—এই নিন।
—কী দিচ্ছেন?
—আপনার কিঞ্চিৎ নতুন খোরাক, বলে ও-পাশের টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে ধরলেন আমার সহকর্মী বিশ্বনাথবাবু। ভাঁজকরা কাগজখানা টেনে নিলাম। আজ সন্ধ্যায় যারা কোর্ট থেকে নতুন ভরতি হল, তাদেরই একজনের জেল-ওয়ারেন্ট। খলে দেখা গেল, চুরির অপরাধে তিনমাস সশ্রম কারাদণ্ড, এবং সঙ্গে পনেরো বেত। ৩৮১ ধারার কেস। অর্থাৎ চোরটি বাইরের লোক নয়, বাড়ির চাকর।
—হুইপিং দেখেছেন আপনি? প্রশ্ন করলেন বিশ্বনাথবাবু।
—বললাম, বেতমারা তো? তা দেখেছি বইকি। গ্রামের পাঠশালায় পড়েছিলাম তিন বছর।
—না, না; সে বেত নয়, জেলখানার বেত।
—আজ্ঞে না; সে সৌভাগ্য এখনও হয়নি।
—এইবার হবে। দেখবেন সে কি কাণ্ড। আর ‘দেখবেন’ বলছি কেন, দেখাবেন। মানে আপনারই কাজ ওটা। সব ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে।
পরদিন সকালেই কয়েদীটির দেখা পেলাম ‘কেস্-টেবিলে’। ১৭/১৮ বছরের জোয়ান ছোকরা। মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল। তার মাঝখানে দিয়ে চলে গেছে লম্বা টেরি। নাকটা বাঁশীর মতো। তার নীচে সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা।
—আপীল করবে? প্রশ্ন করলাম যথারীতি।
বিনা-দ্বিধায় উত্তর এল, না।
সুতরাং জেল-কোডের বিধানমতে এক পক্ষ পরে বেত্রদণ্ডের দিন স্থির করে ফেললাম। সকাল থেকেই শুরু হল আয়োজন। জেলের মাঝামাঝি একটি অনেক কালের নিমগাছ। তার নীচে খানিকটা খোলা জায়গা। চলতি নাম—নিমতলা। সেই ছায়া-ঢাকা সিমেন্ট- বাঁধানো চত্বরে রোজ জমাদারের দরবার বসে। তার চারদিক ঘিরে বড় বড় কয়েদীব্যারাক। বধ্যভূমির পক্ষে আদর্শ স্থান। সেইখানেই খাটানো হল সেই বিচিত্র যন্ত্র, জেলকোর্ডে যার নাম whipping triangle, সিপাই-কোর্ডে বলে ‘টিকটিকি’। এই নামকরণের তাৎপর্য এবং ইতিহাস আমার জানা নেই! এমন একটা ভয়াবহ বস্তুর সঙ্গে এই ক্ষুদ্র নিরীহ প্রাণীর নামটা যে কেন যুক্ত হল, সে গবেষণার জন্যে যোগ্যতর ব্যক্তির প্রয়োজন।
কাঠ এবং লোহা দিয়ে তৈরী ন’ ফুট লম্বা একটি ত্রিকোণ ফ্রেম। দেখতে খানিকটা ব্ল্যাকবোর্ডের স্ট্যাণ্ডের মতো। তার সঙ্গে লাগানো উপরে দুটো লোহার কড়া আর নীচে দুটো বেড়ি। খানিক দূরে এনামেলের গামলা-ভর্তি ডাক্তারি রসায়ন। তার পাশে সারি সারি দু’খানা বেত— লম্বায় হাত-তিনেক, ব্যাস আধ ইঞ্চি। এক দিকে কাপড়ে জড়ানো বাঁট, ধরবার সুবিধার জন্যে।
—দু-খানা কি হবে? জিজ্ঞাসা করলাম সামনের কয়েদীটিকে।
—বলা যায় না, একটা যদি ভেঙে যায়, উত্তর করল জমাদার।
সদলবলে সুপার এসে গেলেন। আসামীকে হাজির করা হল তাঁর সামনে। প্রশ্ন করলাম, কি নাম?
—মধুসূদন হালদার।
—কদ্দিনের সাজা?
—তিন মাস।
—আর?
