দুই

পিতার সঙ্গে আলেখ্য জীবনে এই প্রথম তাহার স্বর্গীয় পিতামহগণের পল্লীবাসভবনে আসিয়া উপস্থিত হইল। বয়স তাহার বেশী নয়, তথাপি এই বয়সেই সে তিনবার য়ুরোপ ঘুরিয়া আসিয়াছে। দার্জিলিং ও সিমলার পাহাড় বোধ করি কোন বৎসরেই বাদ পড়ে নাই; চা ও ডিনারের অসংখ্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়াছে এবং মা বাঁচিয়া থাকিতে নিজেদের বাটীতেও তাহার ত্রুটিহীন বহু আয়োজনে যোগ দিয়াছে। গান-বাজনার মজলিস হইতে শুরু করিয়া খেলাধূলা ও সাধারণ সভা-সমিতিতে কিভাবে চলাফেরা করিতে হয়, সোসাইটিতে কেমন করিয়া কথাবার্তা কহিতে হয়, কোথায়, কবে এবং কোন্‌ সময়ে কি পোশাক পরিতে হয়, কোন রং, কোন্‌ ফুল কখন কাহাকে মানায়, এ-সকল ব্যাপার সে নির্ভুলভাবে শিক্ষা করিয়াছে; রুচি ও ফ্যাশন সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিবার বাকি কিছু আর তাহার নাই, শুধু কেবল এই খবরটাই সে এতকাল লয় নাই, এ-সকল কোথা হইতে এবং কেমন করিয়া আসে। মা ও মেয়ে এতদিন শুধু এতটুকু মাত্র জানিয়াই নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, বাংলাদেশের কোন্‌ এক পাড়াগাঁয়ে তাহাদের কল্পবৃক্ষ আছে, তাহার মূলে জলসেক করিতে হয় না, খবরদারি লইতে হয় না, শুধু তাহাতে সময়ে ও অসময়ে নাড়া দিলেই সোনা ও রূপো ঝরিয়া পড়ে। জননী ত কোনদিনই গ্রাহ্য করেন নাই, কিন্তু আলেখ্য কখন কখন যেন লক্ষ্য করিয়াছে, এই বিপুল অপব্যয়ের যোগান দিতে পিতা যেন মাঝে মাঝে কেমন একপ্রকার বিরস ম্লান ও অবসন্ন হইয়া পড়িতেন। তাহাকে এমন আভাস দিতেও সে দেখিয়াছে বলিয়াই মনে পড়ে, যেন এতখানি বাড়াবাড়ি না হইলেই হয় ভাল। অথচ প্রত্যুত্তরে মায়ের মুখে কেবল এই কথাই সে শুনিয়া আসিয়াছে যে, সমাজে থাকিতে গেলে ইহা না করিলেই নয়। শুধু অসভ্যদের মত বনে-জঙ্গলে বাস করিলেই কোন খরচ করিতে হয় না।

পিতাকে প্রতিবাদ করিতে কখন দেখে নাই,—কিন্তু চুপ করিয়া এমন নির্জীবের মত বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছে যে, ধুমধামের মাঝখানে গৃহকর্তার সে আচরণ একেবারেই বিসদৃশ। কিন্তু সে ত ক্ষণিকের ব্যাপার, ক্ষণকাল পরে সে ভাব হয়ত আর তাঁহাতে থাকিত না।

বিশেষতঃ তখনও কত আয়োজন, কত কাজ বাকী,—নিমন্ত্রিতগণের বাড়ি ও মোটর আসিবার মুহূর্ত আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে—সে লইয়া মাথাব্যথা করিবার সময় ছিলই বা কৈ? এমনি করিয়াই এই মেয়েটির ছেলেবেলা হইতেই এতকাল কাটিয়াছে এবং ভবিষ্যতের দিনগুলাও এমনিভাবেই কাটিবার মত করিয়াই মা তাহার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করিয়া গিয়াছেন।

