অভিযান
খুব অল্প পরিসরে হলেও ‘সুকান্ত ভট্টাচার্য’ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কবিতা, গীতি, গল্প ও নাটিকা তাঁর প্রতিভার প্রমাণ রয়েছে। তবে কবিতার সংখ্যা কম হলেও গুণে ও মানে প্রতিভার যে বিস্ময়কর স্ফুরণ ঘটেছে সে জন্য আর সব খ্যাতিকে ছাড়িয়ে সুকান্ত কবি হিসেবেই সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।
‘অভিযান’ বহুমুখী প্রতিভার সমাজ সচেতন কবি ‘সুকান্ত ভট্টাচার্যে’র একটি গীতিনাট্য। এই গ্রন্থ তিনি কবিতা ও গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও অধিকার আদায়ের চিত্র এঁকেছেন। চরিত্রসমূহের সংলাপ, ঝগড়া-বিবাদ, চরিত্রের প্রকাশ এবং শেষে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল— সব কিছুই কাব্যিক।
‘কালের যাত্রা’ নাটিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন— ‘যারা এতদিন মরেছিল, তারা উঠুক বেঁচে, যারা যুগে যুগে ছিল খাট হয়ে তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’ সুকান্ত যেন প্রাণ ভরে রবীন্দ্রনাথের কথা শুনেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্ত করবী’তে রাজা-প্রজার কথা আছে, ধনদৌলতের কথা আছে, শোষণ-বঞ্চণার কথা আছে। সুকান্তের ‘অভিযানে’ও আছে মহারাজ, আছে কোতোয়াল, আছে শোষণ, ক্ষুধা আর বঞ্চনার জ্বালা। অভিযানের ‘সঙ্কলিতা’ আর রক্ত করবীর নন্দিনীর চরিত্র হুবহু এক নয়, কিন্তু আছে লক্ষ্যণীয় কিছু ব্যাপার। কালের যাত্রার সাথেও আছে অভিযানের খানিক মিল। কালের যাত্রায় আছে,— ‘আমরাই তো যোগাচ্ছি অন্ন তাই খেয়ে তোমরা বেঁচে আছ, আমরাই বুনেছি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জা রক্ষা!’ অথবা ‘দরিদ্রের রক্ত করে শোষণ বিরাট অহঙ্কারকে কর পোষণ’…।
অভিযানের শেষ সংলাপ হল—
‘চলবে না অন্যায়, খাটবে না ফন্দি,
আমাদের আদালতে আজ তুই বন্দী!’
যুগ যুগ ধরে সমাজে যে শোষণ চলে এসেছে তার চির অবসানের আন্দোলন ও বিপ্লবের জন্য চাই সমাজ সচেতন কর্মী বাহিনী। তারা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে, ছিনিয়ে আনবে চূড়ান্ত বিজয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য এই কথাটাই ভাল করে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিযানে।
অভিযান সাম্যবাদী প্রচারণার মোক্ষম হাতিয়ার নয়; ক্ষুধা ঘুচানোর অভিযান। এ অভিযান সমাপ্ত হলে অসহায় নারী-শিশু আর ক্ষুধায় কাতর হবে না, কাঁদবে না। অন্ধকারের চির অবসান হবে। এই জন্য চাই তাত্ত্বিক জ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ব্যাবহারিক দিকে পারঙ্গম জ্ঞানী ক্যাডার। যারা শাসকের রক্তচক্ষু, কোতোয়াল ও চরকে ভয় পাবে না, নির্ভয়ে এগিয়ে যাবে। প্রয়োজনে জীবন বাজী রাখবে। অভিযানে কোতোয়ালকে লক্ষ্য করে সঙ্কলিতার উক্তি—
‘তোমরা দেখাও শুধু শক্তি
তাই তো করে না কেউ ভক্তি,
কর না প্রজার কোন কল্যাণ,
তোমরা অন্ধ আর জ্ঞান।’
‘চিরদিন তরুণেরা অন্যায়ের করে নিবারণ।’ তাই সত্যকাম কোতোয়ালকে বলতে পেরেছে—
‘তোমার মত দুর্জনকে করতে হলে ভয়।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মোটেই উচিত নয়।’
ইন্দ্রসেন বলছে, তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই। এভাবে চিরকাল শাসন করা যাবে না। শোষকের দিন আজ গত। সঙ্কলিতা তাই আর্তনাদ করে বলছে—
‘দরিদ্রের রক্ত করে শোষণ
বিরাট অহঙ্কারকে কর পোষণ,
তুমি পশু, পাষণ্ড, বর্বর
অত্যাচারী, তোমার ও হাত কাঁপে না থরথর?’
