» » দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

বনহুরের আদেশে রহমান তার সমস্ত অনুচরকে ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দিল। চৌধুরী মাহমুদ খান সাহেবের কন্যা মনিরাকে খুঁজে বের করতেই হবে। যে তাকে খুঁজে বের। করতে সক্ষম হবে, সে সর্দারের অত্যন্ত প্রিয় হবে এবং তাকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

বনহুরের অনুচরগণ কথাটা শুনে খুশিতে আত্মহারা হল। তেমনি অবাকও হলো তারা। চৌধুরী মাহমুদ খানের কন্যার জন্য আমাদের সর্দারের এত চিন্তা কেন? কথাটা তাদের মনে অনেক রকম প্রশ্ন জাগাল, কিন্তু কেউ সমাধান খুঁজে পেল না।

নূরীও কথাটা শুনে অবাক হলো। ধনবান চৌধুরী মাহমুদ খানের নাম সে অনেক শুনেছে। বনহুরের আংগুলে এখন চৌধুরী কন্যা মনিরার হাতের আংটি শোভা পাচ্ছে। বনহুর নূরীকে না। দিয়েছে এমন কিছুই নেই, কিন্তু ঐ আংটিটি আজও বনহুর তাকে দিল না। আংটি সম্বন্ধে নূরীও সে জন্য আর কোন কথা বলেনি, যদিও একদিন এই আংটি সম্বন্ধে তার অনেক কৌতূহল ছিল। আজ আবার সেই আংটির কথা স্মরণ হলো তার। তবে কি এর পেছনে কোন রহস্য আছে? নূরী। লক্ষ্য করেছে-বনহুর মাঝে মাঝে নির্জনে বসে এই আংটির দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার পদশব্দে চমকে উঠতো, সজাগ হয়ে ফিরে তাকাত নূরীর দিকে।

নূরী কিছু জিজ্ঞাসা করলে হেসে বলতো কিছু না। ।

এর বেশি কোন দিন কিছু জানতে পারেনি নূরী। আজ সেই চৌধুরী কন্যার জন্য বনহুরের এত মাথাব্যথা কেন?

বনহুর শিকারীর ড্রেসে সেই যে বেরিয়ে গেছে এখন সন্ধ্যা হয়ে এলো, তবু ফিরে এলো না। নূরী অস্থিরচিত্তে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে–কখন ফিরে আসবে বনহুর।

ক্রমে রাত বেড়ে আসছেনূরী দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় উন্মাদিনীর ন্যায় হয়ে পড়ে। সবচেয়ে তার আপনজন বনহুর–তার ধ্যান-জ্ঞান স্বপ্ন-সাধনা সব। বনহুরকে নূরী নিজের জীবন অপেক্ষা বেশি ভালবাসে।

এক সময় নূরী রহমানের খোঁজে বনহুরের গোপন দরবার কক্ষের দিকে এগুলো হয়তো রহমান সেখানেই রয়েছে। কিন্তু নূরী আশ্চর্য হলো-দরবারকক্ষের আশে পাশে আজ কেউ নেই। শুধু দু’জন রাইফেলধারী দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। তাদের কোন প্রশ্ন করা নিরর্থক, কারণ তারা এসবের কিছুই জানে না। নূরী বিমর্ষ মনে ফিরে এলো নিজের কক্ষে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে তার মন টিকলো না। আবার ছুটে গেল সে বনহুরের কক্ষে। ওর শূন্য বিছানায় বসে চোখের পানি ফেলল। বনহুরের রিভলবার খান বুকে চেপে ধরে ওর স্পর্শ অনুভব করতে চাইল।

এমন সময় নূরীর কানে তাজের খুড়ের শব্দ এসে পৌঁছলো নিশ্চয়ই বনহুর ফিরে এসেছে। সে দ্রুত ছুটলো বাইরে।

ক্রমে অশ্বপদশব্দ নিকটবর্তী হচ্ছে। নূরী উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল বনহুরের।

অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজের পিঠে বনহুর এসে পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে নূরী হাত বাড়িয়ে তাজের লাগাম চেপে ধরল। বনহুর ততক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছে।

বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে নূরী চট করে কিছু বলতে পারল না। আজ তার কেমন যেন এক উন্মত্ত চেহারা। নূরীর সঙ্গে কোন কথা না বলেই বনহুর এগুলো দরবারকক্ষের দিকে। নূরী তাকে নীরবে অনুসরণ করল।

দরবারকক্ষের দরজায় পৌঁছে মেঝের এক স্থানে পা দিয়ে চাপ দিল বনহুর সঙ্গে সঙ্গে দু’টি লোক ছুটে এলো–সর্দার! কুর্ণিশ করে দাঁড়াল তারা।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–রহমান ফিরে এসেছে?

লোক দুটির একজন জবাব দিল–না সর্দার, তারা কেউ এখনও ফিরে আসেনি।

এলেই তাকে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে বলবে–যাও। বনহুর কথাটা বলে বিশ্রামকক্ষের দিকে এগুলো।

নূরী নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখছে।

বনহুর যখন বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলো তখন নূরী তার পাশে যাবে কিনা ভাবছে। মনকে সে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। আবার ভয়ও হচ্ছে-হঠাৎ যদি বনহুর তাকে কিছু বলে বসে। নূরী তবু কক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর কক্ষে পায়চারী করছে।

নূরী একপাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো–হুর, আজ তোমার কি হয়েছে?

বনহুর পায়চারী বন্ধ করে ফিরে তাকালো নূরীর দিকে, তারপর শয্যায় গিয়ে বসলো।

নূরীঃ গিয়ে বসল তার পাশে। এমনি কতদিন বনহুর নানা কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে– নূরী দিয়েছে সান্ত্বনা, মিষ্টি হাসিতে তার মনের দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করেছে সে। আজও হেসে নূরী বলে–হুর, কি হয়েছে তোমার, বল না?

বনহুর স্থির দৃষ্টি মেলে তাকাল নূরীর দিকে, তারপর বলল–আমার একটি জিনিস হারিয়ে গেছে।

জিনিস হারিয়ে গেছে?

ঠিক হারিয়ে নয়, চুরি গেছে।

চুরি গেছে! কি এমন মূল্যবান জিনিস যার জন্য তুমি এত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছ হুর?

সে তুমি বুঝবে না নূরী।

হুর, তোমার মনের ব্যথা আমি সব বুঝি। এই সামান্য কথা আমি বুঝি না। কি এমন জিনিস হারিয়েছে, যার জন্য তুমি লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছো?

কে বললো আমি লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছি?

নূরী কোন জবাব দিল না, কারণ সে সব শুনেছে। বনহুর যে চৌধুরী কন্যার জন্য আজ উন্মাদের মত হয়ে পড়েছে, এ কথা বনহুর তাকে না বললেও অনুমানে বুঝতে পেরেছে নূরী। মনের মধ্যে তার একটা জ্বালা ধরে গেছে। সে ভাবতেও পারে না তার হুর আর কোন নারীকে ভালবাসতে পারে।

একটা ঢোক গিলে জবাব দেয় নূরী, সত্য কোনদিন গোপন থাকে না হুর, চৌধুরী কন্যার জন্য তোমার এত দরদ কেন বলতো?

