» » মীরা-সৌদামিনী

বর্ণাকার

কবে সুদুর হিমালয়ের কোন এক অজ্ঞাত পল্লী হইতে এক পুত্রহারা জননী ব্যর্থ-সন্ধানের নিরুদ্দেশ যাত্রা করিযাছিল। ঘটনাটি আকস্মিক, কিন্তু আমার জীবনে এর প্রভাব আছে; অল্প নয়, বহুল পরিমাণে।

ভুটানী না আসিলে মীরার আপাতত রাঁচি যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।

মীরার রাঁচি যাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। প্রথমে ভাবিয়া ছিলাম আসুকই না একটু বিরহ, মীরা যে-স্মৃতিসম্পদ দিয়া যাইতেছে তাহাকে পূর্ণ ভাবে পাওয়ার জন্য অবসর চাই না?

কিন্তু বিচ্ছেদ কি শুধু স্মৃতিকেই পুষ্ট করে?

কলিকাতায় এই কয়টা মাসে অনুকূল প্রতিকূল নানা ঘটনার মধ্য দিয়া একটা বিশেষ অবস্থা এবং একটা পরিচিত সামাজিক গণ্ডির মধ্যে আমি আর মীরা যেন পরস্পরের অভ্যাস হইয়া গিয়াছিলাম। রাঁচিতে মীরা নিজেকে নিজেদের অভিজাত সমাজে আবার নূতনভাবে দেখিবার সুযোগ পাইল।

আবার ভাবি আমাদের উভয়ের জীবনে বোধ হয় এইটুকুর প্রয়োজন ছিল। বিনা প্রয়োজনে কোন্ ঘটনাই বা ঘটে জীবনে?…

কিন্তু থাক্ একথা এখন, যথাস্থানেই আলোচনা হইবে।

মিস্টার রায় সকলকে রাঁচিতে রাখিয়া আসিবার দুই দিন পরে তরুর চিঠি পাইলাম। মীরার চিঠির অপেক্ষায় আরও কয়েক দিন থাকিতে হইল। তাহার পর আসিল একদিন চিঠি।

মীরা উচ্ছ্বসিত হইয়া রাঁচির কথা লিখিয়াছে। ওদের বাসাটা রাঁচি হাজারিবাগ রোডে; খুব চমৎকার ফাঁকা জায়গা। সামনেই মোরাবাদী পাহাড়। ওরা গিয়াছিল একদিন বেড়াইতে এর মধ্যে। পাহাড়ের উপর মহাপ্রাণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। আরও উঠিয়া গেলে, পাহাড়ের একেবারে শীর্ষদেশে চারিদিকে খোলা একটি চমৎকার মন্দির, এইখানে বসিয়া তিনি উপাসনা করিতেন। এইখান হইতে নীচের চারিদিকের দৃশ্য যে কী চমৎকার বলিয়া বুঝানো যায় না। কৃষ্ণনগরের গড়া, বাগান দিয়া ঘেরা মডেল পুতুল-বাড়ির মত দূরে কাছে বাড়ি সব—বাগানে পুতুলের মত মালী কাজ করিতেছে—কোন বাড়ির গেটের ভিতর খেলনার মোটরের মত একটি মোটর প্রবেশ করিল—পুতুলের মত কয়েকজন ছোট ছোট মানুষ নামিয়া ভিতরে গেল। সামনে চাহিলে অনেক দূরে দেখা যায় রাঁচি শহর, মাঝখানে রাঁচি হিল। তাহার চুড়ায় মন্দির। আরও অনেক দূরে কাঁকের নবনির্মিত পল্লী। অনেক দূর পর্যন্ত আকাশ আর চারিদিকে সুবিস্তীর্ণ উঁচুনীচু পল্লী দেখিয়া মনটা আপনা-আপনিই যেন কিসে ভরাট হইয়া আসে। মীরার অসুবিধা হইয়াছে যে সে কবি নয়, তাহারও উপর অসুবিধা যে একজন কবির কাছে বর্ণনা করিবার চেষ্টা করিতেছে। প্রথম ছুটিতেই যেন যাই আমি একবার, যদি মনে করি পড়িবার ক্ষতি হইবে তো সে ক্ষতি স্বীকার করিয়াও।

