» » তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

হতাশ হয়ে শয্যায় শুয়ে পড়লো বনহুর। আজ কতদিন তার এতটুকু বিশ্রাম হয় নি। অহরহ। মনিরার সন্ধানে সে উল্কার মত ছুটে বেড়িয়েছে। আহার ন্দ্রিা একেবারে পরিহার করেছে সে। নূরী জোর করে চারটি খাইয়ে দেয়, তাই সে বেঁচে আছে।

শুধু বনহুরই নয়, তার অনুচরগণও এতদিনে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায় নি। কেউ হোটেলের বয়ের কাজ নিয়েছে, কেউ বা ধোপা, কেউ নাপিত যে যেভাবে পারে মনিরার অনুসন্ধান করে চলছে।

যদিও সকলের মনে ঐ একটি প্রশ্ন, চৌধুরীকন্যার জন্য দস্যু বনহুরের এত মাথাব্যথা কেন, তবু কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা জিজ্ঞাসা করতে সাহসী হয় না। একদিকে ভয় অন্যদিকে লাখ টাকা পুরস্কারের লোভ দস্যু বনহুরের অনুচরগণকে উন্মত্ত করে তুলেছে। সবাই আপ্রাণ চেষ্টায় চৌধুরীকন্যাকে খুঁজে চলেছে।

এমন দিনে বনহুরের কয়েকজন অনুচর একটি যুবতাঁকে কোন লম্পট গুণ্ডাদলের কবল থেকে উদ্ধার করে এনে হাজির করলো তাদের আস্তানায়।

অনুচর ক’জনের আনন্দ আর ধরে না। সর্দার আজ খুশি হয়ে তাদের আশাতিরিক্ত পুরষ্কার দেবেন।

কথাটা প্রথম নূরীর কানে যায়। মনিরাকে পাওয়া গেছে জেনে সেই প্রথম ছুটে আসে বনহুরকে কিছু না জানিয়ে। কারণ মনিরার জন্য দস্যু বনহুরের মত লোক আজ কতদিন হলো উন্মাদের মত হয়ে পড়েছে। যদিও বনহুর মনিরার সম্বন্ধে নূরীর নিকট কিছু বলেনি তবু নূরী বেশ বুঝতে পারে বনহুর সেই মনিরার জন্য কত চিন্তিত।

নূরী বনহুরের মনিরাকে আগে দেখে নেবে।

নূরী ছুটে গেল আস্তানার বাইরে যেখানে বনহুরের অনুচরগণ মেয়েটিকে এনে জটলা পাকাচ্ছে।

নূরী আসতেই সবাই সরে দাঁড়ালো।

নূরী এগিয়ে গেল মেয়েটির পাশে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। যুবতীর বয়স সতের কি আঠারো হবে। ছিপছিপে মাঝারি গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা চেহারা বিশ্রী। নাকটা চ্যাপ্টা। নূরী ওকে দেখে হাসলো এই যার রূপের ছিরি, তাকেই কিনা খুঁজে মরছে হাজার হাজার লোক। নূরী জিজ্ঞাসা করলো এই, তোমার নাম?

মেয়েটা নূরীকে দেখে একটু আশ্বস্ত হয়েছিল। নইলে এই লোকগুলোর কার্যকলাপ তার কাছে মোটেই ভাল লাগছিল না। নূরীকে কথা বলতে দেখে খুশি হল, বলল–আমার নাম মনি।

নূরী ওর নাম শুনে ভাবলো, এই বুঝি সেই চৌধুরীকন্যা মনিরা, ওকে বুঝি সবাই মনি বলে ডাকে। নূরীর মায়া হলো ভাবলো অযথা বনহুরকে সে সন্দেহ করে চলেছে। এমন চেহারার কোন। মেয়েকে কোন পুরুষ ভালবাসতে পারে? বনহুর লোকের কষ্ট ব্যথা সহ্য করতে পারে না,তাই বুঝি। এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

নূরী মেয়েটার খাওয়া এবং বিশ্রামের আয়োজন করে চলে গেল বনহুরের কাছে।

বনহুর তখন বিছানায় চিৎ হয়ে আকাশ পাতাল কত কি ভাবছে এমন সময় নূরী গিয়ে বসলো তার সামনে। আজ নূরীর মুখ হাস্যোজ্জল। আজ ক’দিন নূরী বনহুরের সামনে আসে, পাশে বসে কথা বলে কিন্তু ঠিক আগের মত স্বচ্ছমনে কথা বলতে পারে না। তেমনি করে আগের মত হাসতে পারে না। বনহুর তার পাশে রয়েছে তবু মনে হয় অনেক দূরে-নূরীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আজ নূরীর মন থেকে একটা কালো মেঘ যেন কেটে গেছে। মনিরা সম্বন্ধে তার যে একটা ধারণা ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। হেসে বলল নূরীহুর, তোমার মনিকে পাওয়া গেছে।

মনি? মনিরাকে পাওয়া গেছে!