—পনেরো বেত, থেমে থেমে বলল মধুসূদন। ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালো অদূরে দাঁড়ানো ‘টিকটিকি’ এবং তার পাশে শুইয়ে-রাখা বেত দু-খানার দিকে। দুজন মেট তাকে টেনে নিয়ে উপুড় করে ধরল পেছন-দিকে-হেলানো সেই ত্রিকোণফ্রেমের উপর। হাত এবং পা দুটো ছড়িয়ে ঢুকিয়ে দিল সেই কড়া আর বেড়ির মধ্যে। তারপর শক্ত করে এঁটে দিল স্ক্রু। কোমরের উপর দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে দিল চামড়ার বেল্ট। আগাগোড়া সমস্ত শরীরটা গাঁথা হয়ে গেল টিকটিকির সঙ্গে। খোলা রইল শুধু দুটি অঙ্গ—ঘাড় আর মাথা। বিবস্ত্র দেহ। শুধু কোমরের নীচে জড়িয়ে দেওয়া হল সেই গামলার জলে ভেজানো এক টুকরো পাতলা ন্যাকড়া।
এবার বীর বিক্রমে এগিয়ে এল বেত্র-জল্লাদ। ছ’ফুট লম্বা পেশোয়ারী। প্রস্থটাও দৈর্ঘ্যের সমানুপাত। নারীধর্ষণ মামলায় পাঁচ বছর সশ্রম দণ্ড নিয়ে সে এসেছিল জেলখানায়। কিন্তু অন্য সব কয়েদীর মতো বাঁধা-ধরা খাটনি বা task এই উষ্ণ মেজাজ বেয়াড়া চেহারার লোকটার ঘাড়ে চাপানো হয়নি। দরজি কিংবা কাঠ-কামান বা ঐ জাতীয় একটা কিছু যথারীতি ওই টিকিটেও লেখা আছে। সেটা কাগজ-কলমের ব্যাপার। কার্যক্ষেত্রে জুম্মা খাঁ গোড়া থেকেই বড় সাহেবের ছত্রধর আর বড় জমাদারের বডিগার্ড। এই দুইটি তার বৃত্তি। তার উপর মাঝে মাঝে এই বেত্রদানের পবিত্র কর্তব্য। এতগুলো কঠিন দায়িত্বপালনের উপযোগী দৈহিক সামর্থ্য বজায় রাখতে হলে কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত রসদের প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে উদাসীন নন। তাই হাসপাতাল থেকে এক পোয়া মাংস এবং এক ছটাক মাখন তার দৈনিক বরাদ্দ।
একখানা বেত তুলে নিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে যখন সে ঠিক জায়গাটিতে গিয়ে দাঁড়াল, তার উল্লাস-দীপ্ত মুখের দিকে একবার চেয়েই স্পষ্ট বোঝা গেল, মূল্যবান সরকারী খাদ্যের সার্থকতা প্রমাণ করতে সে চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
—এক! আকাশ ফাটিয়ে হুঙ্কার দিল বড় জমাদার। মুক্ত বাতাসে সন্-সন্ করে উঠল জুম্মা খাঁর বেত। তার মাথার উপরে একটা দ্রুত চক্কর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে পড়ল গিয়ে মধুসূদনের কোমরের নীচে।
—আঁ—আঁ—আঁ…সঙ্গে সঙ্গে এক বীভৎস আর্তনাদ।
মানুষের কণ্ঠে নয়, কোনো কোনো আহত জানোয়ারের কণ্ঠ থেকে শোনা যায় সেই নারকীয় শব্দ। হঠাৎ চোখে পড়ল সেই হলদে রং-এর ন্যাকড়ার মাঝখানটা বসে গেছে মাংসের ভিতর। তার উপর ভেসে উঠেছে লাল রং-এর ছোপ।
—দুই! গর্জে উঠল জমাদার সাহেব! সপাং করে উঠল বেত এবং তার সঙ্গে আবার সেই জানোয়ারের মৃত্যু-নিনাদ। বেতের সংখ্যা যেমন এগিয়ে চলল, ধীরে ধীরে নেমে এল গোঙানির পরদা। সাত-আট ঘা যখন পড়েছে তখন আর শব্দ নেই। নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম, বাঁচা গেল! এই চিৎকারটা যেন আর সহ্য হচ্ছিল না।
এবার তাকিয়ে দেখলাম ঘাড় সমেত মাথাটা ঝুলে পড়েছে ডান দিকে। হাত দুটো টান করে ঝুলিয়ে বাঁধা। হঠাৎ চোখের উপর ভেসে উঠল ক্রুশবিদ্ধ যিশুখৃষ্টের সেই পরিচিত ছবি। কয়েদীটা ভাগ্যবান বলতে হবে।
ডাক্তার যিনি উপস্থিত ছিলেন, তাঁর চাকরি বেশী দিনের নয়। লক্ষ্য করছিলাম, তাঁর মুখের উপর ফুটে উঠেছে উদ্বেগের ছায়া। দু-একবার ইতস্তত করে সুপারের কাছে গিয়ে কী বললেন। প্রবীণ লেফট্নান্ট্ কর্নেল হেসে উঠলেন, আই. এম. এস.-সুলভ উচ্চাঙ্গের হাসি। বললেন ‘Oh, No No, কিচ্ছু হয়নি। He is just creating a scene.’
—বি ক্লাস ঘুঘু তো, যোগ করলেন জেলর সাহেব।
কী ভাবছিলাম জানি না, হঠাৎ কানে এল জমাদারের শেষ গর্জন—’পন্দরো।’ দেখলাম বড় সাহেবের প্রসেশন ফিরে চলেছে। জুম্মা খাঁর হাতে বেত নেই, তার জায়গায় সেই সুবিশাল ছত্র। ডাক্তার টিকটিকির কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করছেন, হাত-পায়ের বেড়ি আর বেল্ট খুলে দেয়ার জন্যে। মেট দুটো সেদিকে বিশেষ ভ্রূক্ষেপ না করে ধীরে-সুস্থে কাজ করে যাচ্ছে। স্ট্রেচার পাশেই ছিল। তার উপরে নামানো হল মধুসূদনের অসাড় উলঙ্গ দেহ। ডাক্তার পাসে হাত দিলেন এবং স্ট্রেচার-বাহকদের তাড়া দিয়ে নিয়ে চললেন হাসপাতালের দিকে।
