২
অপর্ণা দেবীর ঘরের সামনে গিয়া ডাকিলাম, “তরু আছ?”
উত্তর করিলেন অর্পণা দেবী, “কে, শৈলেন? এস।”
পর্দা ঠেলিয়া ভিতরে গিয়াছি, তরু আসিয়া আমার হাতটা ধরিল। ও বেচারি যেন কি রকম হইয়া গিয়াছে, বুঝিতেছি আমায় পাইয়া অনেকটা ভরসা পাইয়াছে। অপর্ণা দেবীর চরণ স্পর্শ করিয়া তরুকে লইয়া একটা সোফায় বসিলাম। অপর্ণা দেবী একটা হেলান চেয়ারে বসিয়া আমি আসিবার পূর্বে বোধ হয় একটা বই পড়িতেছিলেন। পায়ের কাছে বিলাস-ঝি বসিয়া তরুর সঙ্গে বোধ হয় তরুর প্রাইজ-বইয়ের ছবি দেখিতেছিল। দেখিলাম কতকগুলা বই ছড়ানো রহিয়াছে।
চরণ স্পর্শ করিতে অপর্ণা দেবী বলিলেন, “এসে গেছ তুমি, ভালই হ’ল; এরা দুই বোনে বড্ড ভয় পেয়ে গেছে।”
তরুর দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, “তরু ভেবেছে ওর মা এবার মরে যাবে, মীরা ভেবেছে পাগল হ’য়ে যাবে।”
আমি আর মীরা-তরুর দোষ ধরিব কি, ওঁর কথা বলিবার ভঙ্গি দেখিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলাম। বিলাস মুখ তুলিয়া বলিল, “বড় মিছে ভাবেনি, কাল তোমার ভাবগতিক ঐ রকমই দাঁড়িয়েছিল, বরং আজ সকাল পর্যন্তও বলতে পারি।”
অপর্ণা দেবী বলিলেন, “বুড়ীটা ছিল এতদিন কাছে কাছে, হঠাৎ মারা গেল, কষ্ট হয়েছিল যে এ-কথা অস্বীকার করব না; কিন্তু সত্যিই কি আমি এতই অধীর হ’য়ে পড়েছিলাম?”
বিলাস-ঝি বলিল, “অধীর হওয়া বরং ভাল, তুমি একেবারে গুম হ’য়ে বসে থেকে যে আরও ভাবিয়ে তুললে।”
অপর্ণা দেবী হাসিয়া বলিলেন, “ঐ শোন শৈলেন। শুধু শোকে কেন, যে কোন অবস্থাতেই মানুষ দুটি উপায়ে কাটাতে পারে—হয় চঞ্চল হ’য়ে, না-হয় শান্ত হ’য়ে। যদি একটু অধৈর্য হতাম, এরা বলত শোকে উন্মাদ হয়ে গেল; শান্ত হয়ে ছিলাম, এখন বলছে—সে আরও ভাবনার কথা…তোরা বুঝি ভেবেছিলি বিলাস, আমার বাক্রোধ হ’য়ে গেছে, আর বেশিক্ষণ নয়?”
অপর্ণা দেবী মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। বিলাস রাগিয়া উঠিয়া নথ নাড়িয়া বলিল,— “তা বলে তুমি বাপু যেখান-সেখান থেকে ঐ সব নেপালী ভুটানী টেনে আর বাড়িতে তুলতে পারবে না, এটা আমি বলে দিলাম। যত সব অসৈরণ তোমার। জানা নেই শোনা নেই…”
এময় সময় পর্দার বাহির হইতে রাজু বেয়ারার গলা শোনা গেল, “বিলাস, বড়দিদিমণি ডাকছেন তোমায় একবার।”
বিলাস উঠিয়া গেল। বোধ হয় আমার কথাবার্তার সুবিধার জন্যই মীরা তাহাকে সরাইয়া লইল, বাকি সুবিধাটুকু অন্য প্রকারে হইয়া পড়িল। অপর্ণা দেবী হাসিয়া বলিলেন, “মীরার এই অবস্থা ক্রমাগতই বিলাসকে ডেকে পাঠিয়ে খবর নিচ্ছে, মা আছে কি গেল। এদিকে তরু একেবারে আগলে আছে ওর মাকে—পাছে ভুটানী-বুড়ী ডেকে নেয়।”
তরু অভিমানের সুরে বলিল,– “যাও, ভারি দুষ্টু তুমি মা!”