এরপর যা হবার তাই হল; সঙ্কলিতার প্রাণ গেল দেশপ্রেমিক বলে। কিন্তু এতে কী মুক্তিযুদ্ধ থেমে থাকে? হাত দিয়ে যেমনি সূর্যের আলোকে রোখা যায় না, থামানো যায় না। গণজোয়ারের ঢেউ, সত্যের জন্য অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীতে একদিন সত্যের জয়পতাকা উড়বেই।
‘চলবে না অন্যায় খাটবে না ফন্দি,
আমাদের আদালতে আজ তুই বন্দী।’
সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন জনতার আদালতে সকল অপরাধীর বিচার হবে। বিচার হবে বিচারপতির, যিনি শাসকের স্বার্থে অন্যায় ও অবৈধ রায় প্রদান করেছেন। জনতার আদালত হবে বড় কঠিন ও নির্মম এক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। ‘সূর্যপ্রণামে’র সমবেত গান ‘আহ্বানে’ কবি বলেছেন—
‘আমাদের ডাক এসেছে
এবার পথে চলতে হবে,
ডাক দিয়েছে গগণ-রবি
ঘরের কোণে কেই বা রবে।
ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে
বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে।’
যে কথা কবি বারবার বলতে চান, সে কথা অস্তাচলের ‘প্রান্তকে’ আছে এভাবে— ‘সেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে।/… ক্ষীণদীপ উধর আলোতে/ চিরন্তন পথের সঙ্কেত-রেখে যায় প্রভাতের কানে।’
রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার সুর সুকান্তের ‘শেষ মিনতি’তে খুঁজে পাওয়া যায়—
‘ওকে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে
আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও,
সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও।’
আর সোনার তরীর — কোন পাড়ে নিয়ে যাবে হে সুন্দরী/ কোন পাড়ে ভিড়িবে তোমার সোনার তরী’র সাক্ষাত মিলে সুকান্তের ‘আয়োজন’ বর্ণনায়—
‘তুমি যাবে আমাদের মথিত করে! কোন মহাদেশের
কোন আসনে হবে তোমার স্থান?
কতদূর তা কে জানে।’
শেষ করছি সঙ্কলিতা ও কোতোয়ালের কিছু সংলাপ উল্লেখ করে।
সঙ্কলিতা (আঁচল তুলে)
ওগো রাজপ্রতিনিধি,
তুমি রাজ্যের বিধি।
তুমি দাও আমাদের অন্ন,
আমরা যে বড়ই বিপন্ন।
কোতোয়াল
য চ’লে ভিখারী মেয়ে যা চ’লে
দেব না কিছুই তোর আঁচলে।
সঙ্কলিতা
তুমি যদি না দেবে তো কে দেবে এ রাজ্যে?
সবারে রক্ষা করা তোমাদের কাজ যে।
কোতোয়াল
চুপ কর হতভাগী, বড় যে সাহস তোর?
এখুনি বুঝিয়ে দেব আমার গায়ের জোর।
সঙ্কলিতা
তোমরা দেখাও শুধু শক্তি,
তাইতো করে না কেউ ভক্তি;
করো না প্রজার কোনো কল্যাণ,
তোমরা অন্ধ আর অজ্ঞান।
কোতোয়াল
চল তবে মুখপুড়ী, বেড়েছিস বড় বাড়–
কপালে আছে রে তোর নির্ঘাত কারাগার।