আফিসে ফিরবার পথে আমার মনে পড়ল ছেলেবেলার একটা ছোট্ট ঘটনা। আমার বয়স তখন বারো-তেরো। আমাদের গ্রামে জেলেপাড়ার দুধরাজ মাঝির বউকে ভূতে পেয়েছিল। অকারণে হাসত, চেঁচাত, গান করত, আবার পা ছড়িয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে বসত। গ্রামেরই মেয়ে, কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। যখন কুমারী ছিল, পূজাপার্বণে আমাদের বাড়ি তাকে আসতে দেখেছি অনেকবার। ডুরে কাপড়-পরা শ্যামবর্ণ সুশ্রী মেয়েটি। বয়সে আমার কিছু ছোটই হবে। মনে আছে, একটা কি কাজ উপলক্ষে জেলেপাড়ার মেয়েদের খাওয়ানো হয়েছিল। আমার উপর ছিল পান পরিবেশেনের ভার। সবাইকে একটা করে দিয়ে কী মনে করে ওর হাতে দুটো পান দিয়ে ফেলেছিলাম। ও আমার মুখের দিকে চেয়ে ফিক্ করে হেসে ফেলল। পাশে ছিল এক বুড়ি, ওর দিদিমা কিংবা ঠাকুরমা। ব্যাপারটা তার চোখ এড়ায়নি। ওকে এক ধমক দিয়ে বলেছিল, হাসছিস কেন হতভাগী? ছোটবাবুর তোকে মনে ধরেছে। পেন্নাম কর শিগগির। বলামাত্র আমার পায়ের ওপর ঢিপ্ করে মাথা ঠেকিয়ে সে আরক্ত মুখে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল।
সেই মেয়েকে ভূতে পেয়েছে শুনে কৌতূহল হল, কষ্টও হল। দেখতে গেলাম।
উঠোনের মাঝখানে পিঁড়ির উপর আসনপাতা। পাশে একটা জলের ঘড়া, আরও কিসব জিনিসপত্র। এক বিকটাকৃতি ভূতের ওঝা বিচিত্র সাজে ঘুরে ঘুরে মন্ত্র পড়ছে, আর একটা প্রকাণ্ড ঝাঁটা দিয়ে ঘা দিচ্ছে আসনের উপর। কিছুক্ষণ পরে বৌটার ডাক পড়ল। দুজন লোক তাকে ধরে নিয়ে দাঁড় করালো সেই আসনের সামনে। ওঝা হঠাৎ রুখে গিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিল খানিকক্ষণ, এবং তারপরই নির্মমভাবে ঝাঁটা চালাল তার পিঠের উপর। দু’চার ঘা লাগাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটির কি কান্না! আমি আর সইতে পারলাম না। সামনে ছুটে গিয়ে বললাম, এসব হচ্ছে কি? মেয়েছেলের গায়ে হাত তুলছ, পুলিসে দেব তোমাকে।
আমার কাণ্ড দেখে সভাসুদ্ধ সবাই হেসে আকুল। মেয়েটির বাপ ওখানেই ছিল। উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল, তুমি এদিকে এসো ছোটবাবু। ও ঝাঁটা তো ময়নার গায়ে পড়ছে না, পড়ছে সেইটার পিঠে, যে ওর ওপর ভর করেছে। এবার সে নিশ্চয়ই পালাবে।
চুরির অপরাধে মধুসূদনের উপর বেত্রাঘাতের আদেশ দিয়েছিলেন যে হাকিম, ময়নার বাপের মতো তাঁরও বোধহয় বিশ্বাস, বেত আসামীর দেহে পড়বে না। ঐ দেহের মধ্যে বাসা বেঁধেছে যে ক্রাইমের পোকা, পড়বে তারই উপর। ওতেই তারা মরবে। সুধন্য মাঝি যেমন আশা করেছিল, ভূত পালিয়ে তার ময়না আবার সহজ, স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তার ছোট্ট সংসারের মধ্যে, ফিরে পাবে কল্যাণী বধূর সুস্থ দেহমন, মধুসূদনের হাকিমও ঠিক সেই ভরসাই করেছিলেন। অপরাধের জীবাণু ধ্বংস হলেই অপরাধী তার স্বাভাবিক সমাজ জীবনে ফিরে আসবে; নতুন করে গড়ে উঠবে তার নাগরিক নীতিবোধ। এই বিশ্বাস ছিল বলেই কিশোরী কন্যার রক্তাক্ত দেহ দেখে সুধন্য বিচলিত হয়নি; হাকিমও তাঁর কিশোর আসামীর বেত-জর্জর দেহের চিত্র অবিচল চিত্তে গ্রহণ করেছেন। আমি বিশ্বাসী। তাই ওঝার ঝাঁটাকে যেমন মেনে নিতে পারিনি, জুম্মা খাঁর বেতকেও তেমনি স্বীকার করতে পারলাম না।
এর কিছুদিন আগেই ক্রাইম এবং তার শাস্তি সম্বন্ধে একখানা বই পড়েছিলাম। গ্রন্থকার অপরাধ-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। লিখেছেন, ক্রাইম নাম বস্তুটিকে আমাদের পিতামহেরা যে চোখে দেখতেন, আমাদের দৃষ্টি তার চাইতে অনেক উদার। তখনকার দিনে অপরাধী যে দণ্ড পেত, তার মূলে ছিল প্রতিশোধ। Tooth for a tooth and eye for an eye.—এই ছিল তাদের দর্শন। তুমি আমার দাঁত নিয়েছ, আমিও তোমার দাঁত নেবো, চোখের বদল নেবো চোখ। যে হাত দিয়ে তুমি পরধন হরণ করেছ, সে হাত তোমার কেটে নিলাম—চুরি অপরাধে এই ছিল রাজদত্ত শাস্তি। কারও দেহে তুমি আঘাত করেছ, কেড়ে নিয়েছ কারও প্রাণ, বিনিময়ে তোমারও মাংস ছিঁড়ে খাবে হিংস্র কুক্কুর, তোমার প্রাণ দিতে হবে ঘাতকের হাতে কিংবা শূলের উপর।