অপর্ণা দেবী বলিলেন, “দুষ্টু মা যাওয়াই তো ভাল। বেশ একটা ভাল মা আসবে…”
দেখিলাম অপর্ণা দেবী ভুল করিতেছেন। তরুর মুখটা জলভরা মেঘের মত থম্থম্ করিয়া উঠিয়াছে, এধরনের কথা আর একটু চাপাইলেই ও আর নিজেকে সংবরণ কবিতে পারিবে না। বলিলাম, “হ্যাঁ, তরু, তুমি বরং যাও, বই-টইগুলো ঠিক ক’রে রাখ গিয়ে। ভয় নেই, পড়তে হবে না, এসে একবার দেখে নিচ্ছি এ ক’টা দিনে কোন্ পড়া কতদূর এগুল। যাও তুমি।”
তরু চলিয়া গেলে অপর্ণা দেবী অনেকক্ষণ দৃষ্টি নত করিয়া রহিলেন। হঠাৎ এই চুপচাপের ভাবটা ক্রমেই বড় অস্বস্তিকর হইয়া উঠিতে লাগিল। আরও একটা ব্যাপার দু-একবার চোখ তুলিয়া দেখিলাম, অপর্ণা দেবীর আনমিত মুখের ভাবটা ক্রমেই পরিবর্তিত হইয়া আসিতেছে—কেমন একটা গম্ভীর চিন্তিত ভাব, প্রতি মুহূর্তেই যেন একটা বিভীষিকার অতলে তলাইয়া যাইতেছেন।
সহসা মুখ তুলিয়া এমনভাবে চাহিলেন, বেশ টের পাওয়া গেল আমার উপস্থিতির কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সংযত করিয়া লইলেন। চেয়ারে মাথাটা হেলাইয়া দিয়া সুপ্তোত্থিতের মত দুই হাতে নিজের মুখটা একবার মুছিয়া লইলেন, তাহার পর আবার সোজা হইয়া বসিয়া বলিলেন, “শৈলেন, তুমি এসেছ, ভাল হয়েছে।”
ঐটুকু বলিয়াই চুপ করিলেন। আমি প্রতীক্ষা করিয়া রহিলাম। একটু পরে অপর্ণা দেবী আবার বলিতে লাগিলেন, “ভুটানীর মৃত্যুটা আমায় ভাবিয়ে তুলেছে শৈলেন; অবশ্য তুমি আর কি করবে, তবুও যেন একজন কাউকে বললে মনটা হাল্কা হচ্ছে না। তোমার মনে থাকতে পারে, একদিন তুমি জিগ্যেস করতে ভুটানীর সম্বন্ধে আমার আশঙ্কার কথা তোমায় বলেছিলাম আমি। তোমায় বলেছিলাম—মনের গতি বড় দুর্জ্ঞেয়, যখন ভাবা যায় বাইরের কোন একটা জিনিসকে আশ্রয় ক’রে ওপরে উঠছে, তখন হয়তো সে ভেতরে ভেতরে আরও নিজের চিন্তা নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থাটা বড় সাংঘাতিক, আর ভুটানীর ব্যাপারে ঠিক এই কাণ্ডটাই হ’ল। ওকে নিয়ে আমার একটা পরীক্ষা চলছিল জানই। শেষের দিকে এই পরীক্ষাটা আশ্চর্য রকম সফল হ’য়ে আসছিল। বুড়ি এদিকে একেবারে বুদ্ধগত প্রাণ হ’য়ে উঠল। ওর পুজোটা বসে বসে খালি বুদ্ধের জপ থেকে বুদ্ধের সেবায় গিয়ে দাঁড়াল—বৈষ্ণবেরা সেবার মধ্য দিয়ে যেমন শ্রীকৃষ্ণের পূজো করে—ধোওয়ান, মোছান, সাজান। অল্প উত্তেজনাতেই যে ‘বেটা-বেটা’ ক’রে উঠত সে ভাবটাও কমে এল, আর সবচেয়ে আশ্চর্য পরিবর্তন এই হ’ল যে, ওর মনটা যে নিঝুম মেরে থাকত, সেটা কেটে গিয়ে প্রফুল্ল হ’য়ে উঠল। আমি ঝোঁকের মাথায় বৌদ্ধ ধর্মের কিছু বই আনিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল ধর্মের স্থুল কথাগুলো বুড়ীর মনে আস্তে আস্তে সাঁদ করানো! ওদিকে আলোচনার মধ্যে একেবারেই আসতে