দিন-চারেক হইল, তাঁহারা এখানে আসিয়াছেন। জমিদারের বাড়ি, বড়লোকের বাড়ি,—বড়লোকের জন্যই নূতন করিয়া নির্মিত হইয়াছিল, কোথাও কোন ত্রুটি নাই, তথাপি কত অভাব, কত অসুবিধাই না আলেখ্যের চোখে পড়িতেছে। বসিবার ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘরগুলার আগাগোড়া পেণ্টিং নূতন করিয়া না করাইলে ত একটা দিনও আর বাস করা চলে না। দরজা-জানালার কদর্য রং বদল না করিলেই নয়। আসবাবগুলা মান্ধাতার কালের, না আছে ছাঁদ, না আছে তাহার শ্রী, ধূলায় ধূলায় বার্নিশ ত না থাকার মধ্যেই, সুতরাং এ বাটীতে থাকিতে হইলে এ সকলের প্রতি চোখ বুজিয়া থাকা অসম্ভব। যেমন করিয়া হউক, চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে হইবে না। এই প্রস্তাব লইয়া সেদিন সকালে আলেখ্য তাহার পিতার দরবারে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাবা একজন অল্পবয়সী অধ্যাপক ব্রাহ্মণের সহিত বসিয়া গল্প করিতেছিলেন, মেয়ের সহিত তাঁহার পরিচয় করিয়া দিতে কহিলেন,—ইনি আমাদের পুরোহিত বংশের দৌহিত্র, অমরনাথ ন্যায়রত্ন, আমাদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত বরাট গ্রামে এঁর পৈতৃক টোলে অধ্যাপনা শুরু করেছেন,—ইনি আমার কন্যা আলেখ্য রায়,—মা, এঁকে প্রণাম কর।

আদেশ শুনিয়া আলেখ্যের গা জ্বলিয়া গেল। একে ত একান্ত গুরুজন ব্যতীত ভূমিষ্ঠ প্রণাম করার রীতি তাহাদের সমাজে নাই বলিলেই হয়, তাহাতে আবার এই অপরিচিত লোকটি পুরোহিত-বংশের। এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সে শিশুকাল হইতে সংখ্যাতীত অভিযোগ শুনিয়া আসিয়াছে; ইহাদের অন্ধতা ও অজ্ঞতা ও নিরতিশয় সঙ্কীর্ণতাই যে দেশের সকল অনিষ্টের মূল, ইহাদের প্রতিকূলতার জন্যই যে তাহারা হিন্দু-সমাজে স্থান পায় না, সেই বিশ্বাসই তাহার মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া আছে, এখন তাহাদেরই একজন অজানা ব্যক্তির পদতলে কিছুতেই তাহার মাথা হেঁট হইতে চাহিল না। সে হাত তুলিয়া ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিয়া কোনমতে তাহার পিতৃ-আজ্ঞা পালন করিল।

কিন্তু এতটুকু তাহার চক্ষু এড়াইল না যে, সে ব্যক্তি নমস্কার তাহার ফিরাইয়া দিল না, শুধু নীরবে একদৃষ্টে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। আলেখ্য পলকমাত্র তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল। সে পিতার সঙ্গেই কথা কহিতে আসিয়াছিল,—সুতরাং যে অপরিচিত, তাহাকে অপরিচিতের মতই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া দিয়া তাঁহার সঙ্গেই কথা কহিতে নিরত হইল, তথাপি সকল সময়েই সে যেন অনুভব করিতে লাগিল, এই অপরিচিত অধ্যাপকের অভদ্র বিস্মিত দৃষ্টি তাহাকে পিছন হইতে যেন নিঃশব্দে আঘাত করিতেছে।

আলেখ্য কহিল—বাবা, ঘরগুলো সব কি হয়ে আছে, তুমি দেখেছ?

পিতা কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন—কেন মা, বেশ ভালই ত আছে।

কন্যা ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিল। কহিল—ওকে তুমি ভাল বল বাবা? বিশেষ করে বসবার আর খাবার ঘর দুটো? আমার ত মনে হয়, তাড়াতাড়ি একবার পেণ্ট করিয়ে না দিলে ওতে না-বসা, না-খাওয়া কোনটাই চলবে না। আচ্ছা, লোকগুলো তোমার এতদিন করছিল কি? আমার মতে এদের সব জবাব দেওয়া দরকার। পুরানো লোক দিয়ে হয় না,—তারা শুধু ফাঁকিই দেয়।

পিতা মাথা নাড়িয়া সায় দিলেন, কিন্তু আস্তে আস্তে বলিলেন—সে ঠিক কথাই বটে, কিন্তু হলোও ত অনেকদিন মা,—বাস না করলেও ঘরদোরের শ্রী থাকে না।