হ্যাঁ, তাকে আমাদের আস্তানাতেই আনা হয়েছে। এখন সে বিশ্রাম কক্ষে বিশ্রাম করছে।

বনহুর নূরীর কথায় অত্যন্ত বিস্মিত হলো–দু’হাতে নূরীকে এঁটে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো–সত্যি? সত্যি বলছ নূরী?

হ্যাঁ হ্যাঁ যাও, ওকে দেখে এসো।

বনহুর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ছুটলো আস্তানার দিকে।

বনহুরকে দেখেই কয়েকজন অনুচর আনন্দ ভরা কন্ঠে বললো সর্দার চৌধুরীকন্যাকে আমরা উদ্ধার করে এনেছি।

বনহুর বলে ওঠে–কোথায় সে?

মেয়েদের বিশ্রামাগারে বিশ্রাম করছে।

বনহুর আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে বিশ্রামাগারের খোঁজা পাহারাদারকে ডেকে বললো– যাকে এইমাত্র উদ্ধার করে আনা হয়েছে, তাকে পাঠিয়ে দাও।

খোঁজা পাহারাদার চলে গেল।

বনহুর বাইরে পায়চারী শুরু করলো। অন্য কোন ব্যাপারে হলে দরবারকক্ষে বসে তাকে। সেখানে ডেকে পাঠাতো সে। কিন্তু এ যে মনিরা–তার হৃদয়ের রাণী।

পদশব্দে ফিরে তাকালো বনহুর খোঁজা পাহারাদারের পেছনে ঘোমটা টানা একটা নারী।

বনহুরের চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটে উঠল। সে দ্রুত হস্তে একটানে যুবতীর ঘোমটা সরিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখমণ্ডল গম্ভীর বিষণ্ণ হলো। এই কি তার মনিরা। রাগে ক্ষোভে অধর দংশন করতে লাগলো। মেয়েটি বনহুরকে দেখে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বনহুর দক্ষিণ হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো তারপর ডাকালো রহমান, রহমান।

অনুচরদের মধ্য থেকে একজন বললো–রহমান ভাই এখনও ফেরেনি সর্দার।

বনহুর তাকেই ডাকলো–মংলু।

জ্বী সর্দার।

একে জিজ্ঞাসা করো–কোথায় এর বাপ মা, আত্মীয় স্বজন পৌঁছে দিয়ে এসে সেখানে। কোন অসুবিধা যেন না হয় ওর।

আচ্ছা সর্দার।

বনহুর ততক্ষণে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করেছে।

নূরী মেয়েটাকে পূর্বেই দেখেছে। একটা অবজ্ঞা ভাব ফুটে উঠেছে তার মনে। কতকটা আশ্বস্ত হয়েছে। তার হুরকে নিয়ে আর কোন চিন্তার কারণ নেই। কাজেই সে আর বনহুরকে অনুসরণ না করে সেই কক্ষেই বসে ছিল।

বনহুরকে অল্পক্ষণের মধ্যেই গম্ভীর মুখে ফিরে আসতে দেখে নূরী হেসে বলে–মনিকে পেয়েছ?

বনহুর ধপ করে শয্যায় বসে পড়ে বলে–হ্যাঁ।

কোথায় সে?

পাঠিয়ে দিয়েছি।

তার বাপ মার কাছে বুঝি?

হ্যাঁ।

কই, তোমার মনিরাকে পেয়েও তোমার মুখে হাসি ফুটলো না আশ্চর্য। এসো ঝর্ণার ধারে যাই। নূরী বনহুরের দক্ষিণ হাত ধরে টেনে তোলে।

ঝর্ণার ধারে গিয়ে পাশাপাশি বসে ওরা।

নূরী বলে–দেখ হুর, কত সুন্দর স্বচ্ছ জলধারা। আমার মনে হচ্ছে, অনেকগুলো মেয়ে যেন একসঙ্গে হাসছে।

না, কাঁদছে। কথাটা গম্ভীর ভাবাপন্ন কণ্ঠে বলে বনহুর।

ছিঃ তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ। এসো, আমার কোলে মাথা রেখে শোও। দেখ হুর কি সুন্দর নীল আকাশ। ঐ যেন শুভ্র বলাকাগুলো ডানা মেলে উড়ে চলেছে তোমার কি মনে হয় না আমরাও অমনি করে ডানা মেলে উড়ে যাই?