প্রাচীন শাস্তি-প্রণালীর ধারা বহু নৃশংস দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে তারপর বলেছেন ভদ্রলোক, দণ্ডনীতির চণ্ডমূর্তি আজকার মানুষের কাছে বীভৎস বর্বরতা। শাস্তি আজ আর retribu- tive নয়, reformative. আধুনিক মানুষের কাছে ক্রাইম একটা ব্যাধি মাত্র। সেই ব্যাধিকে বিনাশ করে অপরাধীকে নিরাময় করে তোল। তার জন্যে যতটুকু কঠোরতা দরকার, তার বেশি যেন তাকে সইতে না হয়। তার সমাজ-বিরোধী আচরণকে সমাজকল্যাণের দিকে মোড় ফেরাতে হলে যে ন্যূনতম অবরোধ বা সামান্যতম বল-প্রয়োগের প্রয়োজন, সেইটুকুই হল শাস্তি। দণ্ডের একমাত্র উদ্দেশ্য অপরাধীকে সমাজ-জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সেদিন মধুসূদনের বেত্র-চিকিৎসা স্বচক্ষে উপভোগ করবার পর বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীর এইসব জ্ঞানগর্ভ তত্ত্ব হজম করা আমার পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। ইচ্ছা হল, তাঁকে ডেকে এনে বলি, বর্তমান দণ্ড-প্রণালীর স্তবগান করবার আগে একবার আমাদের বেত্রপাণি জুম্মা খাঁকে দেখে যান। দেখিয়ে দিয়ে যান, পিতামহের যুগ থেকে কোথায় কতটুকু আমরা উদার এবং অগ্রসর। তারা যদি অপরাধী নামক জীবটাকে উলঙ্গ করে বন্য পশুর মুখে ফেলে আমোদ পেয়ে থাকেন, আমরাও সেই হতভাগ্য প্রাণীটাকে বিবস্ত্র করে নর-পশুর কবলে ফেলে তার চেয়ে কম আনন্দ পাই না। সেখানে তার মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে সিংহ কিংবা কুকুরের দাঁত, এখানে সেই মাংস তুলে নিচ্ছে জুম্মা খাঁর বেত! তাঁরা গলায় কোপ মেরে নামিয়ে দিয়েছেন, আমরা গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিচ্ছি। তফাৎ কোথায়? তফাৎ শুধু এই—তারা যেটা করেছেন, সহজ সরল পথে বিনা দ্বিধায় করে গেছেন, আমরা সেই একই জিনিস করছি, কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বড় বড় তত্ত্বকথার আড়াল দিয়ে। তাঁরা বেতটাকে বেত ছাড়া আর কোনো রূপে দেখেননি এবং মেরেছেন মারবার জন্যেই; আমরা মারছি আর বলছি, এ বেত নয়, বেতরূপী কল্যাণ।
ঝাঁটা খেয়ে ময়নার ঘাড় থেকে ভূত বিদায় নিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। কেননা ক’দিনের মধ্যে সে নিজেই বিদায় নিয়ে চলে গেল। সেইদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তুলে নিয়ে যে শয্যায় তাকে শুইয়ে দেওয়া হল, সে শয্যা থেকে সে আর ওঠেনি। মধুসূদন কিন্তু হাসপাতালের বেড ছেড়ে একদিন বেরিয়ে এল এবং তার ক’দিন পরেই দেখলাম, সে জেলের বাইরে দু’নম্বর, “জলভরি দফায়” ভর্তি হয়ে বাবুদের বাসায় জল টানছে।
নামে “জলভরি” হলেও এসব “দফা” বা কয়েদীগোষ্ঠীর কর্মক্ষেত্র শুধু জল ভরাতেই সীমাবদ্ধ থাকত না। গৃহিণীদের খাস এলাকায় অর্থাৎ রান্না, ভাঁড়ার এবং কলতলাতেও ছিল তাদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধি। আস্তে আস্তে কি করে জানি না, একদিন সে আমার বাড়িতে এসে পড়ল। জেলর সাহেব বললেন, মধুসূদনের ইতিহাস যেটুকু জানলাম ঐ ছাড়া ওকে Bachelor’s den—আর কোথাও রাখতে ভরসা পাই না।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। উনি পরিষ্কার করে বললেন, ওর কেস্টা জান তো? হার চুরি। তোমার বাড়িতে সে বালাই নেই।
বললাম, একবার হার নিয়েছে বলে, ঘড়ি বা কলম সে কখনও নেবে না, এমন কিছু গ্যারান্টি আছে কি?
—তা আছে, অন্তত ওর বেলায়। যদ্দূর শুনেছি, ওর নজরটা ঠিক হারের দিকে ছিল না, ছিল হার যারা পরে, এমন একজনের দিকে। তোমার তো সে গুড়ে বালি। অতএব শ্রীমধুসূদন তোমার সহায় হউন।
সকালে ইক্মিক্ কুকারে চাল ডাল আর একটা কিছু সেদ্ধ-টেদ্ধ চাপিয়ে আপিসে চলে যেতাম। বারোটায় ফিরে নামিয়ে নিয়ে কোনো রকমে গলাধঃকরণ—এই ছিল আমার জীবনযাত্রা। সেদিন এই পর্ব যখন শুরু করতে যাচ্ছি, মধুসূদন বলল, আপনি যান বাবু, ওসব আমি করে রাখবো।
বললাম, তুমি পারবে?
মধু ঘাড় নাড়ল।
অফিস থেকে যখন ফিরলাম, মধুসূদন তার আগেই ভিতরে চলে গেছে। স্নান সেরে খেতে গিয়ে দেখি, কুকার নেই। তার জায়গায় পরিপাটি করে আসন পাতা। পাশে জলের গ্লাস, সামনেই ঢাকা দেওয়া ভাতের থালা, চারদিকে বাটি করে সাজানো দু’তিনটা তরকারী। ইক্মিকের বোঁটকা গন্ধ নেই। সুপাচ্য সুস্বাদু খাদ্য।
দুপুরের পর ও আসতেই বললাম, এত সব কাণ্ড করতে গেলে কেন তুমি? ঐ কুকারেই আমার চলে যেত।
মধু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, খাবার মতো হয়েছিল বাবু?
