বাবরের আত্মকথা

জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর, ভারতবর্ষের মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুর পর মাত্র বার বৎসর বয়সে ফারগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন। পারস্যের পূর্ব সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য যা বর্তমানে চীনা তুর্কিস্থানের আওতাভূক্ত। রাজধানী ছিল আন্দেজান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ফারগানা থেকে বিতাড়িত হন। তবে ১৫০৪ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে দখল করেন কাবুল। এরপর সমরখন্দ দখলের চেষ্টা করেন। সেখানে ব্যর্থ হয়ে ভারতের দিকে মন দেন। ভারতে তখন লোদী বংশের শাসন হলেও বিভিন্ন অঞ্চল ছিল প্রায় স্বাধীন। ১৫২৪ সালে বাবর প্রথম লাহোর দখল করেন। কিন্তু ফিরে যেতে বাধ্য হন। ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন।

জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের জন্ম ১৪৮৩ সালে; তিনি বেঁচে ছিলেন ৪৮ বছর, এর মধ্যে রাজত্ব করেছেন ৩৬ বছর।  রাজা হবার পর ভারতজয় পর্যন্ত মোটামুটি সব ঘটনাই আত্মচরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।

“রজব মাসের আঠাশে তারিখ বৃহস্পতিবার বৈকালিক নামাজের সময় আমি আগ্রাতে প্রবেশ করি। সুলতান ইব্রাহিমের প্রাসাদেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়।

১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন কাবুল জয় করি, সেইসময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত তখনি সর্বদাই এই আশা পোষণ করে এসেছি যে হিন্দুস্থান আমি জয় করবই করব। কিন্তু কখনও কখনও আমার আমীরদের অসদাচরণ— কারণ আমার ভারত জয়ের অভিলাষ তাদের মনোঃপুত ছিল না— এবং কখনও কখনও আমার ভাইদের গুপ্ত ষড়যন্ত্র ও বিরুদ্ধতা আমাকে এই দেশ জয় করার জন্য অভিযান চালান থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। ফলে, হিন্দুস্থানের প্রদেশগুলি এতদিন আমার আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। অবশেষে এইসব বাধা দূর হল। এখন ছোট বড় ধনী নির্ধন, সাধারণ এমন কেউ নেই যে আমার এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করার সাহস রাখে।”

তিনি আরো লিখেছিলেন, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও বিশ্বাসই তাঁকে হিন্দুস্থান দখলে সহায়তা করেছে। “তারই কৃপায় আমি পরাক্রমশালী শত্রুকে পরাজিত করে এই বিশাল হিন্দুস্থান জয় করার গৌরব লাভ করেছি। এই কৃতকার্যতা আমার নিজ শক্তিতে হয়েছে কিংবা আমার এই সৌভাগ্য আমার নিজের চেষ্টায় লাভ করেছি একথা আমি কখনই মনে করি না।”

১৫২৬ থেকে পরবর্তী চার বছরে বাবর দৃঢ়ভাবে তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার বিস্তার ছিল আফগানিস্তান থেকে বাংলা। হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত।

বাবর মারা যান ১৫৩০ সালে। এ সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনি হল— তাঁর পুত্র হুমায়ুন রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। বাবর তিনবার তার শয্যা প্রদক্ষিণ করে আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ করেন যেন পুত্রের রোগ পিতার ওপর বর্তায়। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন, বাবর রোগাক্রান্ত হন এবং সুস্থ হয়ে তিনি আর ওঠেননি। গুলবদন এই তথ্য দিয়েছেন। তবে ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ মনে করেন, হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠার পর বাবর দু’ থেকে তিন মাস অসুস্থ ছিলেন। রামশরণ শর্মা মনে করেন, ইব্রাহিম লোদির মা তাঁকে বিষ খাইয়েছিলেন। গুলবদনও তা লিখেছেন।

শচীন্দ্রনাথ রায় বাবরের আত্মজীবনী অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি ভাষ্য থেকে। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে কলকাতা থেকে তা প্রকাশিত হয়েছিল। শচীন্দ্রনাথ তাঁর ভূমিকায় এই আত্মজীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন যার বাবর একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত টিকেছিল।

 বাবর ছিলেন একাধারে বীর সৈনিক ও সুচতুর রাজনীতিবিদ। শুধু তাই নয়—তিনি ছিলেন দার্শনিক এবং কবি। ফারসী ভাষায় লেখা তাঁর কবিতাগুলি সুন্দর। তুর্কি ভাষাতে গদ্য ও পদ্য রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন তিনি। তিনি শিকারে পারদর্শী ছিলেন। উদ্যান রচনায় তার অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হত। তিনি পুষ্প-বিলাসী ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেই অনেক সময় ফুলের বাগানে প্রবেশ করতেন এবং একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। তাঁর লেখায় যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনার পাশেই ফুলের বিবরণ দেখা যায়। তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি ব্যবহার প্রীতিপূর্ণ ছিল। বীর ছিলেন, কিন্তু নির্মম ছিলেন না তিনি।

সুতরাং তিনি যে ভাল যোদ্ধা ছিলেন সে সম্পর্কে বিতর্ক নেই। কিন্তু তাঁর আত্মজীবনী তুজুক-ই বাবরী তাকে অমর করে রেখেছে। উল্লেখ্য, বাবর তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে আত্মজীবনী লিখেছিলেন যার সাহিত্য গুণও অনন্য। মোঘলদের আর যারা আত্মজীবনী লিখেছেন, তাঁরা লিখেছেন ফার্সিতে।

এই আত্মজীবনী ফার্সি ভাষায় প্রথম দু’বার অনূদিত হয়। অনুবাদ করেন পায়েন্দা খান ও আবদুর রহিম খানই খানান।

তারপর ফরাসি, ওলন্দাজ, ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থটি অনূদিত হয়। তবে বেভারিজের করা অনুবাদকে প্রামাণ্য বলে মনে করা হয়, কারণ তিনি তুর্কি থেকে অনুবাদ করেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। অন্যরা অনুবাদ করেছিলেন ফারসি থেকে।

শচীন্দ্রলাল রায় অনূদিত ‘বাবরের আত্মকথা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিত্র ও ঘোষ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলিকাতা ১২; প্রকাশক এস. এন. রায়। মুদ্রাকর ছিলেন শ্রীফণিভূষণ হাজরা, গুপ্তপ্রেস, ৩৭/৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলিকাতা।

সাড়ে পাঁচ টাকা মূল্যমানের বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কানাই পাল, এবং প্রচ্ছদ মুদ্রিত হয়েছিল ‘ফোটোটাইপ সিণ্ডিকেট’ থেকে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করে অনুবাদক লিখেছিলেন—

বকু, নারায়ণকে

—বড়দাদা