উঁহু জানতো আমি দস্যু।

হলেই বা।

দস্যুর মনে কি কাব্যের রঙ লাগে? ওসব তোমাদের চোখে ভাল লাগে।

নূরী বনহুরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে, তারপর গুণ গুণ করে গান ধরে।

বনহুর নীরবে তাকিয়ে থাকে পশ্চিম আকাশে অস্তাচলগামী সূর্যের ক্ষীণ রশ্মির দিকে– ভাবে, তার মনিরার জীবন সূর্যও বুঝি এমনি করে নিঃশেষ হয়ে আসছে।

মনিরার কথা মনে পড়তেই বনহুর সোজা হয়ে বসে। এখন তার বসে থাকার সময় নয়। চঞ্চল হয়ে ওঠে বনহুর।

নূরী উঠে বসে দু’হাতে বনহুরের গলা বেষ্টন করে বলে–ভাল লাগছে না তোমার?

বনহুর কোন জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

নূরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অভিমানে ভরে ওঠে তার মন, বনহুর ততক্ষণে সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে।

নিজের কক্ষে প্রবেশ করে পায়চারি করতে থাকে বনহুর। এমন সময় রহমান দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়–সর্দার, আমি এসেছি।

ভেতরে এসো। গম্ভীর গলায় বলে বনহুর।

রহমান ছিন্নভিন্ন মলিন বসন পরিহিত অবস্থায় ভেতরে প্রবেশ করে–সর্দার।

বল?

আজ আমি ভিখারীর বেশে বেরিয়েছিলাম।

কোন সন্ধান পেয়েছ?

পেয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো উপকার হবে কিনা জানি না।

বনহুর খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে প্রশ্ন ভরা ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকায় রহমানের মুখের দিকে।

রহমান বলে–সর্দার আমি আজ ভিখারীর বেশে পুলিশ অফিসের পিছনে গিয়ে বসেছিলাম। আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। অফিসের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। আমি যা শুনতে পেলাম, তার সারাংশ হচ্ছে এই–একটা পোড়াবাড়ির সন্ধান নাকি তারা পেয়েছিল। সে বাড়ির একটা গোপন কক্ষে চৌধুরী কন্যাকে আটক করে রাখা হয়েছিল। এখন সেখানে-মানে সেই বাড়ি শূন্য পড়ে রয়েছে, সেখানে কাউকে তারা পায়নি।

এটুকু শুধু শুনেছিলে?

হ্যাঁ সর্দার, পুলিশ অফিসের বাইরে থেকে শুধু ভাঙা ভাঙাভাবে এইটুকু আমার কানে এসেছিল।

বেশ, তুমি এখন যাও, বিশ্রাম করাগে।

রহমান বেরিয়ে যায়।

বনহুর মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু চিন্তা করে। হঠাৎ তার মুখোভাব বেশ স্বচ্ছ হয়ে আসে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ড্রেসিংরুমে। প্রবেশ করে।

জম্বুর বনের পথে ছোট্ট পাহাড়টির পাদমূলে একটি টিলার পাশে জটাজুটধারী ভস্মমাখা বাঘের চামড়া পরিহিত একজন সন্ন্যাসীর আর্বিভাব হয়েছে। চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত। ললাটে চন্দনের তিলক। দক্ষিণ হাতে আশা। মুখে চাপদাড়ি। বিড়বিড় করে মন্ত্র জপ করছে।

সে অঞ্চলের সকলেই সন্ন্যাসীর আবির্ভাবে মুগ্ধ ও আনন্দিত হয়েছে। নিশ্চয়ই এ সন্ন্যাসী মহাদেব শিবশঙ্করের কোন ভক্ত বা শিষ্য। কারণ সন্ন্যাসীর চেহারা অতীব প্রশান্তিময় পবিত্রময় প্রশান্ত ললাট উন্নত নাসিকা বিশাল বক্ষ উজ্জ্বল দীপ্ত মুখমণ্ডল। সবাই এই দেবসমতুল্য সন্ন্যাসীর।– সেবায় আত্মনিয়োগ করলো। কেউ বা ফলমূল নিয়ে হাজির হলো তার সামনে, কেউ বা ফুল নিয়ে গেল তার পূজার জন্য।