চাইত না, কিন্তু এদানিং নিজেই এসে বুদ্ধ সম্বন্ধে আর তাঁর ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ কবত, বললে মন দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করত, বেশ বোঝা যেত সে যেন নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছে। তারপর আবার হঠাৎ বদলে গেল বুড়ী। পরশু দিন বিকেলে আমি একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেড়াতে গেলেই বুড়ী সঙ্গে থাকে, কিন্তু সেদিন জানিয়ে দিলে বুকটা একটু কেমন করছে, যাবে না। ফিরে এসে দেখি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধের মূর্তিটাকে বুকে চেপে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলোচ্ছে, আর ওর নিজের ভাষায় বিড় বিড় ক’রে কি বলছে। পেছন ফিরে ছিল বলে আমায় দেখতে পায়নি, যখন টের পেলে আমি এসেছি, একটু যেন অপ্রস্তুত হ’য়ে গিয়ে আমার কাছে এসে বসে নিজে থেকেই বুদ্ধের কথা পাড়লে। সন্ধ্যা থেকে জ্বর এল, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই একেবারে একশ পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত ঠেলে উঠে বিকার আরম্ভ হ’ল—শুধু ছেলের কথা। সে যে কী কষ্টকর ব্যাপার না দেখলে বিশ্বাস হয় না শৈলেন। ওর নিজের ভাষা বুঝি না, কিন্তু যেন মনে হচ্ছে ও ওর ছেলের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও যেন দেখা পেয়েছে, বাড়ি যাবার জন্যে সাধছে। ছেলের বৌকে দেবে বলে বুড়ী ফুলকাটা ইটালিয়ান র্যাপার আর চব্বিশ ফলার চুরিটা সর্বদাই বুকের কাছে রাখত–বিকারের ঝোঁকে এক-একবার ঝোলার মধ্যে হাত দিয়ে সেগুলো বের করে আনবার চেষ্টা করছে, আর এক-একবার শূন্যদৃষ্টিতে কাতরভাবে শুধু ‘মেমসাহেব, বেটা দেও, বৌ দেও।’ ওর ছেলের সন্ধান নিতে যেমন কসুর করিনি, ডাক্তারের বেলাও সেই রকমই যথাসাধ্য করলাম, কিন্তু রোগের কিছুই উপায় হ’ল না। ডাক্তাররা বললে ওর ব্রেন অ্যাফেক্ট করেছে, রক্তেরও জোর নেই, কোন আশাই নেই। সমস্ত রাত একভাবে গিয়ে সকালের দিকে বুড়ী একটু নিঝুম হয়ে পড়ল। বেলা যখন আটটা, মনে হ’ল বুড়ীর যেন একটু একটু জ্ঞান ফিরে এসেছে। সেটা প্রদীপ নেবার আগে জ্বলে ওঠা আর কি। তারপরই—ঘড়িতে ঠিক যখন ন’টা-পনের হয়েছে, বিকারের শেষ ঝোঁকটা উঠে বুড়ী মারা গেল।”
অপর্ণা দেবী চুপ করিলেন। খুব সহজভাবে ব্যাপারটা বর্ণনা করিবার চেষ্টা করিলেও বোঝা গেল তাঁহার মনের উপর বেশ খানিকটা ঝোঁক পড়িয়াছে। শেষ করিবার পথ তাহার প্রতিক্রিয়াটা যেন আরও স্পষ্ট হইয়া উঠিল। যেন, যে ব্যাপারটুকু এইমাত্র বর্ণনা করিয়া গেলেন, সেটা এবার সত্যের স্পষ্টতায় তাঁহার মনশ্চক্ষুর সামনে ফুটিয়া উঠিয়াছে। নিস্তব্ধতার মাঝে একবার চোখ তুলিয়া দেখিলাম অপর্ণা দেবীর মুখের চেহারাটা বদলাইয়া গিয়াছে। বুদ্ধমূর্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চাহিয়া আছেন, মুখে একটা চাপা আতঙ্কের ভাব, আর সেটা যেন বাড়িয়াই যাইতেছে। আমার ভয় হইল! বেশ বুঝিতে পারিলাম এই জিনিসটি দেখিয়াই মীরা প্রমুখ সকলে শঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে, আর চেষ্টা করিয়া অপর্ণা দেবী আমার কাছে এই ভাবটাই গোপন করিয়া আসিয়াছেন এতক্ষণ।
আমি যে কি বলিব, কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। তাহার পর মনে হইল ঘরটা কয়েক দিনের জন্য বদলাইয়া ফেলিবার কথা বলি। পাড়িতে যাইব কথাটা, অপর্ণা দেবী আমার পানে দৃষ্টি ফিরাইয়া কতকটা উত্তেজিতভাবে বলিলেন, “বুড়ী গেছে খুবই ভাল হয়েছে শৈলেন, ওর জীবন যে কী দুর্বহ হয়ে উঠেছিল তা আমি বুঝতাম, কিন্তু ওর মৃত্যুটা হ’ল বড় ভীষণ!–শেষ পর্যন্ত জগতে আর ওর ধর্ম রইল না, কিছু রইল না, রইল শুধু ওর ছেলে কিংবা আরও ঠিকভাবে বলতে গেলে—ওর ছেলের স্মৃতি। আমি অস্বীকার করব না শৈলেন, আমি ভয় পেয়ে গেছি, আমার পরিণামও কি শেষ পর্যন্ত এই হবে? আমার দৃষ্টির সামনে থেকেও ঐ রকম ক’রে ইহকাল পরকাল সব মুছে গিয়ে শুধু জেগে থাকবে এক অপদার্থ ছেলের মূর্তি? কি ভয়ংকর অবস্থা বল তো শৈলেন, ভাবতে পার? আমি তোমায় মিথ্যে বলছি না, আমি প্রাণপণে আমার দূরদৃষ্ট থেকে সরে যেতে চেষ্টা করছি। আমি ধর্মে বিশ্বাসী—আমাদের যা ধর্ম, যাতে বলে ভগবান সহস্রমূর্তিতে আমাদের ঘিরে রয়েছেন—সেই ধর্ম আমি জীবনে সত্য ক’রে নিয়েছি। আমার আলমারীতে যা বই দেখছ, আমার ঘরে যা ছবি দেখছ, সে-সব আমার ঘর সাজাবার সৌখিন উপকরণ নয় শৈলেন; কিন্তু আমার আর সন্দেহ নেই কোন এক সময় ভুটানীর মত আমার ছেলের স্মৃতি যখন কাল হ’য়ে আমার জীবনে দেখা দেবে, তখন অন্য কিছুই তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কি পাপে এই পরিণাম আমার জন্যে ওত পেতে রয়েছে শৈলেন? কি ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করা যায়?—কেন এমনটা হ’ল?”
কখনও এ রকম ভাবান্তর দেখি নাই অপর্ণা দেবীর মধ্যে, অথবা বোধ হয় মাত্র আর একদিন দেখিয়াছিলাম—যেদিন ভুটানী প্রথম আসে। সেও কিন্তু বিস্ময়কর, হইলেও এতটা ভয়াবহ ছিল না। আমি নিরতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতেছিলাম, একটু বিরতির সুযোগ পাইয়া শান্ত, সহজ কণ্ঠে বলিলাম, “আপনি মিছিমিছি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, একটা অশিক্ষিতা স্ত্রীলোকের মনের ওপর একটা ঘটনার প্রভাব যেভাবে পড়েছে ঠিক সেইভাবে যে আপনার ওপরও পড়বে এটা আগে থাকতে ধরে নিয়ে আপনি উতলা হয়ে উঠছেন, কিন্তু সেটা কি সম্ভব?”