সবচেয়ে ভাল খবর, মা ভাল আছেন, এত প্রফুল্ল তাঁহাকে কখনও দেখিয়াছে বলিয়া মীরার মনে পড়ে না। ধন্যবাদটুকু আমার প্রাপ্য। নিশীথবাবুর বাড়িটা চমৎকার, কয়েকদিন হইল মায়ের জবানীতে ধন্যবাদ দিয়া তাঁহাকে পত্র দেওয়া হইয়াছে।

চিঠিতে ডায়মণ্ডহারবার রোডের দিক দিয়াও যায় নাই মীরা, যদি যাইত তো শ্রদ্ধা হারাইত আমার।

অনিলের পত্রের উত্তর দিতে একটু বিলম্ব হইল, কেন-না মীরার চিঠির সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। লিখলাম :

“অনিল,

সৌদামিনীর বৈধব্যের খবরটা কি আগাগোড়াই সুখবর? ভগবান সুস্থভাবে চলাফেরা করবার জন্যে দুটি ক’রে পা দিয়েছেন; কিন্তু এমন হতভাগাও তো আছে যাদের এই কাজটুকুর জন্যে একজোড়া কাঠের ক্রাচই সম্বল? এখন এই ক্রাচ বেচারির আসল পা নয় বলে সে দুটির ওপর চটলে চলবে কেন?… …সৌদামিনীর পঁচাত্তর বৎসরের স্বামী বা তোর দিক দিয়া বলতে গেলে স্বামী পদবাচ্য জীবটি তার ঠিক স্বামী না হ’তে পারুক, একটা মস্ত অবলম্বন ছিল যার জোরে সদু দাঁড়িয়ে ছিল, ভূঁয়ে গড়িয়ে পড়েনি। এইবার ওর সেই দুর্দিন এল।”

সৌদামিনীর বৈধব্য সম্বন্ধে এইটুকু অভিমত দিয়া মীরার কথাও একটু লিখিয়া দিলাম, উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট করিয়া দেওয়া যে অনিল স্কুলের মাঠে সদুর সম্বন্ধে যাহা উচ্ছ্বাসের মুখে বলিয়াছিল, সেদিক দিয়া আর কোন আশাই নাই। লিখিলাম—“এদিককার খবর এই যে, মীরারা গেছে রাঁচি, বোধ হয় মাসখানেক থাকবে। যাবার আগের দিন ও আমায় এমন একটা জিনিস দিয়া গেল যা রক্ষা করতে হ’লে আমার আর সব কথাই ভুলতে হবে। এই জিনিসটি পাওয়ার জন্যেই আমার এই এত দিনের তপস্যা, তোকে আমি সে কথা বলেও ছিলাম। এ-ভোলার মধ্যে কর্তব্যহানি এসে পড়বে বোধ হয়, কিন্তু সে অপরাধ আমি নিরুপায় হ’য়েই করলাম এইটে জেনে আমায় মার্জনা করিস।”

কয়েকবার পড়িয়া গেলাম, তাহার পর অন্য একটা কাগজে শুধু উপরের কথাগুলি অর্থাৎ সদুর বৈধব্য সম্বন্ধে আমার মন্তব্যটুকু লিখিয়া চিঠিটা পাঠাইয়া দিলাম। দেখিলাম ওইটুকুতেই আমার উদ্দেশ্যটা বেশ স্পষ্ট হইয়া আছে, বেশি বাড়াইয়া বলিবার দরকার নাই।

একটা কথা আমি স্বীকার করিয়াছি, তাহা এই যে, মীরা আসিয়াছে পর্যন্ত অনিলের সঙ্গে আমি লুকোচুরি করিতেছি, কথা বলিতেছি মাপিয়া জুখিয়া কাটছাট করিয়া; না লুকাইবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও কোথায় কি যেন আপনিই আটকাইয়া যাইতেছে। ভাবি কেন হয় এমন? মীরাকে কাছে আনিতে, অনিল কি দূরে সরিয়া যাইতেছে? প্রশ্নটা অন্যদিক দিয়া করিলে এই রকম দাঁড়ায়—জীবনে প্রিয়তম কি শুধু একজনই হয়?

