ভূমিকা
মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর আত্মচরিত লেখেন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে। এর অনুবাদ হয় ফারসী ভাষায় একাধিকবার। পরে অবশ্য পাশ্চাত্যের নানা ভাষায় এই অদ্ভুত আত্মচরিতের অনুবাদ হয়েছে। ইংরাজীতে এর অনুবাদ করেন জন লিডেন (John Leyden) এবং উইলিয়াম আর্সকিন্ (William Erskine) এবং সে বই ১৮২৬ সালে প্রকাশিত হয়। তারপর অনেক দিন আর এ বই পুনঃ প্রকাশিত হয়নি। এই মহামূল্য আত্মচরিতের কথা বিস্মৃতির অতল তলে ডুবে যায়। ইংরাজী অনুবাদক দুইজনের সূত্র ধরে আর একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ বের করেন— লেফটেনেন্ট কর্ণেল এফ, জি, ট্যালবট্ (F. G. Talbot)। বইখানি ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়। মিসেস্ এ, এস্, বেভারিজ আসল তুর্কি থেকে তানুবাদ করেন ‘বাবুর-নামা’ এবং এই অনুবাদ গ্রন্থ দুই খণ্ডে ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়।
বাবরকে আমরা জানি এক দুর্দ্ধর্ষ যুদ্ধ-বিশারদ ব’লে—যিনি তাঁর বাহুবলে ভারত আক্রমণ করেন এবং বারবার পর্যুদস্ত হয়েও শেষে এ দেশ জয় করেন ও ভারতে বিশাল মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গৌরব লাভ করেন। ইতিহাস পাঠে অবশ্য তাঁর শৌর্য বীর্যের কথা, তাঁর অদম্য অধ্যবসায়ের কথা, ছলে বলে কৌশলে রাজ্য জয়ের কথা, ধর্মে গোঁড়ামির আতিশয্যের কথা এমন কি তাঁর সন্তানবাৎসল্যের কথা জানা যায়—কিন্তু সমগ্রভাবে তাঁর জীবন দর্শন জানতে হলে তাঁর নিজের লেখা আত্মচরিতের শরণাপন্ন হতেই হবে।
ষ্টান্লি লেন্পুল (Mr. Stanley Lanepoole) তাঁর ‘বাবর’ গ্রন্থের ভূমিকায় এই আত্মচরিত সম্বন্ধে লিখেছেন যে এই আত্মচরিতে জগতের তদানীন্তন কালের একজন সুশিক্ষিত কৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিজস্ব ভাবধারা এবং সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি নানা প্রাচ্য ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী স্বচ্ছ ছিল, পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর ফলাফল তিনি সঠিক অনুধাবন করতে পারতেন। মানবচরিত্র বিশ্লেষণে তিনি পারদর্শী ছিলেন। প্রাকৃতিক দৃশ্যে মোহিত হওয়ার মত তাঁর মন ছিল। তাঁর নিজের ধ্যান ধারণা, ভাবনা চিন্তা এবং নানা ঘটনাবলীর বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তিনি সুষ্ঠু ও জোরালো ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর লেখার মধ্যে স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গী এবং মনের ভাবনাগুলি জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। বাবরের সংস্কারমুক্ত বলিষ্ঠ আশাবাদী মনের পরিচয় তাঁর আত্মচরিত থেকেই আমরা পাই। নিজেকেও বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তাঁর লেখার মধ্যে। নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি, দোষগুণ অকুণ্ঠ সততার সঙ্গে তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। তাঁর আত্মচরিত সমকালীন ঘটনার প্রকৃত বিবরণ; এতে সন্দেহ করবার কিছু নেই।
লেন্পুল আরও বলেছেন—কখন এবং কি ভাবে বাবর আত্মচরিত লেখেন তা বলা কঠিন। তবে তিনি যে নিয়মিতভাবে লেখেননি একথা আত্মচরিত পড়লে বোঝা যায়। তিনি এক সময় লেখা শুরু করেন; আবার থেমে যান। হয়তো সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আবার লিখতে শুরু করেন। এটা বোঝা যায় তাঁর লেখার ধরন দেখে। তিনি ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে করতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন—সেটা শেষ না করেই আবার অন্য সূত্র ধরে আরম্ভ করেছেন কয়েক বছর পর যার কৈফিয়ৎ তিনি লেখার মধ্যে দেননি। প্রথম দিকের লেখার ভঙ্গী শেষের দিকের লেখা থেকে পৃথক। এটা বোঝা যায় যে প্রথম দিকের লেখা অনেক পরে অদল বদল করেছেন। অনুমান করা যায় এই আত্মচরিত বিভিন্ন সময়ে লেখা এবং আগেকার লেখা ভারত অভিযানের পর সংশোধন করেছেন। তখন পূর্বস্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার জন্যই হোক কিংবা সময়ের অভাবের জন্যই হোক, ভিন্ন সূত্রগুলি আর তিনি জোড়া লাগাতে পারেননি।
