১০
আমি যখন পৌঁছিলাম সন্ধ্যা হব-হব হইয়াছে। বাড়িতে কাহারও সাড়া নাই, ভিতরে গিয়া দেখিলাম দক্ষিণ হস্তের মুঠায় চিবুকটা চাপিয়া অনিল রকের উপর পায়চারি করিতেছে। আমায় দেখিতে পাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, “শৈল বুঝি? আয়।”
কাছে আসিলে আমার মুখের উপর স্থির-দৃষ্টি ন্যস্ত করিয়া বলিল, “রাঁচি থেকে একটু বেশী তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস্।”
বোধ হয় একটু জড়িত কণ্ঠেই বলিয়া থাকিব, “মিছিমিছি পার্সেণ্টেজটা নষ্ট করা…”
কিছু মন্তব্য প্রকাশ করিল না, স্থির-দৃষ্টিতে আরও কয়েক সেকেণ্ড চাহিয়া রহিল মাত্র। তাহার পর বলিল, “এখানে অনেক ব্যাপার ঘটেছে এবং ঘটবে।”
আমার দৃষ্টিটা উৎসুক হইয়া উঠিল। অনিল বলিল, “এক নম্বর বাড়িতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বাড়িটা হ’য়ে গেছে খালি।”
শঙ্কিত ভাবে একবার চারিদিক চাহিয়া প্রশ্ন করিলাম, “তার মানে?”
অনিল বলিল, “অবশ্য অম্বুরী এণ্ড কোম্পানী কথকতা শুনতে গেছে, আটটা আন্দাজ ফিরবে; আমি বলছিলাম মার কথা—বুঝতে পারছি একা যদি মা না থাকে তো বাড়ি খালি হ’য়ে গেছে বেশ বলা চলে।”
আমি আরও শঙ্কিত ও বিস্মিত দৃষ্টিতে অনিলকে আপাদমস্তক একবার দেখিয়া লইয়া ওর মুখের পানে বিমূঢ় ভাবে চাহিতেই বলিল, “না, অত দূর নয়,— মা কাশীবাসিনী হয়েছেন। মামার একমাত্র ছেলে গেল মারা; বৈরাগ্যে তাঁরা স্বামী-স্ত্রীতে কাশীবাসিনী হলেন। মার একমাত্র ছেলে রয়েছে বেঁচে, আতঙ্কে কাশীবাসিনী হলেন। অনেক বোঝালাম, কিন্তু ভাইপোর কীর্তিতে কি যে একটা অবিশ্বাস আমার ওপর হ’য়ে উঠল, কিছুতেই শুনলেন না। ‘তোরা সব পারিস্, দাদার মত আমারও বুড়ো বয়সে দগ্ধাবার জন্যে আর বেঁধে রাখিস্নি, বাবা বিশ্বনাথের পায়ে শরণ নিচ্ছি, আর বাধা দিস্নি’—বলে জীবিত ছেলের শোকে চোখ মুছতে মুছতে ভাই আর ভাজের সঙ্গ নিলেন!… বাঙালী মায়ের প্রাণের একটা নতুন দিক দেখলাম, অদ্ভুত! কত গভীর স্নেহ হ’লে এ রকম অহেতুক আতঙ্ক হয় ভেবে দেখ দিকিনি! …যাক্ ভালই হয়েছে।”
বলিলাম, “বড় কষ্ট হবে, এই যা…”
অনিল বলিল, “বাঙালীর মেয়ের বিয়ে হবার পর থেকে নিজের শরীর বলে আলাদা কিছু থাকে না, সন্তান হবার পর একেবারেই না; সুতরাং শরীরের কষ্ট ওদের কষ্টই নয়। বাঙালী জাতটা বোধ হয় অনেক বিষয়েই সবার চেয়ে ছোট, কিন্তু এদের স্ত্রী আর মা আর সব জাতের স্ত্রী আর মায়ের অনেক ওপরে। জাতটা এই জন্যেই বেঁচে আছে এখনও, শৈল।”
একটু চুপ করিয়া, অন্যমনস্কভাবে আরও কয়েকবার পায়চারি করিয়া বলিল, “দ্বিতীয় ব্যাপার এই যে, সদু আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল!”
আমি চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম, “আত্মহত্যা! কেন?”
