‌ভ্রান্ত! লোকটার পরনে একটা জীর্ণ ঢলঢলে সুট, মাথায় তাহার মুখের মতই তোবড়ান একটা টুপি।

কয়েকজন নানা রকমের লোক উৎসবের কাপড়-চোপড় পরিয়া এক জায়গায় জটলা করিতেছিস, লোকটা একেবারে তাদের কাছে গিয়া দাঁড়াইল; যেন কি একটা অত্যন্ত দরকারী কাজ আছে অথচ সময়ের নিতান্ত অভাব। কতকটা বিস্ময়ে, কতকটা উন্মাদ লোককে মানুষে যে ভয় করে সেই ভয়ে সবাই একটু সরিয়া দাঁড়াইল একজন প্রশ্ন করিল, “কি চাও?”

বড় বড় পার্বত্য ভাষাগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকে, তাহা ভিন্ন আগন্তুক এখানকার লোক না হইলেও ভাষাটা কিছু কিছু সংগ্রহ করিয়াছে, প্রশ্নটা শুনিয়া যেন পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করিল; নিজের মুখে একবার হাত বুলাইয়া একবার নিজের সুটের পানে চাহিয়া লইয়া উত্তর করিল, “নাপিত পাওয়া যাবে?”

বিবাহের উৎসবের মধ্যে এমন সৌখিন পাগল পাইয়া সবাই উল্লসিত হইয়া উঠিল। একজন বেশ রসিক, আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য হোম্ (বিলাত) থেকে এসেই এখানে চলে এসেছ, সেখানে নাপিতের অভাবে বুঝি আর টেঁকতে পারলে না?”

সমস্ত দলটা উচ্চৈস্বরে হাসিয়া উঠিল।

আগন্তুকের গাম্ভীর্য তাহাতে একটুও ব্যাহত হইল না। প্রশ্ন করিল, “আজ তোমাদের কী এখানে?” সঙ্গে সঙ্গে নিজেই আবার বলিল, “আজ তোমাদের পাদ্রী-সায়েবের বিয়ে, না?”

“হ্যাঁ, এই সঙ্গে তোমারও একটা হ’য়ে যাবে নাকি?”

আবার হাসির একটা তুমুল উচ্ছ্বাস উঠিল। আগন্তুক বলিল, “এ বিয়ে হবে না; হ’তে পারে না”—তাহার মুখের ভাব কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।

সমস্ত হাসি থামিয়া গেল। একজন ছোকরাগোছের আর একটা রসিকতা করিয়া সেটাকে উজ্জ্বীবিত করিতে যাইতেছিল, একজন বয়স্থগোছের তাহাকে বিরত করিয়া প্রশ্ন করিল, “কেন?”

“রেভারেণ্ড্ চাইল্ড জানেন, কেন। তিনি এসেছেন তো? তাঁর সঙ্গে দেখা করব আমি, বাধা আছে?”

“তিনি আজ ছ’মাস হ’ল মারা গেছেন!”

আগন্তুকের মসীবর্ণ মুখটা যেন মুহূর্তের মধ্যে পাণ্ডুর হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে আবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “আর নাথু? তাঁর সহকারী ন্যাথেনিয়েল।”

উত্তর হইল, “সে গেছে প্রায় এক বছর হ’ল।”

পিছন হইতে সেই ছোকরা একটু নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিয়া লইয়া বলিল, “কোন বাধা নেই, তুমি ইচ্ছে করলেই সেখানে গিয়ে দেখা করতে পার!”

দলের মধ্যে যাহারা হাস্যপ্রবণ তাহাদের একটা চাপা হাসি উঠিল।

আগন্তুক নির্বিকার ভাবে বলিল, “কিন্তু এ-বিয়ে হতে পারে না, তিনি অন্য রকম ব্যবস্থা ক’রে গিয়েছিলেন, ত্রাণকর্তা যীশু ভয়ানক আঘাত পাবেন মনে তাহ’লে। কখন বিবাহ?”

“এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে, বরবধূ সাজগোজ করছে, এবার বেরুবে!”

“আমি মিস্ চাইল্ডের সঙ্গে দেখা করব।”

“অসম্ভব।”

“করতেই হবে দেখা…ত্রাণকর্তা যীশু…আর ফাদার চাইল্ডের আত্মাও কষ্ট পাবেন…তিনি বলেছিলেন—

অস্বাভাবিক রকম চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। তখন তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিয়া স্পষ্টই বলিতে হইল, “মিস্ চাইল্ড্ পাগলের সঙ্গে দেখা করবেন না, বিশেষ করে এখন।”

লোকটা যেন কাঠ হইয়া গেল। সুটটা আগাগোড়া দেখিয়৷ লইয়া দুইটা হাত একবার ঘুরাইয়া বলিল, “পাগল!”

