(রূপক)

ত্রিপদী

দ্বিযাম যামিনী যায়,    আ মরি কি শোভা তায়,
নিরখি নির্ম্মল নদী তীরে।
নিরমল নীলাকাশ,       সীমা বিনা সুপ্রকাশ,
মাঝে হেরি মধুর শশিরে ||
যেন কোন নব বালা,        পাইয়া বিরহ জ্বালা,
মলিনতা মধুর বদনে।
গগন গহন বনে,            মনোদুখে মরি মনে,
ভ্রমিতেছে গজেশ গমনে ||
সেই রূপ মনোহর,         রূপ ধরি শশধর
আলো করে ধরণী আকাশ।
গগনের যত তারা,        হইয়াছে কর হারা,
অল্প তারা আকাশ প্রকাশ ||
মাঝে মাঝে শশধরে     ঢাকে ক্ষীণ জলধরে,
মরি যেন নাথ দরশনে।
রহি গুরুজন মাঝে,     মোহিনী মহিলা লাজে,
ঢাকা দেয় বদন বসনে ||
চন্দ্রিকা বসন পরা,        গভীর নিশীথে ধরা,
মোহ মন্ত্রে যেন নিদ্রা যায়।
ঘোর স্তব্ধ ত্রিভুবন,        দেখিয়া চাহিছে মন,
আরাধিতে অচিন্ত্য স্রষ্টায় ||
শুধু হয় শব্দ তায়,         পরশি নিকুঞ্জ গায়,
চলিছে সমীর মৃদু স্বরে।
পূর্ণ নদী স্থির নীরে,       শুধু শব্দ ধীরে ধীরে,
মধুর মলয় মন্দ করে ||
আহা মরি মরি কি রে,     এমন নদীর তীরে,
কে রে শত শোভা ধরি বসি।
বুঝি এ বিরহ লাগি,        প্রণয়িনী অনুরাগী
যুবক জনেক যেন শশী ||

তৃণের কুসুম কুঞ্জ,         ললিতা লতিকা পুঞ্জ,
ঘেরি তারে বারি ধারে রয়।
যেমন মলিন শশী,         মলিন বদনে বসি,
দীর্ঘশ্বাসে বিদরে হৃদয় ||
আঁখি হতে বারে বারে,   ধারা বহে ধারে ধারে,
তাহাতে কতই শোভা ধরে।
যেন সে নয়ন জলে,     শশী পশি ছায়া ছলে,
চুম্বন গণ্ডেতে তার করে ||
নিরখি নয়ন ভরি,       মধুর চন্দ্রমাপরি,
শেষে শশী সম্বোধিয়া কয়।
আরে মনোহর শশী,    গগন মণ্ডলে পশি
পার যেতে ত্রিভুবন ময় ||
তাই বলি শশধর,        আমার বচন ধর,
যাও সেই মোহিনীর কাছে।
যার তরে আশা পথে    আরোহিয়া মনোরথে,
আগে মোর পরাণ গিয়াছে ||

পয়ার

কিন্তু রে কি হেরি তোর, হৃদয় মাঝায়।
কি রে সে কালীর রেখা, লেখা দেখা যায় ||
বুঝি মম মনোরমা, ভাবিয়া আমায়।
আসিবার কথা লিখে, দেছে তোর গায় ||
না রে আর কেন মজি, মিছার স্বপনে।
জানি ভাল ভাবে না সে, অনুগত জনে ||

ত্রিপদী

বুঝি মোর দুখে দুখী,     নাহি দেখি বিধুমুখী,
বুঝি চাঁদ করেছ রোদন।
হৃদয়েরি রেখাচয়,       আঁখি ধারা চিহ্ন রয়,
ও যে নহে কলঙ্ক কখন ||
বুঝি তারি দেখা তরে,      আকাশ রোদন করে,
তারারূপ সহস্র নয়নে।
নীহার নয়ন ধারে,      ফেলিছে যতেক তারা,
শত শত বিন্দু বরিষণে ||

তাই বলি নিশাপতি,    রতনে যতনে অতি,
ঝটিতি কর হে দরশন।
এই ভাষা কহ গিয়ে,  আশা বিনে ফাটে হিয়ে,
তার লাগি মলো একজন ||

পয়ার

শশি হে বসিয়ে আর, বিলম্ব না কর।
এমন অচল কেন, রও শশধর ||
বুঝেছি বুঝি হে তব, যেই ভাব মনে।
যে কারণে যেতে নারো, নারী নিকেতনে ||
মোহিনীর মুখ রূপ, করি দরশন।
কত লাজ কত জ্বালা, পেয়েছ তখন ||
তত আর নাহি দুখ, অদর্শনে।
সুখেতে আকাশ মাঝে, প্রকাশ আপনে ||
সাধেতে সাধিতে বাদ, আপনার প্রতি।
যাবে না যামিনীনাথ, যথায় যুবতী ||
ইহা যদি নিশানাথ, না মান আপনি।
আদি অন্ত জানি আমি, বলিব এখনি ||

চৌপদী

ললনা লপনে লাজ,       পেয়ে মানে দ্বিজরাজ,
লুকালে মেঘের মাঝ,     ঘোমটা ধরিয়া রে।
এই কথা মূঢ়ে কয়,       তাই অমানিশা হয়,
কেহ কহে তাহা নয়,     গিয়াছে মরিয়া রে ||
মহিলার মুখাকারে,       অভিমানে আপনারে,
একেবারে নাশিবারে,     গমন করিয়া রে।
মহেশ ললাট স্থলে,      ধিকি ধিকি বহ্নি জ্বলে,
ঝাঁপ দিলে সে অনলে,    পরাণ হরিয়া রে ||
বিমল বারিধি জলে,       ডুবেছিলে কেহ বলে,
মূঢ়ে বলে বারি তলে,     ছায়া সে পড়িয়া রে।
ভয় এই পাছে তায়,       কামিনী তথায় যায়,
ছিলে কম্পমান কায়,      সলিলে লভিয়া রে ||