বনহুর স্তব্ধ চোখে তাকাল নূরীর দিকে। নিঃশ্বাস যেন দ্রুত বইছে ওর। দু’চোখে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে।

নূরী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে–তুমি কিছু না বললেও আমি সব শুনেছি, সব জানি। চৌধুরীকন্যার জন্যই আজ তুমি উন্মাদ। তোমার সেই মূল্যবান হারিয়ে যাওয়া জিনিসটি অন্য কিছু নয় সেই যুবতী।

বনহুর নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছে নূরীর কথাগুলো।

নূরী আজ আর থামতে চায় না, ক্ষিপ্তের ন্যায় বলে চলে, হুর তুমি না দস্যু? দস্যু হয়ে একটা যুবতীর প্রেমে…।

চিৎকার করে ওঠে বনহুর–নূরী।

তুমি আমাকে ক্ষান্ত করতে পারবে না হুর। আমার গলা ছিঁড়ে ফেললেও আমার কণ্ঠ স্তব্ধ হবে না। না না, আমি তোমাকে কিছুতেই অন্য কোন নারীকে ভালবাসতে দেব না..নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে-কিছুতেই না। আমি সব সহ্য করতে পারবো হুর, কিন্তু তোমাকে হারানোর ব্যথা সহ্য করতে পারব না। আমি তোমাকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসি।

বনহুর গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলো পাশের দেয়ালে। নূরী তার বুকে মুখ লুকিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠল–হুর, তুমিই যে আমার জীবনের সব।

এমন সময় বাইরে পদশব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই ভেসে এলো রহমানের কণ্ঠস্বর–সর্দার।

নূরী তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে সরে দাঁড়াল।

বনহুর আজ রহমানকে তার কক্ষে প্রবেশ করার আদেশ না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল, নূরীর কানে পৌঁছল বনহুরের কণ্ঠস্বর–চলো।

রহমান আর বনহুরের পদশব্দ মিলিয়ে যেতেই নূরী বেরিয়ে এলো, অন্ধকারে তাকিয়ে দেখলো-দু’টি ছায়ামূর্তি ওদিকে বেরিয়ে যাচ্ছে। নূরী বঝুতে পারলো, বনহুর তার সামনে এ সম্বন্ধে কোন আলোচনা করতে চায় না। তাই সরে যাচ্ছে দূরে। কিন্তু নূরীও কম মেয়ে নয়–যেমন করে হউক সেও শুনবে, রহমান কি খবর এনেছে।

অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলল নূরী, অন্ধকারে একটা খামের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

বনহুর আর রহমান দরবার কক্ষের দিকে না গিয়ে সামনে একটা গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াল।

নূরীও হামাগুড়ি দিয়ে ঝোঁপের আড়ালে এসে লুকিয়ে পড়ল।

বনহুর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলো–রহমান, তুমি নিজেও বেরিয়েছিলে?

হ্যাঁ সর্দার।

কোন সন্ধান পেলে না?

না, আজ সারাটা দিন গোটা শহর চষে বেড়িয়েছি।

শহরময় চষে বেড়ালেই তাকে পাওয়া যাবে না রহমান। এমন কোন গোপন স্থানে তাকে আটকে রাখা হয়েছে, যেখানে কেউ তার সন্ধান পাবে না।

সর্দার, আমি ঝাড়ুদারের বেশে অনেক অন্দরবাড়িতেও প্রবেশ করি। গিয়েছি হোটেলে, ক্লাবে দোকানে কিন্তু কোন আভাসই পেলাম না।

তোমার সঙ্গীরা সবাই ফিরে এসেছে?

অনেকে এসেছে-অনেকে আসেনি। কেউ কোন সন্ধান বলতে পারছে না। ওদের ডাকব?

না, আমার কাছে ডেকে কোন লাভ নেই। হ্যাঁ, আমিও তাকে অনেক খুঁজলাম-তুমি গিয়েছিলে ঝাড়ুদারের বেশে আর আমি গিয়েছিলাম শিকারীর বেশে।

সে আমি দেখতেই পাচ্ছি সর্দার।

তুমি ঘুরেছ অন্দরবাড়ি, হোটেলে, ক্লাবে আর দোকানে।

আমি ঘুরেছি বন থেকে বনান্তরে। গহন বনের অন্তরালে পর্বতের প্রত্যেকটা গুহায়। তবু তার সন্ধান পেলাম না।

সর্দার, আপনি বড় ক্লান্ত।

শুধু আমি নই রহমান, তাজের পরিশ্রম আমার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। ওর সেবার জন্য করিমকে বলে দাও।

নূরী আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। চৌধুরীকন্যার জন্য বনহুরের ব্যাকুলতা তার হৃদয়কে খান খান করে দেয়। নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে সে।

বনহুর বলে–রহমান, অল্পক্ষণের মধ্যে আবার বেরুবো, তুমি আমার গাড়ি বড় রাস্তায় তৈরি রাখতে বল।

আবার এক্ষুণি বের হবেন?

হ্যাঁ। যতক্ষণ তার সন্ধান খুঁজে না পাব, ততক্ষণ আমার বিশ্রাম নেই।

নূরী এবার বুঝতে পারে বনহুর হঠাৎ আজ এমন শিকারীর বেশে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কোথায় গিয়েছিল? সব পরিস্কার হয়ে যায় আজ তার কাছে।

বনহুর কক্ষে ফিরে আসে। এবার সে সুন্দর, এক সাহেবের বেশে সজ্জিত হয়। গায়ে দামী সুট, মাথায় ইংলিশ ক্যাপ, হাতে দামী সিগারেট।

নূরী আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এই ড্রেসে বনহুরকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। এখন কেউ তাকে দেখলে বুঝতে পারবে না সে বাঙালি। ঠিক সাহেবের মতই মনে হলো তার চেহারা।

নূরী কিন্তু নিশ্চুপ রইল না। সে বনহুরের ড্রাইভারের বেশে সেজে আয়নার সামনে এসে। দাঁড়ালো। নিজকে নিজেই চিনতে পারে না নূরী। সত্যি আজ তার ছদ্মবেশ স্বার্থক হয়েছে।

বনহুর কক্ষ ত্যাগ করার পূর্বেই নূরী রহমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

রহমান আশ্চর্যকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো– মকসুদ, তুমি এখনো গাড়িতে যাওনি? সর্দারের আদেশ পালন করনি তুমি?

নূরী চাপাকণ্ঠে বললো–রহমান, আমি নূরী।

সে কি, তুমি।

হ্যাঁ, আমি আজ হুরের গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে যাব।

এত রাত-বিরাতে গাড়ি চালাতে পারবে, তুমি?

পারবো। তুমি তো জানোই, আমি খুব ভাল মোটর ড্রাইভিং শিখেছি।

কিন্তু সর্দার যদি জানতে পারে?

সে ভয় তোমার নেই। তুমি শুধু আমাকে গাড়িতে নিয়ে পৌঁছে দাও।

নূরী, এটা কি ঠিক হবে?

যা হয় হবে, তুমি একটা অশ্ব আমার জন্য দাও।

রহমান একজন অনুচরকে ডেকে বললো একটা অশ্ব সেখানে নিয়ে আসতে।

নূরী যখন গাড়িতে পৌঁছল তখন ড্রাইভার আশ্চর্য হলো, বললো–কে তুমি?

রহমান নূরীকে পৌঁছে দেবার জন্য গিয়েছিল-সে–ই সব কথা খুলে বললো, তারপর ড্রাইভারকে সরিয়ে নিল।

নূরী ড্রাইভার আসনে চেপে বসতেই তাজের পিঠে বনহুর এসে পৌঁছল।

বনহুরকে দেখতে পেয়েই রহমান আসল ড্রাইভারকে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ার জন্য ইংগিত করল। ড্রাইভার রহমানের কথামত আত্মগোপন করল।

রহমান তাজের লাগাম চেপে ধরে বললো–সর্দার, তাজকে কি আবার পাঠাবো?