“কেন!” বলিয়া অনিল একটু হাসিল মাত্র। তাহার পর বলিল, “তুই দাঁড়িয়েই আছিস!” ভিতর থেকে একটা মাদুর আনিয়া বিছাইয়া দিয়া বলিল, “এই হ’ল যা ঘটেছে। যা ঘটবে তা এই যে, সদুকে আমি আমার নিজের বাড়িতে এনে রাখব ঠিক করেছি।”
আমি একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। না বলিয়া পারিলাম না, “তোর কি মাথা খারাপ হ’য়ে গেছে অনিল?”
আমি বসি নাই, সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া ছিলাম। অনিল ঠিক আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়া, কতকটা ব্যঙ্গের হাসির সহিত বলিল, “আমি জানতাম ঠিক এই ভাবে প্রশ্ন করবি। তুই হচ্ছিস আমাদের সমাজের প্রতীক শৈলেন; সমাজের নিজের মাথার ঠিক নেই, যদি ঠাণ্ডা ক’রে কেউ সমস্যার সমাধান করে তো উল্টে বলবে তারই মাথা খারাপ হয়েছে। সদু মরতে বসেছে চারদিক দিয়ে, সমাজ ভ্রুক্ষেপও করবে না; এখন আমি তাকে চারদিক থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি—বলবে আমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমায় একঘরে করে আমার ধোপা-নাপিত বন্ধ ক’রে আমার চিকিৎসা করবে। এ-এক চমৎকার ব্যাপার, যতই ভাবি ততই আশ্চর্য বলে মনে হয় আমার। আইন, যেটাকে আমরা প্রাণহীন যন্ত্রের সামিল বলে ধরে নিই, সেটা পর্যন্ত সদুর মত হতভাগিনীকে মরতে দিতে রাজি নয়, মরতে চেষ্টা করছে খবর পেতেই দারোগা এসে তদন্ত ক’রে গেল, একটু লেখালেখি হাঁটাহাঁটি পড়ে গেল, বেশ টের পাওয়া গেল তার যান্ত্রিক বুকে একটা আঘাত লেগেছে। আর সমাজ, যাকে আমরা প্রাণবস্তু বলে মনে করি সে রইল একেবারে নির্বিকার। একবার কেউ ফিরেও দেখলে না।
“ওরই মধ্যে একটা মজার ব্যাপার হ’য়ে গিয়েছিল, তোকে না বলে থাকতে পারলাম না। তার পরদিন ছিল সাতকড়ি চাটুজ্জের ছেলের পৈতের নেমন্তন্ন। আমি যে-সারিটাতে বসেছি তার পেছনের সারিতে, আমার সঙ্গে প্রায় পিঠোপিঠি হয়ে বসেন সনাতন চক্রবর্তী আর পুরুষোত্তম সার্বভৌম। দ্বিতীয়বার মাছ পরিবেশন করতে এসেছে। শুনছি সার্বভৌম কি একটা চিবোতে চিবোতে বলছে— ‘মাছ তো পাতে রয়েছে প্রচুর। মুড়ো থাকে তো দিতে পারো একটা, একটার বেশি নয়, পরিপাক শক্তি আর সে-রকম নেই কি না।’ চক্রবর্তী বললে, ‘কাল দেখলে তো ব্যাপারটা পুরুষোত্তম?—একেবারে আত্মহত্যা!…পুরুষোত্তম ঘেন্নায় আতঙ্কে এমন শিউরে উঠল যে, আমার পিঠটাতে পর্যন্ত ধাক্কা লেগে গেল। বললে, ‘নারায়ণ! নারায়ণ!…তুমি এ-রকম একটা অশুচি প্রসঙ্গ অবতারণা করবার আর অবসর পেলে না সনাতন? শাস্ত্র বলেছেন আত্মহত্যার কথায় শ্রুতি পর্যন্ত কলুষিত হ’য়ে যায়। শিব! শিব! নারায়ণ! নারায়ণ!