আলেখ্য কহিল—সে শ্রী অন্যরকমের, নইলে এ কেবল তাদের অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়েছে। আমি ম্যানেজার থেকে চাকর মালী পর্যন্ত সকলের কৈফিয়ত নেবো। দোষ পেলেই শাস্তি দেবো, বাবা, তুমি কিন্তু তাতে বাধা দিতে পারবে না।

পিতা হাসিয়া কহিলেন—বাধা দিতে যাব কেন মা, সমস্তই ত তোমার। তোমার ভৃত্যদের তুমি শাসন করবে, আমি কেন নিষেধ করব? বেশ জানি, অন্যায় তুমি কারও ‘পরেই করবে না।

কন্যা মনে মনে খুশী হইল। কহিল—ফার্‌নিচারগুলোর দশা এমন হয়েছে যে, সেগুলো ফেলে দিলেই হয়। চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে বোধ করি কিছুই করতে পারা যাবে না।

—এত টাকা? বৃদ্ধ শঙ্কিত হইয়া কহিলেন—কিন্তু এ জঙ্গলে তুমি ত থাকতে পারবে না আলো, দু’দিনের জন্যে খরচ করে সমস্তই আবার এমনি ধারা নষ্ট হয়ে যাবে।

আলেখ্য মাথা নাড়িল। কহিল—আমি স্থির করেছি বাবা, এবার আমরা থাকবো। যদি যেতেও হয়, বছরে অন্তত: দু’বার করে আমরা বাড়িতে আসবই। চোখ না রাখলে সমস্তই নষ্ট হয়ে যাবে, এ আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি।

পিতা প্রফুল্লমুখে বারবার মাথা নাড়িয়া বলিলেন—এতকাল পরে এ কথা যদি বুঝে থাক আলো, তার চেয়ে সুখের কথা আর কি আছে?—এই বলিয়া অধ্যাপকটিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—কি বল অমরনাথ, এতদিনে মেয়ে যদি এ কথা বুঝে থাকেন, তার চেয়ে আনন্দের কথা কি আছে?

অধ্যাপক হাঁ না কোন মন্তব্যই প্রকাশ করিলেন না, কিন্তু কন্যা হাসিয়া কহিল—আমার বুঝতে ত খুব বেশীদিন লাগেনি বাবা, লাগলো তোমার। বছর দশ-পনর আগেও যদি বুঝতে, আজ আমাকে আবার সমস্ত নূতন করে করতে হ’ত না।

কন্যার ইচ্ছাকে বাধা দিবার শক্তি বৃদ্ধের ছিল না। কিন্তু তাঁর মুখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝা গেল, তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছেন। কহিলেন—যদি করতেও হয়, তার তাড়াতাড়ি কি? ধীরেসুস্থে করলেও ত চলবে।

মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া বলিল—না বাবা, সে হয় না। এই বলিয়া সে তাহার হাতের একখানা ইংরাজি উপন্যাসের পাতার ভিতর হইতে খুঁজিয়া একখানা টেলিগ্রাম পিতার হাতে তুলিয়া দিল। তিনি পকেট হইতে চশমা বাহির করিয়া কাগজখানি আদ্যোপান্ত বার দুই-তিন পাঠ করিয়া, কন্যাকে ফিরাইয়া দিয়া ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—তাই ত ! কমলকিরণ তাঁর মা ও ভগিনীকে নিয়ে কলকাতায় আসছেন, সম্ভবত: ঘোষ-সাহেবও আসতে পারেন। কি নাগাত তাঁরা এ বাড়িতে আসবেন, কিছু জানিয়েছেন?

মেয়ে কহিল—কলকাতায় এসে বোধ হয় জানাবেন।

রে-সাহেব চশমা খুলিয়া খাপে পুরিয়া পকেটে রাখিলেন, সমস্ত মাথাজোড়া টাকের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে বুলাইতে শুধু বলিলেন—তাই ত—

তাহার অকালবৃদ্ধ পিতার অসচ্ছলতার পরিমাণ ঠিক না জানিলেও আলেখ্য কিছুদিন হইতে তাহা সন্দেহ করিতেছিল; এবং হয়ত, এখনই এ লইয়া আলোচনাও করিত না, কিন্তু তিনি নিজেই জিজ্ঞাসা করিলেন—কত টাকা তোমার আবশ্যক বলে মনে হয়, আলো? নিতান্তই যা না হলে নয়, এমনি—