না, তাজ আজ বিশ্রাম করবে।

ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে।

বনহুর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল–নাইট ক্লাবে চলো।

নূরী একদিন বনহুরের সঙ্গে নাইট ক্লাব দেখার জন্য এসেছিল অবশ্য ভেতরে প্রবেশ করেনি। আজ সেদিনের আসরে স্বার্থকতা উপলব্ধি করে। ভাগ্যিস সেদিন এসেছিল সে। তার নাইট ক্লাবের পথটা চিনতে কষ্ট হয় না।

বনহুর পেছন আসনে বসে সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে। বনহুরের পরিত্যাক্ত ধুম্রকুন্ডগুলো ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে ড্রাইভারের চোখে মুখে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছিলো। ড্রাইভার নিপ গাড়ি চালিয়ে চলেছে।

রাত তখন দশটা বেজে গেছে। শীতের রাত-শহরের পথঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি তাদের গাড়ির পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। ড্রাইভার সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে। সে তো আর দক্ষ ড্রাইভার নয়। তবু গাড়ি চালনায় কোন ভুল হচ্ছে না তার।

গাড়িখানা এক সময় নাইট ক্লাবে এসে থেমে পড়লো।

বনহুর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।

ড্রাইভার তার পূর্বেই ড্রাইভ আসন থেমে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিল। বনহুর নেমে যেতেই সে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। এমন স্থানে দাঁড়াল সে, যেখান থেকে ক্লাবের গোটা অংশ নজরে পড়ে।

ক্লাবের ভেতর থেকে তখন একটা ইংলিশ গানের সুর ভেসে আসছে। আর ভেসে আসছে। হাসি আর বোতলের ঠন ঠন শব্দ।

বনহুর ক্লাবে প্রবেশ করতেই তাদের গাড়ির পাশে আর এক খানা গাড়ি এসে থেমে পড়ল। গাড়ি থেকে নামলেন দুজন ভদ্রলোক যদিও তাঁদের শরীরে স্বাভাবিক সট কিন্তু আসলে তাঁরা পুলিশের লোক-একজন মি. হারুন, অন্যজন মি. হোসেন। তাঁরাও ক্লাবে প্রবেশ করলেন।

নূরী ড্রাইভারের বেশে সব লক্ষ্য করছে। শুধু বনহুরই তার লক্ষ্য নয়, সেও অনুসন্ধান করে দেখছে চৌধুরী কন্যার খোঁজ সে পায় কিনা।

মি. হারুন আর মি. হোসেনের গতিবিধি নূরীর কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয়। সে গোপনে ওদের দু’জনকে অনুসরণ করে। ক্লাবের একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলো নূরী। ক্লাবের মধ্যে কোনদিন সে প্রবেশ করেনি-অবাক হয়ে সব দেখছে। ক্লাবে এদের দেখে নূরীর চোখে ধাঁধা লেগে যায়। এখানে নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই। গায়ে পড়ে ঢলাঢলি হাসাহাসি করছে। কি সব খাচ্ছে। কোথাও বা জুয়ার আড্ডা বসেছে। ওদিকে কতকগুলো মেয়ে পুরুষ এক সঙ্গে নাচছে। নূরীর মনে পড়লো, বনহুর তাকে একদিন বলেছিল ক্লাবে মেয়ে পুরুষ মিলে বলড্যান্স হয় বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে দেখে নূরী সব।

কিন্তু হুর কোথায়, তাকে তো দেখা যাচ্ছে না।

যে লোক দুটির অনুসরণ করে নূরী ক্লাবে প্রবেশ করেছে, তারা ওদিকের একটা টেবিলের পাশে দু’খানা চেয়ারে বসেছেন। চার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছেন তাঁরা।

বয় দুটো প্লেটে করে কি রেখে গেল। খেতে খেতে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন ওরা।

নূরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বনহুরের অনুসন্ধান করছে। হঠাৎ তার নজর পড়লো ওদিকের একটা পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলো বনহুর। তার পাশে একটি যুবতী। বনহুরের সঙ্গে কিছু আলাপ করছে। সে। বনহুর এগুতেই যুবতী ওর দক্ষিণ হাত ধরে বসিয়ে দিল খালি একটা চেয়ারে। তারপর টেবিলস্থ বোতল থেকে খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে বনহুরের দিকে এগিয়ে ধরলো।

শিউরে উঠলো নূরী। বাঁকা চোখে একবার তাকাল-সত্যই কি হুর এ তরল পদার্থ গলধঃকরণ করবে।

বনহুর যুবতীর হাত থেকে কাঁচপাত্রটা নিল। নূরীর হৃদয়ে প্রচণ্ড একটা হাতুড়ির ঘা পড়লো। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সে তাকিয়ে আছে। বনহুর দস্যু-ডাকু কিন্তু মাতাল নয়। আজ থেকে সে মাতাল হবে? চৌধুরী কন্যাকে ভুলবার জন্য সে মদ খাবে অসম্ভব।

বনহুর কাঁচপাত্রটা মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। এইবার সে ঠোঁটে চেপে ধরবে-হঠাৎ নূরী দেখল তার হাত থেকে পাত্রটা মাটিতে পড়ে সশদে ভেঙে গেল।

নূরীর মুখমণ্ডল উজ্জল দীপ্ত হলো। খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাল সে।

সেই মুহূর্তে যুবতী নাচতে শুরু করল বনহুরের সামনে নাচছে সে। বনহুরের দৃষ্টি চক্রাকারে ক্লাবের প্রতিটি লোকের মুখে ঘুরপাক খেয়ে ফিরছে।

হঠাৎ বনহুরকে উত্তেজিত মনে হলো যুবতী তখনও নেচে চলেছে। বনহুরের দৃষ্টি ও পাশে কয়েকটি লোকের ওপর সীমাবদ্ধ যারা এতক্ষণ গোল টেবিলটা জুড়ে জুয়ার আড্ডা দিচ্ছিল।

নূরীও তাকালো লোকগুলোর দিকে।

দেখতে পেল-কয়েকজন ভীষণ চেহারার লোক একটা যুবককে পাকড়াও করেছে। একজন বলিষ্ঠ লোক যুবকের জামার কলার চেপে ধরেছে।

মারামারি বাঁধবার পূর্বলক্ষণ।

এক মুহূর্ত বিলম্ব হলো না, ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু হলো, সারা কক্ষে একটা হট্টগোল ছড়িয়ে পড়ল।

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে বনহুর। দ্রুত পদক্ষেপে এগুলো সে ঐখানে। যুবতী বনহুরের সামনে গিয়ে পথ আগলে বাধা দিল, কিন্তু বনহুর তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল। কোন। রকম দ্বিধা না করে একজনের নাকের ওপর প্রচণ্ড ঘুষি লাগাল।

গুন্ডাগোছের লোকগুলো এবার যুবকটাকে ছেড়ে আক্রমণ করল বনহুরকে। সবাই মিলে। একসঙ্গে বনহুরের সঙ্গে লড়াই লেগে পড়ল।

নূরীর মুখ বিষণ্ণ হলো। হঠাৎ এমন অবস্থার জন্য সে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। বনহুরের অমঙ্গল আশঙ্কায় আশংকিত হলো সে।

ততক্ষণে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেছে কিন্তু বনহুরের সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। ওরা অন্ততপক্ষে সাত আটজনের বেশি হবে–আর বনহুর একা কিন্তু অল্পক্ষণে বনহুর সকলকে। পরাজিত করে ফেলল। কে কোনদিকে পালাবে পথ খুঁজছে এমন সময় মি. হারুন এবং মি. হোসেন রিভলবার হাতে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মি. হারুন বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলেন, খবরদার, নড়েছ কি মরেছ।

গুণ্ডালোকগুলো হাত তুলে দাঁড়াল।

মি. হারুন বাঁশি বাজালেন, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ ক্লাবে প্রবেশ করে গুন্ডা লোকগুলোর হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দিল।

এবার মি. হারুন এবং মি. হোসেন নিজেদের পরিচয় দিয়ে বনহুরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। তাঁরা বারবার ধন্যবাদ জানালেন তাকে।

অবশ্য পরিচয় দেবার পূর্বেই মি. হারুন এবং মি. হোসেনকে চিনতে পেরেছিল বনহুর। সেও হেসে তাদের অভিনন্দন জানালো। মি. হারুন বলেন–আপনার পরিচয়?

বনহুর কিছুমাত্র না ভেবে চট করে জবাব দিল-আমি বিদেশী ব্যবসায়ী। আমার নাম মি.। প্রিন্স।

মি. হারুন খুশি হয়ে বলেন–আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মি. প্রিন্স। নামের সঙ্গে আপনার চেহারার মিল রয়েছে। আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় অনেক খুশি হয়েছি।

মি. হোসেনও আনন্দ প্রকাশ করলেন।

ততক্ষণে গুণ্ডা লোকগুলোকে পুলিশ পাকড়াও করে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নিয়েছে।

মি. হোসেন বলেন–মি. হারুন, আমার সন্দেহ হয়, এরা নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের অনুচর।

মি. হোসেন বললেন–এ রকম সন্দেহের কারণ?