—খাবার মতো মানে! চমৎকার রেঁধেছ তুমি। দ্যাখ না, কিচ্ছু পাতে পড়ে নেই। অতঃপর ইক্মিক্ শিকেয় উঠলেন। তার জায়গায় পাকাপাকি বহাল হল মধুসূদন হালদার। খাওয়াটা শুধু উদরপূর্তি নয়। বাড়তি যেটুকু, সেটা যে আপনার জন ছাড়া অন্য কারও কাছেও পাওয়া যায়, এই প্রথম তার পরিচয় পেলাম। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, এতসব রান্না তুই কোথায় শিখলি মধু? আর এরকম যত্নআত্তি?
মধু লজ্জিত হল—যত্নআত্তি আর কোথায় করছি বাবু? রান্না যেটুকু জানি গিন্নীমার কাছে শেখা। বড় ভালবাসতেন আমাকে।
হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আর সেই গিন্নী-মার হারটা তুই চুরি করে বসলি?
মধু যেন একটু আহত হল। মাথা নীচু করে বলল, হারটা গিন্নীমার নয়, তার মেয়ের। আর চুরিও আমি করিনি বাবু।
—তবে?
—সে অনেক কথা। এক দিন সব বলব আপনাকে।
.
সে “এক দিন” আসতে দেরি হল না। কিন্তু কথা যেটুকু বলা হল সে “অনেক” নয়, সামান্যই। অনেক হয়তো রয়ে গেল তার না-বলা কথা।
বাপ মারা যাওয়ার পর সংসার চলে না। গুটিতিনেক ভাইবোন নিয়ে মা বিব্রত হয়ে পড়লেন। মামার সঙ্গে মধুসূদন কলকাতায় এল চাকরির খোঁজে। উঠল এসে মামার কাছেই হাওড়ার এক বস্তিতে। মাস খানেকের মধ্যেই এই কাজটা জুটে গেল। ছোট্ট পরিবার। বাবু ঠিক দশটায় ডালভাত খেয়ে ট্রামে করে বেরিয়ে যান কলকাতার কোন্ অফিসে। তার পরই ইস্কুলে যায় দিদিমণি—চোদ্দ-পনরো বছরের মেয়ে, ঝর্ণা। মাইল দেড়েক পথ। মধুকেই পৌঁছে দিতে হয়; আবার নিয়ে আসতে হয় সেই চারটের সময়। বাড়িতে থাকেন গিন্নীমা আর বছর চারেকের ছেলে পল্টু। ঠিকা ঝি আছে; বাসন মাজে, ঘর মোছে, বাটনা বাটে। বাকী সব কাজ মধুর। গিন্নী বারোমেসে হার্টের রুগী। সকালে কোনও রকমে ডাল-ভাত ফুটিয়ে তার সঙ্গে দু’খানা ভাজা কিংবা একটু আলুসেদ্ধ দিয়ে স্বামী আর মেয়েকে রওনা করে দেন। আর পেরে ওঠেন না। মাছ এবং অন্য দু-একটা বিশেষ পদ রাঁধতে হয় মধুকে। তিনি কাছে বসে দেখিয়ে দেন। বাবুর ফিরতে রাত হয়। ঝর্ণা চারটেয় ফিরে জলখাবারের বদলে ভাত খায়। উপকরণের অভাব ঘটলে মুখ ভার হয়ে ওঠে। মাকে কিছু বলে না। মধুর সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যায়। ওর নিজের কোনো কাজ করতে এলে বলে, এটা আমিই করে নিতে পারবো। তোমাকে আর দয়া করে আসতে হবে না।
মধু মুখ টিপে হাসে, বলে, কাল কিরকম কাটলেট করবো দেখো। দেখি ক’খানা খেতে পার।
—চাই না, ঠোঁট উলটে জবাব দেয় ঝর্ণা।
পরদিন দু’খানার জায়গায় চারখানা কাটলেট পড়ে তার পাতে। সবটা চেঁচে-মুছে খেতে খেতে বলে মধুকে শুনিয়ে শুনিয়ে, কী কাটলেটই না হয়েছে। খালি ঘি-মসলার শ্রাদ্ধ!
মধু মুচকি হেসে তার কাজে চলে যায়।
একদিন ইস্কুলের ছুটির পর বেরিয়ে আসতেই রোজকার মতো বইগুলো যখন ওর হাত থেকে নিয়ে নিল মধু, ঝর্ণা বলল, চল মধু, একটু গঙ্গার ধারে বেড়িয়ে আসি।
—আমার যে অনেক কাজ পড়ে আছে দিদিমণি।
ঝর্ণা ঝাঁঝিয়ে উঠল, আমি কিছু বললেই অমনি কাজের ওজর। বেশ, যেতে হবে না তোকে। আমি একাই যাব— বল হাঁটতে শুরু করল গঙ্গার দিকে। মধুকে অনুসরণ করতে দেখে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ, তোকে আবার কে আসতে বলেছে?
মধু সেকথার জবাব না দিয়ে বলল, থামলে কেন? চল না কোথায় যেতে হবে। ফিরতে দেরি হলে আবার মা বকবেন।
—ইস্! কারও বকুনি-টকুনির ধার ধারি না আমি। আমার বেড়াতে ইচ্ছে হয়েছে, আমি বেড়াবো।
তেলকল ঘাটে জেটির উপর গিয়ে বসল দুজনে। কূলে কূলে ভরে উঠেছে ভাদ্র মাসের গঙ্গা। মাঝখান দিয়ে একখানা স্টীমার চলে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে আস্তে আস্তে বলল ঝর্ণা, একটা গল্প বল না, মধু।
—আমি কি লেখাপড়া জানি যে গল্প বলব?