একটা দিন বাদ দিয়াই অনিলের উত্তর আসিল। লিখিয়াছে — ‘সত্যটাকে তুই পুরোপুরি দেখতে পাস্‌নি, দেখেছিস তার অর্ধেকটা। আসল কথা আমাদের দেশে মাত্র পুরুষ মানুষেরই পা আছে, মেয়েদের নেই। এই কথাটা শাস্ত্র নানা ভাবে যুগ যুগ ধরে প্রমাণ করবার চেষ্টা ক’রে এসেছে। পা নেই বলে—কিংবা আরও ঠিক ভাবে বলতে গেলে, পা যে নেই এই সিদ্ধান্তটা নানা উপায়ে সাব্যস্ত ক’রে মেয়েদের জন্যে আগাগোড়া পরিবর্তনশীল ক্রাচের ব্যবস্থা করেছে—যেমন বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র। এর মধ্যে আগের আর শেষের দুটি বিধাতার হাতে, মাঝেরটি সমাজ রেখেছে নিজের আয়ত্তের মধ্যে। ব্যবস্থাটার দোষ-গুণ নিয়ে আমি আলোচনা করছি না এখানে। আমার কথা হচ্ছে—যদি সমাজই এ-ভার নিয়ে থাকে তো মেয়েদের এ-বিষয়ে স্বাধীনতা যদি না দেয় তো, এই যে একটা সুস্থ সবল “রোগী”র জন্যে ঘুণ-ধরা ক্রাচের ব্যবস্থা করা হ’ল এ প্রবঞ্চনার কে জবাবদিহি করবে? সদুর ক্ষেত্রে জবাবদিহি কেউ চাইবেও না, কেউ দেবেও না, বরং সমাজের যদি অনার্স লিস্ট বের করবার ক্ষমতা থাকত তো ভাগবত হালদার অচিরেই নাইট উপাধিতে ভূষিত হ’ত, কেন-না সে যা শিভ্যালরির কাজ করেছে তা মধ্যযুগের ইউরোপীয়ান নাইটের দ্বারাই সম্ভব ছিল। আমি জানি এসব কথা, তাই সাজা-পুরস্কারের কথা না তুলে, নবীনের কাছে আপীল করেছিলাম যে, (আমি ভেবেছিলাম) সে যৌবনের স্পর্ধিত-বিক্রমে এই অন্যায়ের একটা সমাধান করতে পারবে। সদু যদি শুধুই বিধবা হ’ত তো আমি তাও করতাম না, করলাম এই জন্যে যে ওর বৈধব্য-যন্ত্রণার শেষে আছে ভাগবত প্রাপ্তি।

“আজকাল আমাদের হাসপাতালের চার্জে একজন নতুন ডাক্তার এসেছে। সে রোগীদের ভাল করবার জন্যে এমন উঠে পড়ে লেগেছে যে, রোগীদের একটা আতঙ্ক এসে গেছে এবং সুস্থ মানুষেরা প্রাণপাত ক’রে চেষ্টা করছে যাতে রোগী হ’য়ে না পড়তে হয়। ডাক্তার বাড়ি বাড়ি ঘুরে দু-বেলা কুশল-সংবাদ নিয়ে বেড়াচ্ছে, এবং ঘুণাক্ষরেও কোথাও রোগের আঁচ পেলেই হয় আউট্‌ডোর নয় ইন্‌ডোর পেশেণ্ট ক’রে ভর্তি ক’রে ফেলছে। লোকেরা খাতিরে পড়ে কিছু বলতে পারছে না—একটা অতবড় ডাক্তার-গভর্ণমেণ্ট হাসপাতালের চার্জে রয়েছে—সে এসে যদি দু-বেলা তোমার জন্যে তোমার চেয়েও উদ্বিগ্ন হ’য়ে পড়ে তো কি রকম একটা বাধ্যবাধকতায় পড়ে যেতে হয় ভেবে দেখ না। মনে হয় না যে অসুখে না পড়ে কত বড় একটা অন্যায় করছি? এর ওপর বিপদ হয়েছে লোকটা রোগ সারাতে পারে না এবং তার চেয়েও বিপদের কথা এই যে, সারাতে না পারা পর্যন্ত ছাড়ে না। আউট্‌ডোর পেশেণ্টরা দেখতে দেখতে ইন্‌ডোরের বিছানা ভর্তি ক’রে ফেলেছে এবং ইন্‌ডোর পেশেণ্টদের মনের ভাবটা এই যে, যদি যমের দোর দিয়েও তারা বেরিয়ে পড়তে পারে তো বাঁচে। …পরশু একটা ইন্‌ডোর পেশেণ্ট রাত দুপুরে জানালা টপকে পালাবার চেষ্টা করেছিল, তার ধারণা ছিল তার কোন রোগ নেই অথচ তাকে নাহক আটকে রাখা হয়েছে। এখন তার সে ভুল ধারণাটা গেছে, পা ভেঙ্গে কায়েমী ভাবে পড়ে আছে হাসপাতালে। একটা এমন ত্রাহি ত্রাহি ডাক পড়ে গেছে যার তুলনা শুধু কলকাতায় দাঙ্গার সঙ্গে হতে পারে। যার যেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে সেখানে ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে বাড়ি খালি ক’রে ফেলছে।