দেখলেন না লোকগুলোর চেহারা ঠিক ডাকাতের মত?

বনহুর শুনে নীরবে হাসলো।

মি. হারুন এবং মি. হোসেন বেরিয়ে যেতেই বনহুর যুবকটার পাশে এসে দাঁড়ালো গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো সে–আপনার পরিচয়।

যুবকটার চেহারায় বেশ আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। উজ্জ্বল দীপ্ত মুখমণ্ডল। বয়স বনহুরের। চেয়ে কম হবে। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবী। সে হিন্দু তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। বনহুরের দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো সে আমার নাম মধু সেন। আমার পিতা মাধবগঞ্জের জমিদার বিনোদ সেন।

বনহুর হাসলো, তারপর কঠিন কণ্ঠে বললো–আপনি একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সন্তান, আপনি এসেছেন ক্লাবে, ছিঃ। আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি–খবরদার আর কোনদিন এ। পথ মাড়াবেন না, বুঝেছেন।

বুঝেছি, সত্যি আপনি না থাকলে আজ…

যান-বেরিয়ে যান ক্লাব থেকে। কোন কথাই আমি শুনতে চাইনা। আপনাদের মত লোকের। কৃতজ্ঞতাকেও আমি ঘৃণা করি।

যুবক মধু সেন নতমস্তকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল।

বনহুর এবার এগুলো নিজের গাড়ির দিকে।

ড্রাইভার পূর্বেই ড্রাইভ আসনে বসেছিল।

বনহুর গাড়িতে চড়ে বসতেই স্টার্ট দেয়। বনহুর বলে লেকের ধারে চলো।

ড্রাইভার অস্বস্তি বোধ করে। এত রাতে আবার লেকের ধারে কেন? ক্লাবে আসার সখ মিটলো-এবার লেকের ধারে। ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিল।

গাড়ি ছুটে চলেছে। রাত এখন দুটোর কম হবে না। শির শিরে হিমেল হাওয়ায় ড্রাইভারের শরীরে কাঁপন লাগে, রাগ হয় বনহুরের ওপর-লেকের ধারে কি করতে যাবে সে?

গাড়িখানা সাঁকোর উপর উঠতেই সহসা তাদের পাশ কেটে বেরিয়ে গেল আর একখানা গাড়ি। বনহুর হঠাৎ ঝুঁকে গাড়ি খানাকে লক্ষ্য করলো। তারপর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো ড্রাইভার যে গাড়িটা আমাদের গাড়িকে পেছনে ফেলে চলে গেলো, ওটাকে ফলো কর।

নূরী গাড়ি চালাতে জানে, তা বলে খুব দক্ষ ড্রাইভারের মত চালাতে জানে না। বিপদে পড়ল নূরী। তবু সে যতদূর সম্ভব স্পীডে গাড়ি চালাতে শুরু করল।

বনহুর কি যেন ভাবলো তারপর সে ড্রাইভারের পাশে বসে হ্যাঁন্ডেল চেপে ধরল। অন্য কোনদিকে খেয়াল করার সময় নেই বনহুরের। সামনের গাড়িখানাকে ফলো করতেই হবে। কারণ। গাড়িখানার গতিবিধি তার কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হল।

ড্রাইভার সরে বসল।

বনহুর ডবল স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে। উল্কাবেগে ছুটছে গাড়িখানা।

সম্মুখস্থ গাড়িখানা তখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। বনহুর নাছোড়বান্দা-ঐ গাড়িকে সে ধরবেই।

পথটা বেশ নির্জন এবং চওড়া। তাছাড়া পথের দু’পাশে লাইটপোষ্ট থাকায় গাড়ি চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না।

নূরীর মনে কিন্তু খুব ভয় হচ্ছে, না জানি হঠাৎ কোন এক্সিডেন্ট হয়ে বসে। পথের দু’ধারে বাড়িগুলো সাঁসাঁ করে সরে যাচ্ছে। হিমঝরা শীতের রাত-তাই কোন বাড়ির দরজা জানালা খোলা নেই। বাড়িগুলোও যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ঘুম পাড়ছে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রথম গাড়িখানা বুঝতে পারলো পেছনে গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে।

বনহুর অতি কৌশলে নিজের গাড়িখানাকে সামনের গাড়ির সামনে এনে অবরোধ করে। ফেলল।

সামনের গাড়িখানা উপায়ান্তর না দেখে ব্রেক করে থামিয়ে ফেলল।

বনহুর ড্রাইভ আসন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল।

ততক্ষণে প্রথম গাড়ির চালকও গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়েছে।

বনহুরকে সে–ই প্রথম আক্রমণ করল। বনহুর প্রচন্ড এক ঘুষিতে লোকটাকে ধরাশায়ী করল।

বনহুর তক্ষণি বুঝতে পারলো–যাকে সে এই মুহূর্তে ধরাশায়ী করেছে সে নাথুরাম ছাড়া কেউ নয়। বনহুর একবার যাকে দেখতো তাকে ভুলতো না কোনদিন। নাথুরামকে তো সে কয়েকবার কাবু করেছে। তাই আজও অন্ধকারে অনুমান করে নেয়। বনহুরের রাগ আরও বেড়ে যায় শয়তান নাথুরামই তার মনিরাকে আর একবার নদীপথে নিখোঁজ করতে চেয়েছিল।

বনহুর ঝাঁপিয়ে পড়লো নাথুরামের ওপর। দু’হাতে ওর টুটি টিপে ধরল।

কিন্তু নাথুরামকে কাবু করা অত সহজ ব্যাপার নয়। সেও মরিয়া হয়ে বনহুরের গলা চেপে ধরল। আবার শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।

নূরী কোনদিন এমনভাবে বনহুরকে তার সামনে যুদ্ধে লিপ্ত হতে দেখেনি। আজ ক্লাবে গুণ্ডাদের সঙ্গে লড়াই করতে দেখে নূরী স্তম্ভিত হতবাক হয়েছিল। সাত আটজন বলিষ্ঠ লোকের সঙ্গে একা বনহুর-শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো সে। এক্ষণে বনহুর নাথুরামের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হবে, এ-তো জানেই সে। তবুও সে ভীত হয়ে পড়ছিল। বনহুরের কোন ক্ষতি হয় এই আশংকায় মনে প্রাণে খোদাকে স্মরণ করছিল সে। নূরী তখন গাড়ির পেছন আসনে বসেছিল।

নাথুরাম আর পেরে উঠছিল না, বনহুরের প্রচন্ড ঘুষিতে তার নাক দিয়ে দর দর করে রক্ত পড়ছিলো। সে তবু মরিয়া হয়ে লড়াই করছিল আর পালাবার পথ খুঁজছিল। শয়তান নাথুরাম হঠাৎ একমুঠো ধুলো তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো বনহুরের চোখ লক্ষ্য করে।

আচমকা চোখে ধুলোবালি এসে পড়ায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো বনহুর সঙ্গে সঙ্গে চোখ রগড়ে তাকাল। ততক্ষণে নাথুরাম বনহুরের দৃষ্টির আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। বনহুর অন্ধকারে তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করতে লাগল, শুধু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না।

এবার এগিয়ে গেল বনহুর নাথুরামের গাড়ির দিকে। আশা আকাঙ্খায় মনটা তার দুলে উঠলো। হয়তো ঐ গাড়ির মধ্যে মনিরা থাকতে পারে। গাড়ির মধ্যে উঁকি দিয়ে আশ্চর্য হলো বনহুর। একটা লোক হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় গাড়ির মেঝেতে পড়ে রয়েছে। বনহুর বিলম্ব না করে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। যদিও লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তবুও অনুমানে বুঝে নিলো নিশ্চয়ই কোন ভদ্রলোককে শয়তান নাথুরাম বন্দী করে নিয়ে চলেছে।

বনহুর তাড়াতাড়ি তাঁর হাত পা মুখের বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকটি উঠে বসলেন, তিনি আনন্দসূচক কণ্ঠে বললেন– কে আপনি? আমাকে বাঁচালেন।

বনহুর ভদ্রলোকটির গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো এ যে প্রখ্যাত ডিটেকটিভ মি.। শঙ্কর রাওয়ের গলা। সে পকেট থেকে ছোট্ট টর্চলাইটটা জ্বেলে দেখলো তার অনুমান মিথ্যা নয়। শংকর রাওয়ের একি অবস্থা-চোখ বসে গেছে, চুল এলোমেলো, কোট প্যান্ট টাই মলিন-নোংরা।

বনহুর মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন মি. রাও-কে আপনি? আমাকে রক্ষা করলেন? এই জঘন্য অবস্থা থেকে বাঁচালেন?