—এদের পাশে যে বসে আছি এতে আমার সমস্ত শরীরটা ঘিন্ ঘিন্ ক’রে উঠল। মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি এল। সার্বভৌম যেই ‘নারায়ণ! নারায়ণ!’ ক’রে উঠেছে, আমি আগে যেন কিছুই শুনিনি এই ভাবে ‘কি হ’ল! কি হল!…বলে একেবারে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম! একটা হৈ-হৈ পড়ে গেল, আর এ অবস্থায় যেমন হ’য়ে থাকে, আরও কযেকজন আতঙ্কের মাথায় উঠে দাঁড়াল! সার্বভৌম মুড়োটা তুলতে যাচ্ছিল মুখে, হাঁ ক’রে ঘাড় ফিরিয়ে আমার মুখের পানে চেয়ে বলগে, ‘কি হ’ল?’ সেরকম নৈরাশ্য আর নিষ্ফল ক্রোধের মূর্তি আর কখনও দেখিনি শৈল। কি আনন্দ যে হ’ল! বললাম, ‘আপনি হঠাৎ ‘নারায়ণ নারায়ণ’ ক’রে উঠলেন, ভাবলাম মস্তবড় একটা ছোঁয়াছুঁতের ব্যাপার হ’য়ে গেছে বা অন্য রকম কিছু বিঘ্ন হয়েছে; পেছনে ফিরে আছি, দেখতে তো পাইনি, ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছি; আর বসাটা শাস্ত্ৰসংগত হবে না বোধ হয়?’…সবারই খাওয়া গেল, কষ্ট হ’ল, একটা গোলোযোগও হ’ল খুব; কিন্তু একা সার্বভৌমের হাতের মুড়ো যে মুখে উঠতে পেল না সেই আনন্দে আমি আর কিছু গ্রাহের মধ্যে আনলাম না; মনে হ’ল সদুর অপমানের তবুও টাটকা-টাটকি একটা প্রতিশোধ নিতে পারলাম। কিন্তু সে একটা সাময়িক ফুৰ্তি; নেহাত একটা সুবিধে হাতের কাছে এল, ছাড়লাম না। ওতে তো সদুকে বাঁচাতে পারা যাবে না। একটা উপায় ছিল তোর হাতে; কিন্তু তোর যা চিঠি দেখলাম, তারপর আমার দ্বিতীয় চিঠির পরে তুই যেমন তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করলি তাতে বুঝলাম ও-গুড়ে বালি। তখন নিরুপায় হ’য়ে ভেবে ভেবে এই উপায় ঠাওরালাম, মানে সদুকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসা। অম্বুরীকে পর্যন্ত রাজি করলাম, অবশ্য খুব সহজেই হ’ল, কেন-না যে-ব্যাপারে আমি রয়েছি তাতে অম্বুরীর নিজস্ব একটা মত থাকতে পারে, কিন্তু অমত নেই। অর্থাৎ কি ভাল কি মন্দ সে খুবই জানে, কিন্তু সবার ওপরে জানে স্বামী-দেবতার কথা।
“এখন তুই প্রশ্ন করবি, সবই যখন ঠিক তখন তোঁর কাছে আবার কি করতে ছুটেছিলাম। ছুটেছিলাম এই জন্যে যে, সমস্যাটার যখন প্রায় জোট খুলে এনেছি মনে করলাম, তখন হঠাৎ দেখি সেটা আরও সাংঘাতিক রকম জটিল। …তুই দাড়িয়ে রইলি শৈল, বস্।”
অনিল নিজেও মাছরটাতে বসিল। আমি বসিলে বলিল, “অম্বুরীর মত পাওয়ার পর, কিম্বা অম্বুরীর মুখে আমার মতের প্রতিধ্বনিটা শোনবার পর বাকি রইল খোদ সৌদামিনীর মত নেওয়া। তার সঙ্গে দেখা করলাম। কোথায়, কবে, কখন—সে-কথা থাক্; এ তো আর কাব্য হচ্ছে না। সদুকে সব কথা বললাম। বললে, ‘এটা তোমার সম্ভব বলে মনে হয় অনিল দা?’… বললাম, ‘অসম্ভব কিসে?’ বললে, ‘ভাগবত-কাকা ছাড়বে কেন? একটা কুকুরকে দু-মুঠো ভাত দিলে তার ওপর অধিকার জন্মে যায়।’…আমি বললাম, ‘কিন্তু মানুষের ওপর জন্মায় না; তুমি সাবালিকা।’