নানা জন নানা মনোবাসনা নিয়ে সন্ন্যাসীর চরণযুগল আঁকড়ে ধরলো। কেউ সন্তান আশায়, কেউ বা মামলা মোকদ্দমার জন্য, কেউ ভালবাসা কামনায়। সন্ন্যাসীর সামনে ভক্তের দল জটলা পাকাতে লাগল।

কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই শুনল এই সন্ন্যাসীর কথা।

একদিন মুরাদের কানেও পৌঁছল সন্ন্যাসীর আগমনবার্তা। এ কথাও সে জানতে পারল সন্ন্যাসী বাবাজীর আশীর্বাদে সকলেরই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়।

মুরাদ চিন্তা করলো–আজও সে মনিরাকে বশীভূত করতে পারল না। তার সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হতে চলেছে। মনিরাকে জোরপূর্বক সে আটকে রাখতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ মনিরা তাকে মনেপ্রাণে ভাল না বাসছে, ততক্ষণ তার এ আটকে রাখায় কোন সাফল্য নেই।

একদিন রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করে মুরাদ সন্ন্যাসী বাবাজীর নিকটে গেল। তখন সন্ন্যাসী একা ছিলেন। কোনো লোকজন ছিল না তার পাশে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে মুরাদ লুটিয়ে পড়ল সন্ন্যাসীর পায়ে। ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলল–বাবাজী বাবাজী, আমার প্রতি সদয় হোন, আমার প্রতি সদয় হোন। আমি বড় দুঃখী…..

বারবার অনুনয় বিনয় করায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন সন্ন্যাসী বাবাজী। শান্ত সুমিষ্ট গম্ভীর কণ্ঠে বলেন–বৎস, আমি জানি তুমি কি চাও। কিন্তু যা চাও, তা পাবার নয়! সন্ন্যাসী বাবাজী নীরব হলেন।

মুরাদ অশ্রুবিগলিত কণ্ঠে বলে ওঠে–বাবাজী, তাহলে উপায়? বলুন, বলুন, আমি কি করে তার মন পাব?

সন্ন্যাসী আবার নিশ্চুপ।

গভীর রাতের অন্ধকারে মাটির প্রদীপের ক্ষীণালোক সন্ন্যাসী বাবাজীকে পাথরের মূর্তির মত স্থির মনে হচ্ছে। আশে পাশে ঝোঁপঝাড়ের মধ্য থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ।

মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতাগুলো টুপটাপ করে খসে পড়ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে। শেয়ালের ডাক। মেঘশূন্য স্বচ্ছ আকাশ। অসংখ্য তারা জ্বলছে সেখানে। সন্ন্যাসী চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন–মেয়েটার নাম উচ্চারণ কর। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নাম উচ্চারণ করবে। একবার, দু’বার, তিনবার। খবরদার! ততক্ষণ নিঃশ্বাস নেবে না।

মুরাদ নিঃশ্বাস বন্ধ করে তিনবার উচ্চারণ করলো–মনিরা…… মনিরা–মনিরা…..

ব্যাস! আবার চোখ বন্ধ করলেন সন্ন্যাসী বাবাজী। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়ালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বলেন–বৎস! কন্যার নামের সঙ্গে তোমার নামের মিল রয়েছে। মুরাদ আর মনিরা।

সন্ন্যাসীর মুখে নিজ নাম শুনে অত্যধিক বিস্মিত হলো মুরাদ। সে তো তাঁকে নিজের নাম বলেনি। ভক্তিতে নুয়ে পড়লো মুরাদ।

সন্ন্যাসী আবার জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি তাকে স্পর্শ করেছ?

না, সে মেয়ে নয় যেন কালনাগিনী। তার নিকটে গেলে আমি তার চোখের দিকে চাইতে পারি না। মনে হয় ওর নিঃশ্বাসে আগুন ঝরছে। সে আগুনে আমি জ্বলেপুড়ে ছাই হবার জোগাড় হই।

বেশ।

মুরাদ অভিমানভরা কণ্ঠে বলে–এটা বেশ! আমি তাকে ভালবাসি আর সে আমাকে বিষচোখে দেখে-এটা বেশ?