বনহুর জবাব দিল–আমি একজন ব্যবসায়ী। আমার নাম মি. প্রিন্স।

মি. রাও বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা দু’হাত চেপে ধরলেন আপনি আমার জীবন রক্ষা করলেন, আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো মি. প্রিন্স আপনি ….

থাক, ওসব পরে হবে। এখনও আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ নন। আসুন আমার গাড়িতে আপনাকে পৌঁছে দিই।

শংকর রাওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ড্রাইভ আসনে বসে বনহুর তারপর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলে– ড্রাইভার, তুমি সামনের আসনে এসে বসো।

নূরী এতক্ষণ নির্বাক পুতুলের মত স্তব্ধ হয়ে বসে বসে দেখছিল। বনহুরের প্রতি একটা অভিমান জমেছিল তার মনে, এক্ষণে তা কোথায় উড়ে গেছে। ড্রাইভারের সঙ্গে বনহুর তো কোনদিন এভাবে কথা বলে না। মনে মনে একটু আশ্চর্য হয় নূরী। পেছন আসন থেকে সামনের আসনে এসে বসে সে।

মি. শংকর রাওকে নিয়ে বনহুর যখন গাড়িতে স্টার্ট দিল, তখন নাথুরাম মাথা তুলে একবার তাকালো। গাড়িখানা দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলে শরীরের ধুলো ঝেরে উঠে দাঁড়ালো নাথু। তখনো নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে তার। দাঁতে দাঁত পিষে গাড়িখানার দিকে চেয়ে রইলো সে।

বনহুর গাড়ি চালাতে চালাতে বললো–মি. রাও, আপনি কোথায় যাবেন? অফিসে না বাসায়?

মি. শংকর রাও অচেনা অজানা মি. প্রিন্সের মুখে তার নাম শুনে আশ্চর্য হলেন। বিস্ময়ভরা। কণ্ঠে বলেন–বাসায় যাব। ক্ষুধায় আমার অবস্থা শোচনীয়। আজ এক সপ্তাহের মধ্যে পানি ছাড়া। আর কিছু আমার ভাগ্যে জোটেনি। কিন্তু একটা কথা মি. প্রিন্স, আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?

হেসে বললো বনহুর–আপনি একজন প্রখ্যাত ডিটেকটিভ, আপনাকে চিনতে কারও ভুল। হয় না। আচ্ছা মি. রাও, আপনার উধাও ব্যাপারটা সংক্ষেপে যদি বলতেন

ঘটনাটা সত্যি অতি বিস্ময়কর। আমি দস্যু বনহুরের চক্রজালে জড়িয়ে পড়ছিলাম।

দস্যু বনহুর!!

হ্যাঁ, মি. প্রিন্স, শয়তান দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে গিয়ে আপনি নিজেই পাকড়াও। হয়ে পড়েছিলেন বুঝি?

কথার ফাঁকে গাড়িখানা এসে পৌঁছে গেল মি. রাওয়ের বাসার গেটে।

শংকর রাও গাড়ি থেকে নেমে আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন– আসুন মি. প্রিন্স, কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো।

থাকা আজ আর নামবো না, সময় পেলে আবার দেখা হবে।

শংকর রাও বলে ওঠেন–আপনার ঠিকানা যদি দয়া করে শুনাতেন, তাহলে মি. হারুনকে নিয়ে

ও! বেশ এই নিন। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে বনহুর মি. শংকর রাওয়ের হাতে দেয়। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দেয় সে।

গাড়ি স্পীডে ছুটে চলেছে।

পাশে বসে আছে ড্রাইভারবেশী নূরী। ওর মনে নানারকম প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। আজ সে বনহুরের সঙ্গে এসে স্বচক্ষে যা দেখল এবং অনুভব করল, তা অতি বিস্ময়কর। নূরী এসব কল্পনাও করতে পারেনি। বনহুর যে শুধু সেই চৌধুরী কন্যাকে নিয়েই উন্মত্ত রয়েছে তা নয়। বাইরের সমগ্র জগৎ জুড়ে তার কাজ। অনাবিল এক আনন্দে আপুত হয় নূরীর হৃদয়। বনহুরকে সে যতখানি গণ্ডির মধ্যে কল্পনা করেছে তার চেয়ে সে অনেক, অনেক বেশি।

নীরবে গাড়ি চালাচ্ছিল বনহুর। রাত প্রায় শেষের পথে। শীতের কনকনে হাওয়া শার্সীর ফাঁকে প্রবেশ করছিল না সত্য কিন্তু তবু একটা জমাট ঠান্ডা নূরীকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। জনশূন্য পথ। পথের দু’ধারে লাইটপোষ্টের আলোগুলো নীরব প্রহরীর মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লাইটপোষ্টের আলোগুলো কেমন ঝাপসা কুয়াশাচ্ছন্ন।

গাড়ির মধ্যে শুধু দুটি প্রাণী–বনহুর আর নূরী।

নূরী এতক্ষণ কোন কথা না বলায় হাঁপিয়ে পড়েছিল। গাড়িতে চাপার পর থেকে সেই মুখ। বন্ধ হয়েছে, এখনও সে নিশ্চুপ।

হঠাৎ বনহুর বলে ওঠে–তোমার সখ দেখে আমি সত্যি আশ্চর্য হলাম।

নূরী চমকে উঠলো, বনহুর কি তাকে চিনতে পেরেছে। নিশ্চয়ই তাই হবে। একবার আড় নয়নে বনহুরকে দেখার চেষ্টা করল সে। বনহুর এবার মৃদু হাসলো–নূরী, তুমি আজ এসে ভালই করেছ। তুমি পাশে থাকায় আমি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।

নূরী স্তকণ্ঠে অস্কুটধ্বনি করে উঠে–হুর।

গাড়িতে যখন প্রথম স্টার্ট দিলে তখনই আমি তোমাকে চিনে নিয়েছি।

কেন তবে তুমি আমায় নামিয়ে দিলে না?

তোমার মনের দ্বন্দ্ব দূর হয়েছে তো?

হুর, আমি তোমাকে কোনদিন অবিশ্বাস করিনি।

আজ কেন তবে তুমি আমাকে অনুসরণ করেছিলে?

নূরী বনহুরের হাতের ওপর হাত রেখে–তুমি আমাকে ক্ষমা করো হুর, না জেনে আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি।

নূরী!

বল?