আলেখ্য মনে মনে হিসাব করিয়া কহিল—দাম ঠিক বলতে পারব না বাবা, কিন্তু গোটা-চারেক শোবার ঘর অন্তত: চাই-ই। গোটা-চারেক ড্রেসিং টেবল্‌, গোটা-দশেক ইজিচেয়ার—

সাহেব সভয়ে বলিয়া উঠিলেন—গোটা-দশেক! একটুখানি থামিয়া অধ্যাপকের প্রতি মুখ তুলিয়া কহিলেন, অমরনাথ, তোমার বিদেশী ছাত্রদের সম্বন্ধে—দেখ, আমি বিশেষ দুঃখিত হয়ে জানাচ্ছি, সাহায্য যে কিছু করে উঠতে পারবো, তা আমার মনে হয় না।

অধ্যাপক শুধু একটু মুচকি হাসিয়া কহিলেন—সে আমারও মনে হয় না, রায়-মশায়।

ক্রোধে আলেখ্যের সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। তাহাদের পারিবারিক আলোচনার সূত্রপাতেই যে অপরিচিত অভদ্র লোকটার সরিয়া যাওয়া উচিত ছিল, সে শুধু কেবল বসিয়াই রহিল তাহা নয়, প্রকারান্তরে তাহাতে যোগ দিল, সে-ও আবার বিদ্রূপের ভঙ্গীতে। বিশেষ করিয়া পিতার প্রতি তাহার সম্বোধনের ভাষাটা মেয়ের কানে যেন সূঁচ বিঁধিল। ইহা সত্ত্বেও কিন্তু আলেখ্যের চিরদিনের শিক্ষা তাহাকে অসংযত হইতে দিল না, সে বাহিরের এই ভিক্ষুকটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া দিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল—না হলে হবে কেন বাবা? তা ছাড়া খাটের গদিগুলো সব মেরামত করানো চাই; ঘরে কার্পেট নেই, তাও কিনতে হবে, চা এবং ডিনার সেট সব আনিয়ে দিতে হবে, হয়ত তিন-চার হাজারেও কুলোবে না, আরও বেশী টাকার দরকার হয়ে পড়বে।

বৃদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া কহিলেন—সেইরকমই মনে হচ্ছে বটে।

এত বড় নিশ্বাসের পরে মেয়ের পক্ষে হাসা কঠিন, তবুও সে জোর করিয়াই হাসিয়া বলিল—যে সমাজের যে-রকম রীতি। তাঁরা এলে তুমি ত আর রাইট রয়েল ইন্ডিয়ান স্টাইলে ভাঁড় এবং কলাপাত দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করতে পারবে না, ইজিচেয়ারের বদলে কুশাসন পেতেও অতিথি-সৎকার চলবে না,—উপায় কি?

রে-সাহেব ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিলেন,—বেশ তাই হবে।

বাস্তবিক না হলেই যখন নয়, তখন ভাবনা বৃথা। তা হলে তুমি একটা ফর্দ তৈয়ারি করে ফেল।

আলেখ্য ঘাড় নাড়িয়া কহিল—আমি সমস্ত ঠিক করে নেব বাবা, তুমি কিছু ভেবো না।—একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার ভাবনার ত কিছুই ছিল না বাবা, শুধু যদি একটুখানি চোখ রাখতে।

পিতা কথা কহিলেন না। বোধ করি, মনে মনে এই কথাই ভাবিতে লাগিলেন যে, দুই চক্ষু ত এখন বিস্ফারিত হইয়াই খুলিয়াছে, কিন্তু দুশ্চিন্তার পরিমাণ তাহাতে কমিতেছে কৈ? মেয়ে কহিল—তোমাকে কিন্তু আমি আর সত্যিই কিছু করতে দেব না বাবা, যা-কিছু করবার, আমিই করব। কত অপব্যয়ই না এই দীর্ঘকাল ধরে নির্বিঘ্নে চলে আসছে। কিসের জন্য এত লোকজন? চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায় না, এমন বোধ হয় বিশ-পঁচিশজন কাছারি জুড়ে বসে আছে। আমরণ তারা কি ফাঁকি দিয়েই কাটাবে? আমি সমস্ত বিদায় দিয়ে ইয়ং মেন বহাল করব। ঠিক অর্ধেক লোকে ডবল কাজ পাব। কতগুলো ঠাকুরবাড়িই রয়েছে বল ত? কত টাকাই না তাতে বৃথা ব্যয় হয়। একা এর থেকেই ত বোধ হয় আমি বছরে দশ-বারো হাজার টাকা বাঁচাতে পারবো।

বৃদ্ধ বোধ করি এতক্ষণ তাঁহার আগচ্ছমান সম্মানিত অতিথিবর্গের কথাই চিন্তা করিতেছিলেন, এদিকে তেমন মন ছিল না, কিন্তু কন্যার শেষ কথাটা কানে যাইবামাত্র একেবারে চমকিয়া উঠিলেন। কহিলেন—কার থেকে বাঁচাবে বলছ মা, দেবসেবা থেকে? কিন্তু সে-সমস্ত যে কর্তাদের আমল থেকে চলে আসছে, তাতে হাত দেবে কি করে?

