একজন ব্যক্তি তার এক জীবনে সেই ইংরেজ আমলের খিলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্যায় হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত দেখেছেন। এই সময়টায় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন পঞ্চাশেরও বেশি বছর। জড়িয়েছেন রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনায়। পঞ্চাশ বছর কোনো মুখের কথা নয়, এ এক মহাকাল। তার জীবনটা এমন এক সুইট স্পটে ছিল, যে সময়টায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে বড় বড় ঘটনা ঘটছে। আর তিনিও সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন সেসবে। তার এই লম্বা সময়ের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিকথাই হলো এই বই।
আবুল মনসুর আহমদ একজন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সাহিত্যিক। এক ‘ফুড কনফারেন্স’ গল্প দিয়েই সাহিত্য জগতে অমর হয়ে আছেন। তার উপর ছিলেন মেধাবী ছাত্র, সুবক্তা ও সংগঠক। এতগুলো বৈশিষ্ট্য একসাথে যার মধ্যে আছে তার কাজ ও কর্ম ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান হবে তা খুবই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, তিনি বর্তমান ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা।
যুক্ত ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে, সেখানে বাঙালি নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে মতের মিল না হওয়ায় কংগ্রেস ছেড়ে তৈরি করেন প্রজা সমিতি আন্দোলন। যা পরে কৃষক-প্রজা সমিতি এবং আরো পরে কৃষক-প্রজা পার্টি হিসেবে কাজ পরিচালনা করে। এ পার্টি পরবর্তীতে এ কে ফজলুল হকের প্রধানমন্ত্রীত্বে নিখিল বাংলায় (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা) সরকার গঠন করে।
জনমানুষের রাজনৈতিক দাবি বাস্তবায়নে কৃষক-প্রজা পার্টি সরকারের অসফলতায় হতাশ হয়ে পরে যুক্ত হন মুসলিম লীগে। মুসলিম লীগ তখন ভারতবর্ষে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ভারতীয় মুসলমানদের অধিকারের আন্দোলন করছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের ভূমিকায় হতাশ হয়ে যুক্ত হন আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ)-এ। পূর্ব বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগকে হারাতে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কোয়ালিশনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব করেন। যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কেন্দ্রের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় বেশ কিছু দিন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তার মন্ত্রীত্বের দায়িত্বকালে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তাই তিনিও বাংলার উপকারের জন্য বেশিদিন সময় পাননি। (আফসোস, এত বছর পরেও পাকিস্তান স্বাভাবিক হয়নি। আজ অবধি পাকিস্তানের কোনও মন্ত্রীসভা পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ইমরান খানের মন্ত্রীসভা তার শেষ উদাহরণ।)
তার এই বিস্তৃত রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা, স্মৃতিকথা ও মতামত উঠে এসেছে প্রায় সাত শত পৃষ্ঠার এ বইটিতে। বইয়ের নাম ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ সে হিসেবে খুবই সার্থক।
বইটিকে ইতিহাসও বলা যাবে না, আবার স্মৃতিকথাও বলা যাবে না। ইতিহাস আর স্মৃতিকথার মিশ্রণ। ইতিহাস বলা যাবে না এ কারণে, তার সময়ে এমন অনেক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে যেগুলোয় তিনি যুক্ত থাকতে পারেননি। যেসবে যুক্ত থাকতে পারেননি যেগুলো তিনি বলেননি। সেসবই বলেছেন যেসবে তিনি যুক্ত ছিলেন। আবার পুরোপুরি স্মৃতিকথাও বলা যাবে না, কারণ এতে তিনি ইচ্ছে করেই নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু এড়িয়ে গিয়েছেন। যেমন তিনি যে আসনে নির্বাচিত হলেন, নিশ্চয় তার জন্য অনেক খাটতে হয়েছে, অনেক ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সেসবের কিছুই তিনি উল্লেখ করেননি। সেগুলোই উল্লেখ করেছেন যেগুলো ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তির সাথে জড়িত। নিজেকে এক পাশে রেখে এক রকম নির্মোহ লেখা।
এতে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ও এসেছে, তবে সংক্ষেপে। কারণ তিনি ততদিনে বুড়িয়ে গিয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও মন্থর হয়ে গিয়েছে। তারপরেও ঘটনাবলীর হিসেবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে যে যে মতামত দিয়েছেন তা ইতিহাসের ও রাজনীতির পাঠকের জন্য অমূল্য।
উনার লেখার ধাঁচটাও দারুণ। শুরুর শ দুয়েক পৃষ্ঠা হাস্যরসে ভরা। এমন রসাত্মক পন্থায় কথাগুলো বলেছেন বা ঘটনাগুলো তুলে এনেছেন, পাঠকের জন্য কোনো চাপই মনে হবে না। এমন করতে করতে কখন যে ঢুকে যেতে হবে পাঠের ম্যারাথন দৌড়ে বোঝাই যাবে না। মোটা বইয়ের পড়ায় একবার মন বসে গেলে তা আর উঠে না। মোটা বই পড়ার এই একটা অন্যরকম মজা।
বইটি সকলের পড়া উচিত। সচেতন পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য। আমাদের ইতিহাস বিষয়ে আমাদের পপুলার কালচারে আমরা যা পড়ে এসেছি, যা জেনেছি সেসব থেকে দূরে গিয়ে ভিন্ন এক ডাইমেনশনে নিয়ে যাবে পাঠককে। দায়িত্ববান পাঠকের জন্য যা খুবই দরকার। মনে হবে, আমরা ইতিহাসে যা পড়েছি, যা জেনেছি তা পর্যাপ্ত নয়।
যেহেতু এটা রাজনীতির ইতিহাসের বই, তাই এ বই নিয়ে অনেক পাঠকের অনেক মত-দ্বিমত তৈরি হবে। আসলে হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি নানা মানুষের নানা মতের জিনিস। দ্বিমত-ভিন্নমত সেখানে নিত্য বিষয়। এ ধরনের বিষয়গুলোতে এডপ্ট করে আমাদের এগিয়ে যাবার ক্ষমতা যত বেশি হবে, পাঠক হিসেবে আমাদের পরিপক্কতাও তত বাড়বে।