জানি তুমি আমায় ভালবাস। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি তোমাকে,

না না হুর, আর তুমি কিছু বল না। আমি সহ্য করতে পারবো না হুর। নূরী বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

নূরীর হৃদয়ের ব্যথা বনহুরের মনে যে আঘাত করে না তা নয়। দস্যু হলেও সে মানুষ। তার চোখ দুটোও ঝাপসা হয়ে আসে।

গাড়ি ততক্ষণে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেছে।

বনহুর নেমে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ধরে বলে–এসো।

নূরী নেমে দাঁড়ায় বনহুরের পাশে।

গতরাতে অফিস থেকে ফিরতে মি. হারুনের রাত প্রায় চারটে বেজে গিয়েছিল। ক্লাবের সে গুণ্ডাগুলোকে হাজতে রেখে অফিসের খাতাপত্র ঠিক করে তবেই তিনি ফিরেছিলেন। ভোরের দিকে ঘুমটা একটু জেঁকে এসেছে–এমন সময় পাশের টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো।

মিসেস হারুন একটু সকাল সকাল উঠেছেন। তিনি স্বামীকে না জাগিয়ে নিজেই ফোন ধরলেন হ্যালো কে মি. হোসেন? পুলিশ অফিস থেকে বলছেন? ব্যাপার কি? না উনি এখনও ওঠেন নি। আপনিও তো খুব রাত করে বাড়ি ফিরেছেন, আবার এত সাত সকালে অফিসে? কি বলেন–মি. রাও ফিরে এসেছেন। সবুর করেন, উনাকে ডেকে দিচ্ছি কি আশ্চর্য। রিসিভারের মুখে হাত রেখে ডাকলেন ওগো শুনছো, শোন শোন মি. রাও নাকি ফিরে এসেছেন।

এ্যাঁ এত চেঁচাচ্ছো কেন? পাশ ফিরে শুয়ে কথাটা বলেন মি. হারুন। মিসেস হারুন পুনরায় বলেন–ওঠো, ওঠো, শোন মি. রাও ফিরে এসেছেন।

কি বললে, মি. রাও ফিরে এসেছেন? এক লাফে শয্যা ত্যাগ করে স্ত্রীর হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কানে ধরলেন– হ্যালো …. কি বলেন মি. রাও ফিরে এসেছেন। আচ্ছা আমি এখনি আসছি।

রিসিভার রেখে উঠে দাঁড়ালেন মি. হারুন–ওগো, আমার জামা কাপড়গুলো এগিয়ে দাও তো।

সে কি, হাত মুখ ধোবে না? নাস্তা করবে না?

রেখে দাও তোমার হাতমুখ ধোয়া আর নাস্তা খাওয়া। কি আশ্চর্য যাকে আজ ক’দিন পুলিশ অহরহ খুঁজে বেড়াচ্ছে যার তল্লাশে সমস্ত পুলিশ বিভাগ আহার নিদ্রা বিশ্রাম ত্যাগ করেছে। এমনকি পুলিশ সুপার পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন–সে শংকর রাওয়ের আবির্ভাব-একি কম কথা?

জামাকাপড় পরে মি. হারুন যখন পুলিশ অফিসে পৌঁছলেন তখন সকাল সাতটা বেজে গেছে। অফিসে তোক ধরছে না। মি. হারুনকে দেখে সবাই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।

মি. হারুন কক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন একটা চেয়ারের উস্কুখুস্কচুল, কোটরাগত চোখ-উত্তেজিতভাবে বসে আছেন মি. রাও। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন পুলিশ অফিসার।

মি. হোসেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। মি. হারুনকে দেখে মি. হোসেন বলেন–গুড মর্নিং মি. হারুন। আজ আমাদের সুপ্রভাত।

মি. হারুন মি. হোসেনের সাথে হ্যান্ডশেক করে মি. রাওয়ের সামনে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। তারপর শংকর রাওয়ের আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বলেন– স্ত্রীর ঔষুধ আনতে গিয়ে কোথায় উধাও হয়েছিলেন মি. রাও?

শংকর রাও কিছু বলার পূর্বেই বলে ওঠেন মি. হোসেন–উনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আমি উনার মুখে যা শুনলাম বলছি।

বলুন?

মি. রাওয়ের কাছে শোনা সমস্ত ঘটনা মি. হোসেন ইন্সপেক্টার মি. হারুনের কাছে বলেন। আরও বলেন–মি. রাও ভেবেছিলেন তিনি দস্যু বনহুরের অনুচরের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। কিন্তু তা নয়। মি. রাওয়ের উধাওয়ের ব্যাপারে দস্যু বনহুর নেই বা ছিল না বরং তাকে উদ্ধার করেছে দস্যু বনহুর।

মি. হারুন–দস্যু বনহুর আমাকে রক্ষা করেছে। আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সেই মুহূর্তে সে যদি আমাকে উদ্ধার না করতো, তাহলে আমার বাঁচার কোনা আশা ছিল না।

শংকর রাও কথাগুলো বলতে বেশ হাঁপিয়ে পড়ছিলেন। তিনি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে, মি. হারুনের হাতে দিলেন–দস্যু বনহুর চলে যাওয়ার সময় এই কাগজখানা আমাকে দিয়ে গেছে।

মি. হারুন কাগজখানা তুলে ধরলেন চোখের সামনে, তাতে লেখা রয়েছে মাত্র দুটি শব্দ–দস্যু বনহুর।

মি. হারুন জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি তার পরিচয় জানতে চাননি?

চেয়েছিলাম, সে নিজের নাম মি. প্রিন্স বলেছিল। সত্যি মি. হারুন দস্যু বনহুরকে যুবরাজের মতই দেখাচ্ছিল।

হ্যাঁ, সে প্রিন্সের মতই দেখতে। কথাটা বলেন মি. হারুন। তারপর একটু ভেবে বলেন– তাহলে যে দস্যু বা ডাকু আপনাকে উধাও করেছিল সে বনহুরের দলের নয়?

না মি. হারুন, আমি এ কদিনে বেশ উপলব্দি করেছি যারা আমাকে পাকড়াও করেছিল তারা শুধু দস্যুই নয়, নারী হরণকারী দলও আমার মনে হয়, চৌধুরী কন্যাও তাদের হাতে বন্দী রয়েছে।

অনুমানে কিছু বলা যায় না, মি. রাও। চৌধুরী কন্যাকে কেউ পাকড়াও করে নিয়ে গেছে, না সে নিজেই গেছে তার সঠিক সন্ধান এখনও হয়নি।

মি. রাও বলেন– আমি যেসব প্রমাণ পেয়েছিলাম তাতে নিঃসন্দেহে বলতে পারি মিস মনিরাকে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া তাদের বাড়ির পুরোন দারোয়ান খুন হওয়ার। পেছনে রয়েছে একমাত্র ঐ কারণ।

মি. রাও এমনও তো হতে পারে-বনহুর নিজে না এসে লোক দিয়ে কার্য সিদ্ধি করেছে এবং দারোয়ানকে খুন করিয়েছে। যাক সে সব কথা-এখন আপনি পূর্ণমাত্রায় বিশ্রাম গ্রহণ করুন। সুস্থ হলে কাজের কথা হবে।

শংকর রাও বলেন–বিশ্রাম নেবার সময় কই আমার মি. হারুন, আমি এই অবস্থাতেই কাজে নামতে চাই।

এই অসুস্থ শরীরে?

হ্যাঁ, মি. হারুন আমার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত ওরা সেখানে অপেক্ষা করবে না।

সেই শয়তানের কথা বলছেন।

হাঁ, যারা আমাকে এই এক সপ্তাহ তিলে তিলে শুকিয়ে মেরেছে। মি. হারুন আমি আর এক। মুহূর্ত বিলম্ব করতে চাই না। আপনারা আমাকে সাহায্য করলে আমি ওদের আস্তানা খুঁজে বের করতে পারবো।

আনন্দভরা কণ্ঠে বলেন মি. হারুন–আমরা আপনাকে সানন্দে সাহায্য করবো, কারণ এটা আমাদেরও ডিউটি।

তাহলে এক্ষুণি পুলিশ ফোর্সকে তৈরি হতে বলুন, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু মি. হারুন, আপনার সঙ্গে গোপনে একটা কথা আছে।

বেশ চলুন।

পাশের কক্ষে গিয়ে দাঁড়ালেন ওরা দুজন মুখোমুখি। মি. রাও বললেন– শয়তানদের পাকড়াও করার পর আমি ডক্টর জয়ন্ত সেনকে গ্রেপ্তার করতে চাই। কারণ, তিনি তাদের সঙ্গে জড়িত আছেন।