“…সদু বললে, ‘ও তো আইনের কথা; একই গ্রামে রয়েছি, ভাগবত-কাকার কাছ থেকে আইন কতদিন বাঁচাব? সমাজের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ, সবার টিকি ভাগবত কাকার কাছে বাঁধা, টিকতে পারবে?’ বললাম, ‘সে ঠিক করেছি; না পারি বাড়ি-ঘর-দোর বেচে চুঁচড়োয় গিয়ে থাকব।’…সদু কাতরভাবে বললে ‘অনিলদা আমার সবচেয়ে ভাবনার কথা কি জান? আমার মাথার একেবারে ঠিক নেই; এই দশা হ’য়ে পর্যন্ত শুধু একটি দিন আমার মাথার ঠিক ছিল—যেদিন বিষ খাই। অনেক ভেবেচিন্তে মাথা ঠাণ্ডা ক’রে দেখলাম এ পৃথিবী থেকে যাওয়াই আমার একমাত্র উপায়। কিন্তু হ’ল না। তারপর থেকে আমার মাথার ঠিক নেই, ভেবে দেখবার ক্ষমতা হারিয়েছি। এ অবস্থায় আমায় আর লোভ দেখিও না অনিলদা। তোমার বাড়ি আমার স্বর্গ, যে নরক যন্ত্রণায় ভুগছে তাকে যদি স্বর্গে ডাকা যায় সে কি বিচার ক’রে দেখতে পারে? তবে মোটামুটি বুঝছি কাজটা ভাল হবে না।’
“আমি অনেক ক’রে বোঝালাম; বললাম, বিপদ যদি থাকে তো আমারই; তা আমরা দুজন যখন তার জন্যে তোয়ের রয়েছি, সদু অমত করে কেন? তার কলঙ্ক আছেই কপালে, আমার বাড়িতে থাকলেও, ভাগবতের বাড়িতে থাকলেও; তবে সে নিজে যদি এই জায়গায় অপবাদের মধ্যে কোন রকম তফাত না দেখে, আমাকে যদি এতই অবিশ্বাস করে তো আমার কথাটা তোলাই ভুল হয়েছে।
“অবিশ্বাসের কথায় সদু একটা কাণ্ড ক’রে বসল। দু-হাতে আমার হাত দুটো খপ্ করে ধরে নিলে। বললে, ‘সেই সদুই আছে তোমার; ঈশ্বর সাক্ষী ছেলেবেলায় তোমাদের হুকুম করতাম, সেই অপরাধের এই রকম করেই শোধ নেওয়ালেন ভগবান,—মেনে নিচ্ছি তোমার এ মোক্ষম হুকুম অনিলদা। কবে আসছে বলছ বলো। সত্যিই ভাগবত-কাকার নির্যাতন আর সহ্য হচ্ছে না।
“সদু একেবারে ভেঙে পড়ল। আমার পায়ের কাছে বসে পড়ে, আমার হাত দুটো নিজের মাথায় চেপে ফুলে ফুলে অনেকক্ষণ কাঁদলে। আমি কিছু বললাম না। মনটা হালকা হ’লে উঠে দাঁড়াল, আমার হাত দুটো ধরেই আছে। মিনতির স্বরে বললে, ‘শুধু একটা কথা রেখ অনিলদা’…জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি কথা?’ সদুর চোখে আবার জল উপচে উঠল, বললে, ‘অবিশ্বাসের কথা নয়, ধর্ম সাক্ষী। কিন্তু সদীর জীবনে কখনও দুঃখের অভাব হয়নি, হবেও না, তাই, যদি কখনও এমনই হয় যে পোড়া প্রাণটাকে হিঁচড়ে বের করে দেওয়া ভিন্ন আর উপায় না থাকে তো বাধা দিও না, এখন থেকেই মিনতি ক’রে রাখলাম।’
“সদু আর এক চোট ভেঙে পড়ল!”
অনিল চুপ করিল। আলো জ্বালা হয় নাই, বাড়িতে অন্ধকার জমাট বাঁধিয়া উঠিয়াছে। আমরা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম। এক সময় অনিল বলিয়া উঠিল, “কি বলিস্? সমস্যা নয়?”