বৎস! ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। তাকে তুমি পাবে। অতি নিজের করে পাবে, কিন্তু সে যাকে ভালবাসে তাকে ওর মন থেকে মুছে ফেলতে হবে।

এ কথা আমিও ভেবেছি, কিন্তু তার কোন উপায় নেই। বাবাজী, মনিরা যাকে ভালবাসে সে দস্যু বনহুর।

হ্যাঁ, আমি গণনায় তারই নাম খুঁজে পেয়েছি।

বাবাজী, ঐ দস্যু বনহুরকে নিপাত করা যায় না? ওকে নিহত করতে পারলে মনিরা আমার হবে।

হাঁ, সে কথা আমিও ভাবছি। কিন্তু বনহুরকে নিপাত করতে হলে চাই সাধনা। তাহলে তুমি অসীম শক্তি লাভ করবে।

কি সাধনা করতে হবে বাবাজী?

সব পরে বলব। তুমি কিছু ভেবো না। আজ যাও, আবার কাল গভীর রাতে এমন সময় এখানে আসবে। মনিরাকে সঙ্গে এনো, ওর বস্ত্রাঞ্চলের ওপর বসে তোমাকে ধ্যান-সাধনা করতে হবে।

বাবাজী, আমি আপনাকে অজস্র অর্থ দেবো।

সন্ন্যাসী কোনদিন অর্থলোভী হয় না। যাও আর বিলম্ব করো না, আমার ধ্যানের ব্যাঘাত হচ্ছে।

মুরাদ সন্ন্যাসী বাবাজীর চরণধূলি মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যায়।

পরদিন আবার আসে মুরাদ।

গোটা পৃথিবী সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে। আকাশ আজ স্বচ্ছ নয়। সন্ধ্যার পর থেকে ঝুপঝাঁপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতের রাত-তদুপরি দুর্যোগময় মুহূর্ত। নিমেল হাওয়া মানুষের হাড়ে হাড়ে কাঁপন লাগায়। জন প্রাণী শূন্য পথ বেয়ে মুরাদ এসে দাঁড়াল সন্ন্যাসী বাবাজীর সামনে। বিনীত কণ্ঠে ডাকলো–বাবাজী।

সন্ন্যাসী বাবাজীর শরীর সিক্ত হয়ে উঠছে। জটা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি। বিদ্যুতের আলোতে সন্ন্যাসীকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। সংসারত্যাগী মানুষ, তার আবার শীত-তাপ কিছু আছে। চোখ বন্ধ করে কি যেন মন্ত্র জপ করছেন। মুরাদের কণ্ঠস্বরে চোখ মেলে তাকালেন সন্ন্যাসী বাবাজী। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলেন–সঙ্গিনী কই?

মুরাদ হাতজোড় করে কম্পিত গলায় বলল–বাবাজী, তাকে আনতে পারলাম না। পাহাড় নড়বে তবু সে নড়বে না। জোরপূর্বক আনা যায় বাবাজী, আপনি যদি বলেন, তাকে লোক দিয়ে পাকড়াও করে আনতে পারি।

দরকার নেই।

তাহলে আমার সাধনা হবে না!

হবে বৎস, তোমার দুঃখ আমার হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। তুমি যাকে চাও সে তোমাকে চায় না-বড় দুঃখ।

তাহলে কি করব?

আমি যাব সেখানে।

আনন্দে অস্ফুটধ্বনি করে ওঠে মুরাদ–বাবাজী!

হ্যাঁ, আমি যাবো। কিন্তু জানো বৎস, আমি লোকের সামনে যাই না।

আমি আপনাকে অতি গোপনে সেখানে নিয়ে যাব। বাবাজী, কি বলে যে আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো।

দরকার নেই।

চলুন তাহলে বাবাজী?

চলো।

এক হাতে আশা, আর এক হাতে রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সন্ন্যাসী বাবাজী।

আগে চলল মুরাদ, পেছনে চললেন সন্ন্যাসী বাবাজী।

গহন বনের মাঝ দিয়ে পাহাড় আর টিলার পাশ কেটে এগিয়ে চলেছে মুরাদ আর সন্ন্যাসী বাবাজী। বৃষ্টি থেমে এসেছে, কিন্তু মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের চমকানী এখনও থেমে যায়নি।

মুরাদের হাতে ছিল একটা টর্চ, তারই আলোতে পথ দেখে এগুচ্ছিল তারা। প্রায় ঘণ্টা দুই চলার পর জম্বুর পর্বতের পাদমূলে গিয়ে পৌঁছল মুরাদ আর সন্ন্যাসী বাবাজী।