মি. হারুন বলেন– আমিও অনেক দিন থেকে ঐ রকম সন্দেহ করে আসছি কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারিনি।

আমি হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছি মি. হারুন, শুনুন তবে।

বেশ বলুন।

রাও স্ত্রীর ঔষুধ আনবার সময় যে ঘটনা ঘটেছিল এবং যে কারণে ডক্টর সেনকে সন্দেহ করে তিনি তার পেছনে ধাওয়া করেছিলেন– সব খুলে বলেন।

মি. হারুন বলেন– ডক্টর সেন শুধু সেই বদমাইশদের সঙ্গেই জড়িত নেই, সে দস্যু বনহুরের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে, নইলে এত ডাক্তার থাকতে দস্যু বনহুর আসে তার কাছে।

এসব আলোচনা পরে হবে মি. হারুন, আপনি তৈরি হয়ে নিন।

আমি তৈরি হয়েই এসেছি মি. রাও চলুন কোথায় যেতে হবে।

তারপর মি. হারুন মি. হোসেনকে ডেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে দুটি মোটর ভ্যানকে তৈরি হতে বলেন।

কিন্তু যখন শংকর রাও এবং পুলিশ ফোর্স সেই পুরানো বাড়িটায় গিয়ে পৌঁছলেন, তখন সে বাড়ি শূন্য হয়ে গেছে। সারাটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেলনা। তবে এটা বুঝা গেল–সকাল হবার পূর্বেও এ বাড়িখানাতে মানুষ ছিল।

প্রত্যেকটা কক্ষে নিপুণভাবে অনুসন্ধান চালালেন মি. হারুন। শংকর রাও একটা ছোট্ট কক্ষে প্রবেশ করে বলেন–আজ এক সপ্তাহ আমাকে এই কক্ষে আটক করে রাখা হয়েছিল।

বাড়িটা একেবারে শহরের শেষ প্রান্তে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে ঠিক পোড়াবাড়ি বলেই মনে হয়।

বাড়িটাতে যখন নিখুঁতভাবে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে তখন হঠাৎ একটা কক্ষের মেঝেতে একটু ফাঁক দেখা গেল। মি. হারুন তখনই পুলিশকে সেখানে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে আদেশ করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা সিঁড়ি বেরিয়ে পড়লো সেখানে।

একটা পাথরের ঢাকনা দিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মি. রাওয়ের চোখে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই সেই পাতালীপুরীর কক্ষে কোন গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।

মি. রাও ও অন্যান্যরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চললেন। আশ্চর্য, মাটির তলায় একটা কক্ষ। সিঁড়িটা অবশ্য কক্ষের বাইরে একটা বারান্দাগোছের জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে। তারপর কক্ষের দরজা।

মি. রাও এবং মি. হারুন টর্চ জ্বেলে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন। কক্ষটা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

মি. হারুন খুব ভালভাবে লক্ষ্য করে বলেন–মি. রাও এ কক্ষেও কাউকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু সে নারী না পুরুষ?

মি. রাও তখন টর্চের আলো জ্বেলে খুব ভালো করে দেখছিলেন, হঠাৎ বলে ওঠেন –মি. হারুন দেখুন তো এটা কি? ততক্ষণে তিনি জিনিসটা হাতে উঠিয়ে নিয়েছেন। টর্চের আলোতেই দেখলেন একগোছা চুল।

মি. হারুন চুলগোছা হাতে নিয়ে বলেন– এ কক্ষে কোন নারী থাকতো। এই দেখুন সে চুল আঁচড়ে খসে পড়া চুলগুলো কুণ্ডলি পাকিয়ে ফেলে দিয়েছে।

তাঁদের অনুমান সত্য। এই কক্ষেই শয়তান নাথুরাম মনিরাকে বন্দী করে রেখেছিলা চুলগোছা তারই মাথার।

এর বেশি আর কিছু পেলেন না মি. হারুন এবং মি. রাও। শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হয়ে তাঁরা ফিরে চললেন। রাগে দুঃখে অধর দংশন করতে লাগলেন শংকর রাও।

পাষাণ প্রাচীরে ঘেরা জম্বুর বনের একটি গুপ্তগুহায় বন্দী করে রাখা হয়েছে মনিরাকে। সেখানে পিপীলিকাও প্রবেশে সক্ষম নয়। শয়তান নাথুরাম কৌশলে এ গুপ্ত গুহ সৃষ্টি করেছিল। গহন বনের অভ্যন্তরে কঠিন পাথরের তৈরি এই জন্ধুর পর্বত।

মনিরা এই নির্জন পর্বতের গুপ্ত গুহায় অবিরত অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। তার মন থেকে মুছে গেছে আশার স্বপ্ন, ধূলিসাৎ হয়ে গেছে সমস্ত বাসনা। আর কোনদিন সে লোকালয়ে ফিরে যেতে পারবে, তা কল্পনাও করতে পারে না।

আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হতে চললো তাকে চুরি করে এনেছে তারা। সেই রাতের কথা মনে হলে আজও শিউরে ওঠে মনিরা। নিশীথ রাতে নিদ্রাহীন মনিরা অস্থিরচিত্তে কক্ষে পায়চারী করছিল–বনহুরের চিন্তায় সে আচ্ছন্ন ছিল–এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা পড়লো দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে দুজন বলিষ্ঠ লোক তার নাকের ওপর একখানা রুমাল চেপে ধরে–তারপর এই নির্মম পরিণতি। যদিও আজ পর্যন্ত মুরাদ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, নাথুরাম এবং তার অনুচরগণও মনিরার দেহে হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হয়নি, তবু সে যদি এখন কোনক্রমে মামা মামীর পাশে ফিরে যেতে পারে তাহলে কি তাঁরা আগের মত স্বচ্ছমনে গ্রহণ করবেন? তাকে তাঁরা স্নেহ করেন, মমতা করেন, ভালবাসেন হয়তো তাঁদের মনে বাধবে না, কিন্তু সমাজ–সমাজ কি তাকে আশ্রয় দেবে? কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, তাতে কিছু আসে যায় না। মনির–তার মনির যদি তাকে বিশ্বাস না করে? হঠাৎ মনিরার চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গুহায় মুখ ধীরে ধীরে এক পাশে সরে যায়, গুহায় প্রবেশ করে মুরাদ।

মনিরার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। হৃদকম্প শুরু হয় তার। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে মুখমণ্ডল। সামনে আজরাইলকে দেখলেও বুঝি এতখানি ভয় পেতো না মনিরা।

মুরাদের চোখমুখ আজ তার কাছে অতি ভয়ংকর মনে হয়। চোখ দুটো রক্ত জবার মত লাল টকটকে। টলতে টলতে প্রবেশ করলো সে। মনিরাকে দেখতে পেয়ে জড়িতকণ্ঠে সাদর সম্ভাষণ জানাল মুরাদ–গুড নাইট মিস মনিরা!

মনিরা কোন জবাব দিল না, সঙ্কুচিতভাবে গুহার এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল।

মুরাদ হেসে বলল–এখনও তোমার লজ্জা গেল না প্রিয়ে? মনিরা এখানে তো তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না?

এমন সময় নাথুরাম একটুকরা কাগজ ও কলম নিয়ে গুহায় প্রবেশ করলো–হুজুর, এই নিন।

মুরাদ ফিরে তাকালো নাথুরামের দিকে, তারপর বলল–এসো।

মনিরা জড়োসড়ো হয়ে আছে। অন্তরের ভয়ার্ত ভাব তার মুখে সুষ্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। মনিরা রাগে ক্ষোভে ভয়ে কেমন যেন হয়ে পড়েছে।

মুরাদ এবার এগিয়ে যায় তার দিকে–এসো, এই নাও কলম, ও যা বলবে লিখে দাও চট চট। তারপর নাথুরামকে লক্ষ্য করে বলে–বল নাথু?

