আজকের দিনে লেখক মাত্রেই সাহিত্যিক এবং পাঠক মাত্রেই সমালোচক। অতএব দুশ্চিন্তার কারণ নেই কোনো তরফেই। একদিকে রইল আমার লেখনী, আরেক দিকে রইল আপনার রসনা; আর উভয়ের মধ্যে রইল যথেচ্ছ উদগিরণের অবাধ অধিকার।
আগের দিনে সাহিত্যের একটা নিজস্ব এলাকা ছিল। শ্যেনচক্ষু সাহিত্যরথীরা লগুড- হস্তে সীমান্ত রক্ষা করতেন। তাঁরা আজ অন্তর্হিত। সাহিত্যের সীমা-রেখাও বিলুপ্তপ্রায় আজকের যাঁরা মহারথী, তাঁদের নয়নে জনতোষণের অঞ্জন, কণ্ঠে গণদেবতার জিন্দাবাদ। তাই সাহিত্যের আসরে চলছে সর্বজনীন দুর্গোৎসব—ঢাক, ঢোল, সানাই, কাঁসি আর লাউড স্পীকারের হুঙ্কার। নিছক রসস্রষ্ট্রা যাঁরা তাঁদের ক্ষীণকণ্ঠ আর শোনা যায় না। কর্কশ কণ্ঠে আস্ফালন করছে ঐতিহাসিকের দম্ভ, দার্শনিকের দ্বন্দ্ব, বৈজ্ঞানিকের বাগাড়ম্বর আর রাষ্ট্রবিদের জিগির। এঁরাই এ যুগের সাহিত্যিক। সাম্যবাদ এবং মন্বন্তর থেকে আরম্ভ করে বুনিয়াদী শিক্ষা ও কালোবাজার—সাহিত্য-মণ্ডপের উদার ছায়াতলে সকলেরই আজ সমান অধিকার।
আগের দিনে সাহিত্যের একটা নিজস্ব এলাকা ছিল। শ্যেনচক্ষু সাহিত্যরথীরা লগুড- হস্তে সীমান্ত রক্ষা করতেন। তাঁরা আজ অন্তর্হিত। সাহিত্যের সীমা-রেখাও বিলুপ্তপ্রায় আজকের যাঁরা মহারথী, তাঁদের নয়নে জনতোষণের অঞ্জন, কণ্ঠে গণদেবতার জিন্দাবাদ। তাই সাহিত্যের আসরে চলছে সর্বজনীন দুর্গোৎসব—ঢাক, ঢোল, সানাই, কাঁসি আর লাউড স্পীকারের হুঙ্কার। নিছক রসস্রষ্ট্রা যাঁরা তাঁদের ক্ষীণকণ্ঠ আর শোনা যায় না। কর্কশ কণ্ঠে আস্ফালন করছে ঐতিহাসিকের দম্ভ, দার্শনিকের দ্বন্দ্ব, বৈজ্ঞানিকের বাগাড়ম্বর আর রাষ্ট্রবিদের জিগির। এঁরাই এ যুগের সাহিত্যিক। সাম্যবাদ এবং মন্বন্তর থেকে আরম্ভ করে বুনিয়াদী শিক্ষা ও কালোবাজার—সাহিত্য-মণ্ডপের উদার ছায়াতলে সকলেরই আজ সমান অধিকার।
সমালোচকেরাও পেছনে পড়ে নেই। গতানুগতিক ধারা ত্যাগ করে তাঁরাও বেরিয়ে পড়েছেন নানা অভিনব পথে নব নব সাহিত্যের রস-সন্ধানে। ডক্টরেট যশঃপ্রার্থী জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হল, যাঁর গবেষণার বিষয় শুনলাম ‘বণিক-সাহিত্য’। উপকরণ যে-সব সংগ্রহ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে হাজার কয়েক বিজ্ঞাপন, কয়েক বস্তা ক্যাশমেমো এবং ডজন তিনেক বড় বড় শিল্পপতির বক্তৃতা। কোনো চর্ম-ব্যবসায়ীর বিল-ফর্মে তিনি নাকি এমন ঘনীভূত কাব্য-রসের সন্ধান পেয়েছেন যার আস্বাদন রবীন্দ্র- সাহিত্যেও সুলভ নয়।
আমার দুর্ভাগ্য, এই রস-গ্রহণের ক্ষমতা থেকে বিধাতা আমাকে বঞ্চিত করেছেন বাণিজ্যলক্ষ্মীর স্বর্ণ-সিংহাসনের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি আমার কারো চেয়ে কম নয়, সরস্বতীর কমলবনে তাকে প্রতিষ্ঠিত দেখলে ব্যথিত হই। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা দিক, আপত্তি নেই, কিন্তু সুখী হই না যদি দেখি, তার রূপান্তর ঘটেছে কবির লেখনী কিংবা শিল্পীর তুলিকায়।
একথা জানি, সাহিত্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমার এই সংকীর্ণতা বর্তমান কালে অচল। আমার রচনা সম্বন্ধে আমার নিজের ধারণা যাই হোক্, কোনো অতি আধুনিক উদার সমালোচক হয়তো এরই মধ্যে এক অনাস্বাদিত কাব্যরস আবিষ্কার করে বসবেন। সুতরাং আশ্চর্য হবো না, যদি দেখি, আমারও খ্যাতি একদিন ছড়িয়ে পড়েছে জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে; ডাক পড়েছে অল্-ইণ্ডিয়া রেডিওর মজদুরমণ্ডলীর অধিবেশনে, কিংবা প্ৰধান অতিথির আসন টলে উঠেছে মফস্বল শহরের কোনো গণ-সাহিত্যের বার্ষিক সভায়। সে দুর্ঘটনা যদি কোনো দিন সত্যিই ঘটে, তবু নিজের কাছে একথা অস্বীকার করি কেমন করে যে, এই লেখনীর রেখায় যে-বস্তু রূপলাভ করল সেটা আর যাই হোক সাহিত্য নয়। জীবনে অনেক কিছু হবার আকাঙ্ক্ষা ছিল; কিন্তু সাহিত্যিক হবো বলে কোনো দিন দুরাশা পোষণ করিনি।
এই সুজলা সুফলা বাঙলা দেশে ব্যাধির অন্ত নেই। তার মধ্যে আছে দুটি সাধারণ ব্যাধি, যাকে বলা যেতে পারে তার জলবায়ুর ধর্ম—ম্যালেরিয়া ও কাব্য। এদের প্রকোপ থেকে পুরোপুরি রক্ষা পেয়েছে, এমন লোক তো কই একটাও চোখে পড়লো না শিক্ষিত বাঙালীর ঘরে! আমার পরম সৌভাগ্য, ম্যালেরিয়ার আক্রমণে বহুবার ধরাশায়ী হলেও কাব্যের কবলে ধরা দিয়েছিলাম শুধু একটি দিন। সেই প্রথম এবং সেই শেষ।
গ্রামের ইস্কুলে উপরের দিকে পড়ি। বাৎসরিক পরীক্ষা আসন্ন। রাত জেগে এবং কম্বল জড়িয়ে ইব্রাহিম লোদীর চরিত্র মুখস্থ করছিলাম। অতর্কিতে মানসপটে কবিতার আবির্ভাব। ইতিহাস বন্ধ করে খাতা টেনে নিয়ে লিখলাম—
চাঁদের আলোয় আজিকে কেন রে
নেচে ওঠে মোর প্রাণ।।
বলা প্রয়োজন, সময়টা ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত। চন্দ্রদেবের প্রত্যক্ষ আবির্ভাব সম্ভব ছিল না। দক্ষিণ হাওয়া, ফুলের সৌরভ ইত্যাদি যেসব বাহন আশ্রয় করে কাব্যলক্ষ্মী অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, তাদেরও ছিল একান্ত অভাব। তবু কি করে তিনি নিতান্ত অসময়ে আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন, সে রহস্য, আজও ভেদ করতে পারিনি। ভর যেমন করেই করুন, বহু চেষ্টা করেও কবিতার দ্বিতীয় ছন্দে অবরোহণ করাতে পারেননি। তারপর কখন এক সময়ে কাব্যের স্থানে নিদ্রার আগমন হয়েছিল, টের পাইনি। টের পেলাম, হঠাৎ কর্ণদেশে প্রবল আকর্ষণে। মুহূর্ত মধ্যে ইব্রাহিম লোদীর রাজ্যে যখন ফিরে এলাম, সবিস্ময়ে দেখি, আমার কবিতার দ্বিতীয় পংক্তি স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে—
নাচন থামিয়ে পড় ইতিহাস