ঝোঁপঝাড় আর জঙ্গলে ঘেরা জন্ধুর পর্বতের গা ঘেঁষে কিছুটা এগুলো। এই পথটুকু চলতে তাদের কষ্ট হচ্ছিল। আরও কিছুটা এগুনোর পর মুরাদ একস্থানে দাঁড়িয়ে একবার, দু’বার, তিনবার শিস্ দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ হলো। দেখা গেল পর্বতের পাদমূল ধীরে ধীরে একপাশে সরে যাচ্ছে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে সুন্দর একটা সুড়ঙ্গপথ বেরিয়ে এলো. দু’জন মশালধারী ভীষণাকার লোক সুড়ঙ্গমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

মুরাদকে দেখে তারা সরে দাঁড়ালো, সন্ন্যাসী বাবাজীকে নিয়ে মুরাদ অতি সন্তর্পণে গুহার মধ্যে প্রবেশ করল। একটি নয়, দুটি নয়-প্রায় সাতটি গুহার মুখ পেরিয়ে মুরাদ সন্ন্যাসী বাবাজীকে নিয়ে একটি পাথরখণ্ডের নিকট দাঁড়ালো। তারপর পাশে একটি যন্ত্রে হাত রাখতেই পাথর হুড়হুড় শব্দে একপাশে সরে গেল।

সন্ন্যাসী বাবাজী আর মুরাদ সেই গুহায় প্রবেশ করলো। গুহার মধ্যে এককোণে একটি মশাল জ্বলছিল। এক পাশে একটি দড়ির খাট। খাটে শুয়ে ছিল এক যুবতী।

মুরাদ আর সন্ন্যাসী বাবাজীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকালো যুবতী। মুরাদের সঙ্গে জটাজুটধারী সন্ন্যাসী দেখে সে চমকে উঠলো। ভয়ে পাংশু হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল। আলুথালু। বেশে উঠে দাঁড়াল।

মুরাদ সন্ন্যাসী বাবাজীকে লক্ষ্য করে বললো–এই সেই মনিরা।

সন্ন্যাসী বাবাজী অস্কুটস্বরে বলেন–হু।

মুরাদ ভক্তিভরে মাথা নত করে বললো–বাবাজী, সব আমি আপনাকে বলেছি, আর…..

থাক, আর বলতে হবে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মনিরার দিকে তাকালেন সন্ন্যাসী বাবাজী। তারপর বলেন “তুমি বাইরে যাও, তোমায় যখন ডাকবো তখন ভেতরে এসো-সাধনা শুরু হবে।

মুরাদ খুশিমনে বেরিয়ে গেল।

সন্ন্যাসী মনিরার দিকে এগুলেন। মশালের আলোতে নিপুণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন। তারপর বলেন–এসো, তোমার মাথায় ফুঁ দিই।

না। দৃঢ় কণ্ঠস্বর মনিরার।

যুবতী, তোমাকে সে চায়–কেন ওকে তুমি পায়ে ঠেলছো?

রুদ্ধকণ্ঠে বলে মনিরা–ওকে আমি চাই না। প্রাণ যদি যায় তবুও না!

কিন্তু আমি এমন মন্ত্র পাঠ করে তোমায় ফুঁ দেবো তখন দেখবে সে–ই তোমার প্রিয়জন হয়ে দাঁড়াবে।

মনিরা আকুলভাবে কেঁদে উঠলো-না না সন্ন্যাসী, আপনি আমার সর্বনাশ করবেন না। তার চেয়ে আমাকে হত্যা করুন।

তা হয় না। সে আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে তবেই এখানে এনেছে। আমি তাকে ফাঁকি দিতে পারি না।

আপনি সংসারত্যাগী মহাপুরুষ, আপনি একজন মহান ব্যক্তি, একটি নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সর্বনাশ করতে পারবেন? আপনার হৃদয় কি এতটুকু কাঁপবে না?

যুবতী, আমি সকলেরই মঙ্গলাকাঙ্খী। তুমি কি চাও-বলতে পার?

মনিরা যেন অন্ধকারে আলোর সন্ধান পায়। ব্যাকুলকণ্ঠে বলে–আপনি আমাকে বাঁচান…..

সন্ন্যাসী গম্ভীরকণ্ঠে বলেন–বুঝেছি, তুমি একজনকে ভালবাস।

হ্যাঁ বাসি।

কে সে?

না না, তা বলতে পারি না।

পারতে হবে। আমি তাহলে তোমাকে তার নিকট পৌঁছে দেব।

সত্যি?