“অবশ্য ভাগবত হালদারের সঙ্গে পরেশ ডাক্তারের তুলনা হতে পারে না, তবু উপকারীর হাত থেকে মুক্তি-সমস্যার কথায় পরেশ ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল। মুক্তি সম্বন্ধে আমি তোর কথা ভেবেছিলাম অনেক কারণে; প্রথমত, এখানে ‘রোগী’ আমাদের সৌদামিনী, আমাদের ছেলেবেলাকার ‘সদী’।

“দ্বিতীয়ত, সৌদামিনী দুলর্ভ স্ত্রীরত্ব, গলায় হার ক’রে পরবার জিনিস। ওর মত মুক্ত-প্রকৃতির স্ত্রীলোক ক’টা পাওয়া যায় সংসারে? ওর অভিজ্ঞতা, আর সেই অভিজ্ঞতার মধ্যেও অমন নিষ্কলুষ শুদ্ধি। আর জানিস? –তোকে কথাটা বলেছি কিনা আমার মনে পড়ছে না—সদু শিক্ষিতা। ‘শিশুশিক্ষা’ আর ‘ধারাপাত’ পড়া নয়—বাঙালী শিক্ষিত মেয়ে বলতে সাধারণত যা অর্থ দাড়ায়; সদু সংস্কৃত খুব ভাল জানে। ভাগবত সৌখীন মানুষ, সংস্কৃত কাব্যে সদুকে বেশ ভাল রকম তালিম দিয়ে রেখেছে, এদিকে বৈষ্ণব সাহিত্যেও। উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় এই যে, যখন নিশ্চিন্ত হ’য়ে হাতে-কলমে কৃষ্ণপ্রেম চর্চা করবে, তাতে কোন গ্রাম্যতা দোষ না এসে পড়ে। তারপর জ্ঞানের একটা স্পৃহা জাগায় চুরি ক’রে ইংরাজীও শিখেছে ও, অল্প অল্প। তুই লক্ষ্য করেছিস্ কি না জানি না, সদু যখন কথা বলে মাঝে মাঝে শুদ্ধ শব্দ এসে পড়ে, যদিও ওর বরাবর চেষ্টা থাকে ওর শিক্ষা-সংস্কৃতির কথা কেউ টের না পায়। এ হেন অমূল্য রত্ন কোন্ ধুলায় গড়াগড়ি দেবে?

“ওকে গ্রহণ করতে বলার—আরও স্পষ্ট ক’রে বলি, বিয়ে করতে বলার অন্য উদ্দেশ্যও ছিল— সমাজকে একটা আঘাত দেওয়া, এমন একটা আঘাত দেওয়া যাতে সমাজকে জেগে উঠে বিস্মিত, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অপলক ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে হবে। আঘাত অন্যভাবে দেওয়া যেত, সদুকে রেফিউজে ভর্তি ক’রে দিয়ে বা হিন্দু মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে সহজেই একটা বিধবা-বিবাহের ব্যবস্থা করতে পারা যেত; ভাগবত হ’ত নিরাশ, সমাজ একটু চোখ রগড়াত, কিন্তু তাতে আমার আশ মিটত না! আমি চাই আঘাত হবে রূঢ এবং তা করতে হ’লে এমন একজন এসে সমাজের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে এই সদ্য-বিধবাকে গ্রহণ করবে যে বংশে, মর্যাদায়, শীলে, শালীনতায়, শিক্ষায় সমাজের একজন আদর্শ যুবা যার এই দুঃসাহসিকতা দেখে সমাজ যেমন স্তম্ভিত হবে, তেমনি অপর দিকে যাকে হারাবার ভয়ে সমাজের বুক উঠবে কেঁপে। আমি এই জন্যে বিশেষ ক’রে বেছেছিলাম তোকেই। সদুর প্রতি অন্যায় হয়েছিল—সদুর মত মেয়ের প্রতি। শুধু তো সদুর ক্ষতি পূরণ করলে চলবে না, যে-সমাজ এই অন্যায় হ’তে দিয়েছিল, তার প্রতিও যে আমাদের একটা আক্রোশ আছে। শুধু ক্ষতিপূরণে হবে না, তার ওপর চাই আক্রোশের আঘাত। তা না হ’লে সৌদামিনীর মত অত্যাচারিত হ’য়ে আজ পর্যন্ত যত নারী মরেছে সদুরও জীবনের যে দেবদুর্লভ অংশ এই অর্ধযুগ ধরে তিলে তিলে দগ্ধ হ’য়ে ছাই হ’য়ে গেছে, তাদের তর্পণ হবে না। এই যুগের নারী প্রতিনিধি হিসাবে সদু তার এই অর্থহীন সদ্য-বৈধব্যকে অস্বীকার ক’রে নিতান্ত শুদ্ধ শুচি কুমারীর মতই এসে দাঁড়াবে আর পুরুষের প্রতিনিধি হিসেবে তুই তার গলায় মালা দিয়ে তুলে নিবি। সমাজের বিস্মিত নীরব প্রশ্নের এই হবে উত্তর—অর্থাৎ এ-অত্যাচার এ-যুগের আমরা সহ্য করব না।