মেয়ে কহিল—কর্তারা নয় ত কি তোমাকে দোষ দিচ্ছি বাবা, তুমি নিজে কতগুলো পুতুলপূজো বসিয়েছ? অপব্যয়ের সূত্রপাত তাঁরাই করে গেছেন জানি, কিন্তু অন্যায় বা ভুল যাঁরাই কেন না করে থাকুন, তার সংশোধন করা ত প্রয়োজন? তোমার ত মনে আছে বাবা, মা তোমাকে কতদিন এই-সব বন্ধ করে দিতে বলেছেন।

পিতা চুপ করিয়া শুধু একদৃষ্টে কন্যার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সেই বিস্ময়ক্ষুব্ধ চোখের সম্মুখে আলেখ্য কেবলমাত্র যেন নিজের লজ্জা বাঁচাইবার জন্যই সহসা বলিয়া উঠিল—বাবা, তুমি কি এই-সব পুতুলপূজো বিশ্বাস কর?

পিতা কহিলেন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর ত এঁদের প্রতিষ্ঠা হয়নি মা !

কন্যা কহিল—তবে তুমি কেন এর ব্যয় বহন করবে, বাবা?

পিতা বলিলেন—আমি ত করিনে, আলো। যাঁরা মাথায় করে এনে স্থাপিত করেছিলেন, আমার সেই পিতৃপিতামহেরাই এখনো তাঁদের ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন। যে-সব পুতুল-দেবতাদের তুমি বিশ্বাস করতে পার না মা, তাঁদেরও বঞ্চিত করতে তোমাকে আমি দিতে পারব না।

প্রত্যুত্তরে আলেখ্য পিতার এই হীন দুর্বলতার একটা তীক্ষ্ণ জবাব দিতে যাইতেছিল, কিন্তু একান্ত বিস্ময়ে সে কথা ভুলিয়া গেল। যে অধ্যাপকটি এতক্ষণ নীরবে বসিয়া ছিল, অকস্মাৎ সে হেঁট হইয়া হাত দিয়া সাহেবের বুটের তলা হইতে ধূলা তুলিয়া লইয়া মাথায় দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যাপার কি হে, অমরনাথ? তুমি আবার এ কি করলে?

অমর সবিনয়ে কহিল—কিছুই না রায়-মশায়, এসে আপনাকে প্রণাম করা হয়নি, শুধু সেই ত্রুটিটা এখন সেরে নিলাম।

সাহেব বলিলেন—ত্রুটি কিসের হে, আমার মত লোককে তুমি প্রণাম করতে যাবে কিসের জন্যে? আমি ত ব্রাহ্মণই নয় বললে হয়।

অমর কহিল—সে আপনি জানেন, আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম মাত্র। অজ্ঞাতে কত ভুল, কত অন্যায়ই না মানুষের হয়।

বুড়া বোধ হয় বুঝিলেন না, বলিলেন—সে ত সর্বদাই হচ্ছে অমরনাথ, মানুষের ভুল-ভ্রান্তির কি আর সীমা আছে? কিন্তু আমাকে প্রণাম না করাটা তোমার ভুলের মধ্যে নয়,—আমি আর ওর যোগ্যই নয়।

অমরনাথ এ কথার প্রতিবাদ করিল না—কোন জবাবই দিল না। চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

কিন্তু চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না আলেখ্য। গায়ে পড়িয়া কথা কহা তাহার শিক্ষাও নয়, স্বভাবও নয়, কিন্তু তাহার বিস্ময়ের মাত্রা ক্রোধে পর্যবসিত হইয়া প্রায় অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কহিল—বাবা, এখন কিন্তু তোমার ওঁর বিদেশী ছাত্রদের সাহায্য না করলেই নয়।

ভালমানুষ বুড়া বিদ্রূপের ধার দিয়াও গেলেন না, আন্তরিক সঙ্কোচের সহিত কহিলেন—সাহায্য করাই ত কর্তব্য মা, কিন্তু তুমি কি মনে কর, এ সময়ে আমরা বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবো?