নইলে ছিঁড়িব কান।
বুঝলাম, অদৃশ্য হস্ত শুধু আমার কর্ণপীড়ন করেই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে নিপুণভাবে করে দিয়েছেন আমার কবিতার পাদপূরণ।
শুনেছি আমার পূর্বে আর একটিমাত্র কবি এই দুর্লভ অভিজ্ঞতার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তিনি মহাকবি জয়দেব। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের লেখনীস্পর্শে তাঁর কাব্যস্রোত বয়ে চলেছিল বিপুল ধারায়। আর পিসেমশাই-এর শ্রীহস্ত-স্পর্শে আমার কাব্যপ্রবাহ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল। সেদিন মনে মনে যতই ক্ষুব্ধ হয়ে থাকি না কেন, আমার পরলোকগত পূজনীয় পিসেমশাই-এর উদ্দেশে বারংবার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শুধু আমার নয়, কৃতজ্ঞতার পাত্র তিনি আপনাদেরও। সেদিন কঠোর হস্তে কাব্য-চিকিৎসা করেছিলেন বলেই আপনারা অন্তত একজন আধুনিক কবির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। নইলে হয়তো দিনের পর দিন এই মুক্ত-হস্ত-নিক্ষিপ্ত রাশি রাশি গদ্য-কবিতার ‘ছেঁড়া মাদুর’, ‘ছ্যাকরা গাড়ি’ কিংবা ‘ভাঙা কোদাল’ আপনাদের কর্ণপটাহ বিদীর্ণ করে দিত।
আপনাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টি আমি লক্ষ্য করছি। কাব্য বা সাহিত্য সম্বন্ধে এই যদি তোমার সত্যিকার মনোভাব, এসব হচ্ছে কি? এর উত্তর আগেই দিয়েছি। এ সাহিত্য নয়, উপন্যাস নয়, এ শুধু—কি, আমি জানি না। যদি বলেন তারই বা কি প্রয়োজন ছিল? আমি নিরুত্তর। প্রয়োজন সত্যিই কিছু নেই। এইটুকু শুধু বলতে পারি, জীবনে এমন একটা পথে আমাকে চলতে হয়েছে, যেটা প্রকাশ্য রাজপথ নয়। সে এক নিষিদ্ধ জগৎ। সেখানে যাদের বাস, তাদের ও আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লৌহদণ্ডের যবনিকা। তার ওপারে পাষাণ-ঘেরা রহস্যলোক। কিন্তু তারাও মানুষ। তাদেরও আছে বৈচিত্র্যময় জীবনকাহিনী – সুখে সমুজ্জ্বল, দুঃখে পরিম্লান, হিংসায় ভয়ঙ্কর, প্রেমে জ্যোতির্ময়! সেই পাষাণপুরীর দীর্ঘ প্রকোষ্ঠের স্তব্ধ বাতাসে জমে আছে যে অলিখিত ইতিহাস, সভ্য পৃথিবী তাঁর কতটুকুই বা জানে? আমি যে সেখানে বিচরণ করেছি, এই দীর্ঘ জীবন ধরে, প্রভাতে, সন্ধ্যায়, নিভৃত রাত্রির অন্ধকারে—আমিই বা কতটুকু দেখেছি, কতখানিই বা শুনেছি! সে চোখ নেই, সে কান নেই, আর নেই সেই দরদ, যার স্পর্শে অন্ধ হয় চক্ষুষ্মান, বধির হয় শ্রুতিধর।
একেবারে যে পাইনি, তা হয়তো ঠিক নয়। সেই আঁধারলোকের কোন প্রাণী অকস্মাৎ কোনদিন ‘খুলেছিল তার অন্তরদুয়ার’। প্রবেশের অধিকার পেয়েছিলাম ক্ষণেকের তরে। আহরণ যা করেছি, তোলা আছে স্মৃতির মণিকোঠায়। এখানে যেটুকু দিলাম, সে শুধু আভাস কিংবা তার ব্যর্থ প্রয়াস।