পরেতে জানিয়া ভাল,     করিছে বিরহ কাল,
কামিনী বদন কাল,        তাই ফিরে আইলে।
ফিরে এলে সিন্ধু হতে,     বলে নর শতে শতে,
যে তুমি এমনি মতে,      সমুদ্রে জন্মাইলে ||
বিধু মুখ মহিলার,         দেখ নাহি ফিরে বার,
নাহি দেখি শোভা তার,   আজো না পলাইলে।
যেতে বলি যতবার,      তত কর অস্বীকার,
বুঝেছি কারণ তার,      জ্বালা পাবে যাইলে।

পয়ার

নাহি ডর শশধর, ধর হে বচন।
চরণে শরণ তার, করিও গ্রহণ।
প্রমদার পদতলে, পড়ি নিরন্তর।
তোমার সদৃশ আছে, দশ শশধর ||
বিশেষতঃ পদ যদি, না পড় প্রথমে।
মুখের সম্মুখে কথা, কহ যদি তমে ||
তখনি ঘটিবে কুহু, যেন নিশাকর।
ললনা ললাটে আছে, সিন্দূর ভাস্কর ||

ত্রিপদী

তাহে যদি বল তবে,     কেন দিন-পতি রবে,
ললনার ললাট উপর।
প্রেয়সীর পদদ্বয়,         সদা কিবা শোভা হয়,
যুগল কমল মনোহর ||
নখর নিকর তায়,        শশী সম শোভা পায়,
কমলের কোলে শশধর।
ক্রোধে রক্ত দিবাপতি,     জানিল অসতী অতি,
পদরূপা নলিনী নিকর ||
ঠেকে শিখে নারী রীতে,   আর পদ্ম আগুলিতে,
বদন কমল কামিনীর।
সিন্দূর বিন্দুর রূপ,          নারী মুখে অপরূপ,
দিনেশ বসিল হয়ে স্থির ||
যদি বল কি প্রকারে,     চিনিবে তুমি হে তারে,
দেখ নাই আগে তো সে জনে।
জান যদি আপনার,          কুমুদিনী প্রেমাধার,
তারে তবে চিনিবে নয়নে ||

চৌপদী

যাও যাও সুধাকর,    কেন হে বিলম্ব কর,
একবার শশধর,       যাও যাও যাও রে।
প্রাণের প্রেয়সী পাশে,  বল গিয়ে যদি আসে,
ধরিব পরাণ পাশে,    বধিও না তাও রে ||
নহে রহে এই স্থলে,   অহরহ কোন ছলে,
যেও না হে অস্তাচলে,  এই ভিক্ষা দাও রে।
মোহিনীর মুখ তোরে,  জ্ঞান করি প্রেম ডোরে,
বাঁধিয়া বাঁচাব মোরে,   যেও না কোথাও রে ||
মনে হয় সে রজনী,     যখন রমণী মণি,
অধরে অধরে ধনী,     ধরিল আমায় রে।
সে কি এই নদী তীরে,  এই সে নিকুঞ্জ কি রে,
তোরি তরে কলঙ্কী রে, দেখেছি কি তায় রে |‎|
হা নিকুঞ্জ মনোহর,     হা মধুর শশধর,
হে তটিনী স্থিরতর,    ধরি সবে পায় রে ||
ফিরে দেখা একবার,   মোহিনী মধুরাকার,
একবার দেখা আর,    হৃদি ফেটে যায় রে ||
ফিরে দরশন কর,     তটিনীর তটোপরি,
চম্পকের শাখা ধরি,   আমা পানে চায় রে।
কি শুনি কি শুনি মরি, মোহন স্বরেতে করি,
কে রে মোর নাম ধরি, ডাকিল কোথায় রে ||
বুঝি মোর প্রাণেশ্বরী,   এহো অনুগতে স্মরি,
রাখি গে হৃদয়োপরি,    আঁখি আঁখি করি রে।
না রে মিছে কেন আর, স্বপ্ন দেখে বারে বারে,
মজি সুখে মিছে কার,   যাতনায় মরি রে ||
নাহিক কপাল তার,      প্রাণেশ্বরী পাইবার,
এত আশা অভাগার,     সম্বরি সম্বরি রে।
যত সুখ আশা আর,     সব করি পরিহার,
শেষ আসা আশা সার,    তা কিসে পাসরি রে ||
যদিও জানি রে মনে,     পাইব না প্রিয়জনে,
গোপনেতে প্রাণপণে,      তবু আশা ধরি রে।
যদ্যপি স্বপ্নে বা ভ্রমে,     ছায়া সুখে কোন ক্রমে,
পাই যদি প্রিয়তমে,     হৃদয় ভিতরি রে ||
দারুণ বিধির বিধি         চেতনে হরিল নিধি,
জ্বালা জ্বালাইল বিধি,      মরি মরি মরি রে।
কিন্তু আশা পাছে আছে,   তাই চাঁদ তোর কাছে,
যেতে বলি যথা আছে,      আমার সুন্দরী রে ||
-‘সংবাদ প্রভাকর’, ৩০ মার্চ্চ, ১৮৫৩

Leave a Reply