মেয়ে কহিল—সাহায্য যদি কর বাবা, একটু লুকিয়ে ক’রো। তোমার দেব-দ্বিজে ভক্তির কথা রাষ্ট্র হয়ে গেলে বিপদ হবে।

পিতা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন—বিপদ হবে?

অধ্যাপক হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন—বিপদ হবে না,—আপনি কোন ভয় করবেন না। ড্রেসিং টেব্‌ল্‌ আর কাঁটা-চামচে-ডিশের নীচে সমস্ত চাপা পড়ে যাবে।

আঘাত করিতে পাইয়া আলেখ্যের মনের তিক্ততা এই অপরিচিত লোকটির বিরুদ্ধে কতকটা ফিকা হইয়া আসিয়াছিল, কিন্তু অকস্মাৎ অপরের তীক্ষ্ণ পরিহাসের প্রতিঘাতে হঠাৎ সে যেন একেবারে ক্রুর হইয়া উঠিল। আলেখ্য সব ভুলিয়া প্রত্যুত্তরে কহিল, চাপা পড়তে পার বটে, কিন্তু বুটের ধুলোর দামটাও ত আপনাকে দিতে হবে!—কিন্তু বলিয়া ফেলিয়াই সে নিজেই যেন লজ্জায় একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। এতবড় নিষ্ঠুর কদর্য কথা যে কি করিয়া তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল, সে ভাবিয়াই পাইল না। রে-সাহেব অত্যন্ত বিস্ময়ে কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন। তিনি যত সাদাসিধাই হউন, এ কথার তাৎপর্য বুঝিতে পারিলেন। বেহারা আসিয়া স্মরণ করাইয়া দিল যে, ভদ্রলোকগুলি বাহিরের ঘরে বহুক্ষণ অবধি অপেক্ষা করিতেছেন।

বল গে যাচ্ছি, বলিয়া সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। শান্তকণ্ঠে কহিলেন,—কথাটা তোমার ভাল হয়নি আলো। অমরনাথ, তুমি একটু বসো, আমি এখনি আসছি।—এই বলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন। আলেখ্য তাঁহার পিছনে পিছনেই ঘর ছাড়িয়া যাইতে পারিল না। পিতা দৃষ্টির অন্তরালে যাইতেই নিরতিশয় লজ্জার সহিত আস্তে আস্তে কহিল—আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু নিজের ব্যবহারের জন্য আমি অতিশয় দুঃখিত। আমি স্বীকার করছি, আপনাকে ও-কথা বলা আমার ভাল হয়নি।

অধ্যাপক কহিলেন—না, ভাল হয়নি।

এই সোজা কথাটাও আলেখ্যের কিন্তু ভাল লাগিল না। সে এক মুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, পিতাকে মর্যাদা দেখালে কন্যার খুশী হবারই কথা। আমার বাবা অত্যন্ত ভালমানুষ, তাঁর সঙ্গে ছলনা কারও আপনার উচিত হয়নি।

অধ্যাপক কহিলেন—ছলনা ত করিনি!

আলেখ্য প্রশ্ন করিল—আড়ম্বর করে হঠাৎ পায়ের ধূলা নেওয়াই কি সত্য?

অধ্যাপক কহিলেন—সত্য বৈ কি।

আলেখ্য বলিল—তা হলে আমার আর কিছুই বলবার নেই। আমি ভুল বুঝেছিলাম।—এই বলিয়া সে চলিয়া যাইতেছিল, সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া কহিল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে। আপনার পুরোহিতের ব্যবসা, সুতরাং বাবার দুর্বলতায় আপনার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক, কিন্তু যাঁর ধর্মবিশ্বাস অন্য প্রকারের, ঠাকুর-দেবতা যিনি কোনদিন মানেন না, তাঁর পক্ষে এই অসত্যের প্রশ্রয় দেওয়া কি আপনিই অন্যায় মনে করেন না?