বলিলাম, “সমস্যা বৈকি; মরণ যেন ওর জন্যে ওত পেতে বসে আছে।”
অনিল বলিল, “অথচ এই মরণের হাত থেকে ওকে বাঁচানো যায়; অব্যর্থ।”
আমার মনটা মথিত হইয়া উঠিতেছে। অনিল কি ভাবে সদু ওর একারই চিন্তা? পত্রের উত্তর দিই নাই বলিয়া আমি নিশ্চিন্ত আছি? ওর একা সদু, আমার সদু আর মীরা—কর্তব্য আর ভালবাসা। আমার যন্ত্রণা অনিল বুঝিবে না, যতই বুদ্ধিমান হোক কেন। আমি নীরব আছি দেখিয়া অনিল বলিল, “তাই তোর কাছে গেছলাম তাড়াতাড়ি শৈল। তোকে এক সময় বলেছিলাম চিঠি পেয়ে এবং না পেয়ে তোর মনের ভাব বুঝেছি, আর যাওয়ার দরকার ছিল না, কিন্তু দেখলাম সদুর সমস্যা আরও জটিল, আমি তাকে বাড়িতে ঠাঁই দিলেই মিটবে না। তাই ভাবলাম আর একবার বলে দেখি শৈলকে। অবশ্য সদুকে বলিনি এখনও, কিন্তু আমি ওর মন জানি। ইদানীং সদুর সঙ্গে কথাবার্তায় একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি শৈল, এ-সময় বলাটা ঠিক হবে না, ভাববি আমি তোর মন ঘোরাবার জন্যে মিথ্যে রচনা ক’রে বলেছি; কিন্তু তবু বলি—সদু আমায় কখনও ভালবাসত না শৈল। যখন টের পেলাম, মনে একটা ভয়ানক আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম ঐটেই ঠিক স্বাভাবিক। আমি সদুকে ভালবাসতাম, তুই ছিলি উদাসীন, সব মেয়েরই উমার অংশে জন্ম—উদাসীনের জন্যেই তাদের তপস্যা।”
আমার মনে একটা ঝড় উঠিয়াছিল। এ তত্ত্বটা আমিও টের পাইয়াছিলাম—অর্থাৎ আমার প্রতি সৌদামিনীর মনের ভাবটা। অনিলের উপর ওর সব-ঢালা নির্ভর আর অপরিসীম শ্রদ্ধা, কিন্তু অনিল যাহা আশা করিয়াছিল সদু তাহা দিতে পারে নাই, সে-জিনিসটা সদু আমায়ই দিয়াছে বলিয়া আমারও মনে হইয়াছিল।
কিন্তু আমার নিজের কথা?…মনে পড়িতেছে মীরার মুখখানি। বেশ বুঝিতেছি ঐ একখানি মুখ জীবনে ভালবাসিয়াছি, কামনা করিয়াছি, স্বপ্নমণ্ডিত করিয়াছি। আঘাত দিয়া আসিয়াছি; স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অপলক দৃষ্টিতে অপসৃয়মান গাড়ির দিকে চাহিয়া আছে মীরা। কি কঠিন, সমস্ত চিত্ত উদাস-করা বিদায়!
অপর দিকে ঐ ভালবাসার সামনে—চিত্তের ঐ বিলাসের তুলনায় সৌদামিনীর ব্যর্থ, বিপন্ন জীবন—রূঢ় কঠোর বাস্তব!
কি করি আমি? এ কি অসহ্য অবস্থা!
আমি ব্যথিতভাবে অনিলের পানে চাহিয়া বলিলাম, “অনিল, আমি পারব না। উপায় নেই; কিন্তু তবুও বলছি আমায় সাতটা দিন সময় দে! পরশু একটা ব্যাপার হয়েছে যাতে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যদি পারি তো জীবনে আর আমি হঠাৎ কিছু ক’রে বসব না। কিন্তু আমি করছি চেষ্টা। বোধ হয় তোর কথা রাখতে পারব না অনিল, এই রকম ভাবেই মনটাকে তোয়ের রাখিস্। সঠিক উত্তর এই সাতটা দিন পরে দোব।”
অন্য দিন হইলে বোধ হয় অনিলকে কথা দিয়াই দিতাম, ওরই প্রস্তাবে সার দিতাম, সদুর মৃত্যুর সম্ভাবনাও তো কম ব্যাপার নয় একটা। কিন্তু মীরাকে আঘাত দিয়া আসিয়া বড় দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি।
অম্বুরী আসিল। বাড়িতে ঢুকিয়াই বলিল, “জ্বালোনি তো আলো ঘরে? কি আল্সে-কুঁড়ে মানুষ বাপু! কোথাও গিয়ে যে একটু নিশ্চিন্তি…”
দু-জন দেখিয়া হঠাৎ থামিয়া গেল।
অনিল হাসিয়া বলিল, “অন্য কেউ না, শৈল এসেছে। তুমি যত মিষ্টি মিষ্টি শোনাবার শুনিয়ে যেতে পার, তোমার পতিভক্তির আসল রূপ জানাই আছে ওর।”