—লেখাপড়ার গল্প নয়, তোর দেশের গল্প, ছেলেবেলাকার গল্প।
নাছোড়বান্দা মেয়ে। অগত্যা বলতে হল মধুকে। ওর সেই মাছচুরির গল্প।
গ্রাম থেকে ক্রোশ তিনেক দূরে সরকারী বাঁধ। পাহারাওলা ঘুমে বিভোর। মধু আর তার পাড়ার আর একটি ছেলে বংশী মস্ত বড় একটা কাৎলা কাঁধে করে যখন ফিরে আসছে, তখন অনেক রাত। এমন আঁধার যে নিজের হাত পা চোখে পড়ে না। বংশী আগে, পিছনে মধু। হঠাৎ ‘উঃ মাগো’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে বসে পড়ল ছেলেটা। মধু তাকিয়ে দেখে ফণা উঁচিয়ে সাক্ষাৎ যম। কী তার গর্জন! মাথার উপরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একটা মস্ত বড় মণি। তারই আলোতে দেখা গেল, বংশীর বুড়ো আঙুল থেকে রক্ত পড়ছে। মাছ রইল পড়ে। কোনও রকমে তাকে কাঁধে তুলে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল মধু। খানিকটা গিয়েই সাঁওতালদের পাড়া। ওর চিৎকার শুনে বেরিয়ে এল একদল মেয়েপুরুষ। খবর গেল গুণীনের কাছে। সাক্ষাৎ দেবতা বললেও চলে। ঝাড়া আরম্ভ হল। রাত যখন প্রায় কাবার, চেঁচিয়ে উঠলেন গুণীনঠাকুর—যে যেখানে আছিস সরে যা। সে আসছে!
সব ফাঁকা হয়ে গেল। রইলেন কেবল তিনি, আর পড়ে রইল বংশী। আরও কিছুক্ষণ ঝাড়-ফুঁক করবার পর শোনা গেল সেই হিস্হিস্ শব্দ। অতদূরে বসেও আমাদের গা ছমছম করে উঠল। গুণীন মন্তর পড়ছে আর ডাকছে ‘আয় বেটা, আয়।’ আসতে কি আর চায়? কিন্তু না এসেও উপায় নেই। মন্তরের জোরে টেনে আনল। সেই কাটা জায়গায় মুখ দিয়ে নিজের বিষ নিজেই তুলে নিল। তারপর কোথা দিয়ে যে চলে গেল কেউ জানতেও পারল না। গুণীনের ডাকে আমরা সব ফিরে এসে দেখি, বংশী উঠে বসেছে।
গল্প যখন শেষ হল, মধুর হঠাৎ খেয়াল হল ঝর্ণা কখন সরে এসে একেবারে তার গা ঘেঁষে বসেছে। বড় বড় চোখ তুলে বলল, সত্যি?
—একেবারে নিজের চোখে দেখা, বললে মধুসূদন।
ওরা যখন বাড়ি ফিরল, সন্ধ্যা হয় হয়। দরজা খুললেন গিন্নিমা—কোথায় ছিলি তোরা? সেই চারটা থেকে ঘর-বার করছি।
ঝর্ণা এগিয়ে গিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, একটু গঙ্গার ধারটা ঘুরে এলাম, মা। তুমি রাগ করেছ?
—না, রাগ করবো কেন? রেগে উঠলেন মা; সেই কোন্ সকালে দু’টো ভাতেভাত খেয়ে মেয়ে আমার সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন, আসুন উনি বাড়ি। তোমাকে রীতিমত শাসন করা দরকার।
মধুকে বললেন, আর কোনোদিন ওকে গঙ্গার ধারে-টারে নিয়ে যাসনে, বুঝলি? বাবু ওসব পছন্দ করেন না।
সপ্তাহ না কাটতেই আবার একদিন ইস্কুল থেকেই মাথা ধরল ঝর্ণার। গঙ্গার হাওয়া না লাগালেই নয়। মধুরও বিশেষ আপত্তি দেখা গেল না। আজ আর জেটিতে নয়, দূরে একটা নির্জন জায়গা দেখে ঘাসের উপর বসল পাশাপাশি। আজও গল্প বলতে হল মধুকে। যাত্রার দলের সঙ্গে পালিয়ে যাবার কাহিনী। সেই দেশ-বিদেশে গান গেয়ে বেড়ানো। প্রথমেই কি আর গাইয়েদের দলে ঢুকতে পেরেছিল? কতদিন শুধু তামাক সেজে অধিকারীর গা হাত পা টেপে, রান্না করে তারপর। গল্প যতক্ষণ চলল, মধুর কাঁধের উপর মাথা রেখে চুপ করে রইল ঝর্ণা।
তারপর আবেশ-জড়ানো সুরে বলল, সত্যিই বড্ড মাথা ধরেছিল আজ। তোর গল্প শুনে একদম ছেড়ে গেছে। বড্ড ভালো লাগছে মধু।
মধুর কানে হল মধু-সঞ্চার; সর্বদেহে খেলে গেল বিদ্যুৎ-শিহরণ।
.
দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন বাবু। মাথা নিচু করে দুজনে এসে দাঁড়াল সেইখানে। খুকী ওপরে যাও—গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি। তারপর মধুসূদনের কান ধরে টেনে নিলেন ভিতরের দিকে। চোখ পাকিয়ে বললেন, আর কোনোদিন ওকে নিয়ে কোথাও গেছ যদি শুনতে পাই, চাবুক মারতে মারতে বের করে দেবো। মনে থাকে যেন।…
কিন্তু মনে থাকল না। এর পরে একদিন ক্লাস পালিয়ে বেরিয়ে এল ঝর্ণা। ট্রামে চড়ে ওরা চলে গেল বোটানিক্যাল গার্ডেন। গাছের ছায়ায়, ঝোপের আড়ালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বসল এসে পদ্মপুকুরের ধারে। কেউ কোথাও নেই। শুধু দূরে কোনও গাছের উপর থেকে ভেসে আসছিল অচেনা পাখির ডাক। মধু তন্ময় হয়ে বলছিল তার জীবনের আর একটা কোনও দুঃসাহসের কাহিনী। তার হাঁটুর উপর চিবুক রেখে ঘাসের বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিল ঝর্ণা।
সেইদিন রাত সাড়ে সাতটায় বাড়ি ঢুকতেই মধুসূদনের জবাব হয়ে গেল। তার সঙ্গে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যাবার হুকুম। বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নামছিল, কানে এল গিন্নীমার গলা, ছেলেটাকে যে তাড়িয়ে দিলে, ওর দোষটা কি শুনি? মেয়ে যে তোমার ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছেন, সেটা দেখতে পাও না?
দেখতে আমি সবই পাই, গিন্নী—গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন বাবু : কিন্তু মেয়েকে তো আর এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাকে যায়, তাকে দিলাম। মেয়ের ব্যবস্থাও করছি।
টিনের সুটকেসটা হাতে করে মধু গেল গিন্নীমার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি রান্না করছিলেন। বললেন, খেয়ে-দেয়ে রাতটা থেকে কাল সকালে যাস্।
মধুর কণ্ঠা পর্যন্ত ঠেলে উঠল কান্না। কোনও রকমে সামলে নিয়ে বলল, না, মা, আমার খিদে নেই। আমি যাই।
তিনি আর কিছু বললেন না। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলেন মধুর দিক থেকে।
রাত কাটল ফুটপাথে। সকালে উঠে একবার ভাবল, মামার কাছে যায়। কিন্তু চাকরি গেল কি করে—এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে? দেশে ফিরে যাওয়া আরও অসম্ভব। তাছাড়া টাকাও নেই। মাইনে যেটা পাওনা ছিল, আগেই নিয়ে নিয়েছে। আসবার সময় পেয়েছে শুধু কয়েকআনা পয়সা। তারই খানিকটা খরচ করে চায়ের দোকানে কিছু খেয়ে নিল। তারপর পার্কে শুয়ে লম্বা ঘুম দিয়ে কেটে গেল বেলা। তিনটা বাজতেই সে উঠে বসল। তারপর কিসের এক অলক্ষ্য টান তাকে নিয়ে গেল সেই পুরনো রাস্তায়। ইস্কুলের গেটটা নজরে পড়তেই নিজের অজ্ঞাতেই চমকে উঠল মধু। পা দুটো দাঁড়িয়ে গেল। একটু পরেই ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল ঝর্ণা। ইস্কুল তখনও ছুটি হয়নি। সোজা এগিয়ে এসে বলল, তুই এসেছিস, মধু? ইস্ বড্ড মুখ শুকিয়ে গেছে! খাসনি বুঝি কিছু?
মধু হাসবার মতো মুখ করে বলল, খেয়েছি বইকি।
ত্রস্ত দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল ঝর্ণা, ঝিটা এখনই এসে পড়বে। এপাশে আয়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ইস্কুলের পিছনদিকে। মধু চলল তার সঙ্গে। একটা বাড়ির আড়ালে চারদিকটা দেখে নিল ঝর্ণা। তারপর গলা থেকে হারছড়া খুলে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে মুঠোটা বন্ধ করে দিল। বলল, এটা রাখ? বিক্রী করে চালিয়ে নে যদ্দিন কাজ-টাজ না জোটে। টাকা ফুরিয়ে গেলে আবার আসিস, বুঝলি?
মধু আপত্তি জানাল, ওরা যে তোমাকে বকবে, দিদিমণি। না না, এ হার তুমি—
—আচ্ছা সে আমি বুঝবো, বাধা দিয়ে বলল ঝর্ণা—তুই এখন যা—বলে সে মিলিয়ে গেল মেয়েদের দলের মধ্যে। ইস্কুলে তখন ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেছে।
মধু দেখল, মামার কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এটা সে বুঝেছিল, সে না খেয়ে প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু ঝর্ণার হার বিক্রী করতে পারে না।
সে-রাত্রে মামার বাসায় শুয়ে এই কথা ভাবতে ভাবতে অনেক রাত পর্যন্ত তার চোখে ঘুম এল না। যখন এল সে শুধু সুখ-স্বপ্নে-ভরা। তারই মধ্যে কানে এল কে যেন বাইরে থেকে দরজা ঠেলছে। তার মামা উঠে খুলে দিয়েই কাঠ হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে পুলিস।