অপর্ণা দেবী খুব অন্যমনস্ক হইয়া আমার কথাগুলা শুনিতেছিলেন, একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসিয়া বলিলেন, “সব মায়ের মন এক শৈলেন,—শিক্ষার সেখানে প্রবেশ নেই। আমাকে যদি শিক্ষিত বলে মনেই করো তো অমন ছেলের চিন্তাই বা আমি করতে যাই কেন? না, ওতে রক্ষা করতে পারবে না। বরং অশিক্ষিতদের মধ্যে ধর্মের প্রভাব বেশি, আমার সেই আশা ছিল বলেই আমি ভুটানীকে এই পথে চালিত করবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অসম্ভব! কি রকম সর্বনেশে ব্যাপার দেখ—বুদ্ধদেব ওর ছেলেকে নিজের মধ্যে টানতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত নিজেই ওর ছেলের মধ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। আমি যে সেদিন বেড়িয়ে এসে দেখলাম বুড়ী পেতলের বুদ্ধমূর্তিকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে—তার ভেতরকার ব্যাপারটা বুঝেছ তো? পেতলের মধ্যে বুদ্ধদেব গেছেন নির্বাণ হয়ে, তার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর ছেলে। অনেক দিন থেকেই এই ব্যাপারটা চলছিল ধোওয়ান, মোছান, সাজানর মধ্যে যে বুড়ী তার ছেলেকেই দেখে যাচ্ছে, এতটা সন্দেহ না ক’রেই আমি আমার পরীক্ষা সম্বন্ধে খুশি হ’য়ে উঠেছিলাম। টের পেলাম, যখন আর একেবারেই উপায় নেই। —শৈলেন আমি সত্যই ভয় পেয়েছি। মীরা, তরু ওরা আমায় দেখে যে আকুল হয়ে উঠেছে তাতে কিছুই আশ্চর্য হবার নেই, কেন-না চেষ্টা করেও আমি ভয়টা চাপতে পারিনি সব সময়। সবচেরে ভয়ংকর ব্যাপার কি হয়েছে জান?—যখন থেকে অসুখে পড়েছিল হাজার চেষ্টা ক’রেও আমি ওকে এক বার বুদ্ধদেবের নাম মুখে আনাতে পারিনি। বিকারের সময় তো কথাই নেই—অসুখ যখন শুরু হয়, আর শেষকালে যখন ওর জ্ঞান হয় খানিকক্ষণ, তখনও হাজার চেষ্টা ক’রেও ওর মনটা বুদ্ধদেবের দিকে ফেরাতে পারিনি। যত বলি—বোলো– ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’—অন্তত একবার নামও করুক বুদ্ধদেবের—শুধু বুকে হাত দিয়ে ‘বেটা—বেটা—বেটা মেমসাহেব বেটা দেও’—”
অপর্ণা দেবী চুপ করিলেন। আমিও আর কিছু বলিলাম না—নূতন করিয়া আবার কোন দুর্বল স্থানে স্পর্শ দিব এই ভয়ে। ওঁর দৃষ্টি ক্রমে মুক্ত জানালার বাহিরে গিয়া পড়িল। ধীরে ধীরে দৃষ্টি শান্ত এবং মুখের ভাব সহজ হইয়া আসিতেছে। বুঝিলাম একজনকে কথাগুলা বলিতে পারিয়া মনটা হাল্কা হইয়াছে। ধীমতী নারী-মনের ব্যাধিও চেনেন, ঔষধ সম্বন্ধেও ধারণা আছে, সেই জন্য গোড়াতে বলিয়াছিলেন, “তুমি কি করবে? কিন্তু তবুও একজনকে বলা দরকার।”
আরও অনেকক্ষণ গেল। একবার বাহির হইতে দৃষ্টি গুটাইয়া লইয়া খুব স্নেহদ্রব কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “খোকাকে ‘অপদার্থ’ বললাম, না শৈলেন?—ক’বার বললাম বল তো?”
চক্ষুপল্লব সিক্ত হইয়া উঠিয়াছে।
উত্তরের প্রয়োজন ছিল না। আমি চুপ করিয়া রহিলাম। আরও কিছুক্ষণ গেল। হঠাৎ অপর্ণা দেবী আবার বিচলিত হইয়া উঠিলেন। আমার পানে চাহিয়া বলিলেন, “শৈলেন, কিছু একটা হওয়া দরকার; এভাবে এ অবস্থায় আমি থাকতে পারছি না, কিরকম যেন অসহ্য হ’য়ে উঠছে। উনি কবে আসবেন টের পেয়েছ?”
টের পাই সেটা আর বলিলাম, না। বলিলাম, “কাল আসবেন…আমার একটা ছোট্ট কথা মনে হচ্ছে, অনুমতি দেন তো বলি।”
অপর্ণা দেবী আগ্রহের সহিত বলিলেন, “বল।”
বলিলাম, “আপনার আপাতত এ-ঘরটা একটু বদলান দরকার।”
অপর্ণা দেবী ঘরের চারিদিকটা, বিশেষ করিয়া ভুটানী যেখানটায় থাকিত—বুদ্ধের মূর্তি, ভুটানীর চেয়ার—একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, দরকার একটু বটে! তরু ওপরে যে ঘরটায় পড়ত সেইটে আমার জন্যে ঠিক ক’রে দিতে বলবে?”