“আমার ছিল এই উদ্দেশ; আশা ছিল সৌদামিনীর মধ্যে দিয়ে জীবনে যে দারুণ আঘাত পেলাম তার একটা সুফল ফলবে, কেন না শক্ত রকম সব আঘাতেরই একটা সুফল আছে শোনা যায়।…নিরাশ হলাম, আমারই ভুল হয়েছিল! কবি, সে এতদিন প্রণয়ের স্বপ্ন নিয়ে ছিল; এখন যখন সেই স্বপ্ন হ’তে চলল বাস্তব, তার কাছে এসব বাজে কথা তোলা উপদ্রব নয় কি? আমাদের আপিসের বীরু গাঙ্গুলীর কথাটা আমার মনে পড়ে যাওয়া উচিত ছিল। বীরু ছিল আন্‌পেড্ অ্যাপ্রেন্টিস! যেদিন তার মাইনে হবার খবর বেরুল সেদিন লড়াইয়ে বাঙালী পল্টন হ’য়ে ভর্তি হবার ফরম্ আপিসে এল। বড়বারু একটু উঠে-পড়ে লাগলেন। বীরু হাতজোর ক’রে বললে, ‘স্যার কাল পর্যন্ত বললে যে-কোন বীরত্বের কাজ করতে বীরু পেছপা ছিল না, দু-বচ্ছর এই পনরটি টাকার স্বপ্ন দেখে যেই ফলল স্বপ্নটা আর সঙ্গে সঙ্গে লড়াইয়ে চল?’

“কাল পর্যন্ত বললে হ’ত একথা অবশ্য তুই বলতে পারবি না, কেননা সদুর কথা তোকে অনেক দিনই বলে রেখেছি। তবে তোতে আর বীরুতে তফাত আছে নিশ্চয়, সে তবুও কেরানী, তুই একেবারে কবি।

“অম্বুরী বলেছে—‘এবার যদি ঠাকুরপো আসতে মাসখানেকের বেশি দেরী করেন তো সদলবলে গিয়ে সবাই উঠব, আর তো ঠিকানা সুকুন নেই।’ মা একরকম ভালই আছেন। সানু তোর দেওয়া বন্দুকটা নিয়ে খুব বড়াই ক’রে বেড়ায়, বলে—‘শৈল টাকা খুব বা-আ-ডুর, এট্টো বড়ো বন্দুক আছে।’…কত যে বাহাদুর আর বলিনি। আমার ছেলে যদি কখনও গ্রামের ইতিহাসের এ অংশটা জানতে পারে আর আমার দৃষ্টি পায় তো নিজেই বিচার করতে পারবে।”

অত্যন্ত চটিয়াছে অনিল। দুঃখ হল। কিন্তু আমি যে কত অসহায় হইয়া পড়িয়াছি তাহা কি কোনদিন ও বুঝিবে না? ওর তো বোঝা উচিত, কেন-না ও-ও তো একদিন ভালবাসিয়াছিল। ওকে যদি জিজ্ঞাসা করি—আজ পর্যন্ত সৌদামিনীর দুঃখ ওর প্রাণে অত বাজে কেন, তাহা হইলে কি ও আমার অন্তরের বেদনা বুঝিতে পারিবে না? ওর এটা কি শুধুই কর্তব্যের তাগিদ? শুধুই সমাজ-সংস্কার? শুধুই সদুর মত নারীরত্নের ক্ষতিপূরণ?