হ্যাঁ, বল তার নাম কি? অবশ্য তুমি না বললেও আমি যোগবলে জানতে পেরেছি। যাকে তুমি ভালবাস-সে দস্যু বনহুর।

মনিরা অস্কুটধ্বনি করে ওঠে-সন্ন্যাসী, আপনি সবই জানেন। আমাকে এই লম্পট শয়তানের হাত থেকে বাঁচান-বাঁচান-আকুলভাবে কেঁদে ওঠে মনিরা।

সন্ন্যাসী মনিরার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলেন–ক্ষান্ত হও। যদি আমাকে বিশ্বাস করো তবে তোমাকে তোমার প্রিয়ের নিকট পৌঁছে দিতে পারি!

সত্যি?

হ্যাঁ, তুমি মুরাদের সঙ্গে আমার আস্তানায় যেও, আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব। আর যা বলি সেইমত কাজ করো-মুরাদের হাতে হাত রাখতে বললে রাখবে, তোমার আঁচল বিছিয়ে ওকে বসতে দেবে।

আচ্ছা।

মনে থাকবে সব কথা?

থাকবে।

সন্ন্যাসী এবার হাতে তালি দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করলো মুরাদ–বাবাজী আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ বৎস, সময় সংকীর্ণ। আমাকে শীঘ্র যেতে হবে। তার পূর্বে আমি তোমার সাধনা শেষ করতে চাই। দেখো বৎস, ওকে আমি মন্ত্রে বশীভূত করে ফেলেছি। হাত পাতো–

মুরাদ দক্ষিণ হাত প্রসারিত করলো।

মনিরাকে ইঙ্গিত করলো সন্ন্যাসী তার হাতের ওপর হাত রাখতে।

মনিরা ধীরপদে এগিয়ে এসে মুরাদের হাতের ওপর দক্ষিণ হাতখানা রাখলো।

সন্ন্যাসী বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন।

মুরাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এত অল্প সময়ে মনিরা এতখানি বশীভূত হয়েছে–বড় আনন্দের কথা!

এবার সন্ন্যাসী মনিরাকে আঁচল পেতে বসতে বলে। মনিরা আঁচল পেতে বসলো। মুরাদকে বললো–বৎস, ওর আঁচলে বসো।

মুরাদ গুরুদেবের আদেশ পালন করলো।

কিছুক্ষণ স্ন্যাসী মন্ত্র পাঠ করার পর বলে উঠলেন–আজ সাধনা শেষ হলো না, কিছু বাকি রইলো। তুমি কাল মনিরাকে নিয়ে আমার আস্তানায় এসো, বাকিটুকু শেষ করবো। সাবধান, সাধনা শেষ হবার পূর্বে যেন মনিরাকে স্পর্শ করো না, তাহলে সব পণ্ড হয়ে যাবে–আজ সময় সংকীর্ণ-আমি চললাম।

বাবাজী, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব?

দরকার হবে না।

মুরাদ সন্ন্যাসী বাবাজীকে গুপ্ত গুহার বাইরে পৌঁছে দেয়। বিদায়কালে বার দুই সন্ন্যাসীর চরণধূলি গ্রহণ করে সে।

মনিরার নিখোঁজের পর চৌধুরী সাহেব এবং তার স্ত্রী মরিয়ম বেগমের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অবিরত কাদা কাটি করে চলেছেন তাঁরা। চৌধুরী সাহেব একে ভাগনী মনিরার জন্য গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়ে পড়েছেন, তদুপরি স্ত্রীর জন্য তিনি বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

সেদিন দ্বিপ্রহরে চৌধুরী সাহেব স্ত্রীর শিয়রে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, এমন সময় বয় এসে জানালো-স্যার, ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছেন, আপনার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে।

চমকে উঠলেন চৌধুরী সাহেব, হঠাৎ এ সময়ে–কোন সন্ধান পেয়েছে কি তারা?

মরিয়ম বেগমও উদ্বিগ্ন হলেন, বলেন–”ওগো, দেরী করো না-যাও, দেখো কি সংবাদ তাঁরা এনেছেন।

যাচ্ছি।

চৌধুরী সাহেব ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন মি. হারুন এবং মি. হোসেন বসে আছেন। উভয়ের মুখমণ্ডলেই বেশ চঞ্চলতা ফুটে উঠেছে। চৌধুরী সাহেবকে দেখেই সালাম জানালেন। তারপর মি. হারুন বলেন–চৌধুরী সাহেব, অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার ভাগনী মিস মনিরার একটি চিঠি আমাদের হস্তগত হয়েছে।

মনিরা চিঠি লিখেছে-কই-কই সে চিঠি? ব্যস্তভাবে চৌধুরী সাহেব এগিয়ে গেলেন মি. হারুনের দিকে।

বসুন আমি দেখাচ্ছি। পকেট থেকে একটি ভাঁজকরা কাগজ বের করে বলেন–এই নিন।

চৌধুরী সাহেব সোফায় বসে কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরেন। ধীরে ধীরে তার মুখমণ্ডল স্বাভাবিক হয়ে এলো!