লেন্পুল আরও বলেছেন— বাবরের আত্মচরিত একাধিকবার তুর্কি থেকে ফারসী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তুর্কি ও ফারসী ভাষার অনেকগুলি হস্তলিপি বিচার করে দেখা গিয়েছে যে আসল পুঁথির সঙ্গে কোনও গরমিল নাই এবং কোনও কিছু প্রক্ষিপ্ত করার বিন্দুমাত্রও চেষ্টা হয়নি। এই বিখ্যাত আত্মচরিতের অসংখ্য বার অনুবাদ হলেও মূলের কোনও বিকৃতি হয়নি— যা সাধারণতঃ অনুবাদ করতে গেলে ঘটে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে এসিয়া মহাদেশের প্রসিদ্ধ এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন বীরপুরুষের লেখা আত্মজীবনী অপরিবর্তিতভাবেই আমাদের হাতে পৌঁচেছে। মোগলসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতার বংশগরিমা অনেক দিন লুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তাঁর লেখা আত্মচরিতের মর্যাদা কালজয়ী, তা নষ্ট হবার নয়।
মিষ্টার ট্যালবট্ বলেছেন— বাবরের আত্মচরিত অগাষ্টাইন ও রুনোর এবং গিবন ও নিউটনের আত্মকাহিনীর সমপর্যায়ভুক্ত। এসিয়ায় এর জুড়ি নেই ।
ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এসিয়া মহাদেশ বিধ্বংসকারী তৈমুরের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ এবং মাতৃকুলের দিকে আর এক ধ্বংসলীলার অধিনায়ক চেন্গিজ খাঁয়ের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ। বিস্ময়ের কথা—কেন তাকে এবং তাঁর উত্তরাধিকারিগণকে মোগল বংশসম্ভূত বলা হয়। তাঁর মাতৃকুল মোগল হলেও পিতৃকুল মোগল নয়। তিনি নিজেও মোগল জাতিকে ঘৃণা করে এসেছেন। তবে চেন্গিজ খাঁয়ের সময় থেকে উত্তর দিক দিয়ে যারাই ভারত আক্রমণ করেছে— তারাই মোগল বলে পরিচিত হয়েছে।
বাবর তাঁর পিতার মৃত্যুর পর মাত্র বার বৎসর বয়সে ফারগানার সিংহাসনে বসেন। পারস্যের পূর্ব সীমান্তে এই ক্ষুদ্র রাজ্য। রাজধানী ছিল আন্দেজান। রাজা হবার পর ভারত জয় পর্যন্ত মোটামুটি সব ঘটনাই আত্মচরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।
বাবর ছিলেন একাধারে বীর সৈনিক ও সুচতুর রাজনীতিবিদ। শুধু তাই নয়—তিনি ছিলেন দার্শনিক এবং কবি। ফারসী ভাষায় লেখা তাঁর কবিতাগুলি সুন্দর। তুর্কি ভাষাতে গদ্য ও পদ্য রচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন তিনি। তিনি শিকারে পারদর্শী ছিলেন। উদ্যান রচনায় তাঁর অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হতো। তিনি পুষ্প-বিলাসী ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেই অনেক সময় ফুলের বাগানে প্রবেশ করতেন এবং একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। তাঁর লেখায় যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনার পাশেই ফুলের বিবরণ দেখা যায়।
তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি ব্যবহার প্রীতিপূর্ণ ছিল। বীর ছিলেন, কিন্তু নির্মম ছিলেন না তিনি। শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করতে জানতেন। প্রবল সন্তান বাৎসল্য তাঁর চরিত্রের একটি বিশেষত্ব। নিজের জীবনের বিনিময়ে তিনি ভগবানের কাছে পুত্র হুমায়ুনের রোগমুক্তি কামনা করেন। জনশ্রুতি তাঁর এই প্রার্থনার ফলে হুমায়ূন আরোগ্য লাভ করেন। কিন্তু বাবরকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।