অধ্যাপক মাথা নাড়িয়া কহিলেন—না করিনে। অন্যায় কেবল সেইখানেই হ’ত স্নেহের দুর্বলতায় যদি তিনি আপনাকে প্রশ্রয় দিতেন—তাঁর নিজের অবিশ্বাস যদি তাঁর কর্তব্যকে ডিঙিয়ে যেতো।

অধ্যাপকের জবাবের মধ্যে খোঁচা ছিল। আলেখ্যর দুই ভ্রূ কুঞ্চিত হইল। কহিল—আপনার বক্তব্য এই যে, নিজের বিশ্বাস যার যেমনই হউক, যা চলে আসছে তাকে চলতে দেওয়াই কর্তব্য।

অধ্যাপক হাসিলেন, বলিলেন—আপনার ওটা বিলাতী ঢঙের অত্যন্ত মামুলি যুক্তি। নিজের বিশ্বাসের দাবী একটা আছেই, কিন্তু তার পরের কথা আপনি যখন জানেন না, তখন এ তর্কে শুধু তিক্ততাই বাড়বে, আর কোন ফল হবে না। কিন্তু সে যাক, ঠাকুরবাড়ির পুতুল-দেবতারা সত্যিই হোন, মিথ্যাই হোন, কথা যে কন না, এ কথা খুবই সত্য। তাঁদের অনাহারে রাখলেও তাঁরা আপত্তি করবেন না। কিন্তু এত টাকার বিলাতী আয়না এবং বিলাতী মাটির বাসন কিনলে যারা আপত্তি করবে, তারা কথাও কবে। হয়ত, খুব উঁচু গলাতেই কথা কবে। এ কাজ করবার চেষ্টা আপনি করবেন না।

এইবার তাঁহার সমস্ত কথার মধ্যেই এমন একটা তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত ছিল যে, আলেখ্য নিজেকে শুধু অপমানিত নয়, লাঞ্ছিত জ্ঞান করিল। এতক্ষণ পরে সে যথার্থই ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বারবার এই লোকটিকে নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার পরিধানের হাতের সূতার মোটা কাপড়, মোটা উত্তরীয় এবং খালি পা লক্ষ্য করিয়া অনুচ্চ কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করিল—আপনি বোধ হয় একজন নন-কো-অপারেটার, না?

অধ্যাপক কহিলেন—হাঁ।

এখানে বটুকদেব কার নাম জানেন?

জানি। আমারই ডাক-নাম।

আলেখ্য কহিল—তাই বটে! তা হলে সমস্তই বুঝেচি। কিন্তু জিনিস কেনা আমার কি করে বন্ধ করবেন? আমার প্রজাদের বোধ করি খাজনা দিতে নিষেধ করে দেবেন?

অধ্যাপক কহিল—অসম্ভব নয়। প্রজাদের অনেক দুঃখের টাকা।

আলেখ্য কহিল—কিন্তু তাতেও যদি বন্ধ না হয়, বোধ হয় ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করবেন?

অধ্যাপক কহিলেন—ভাঙ্গবো কেন, আপনাকে কিনতেই ত দেব না।

আলেখ্য ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া প্রবল চেষ্টায় ভিতরের দুঃসহ ক্রোধ দমন করিল। শান্তকন্ঠে কহিল— দেখুন, অমরনাথবাবু, এ বিষয়ে আমার শেষ কথাটা আপনি শুনে রাখুন। বাবা নিরীহ মানুষ, কিন্তু আমি নিরীহ নই। তা হলে আমার আসার প্রয়োজন হত না। আপনাদের নন্‌-কো-অপারেশন ভাল কি মন্দ, আমি জানিনে,—ভালও হতে পারে। কিন্তু আমার প্রজা, আমার আয়-ব্যয়, আমার সাংসারিক ব্যবস্থার সঙ্গে তার ধাক্কা বাধিয়ে দেবেন না। পুলিশকে আমি ভালবাসি নে, তাদের দিয়ে দেশের লোককে শাস্তি দিতে আমার কষ্ট হয়, কিন্তু আমার হাত-পা বেঁধে দিয়ে আমাকে নিরুপায় করে তুলবেন না।—এই বলিয়া সে উত্তরের জন্য অপেক্ষামাত্র না করিয়াই দ্রুতবেগে চলিয়া যাইতেছিল, অমরনাথ ডাকিয়া কহিলেন—কিন্তু এমন যদি হয়, আপনি অন্যায় করছেন?

আলেখ্য দ্বারের কাছে থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আপনার সঙ্গে ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা আমার এক না-ও হতে পারে।—এই বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল। যে রহিল, সে শুধু অবাক হইয়া সে মুক্ত দ্বারের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।