নাথুরাম কর্কশকন্ঠে বলল–কি আর এমন লিখতে হবে। কথার ফাঁকে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে এগিয়ে দেয় মুরাদের দিকে–শুধু এই কথাগুলো লিখলেই চলবে।

মুরাদ নাথুরামের হাত থেকে সেই কাগজের টুকরাখানা নিয়ে চোখের সামনে তুলে ধরলো। পড়া শেষ করে হেসে বললো তোমার বুদ্ধি শিয়ালের চেয়েও বেশি নাথু।

সাধে কি আর আপনার মত লোক আমাকে টাকা দেয় হুজুর।

দিন চট করে ওটা লিখে দিন আমাকে। এখনই পাঠাতে হবে। ভোর হবার আগেই যেন ওটা পুলিশ অফিসে গিয়ে পৌঁছে।

তুমি যা ভেবেছিলে তাই হলো। ঘুঘুটাকে ফাঁদ থেকে বের করাই ভুল হয়েছিল। তাই সে বেঁচে গেল।

নাথুরামের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে–ঘুঘুটার কোন দোষ নেই হুজুর। ওকে আমি যেভাবে পিছমোড়া করে বেঁধে গাড়ির পেছনে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলাম কোন ব্যাটাই ধরতে পারতো না। যদি ঐ পাজিটা আমার গাড়িখানাকে ফলো না করত।

সে কে তাকে তুমি চিনতে পেরেছিলে নাথুরাম?

তাকে চিনতে না পারলেও অনুমানে বুঝতে পেরেছি সে দস্যু বনহুর ছাড়া আর কেউ নয়।

আমারও তাই মনে হয় নাথু, নাহলে তোমার মত বলবান বীর পুরুষকে কাবু করতে পারে, এমন লোক আছে?

মনিরার হৃদয়ে এক অনাবিল শান্তির প্রলেপ ছোঁয়া দিয়ে যায়। মনির তাহলে মি. রাওকে উদ্ধার করে নিতে পেরেছে। সে তাহলে নীরব নেই। তাকেই খুঁজে ফিরছে সে। হয়তো তার কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলছে। মনির ভাবছে মনিরার কথা–এ যে মনিরার কত বড় সৌভাগ্য মনির–তার মনির না জানি এখন কোথায় কি করছে। মনিরা নিজের জন্য দুঃখ করে না। যত ভাবনা ওর জন্য। তাকে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ কোন বিপদে না পড়ে। খোদা, তুমি ওকে বাঁচিয়ে নিও।

নাথুরামের কথায় মনিরার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ে। নাথুরাম বলছে–মিস মনিরা দাও ওটা লিখে দাও।

মুরাদ কাগজ দু’খানা আর কলমটা মনিরার হাতে গুঁজে দিল।–এ কথাগুলো ঐ সাদা কাগজখানায় লিখে দাও।

মনিরা কাগজখানায় দৃষ্টি বুলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়–না আমি কিছুতেই একথা লিখবো না।

মুহূর্তে মুরাদ গর্জে ওঠে–কি বললে, তুমি লিখবে না?

না!

দাঁতে দাঁত পিষে বলে মুরাদ–তোমাকে লিখতে হবে।

কখনো না।

মুরাদ এবার নাথুরামের দিকে তাকালো নাথুরাম, আমি আদেশ দিলাম, তুমি যেমন করে পারো ওর কাছ থেকে লিখিয়ে নাও।

হুজুর, আপনি একটু বাইরে যান।

বেশ, আমি যাচ্ছি। মুরাদ গুহায় দরজার দিকে পা বাড়ায়।

মনিরার বুক থর থর করে কেঁপে ওঠে। শিউরে ওঠে তার শরীর। মুরাদের চেয়েও মনিরা নাথুরামকে বেশি ভয় করে। মুরাদ বেরিয়ে গেলে নাথুরাম কি করে বসবে ভাবতে পারে না মনিরা।

দুহাতে মাথার চুল টানতে থাকে মনিরা। নাথুরাম তার ভয়ংকর বলিষ্ঠ বাহু দুটি মেলে এগিয়ে যায় তার দিকে লিখবে না তুমি? বেশ! নাথুরাম এগুতে থাকে, মনিরা নাথুরামের কদাকার ভয়ংকর মুখখানার দিকে তাকিয়ে ভীতভাবে কাগজ দু’খানা হাতে তুলে নেয়।

কলমটা ছিটকে দূরে পড়ে গিয়েছিল, ওঠা মনিরার হাতে তুলে দেয় নাথুরাম লক্ষ্মী মেয়ের মত চট করে লিখে ফেলো।

মনিরা কাগজ নিয়ে লিখতে বসে। লেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।

নাথুরাম ডাকে–হুজুর, এবার ভেতরে আসুন।

মুরাদ হাসতে হাসতে গুহায় প্রবেশ করে–হয়েছে?

হ্যাঁ, এই দেখুন। মনিরার লিখিত কাগজখানা নাথুরাম মুরাদের কাছে দেয়।

মুরাদ কাগজখানা পড়ে বলে–চমৎকার! নাথু, তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারি না।

নাথুরাম মুরাদের হাত থেকে কাগজখানা নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলে– এবার আপনি নিশ্চিন্ত হুজুর। এই চিঠি পেলে পুলিশ আর মনিরার সন্ধান নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে না। ওর মামা মামী নিশ্চিন্তে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। আমি তাহলে….

মুরাদ জড়িতকণ্ঠে হাই তুলে বলে–এসো।

মনিরা ক্ষিপ্তের ন্যায় বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মুরাদের দিকে। সে যদি মুনি ঋষি হতো তাহলে তার দৃষ্টিশক্তি দিয়ে ভস্ম করে দিত মুরাদকে।

মুরাদ মনিরার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। মনিরার দৃষ্টি তার শরীরে যেন তীর ফলকের মত গিয়ে বিধছে। গাটা যেন শির শির করে ওঠে তার। মনিরার একি মূর্তি? মুরাদ কেমন যেন। ভড়কে যায়। মদের নেশা ছুটে যায়। মনিরার নিঃশ্বাস যেন তার সমস্ত দেহে আগুন ধরিয়ে দেয়।

মুরাদ যেন আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে পারে না। অসহ্য লাগছে ওকে। কি হলো– হঠাৎ এমন বিশ্রী লাগছে কেন? আর স্থির থাকতে পারে না মুরাদ, ধীরে ধীরে সরে পড়ে।

মুরাদ বেরিয়ে যেতেই বিরাট পাথরের দরজাখানা গুহার মুখ বন্ধ করে ফেলে। হঠাৎ মুরাদের ভয় বা ভীতির কোন কারণ ছিল না, আসলে আজ তার মদের মাত্রা খুব বেশি হয়েছিল।

মুরাদ চলে যেতেই মনিরা লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। কাঁদতে লাগলো ছোট্ট বালিকার মত। মাথার চুল টেনে ছিঁড়ল। ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করলো তবু তার কান্নার বিরাম নেই।

কেঁদে কেঁদে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো মনিরা। স্বপ্ন দেখছে সে, মনিরা কাঁদছে–কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। আর কত কাঁদবে সে! হঠাৎ গুহার দরজা খুলে যায়। মনিরা চমকে উঠে বসলো। একি! গুহার দরজায় মনির দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে ব্যাকুলতার ছাপ। মলিন বিষণ্ণ মুখমণ্ডল–ওষ্ঠদ্বয় শুষ্ক। তাকে দেখতে পেয়ে ওর চোখ দুটো খুশিতে দীপ্ত হয়ে ওঠে। অস্ফুট কন্ঠে ডেকে ওঠে সে–মনিরা তুমি এখানে। আর আমি তোমাকে গোটা পৃথিবী খুঁজে বেড়াচ্ছি। মনিরাও ওকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো। উচ্ছলকন্ঠে বলল–মনির তুমি এসেছো। ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ওর বুকে। হঠাৎ মাটি আঁকড়ে চিৎকার করে ওঠে– মনির– মনির! ঘুম ভেঙে যায় মনিরার–তাকিয়ে দেখে কেউ নেই–কিছু নেই-শূন্য গুহার মেঝেতে সে একা শুয়ে আছে।