মি. হারুন এবং মি. হোসেন এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৌধুরী সাহেবের মুখমণ্ডল লক্ষ্য করছিলেন। এবার মি. হারুন জিজ্ঞাসা করলেন-চৌধুরী সাহেব, এই চিঠিখানা তাহলে সত্যিই আপনার ভাগনী মিস মনিরার হতের লেখা?

হাঁ ইন্সপেক্টার।

তাহলে আপনার ভাগনী মিস মনিরা স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করেছে, সে এখন আপনার পুত্র দস্যু বনহুরের পাশে সুখে দিন কাটাচ্ছে।

চিঠিতে আপনি এখনও আপনার ভাগনীর অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকতে চান?

চৌধুরী সাহেব এ কথার কোন জবাব দিতে পারেন না, নিশ্চুপ থাকেন।

মি. হোসেন বলেন–একথা জানার পরও যদি আপনি ভাগনীর নিখোঁজ ব্যাপারে চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন, তবে এতে আপনার কলঙ্ক বাড়বে।

হ্যাঁ চৌধুরী সাহেব এখন আপনার শান্ত থাকাই উচিত। কারণ যে নারী স্বেচ্ছায় কোন পুরুষের সঙ্গে বেরিয়ে যায় বা গৃহ ত্যাগ করে, তাকে খোঁজ করা বাতুলতা মাত্র! তাছাড়া বনহুর আপনারই পুত্র। এ কথাও আপনি একদিন আমাদের নিকট বলেছেন যে, আপনার সন্তানকে মনিরা ভালবাসে। বলেন মি. হারুন?

চৌধুরী সাহেব আনমনে বলেন–হ্যাঁ ইন্সপেক্টর সাহেব, মনিরা কি ভালবাসে।

তাহলে তো আপনার আর ব্যস্ত হবার কারণ নেই?

না।

মি. হারুন উঠে দাঁড়াল–চলি তাহলে চৌধুরী সাহেব?

চৌধুরী সাহেব নিরুত্তর, তিনি যেন পাথরের মূর্তির মতই স্তব্ধ হয়ে গেছেন।

মি. হারুন এবং হোসেন ড্রইংরুমে থেকে বেরিয়ে যান।

চৌধুরী সাহেব কলের পুতুলের মত ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। সিঁড়ির মুখেই উদ্বিগ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছেন মরিয়ম বেগম। স্বামীকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে দেখে বলেন–কি সংবাদ, কেন এসেছিলেন ওরা?

চৌধুরী সাহেব কোন কথা না বলে হাতের চিঠিখানা মরিয়ম বেগমের হাতে দিলেন-পড়।

কার চিঠি?

মনিরার।

মনিরার চিঠি!

হ্যাঁ, পড়ে দেখ।

তুমিই পড়না, আমার চোখ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এসেছে। স্ত্রীর হাত থেকে আবার চিঠিখানা নিয়ে পড়তে শুরু করেন চৌধুরী সাহেব

“মামুজান, তোমরা আমার জন্য মনে হয় খুব চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছ। কিন্তু আমার জন্য তোমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি মনিরের সঙ্গে চলে এসেছি এবং এখন তার পাশে রয়েছি। “

— তোমাদের মনিরা

মরিয়ম বেগমের মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, খুশিভরা কণ্ঠে বলেন–মনিরাকে তাহলে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি? খোদা তুমি আমাকে বাঁচালে।

রাগতঃকণ্ঠে বললেন চৌধুরী সাহেব-মান-ইজ্জতের মাথা খেয়ে সে আমাদের উদ্ধার করেছে-না? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সব গেল, আমার কিছু আর বাকি রইলো না!

ওগো, কেন তুমি রাগ করছ? ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসে–এ আমাদের সৌভাগ্য।

কলঙ্কটা কোথায় যাবে?

কলঙ্ক! কি যে বল, কিসের কলঙ্ক? মনিরার বিয়ে মনিরের সঙ্গেই হবে, এতে আবার কলঙ্ক কিসে?

তাই বলে এভাবে-না না, আমার সব গেল–মান-সম্মান-ইজ্জত সব গেল!

শান্ত হও। চলো,ঘরে চলো। স্বামীর হাত ধরে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন মরিয়ম বেগম।