এমন সময় পাদ্রী সাহেবের বাসার দিক হইতে একজন ছুটিয়া ভীড়ের বাহির হইতেই বলিল, “মিস্ চাইল্ড্ ওকে একবার ডাকছেন।”

গোলমালের কারণটা বরবধূ ও অতিথিদের নিকট পৌঁছিয়াছিল। মিস্ চাইল্ড অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছিলেন।

চিনিতে একটু বিলম্ব হইল, তাহার পরই মিস্ চাইল্ড উল্লসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন “ইমানুয়েল! হাউ লাকি! তুমি এখানে কোথা থেকে? এরা কি বলছে তোমার সম্বন্ধে? তুমি নাকি বলছ—এ বিবাহ হ’তে পারে না?…তোমার এ রকম চেহারা কেন? কত দূর থেকে আসছ? তুমি কোথায় আমায় কনগ্র্যাচুলেট (অভিনন্দিত) করবে, না…”

মিস্ চাইল্ড হাসিয়া উঠিলেন।

বর মিস্টার শেরিডেনও হাসিয়া বলিলেন, “But I am to be congratulated first (আপনার চেয়ে আমায় আগে অভিনন্দিত করা দরকার)।”

অভ্যাগতদের মধ্যে একজন রসিকতা করিয়া বলিলেন, “But he may be your rival! Excuse me, Miss Child” (কিন্তু ও আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীও হ’তে পারে তো?…মিস, চাইল্ড মাফ করবেন)!”

একটা হাসির রোল উঠিল।

ইমানুল মুগ্ধ বিস্ময়ে মিস্ চাইল্ডের পানে চাহিয়া রহিল। কী অপরূর রূপ! কী অসম্ভব আশা। আপাদমস্তক বধূবেশের শুভ্র আচ্ছাদন, সূক্ষ্ম ছবির পরীদের মত; বদন মণ্ডলে পরীদের মতই একটা দ্যুতি, হাতে একটা শুভ্র ফুলের তোড়া চারটি সুসজ্জিতা বালিকা রাণীর মত পিছনের আস্তরণটা তুলিয়া ধরিয়া আছে…

ইমানুল একবার নিজের পানে চাহিল। কী দুস্তর ব্যবধান! কত দূরে! কত দূরে!—সত্যই কত দূরে!

ইমানুলের শীর্ণ মুখে ধীরে ধীরে বুদ্ধির দীপ্তি ফুটিয়া উঠিল। ওকে অন্ধ করিয়াছিল বিস্তৃত একটা আশা; নিরাশা ওকে আবার চক্ষুষ্মান করিল। দেরী হইল না, এক মুহূর্তেই ও ওর স্বপ্নের অলীক জগৎ হইতে নামিয়া কঠিন মাটি স্পর্শ করিল। নিতান্ত অপ্রতিভ হইয়া ব্যাপারটাকে সামলাইয়া লইবার চেষ্টা করিল; বলিল, “আমি বলতে এসেছিলাম…আমি বলতে এসেছিলাম যে…”

মিস্ চাইল্ড প্রসন্ন হাস্যের সহিত স্নেহদ্রব কণ্ঠে বলিলেন, “আমি জানি তুমি কি বলতে এসেছিলে ইমানুয়েল, আমায় অভিনন্দিত করতেই এসেছিলে। যাও, তাড়া-তাড়ি স্নান-টান ক’রে গির্জায় এস। কত দিন তুমি ভাল ক’রে স্নানাহার করনি? কত দূর থেকে আসছ?”

মিস্টার শেরিডেন একজন চাকরকে ব্যবস্থা করিয়া দিতে বলিয়া দিলেন।

বিবাহের অনুষ্ঠানান্তে ইমানুলের খোঁজ পড়িল। পাওয়া গেল না কিন্তু তাহাকে।

নিরাশা সত্যই কি তাহাকে চক্ষুষ্মান করিল? না, একবার দুর্নিরীক্ষ্য আলোকের সম্মুখীন হইয়া তাহার নয়নের দীপ্তি চিরদিনের জন্যই লুপ্ত হইয়া গেল?