জেল হাজতে আর যেতে হল না। মামার চেষ্টায় জামিন হয়ে গেল থানা থেকেই। কিছুদিন পরেই মামলা উঠল কোর্টে। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন ঘুম ধরে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা ডাক কানে যেতেই চমকে উঠল মধু। ওদিকে চেয়ে আর চোখ ফেরাতে পারল না। সাক্ষীর মঞ্চে উঠে এল ঝর্ণা। চোখদুটো ফুলো-ফুলো। সমস্ত মুখখানা বিষণ্ণ, অন্ধকার! আরও বেশী চমকে উঠল যখন শুনল, কোর্টবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বলে যাচ্ছে ঝর্ণা—হ্যাঁ, ঐ আসামী আমার গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এই হার, অমুক দিন বেলা চারটার সময় যখন ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। তার আগের দিন বাজারের পয়সা চুরি করার জন্যে বাবা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, সন্ধ্যাবেলা এসে ও আমাদের সবাইকে শাসিয়ে গিয়েছিল।…
তারপরে এল এক ঝি। মধু তাকে কোনোদিন দেখেনি। থেমে থেমে বলল, হ্যাঁ, আমি ছিলাম দিদিমণির ঠিক পেছনে। হার ছিনিয়ে নিয়ে ঐ লোকটা যখন পালাচ্ছে, আমি চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে ও মিশে গেল, দেখতে পাইনি।
হাকিম রায় দিলেন। তিন মাস জেল, তার সঙ্গে পনেরো বেত।
তিন মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল।
খালাসের আগের দিন মধুকে ডেকে বললাম, চাকরিই যখন করবি, আমার এখানেই থেকে যা না? মাইনে ওখানে যা পেতিস, তাই নিস।
মধু খুশি হয়ে বলল, আমিও সেই কথা বলবো, ভাবছিলাম। আপনার কাছেই থাকবো আমি। দুটো দিন শুধু ছুটি দিন। বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসি। মাকে অনেকদিন দেখিনি। ভাইবোনগুলোকে দেখতে ইচ্ছা করে।
বললাম, বেশ, তাই, বরং ঘুরে আয়।
দু-দিন নয়, তিনদিনের দিন সন্ধ্যবেলা ঘুরে এল। আমার বাড়িতে নয়, জেলগেটে; কোমরে দড়ি-বাঁধা হাজতি আসামীদের সঙ্গে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল।
পরদিন দুপুর বেলা নির্জন অফিসে মধুকে ডাকিয়ে নিয়ে এলাম। এবার যে কাহিনী শুনলাম, সেটা ওর নিজের কথাতেই বলি—
অনেক দিন পরে বাড়ি ফিরছি, সবাই ছুটে আসবে, তা না, আমাকে দেখেই মা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। ভাইবোনগুলোও, মনে হল যেন ভয় পেয়েছে। খবর শুনেই পাড়ার লোকজন আসতে লাগল একে একে। আমার এক পিসিমা বললেন, হ্যাঁরে মধু, পনেরো ঘা বেত তুই সইতে পারলি?
আরেকজন, আমার সম্পর্কে কাকা হন, বললেন, জেলে শুনেছি গরুর বদলে মানুষ দিয়ে ঘানি টানায়। তেল কম হলে চাবুক মারে। সত্যি নাকি রে? ঘানি টেনেছিস তুই? কে একজন ছোকরা বলে উঠল ভিড়ের ভেতর থেকে, জেলখানায় নাকি হাতা মেপে ভাত দেয়। মেধোটার চেহারা দেখে তা তো মনে হচ্ছে না।
ও, তা জানিস না বুঝি?’—বললেন আমার এক জ্ঞাতিদাদা, ওখানেও চুরি চলে। সিপাইদের পা টিপে দিলে দু-এক হাতা ভাত বেশি দেয়।
খেয়ে-দেয়ে যখন শুতে গেছি, মা এসে বসল মাথার কাছে। বলল, হ্যাঁরে মধু, তোর বাপ-দাদারা গরীব ছিল সবাই, কিন্তু প্রাণ গেলেও চুরি করেনি। তুই শেষটায় বংশের নাম ডোবালি! বাবা?
আমি বললাম, তোমার পা ছুঁয়ে বলছি, মা। চুরি আমি করিনি।
মা চুপ করে রইল। বিশ্বাস করল না আমার কথা। তারপর আস্তে আস্তে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, খুব লেগেছিল, নারে?
আপনাকে সত্যি বলছি, বাবু, বেতের জ্বালা যে কী জিনিস এইবার তা টের পেলাম। বেত যখন মেরেছিল, সে যন্ত্রণা এর কাছে কিছু না। ভোর হবার আগেই কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাওড়াস্টেশনে নেমেই দেখা হয়ে গেল ছেদীরামের সঙ্গে জেলে থাকতে আলাপ। বড্ড ভালবাসত আমাকে। তাকে সব বলেছিলাম। এবারকার কথাও বললাম। শুনে সে হেসে উঠল। তারপর বলল তার সেই ভাঙা-ভাঙা বাংলায়, তুই মরদ না আছিস, মধু। যে মাইয়া তোকে চাবুক দিল, জেল খাটাল, জান থেকে বড় যে ইজ্জত তাই চলে গেল, তার ইজ্জত তুই কেড়ে লে। দিল্ ঠাণ্ডা হোবে।
কথাটা আমার মনে লাগল। বেত আর জেলের জ্বালা আর একবার জ্বলে উঠল বুকের মধ্যে। ঠিক বলেছে ছেদীরাম। আমার মুখে মিথ্যা দুর্নামের চুনকালি লেপে দিয়ে ঐ মেয়েটা ঘরের আড়ালে বসে মনের সুখে ঘর-সংসার করবে, সে হবে না। ওকেও টেনে আনবো পথের ধুলোয়। চাকরকে মেরে মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন আমার মনিব, সেটা হতে দেবো না। চাকরের মুখের কালি তাঁর মেয়ের মুখেও লাগবে। দেখি তারপর কোথায় থাকে তার মান-ইজ্জত।
ছেদীরাম আমার সঙ্গী হল। কথা রইল, ভেতরে ঢুকবো আমি একাই। ঐটুকু একা মেয়েকে সামলাতে আর কারও দরকার হবে না। ও থাকবে বাড়ির বাইরে। কাজ সেরে যখন বেরিয়ে আসবো, কোনোদিক থেকে বাধা এলে ছোরা চালাবে। খানিকটা দূরে একটা বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবে ট্যাসি, সে ব্যবস্থাও ছেদীরামের
রাত তখন সাড়ে নটা। ছোট্ট গলি। লোকজন চলা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকদিন পর মনিব-বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লাম। খানিক পরে খুলে গেল কপাট। ঢুকেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা। কিন্তু এ কী চেহারা! মনে হল যেন অনেক দিন অসুখে ভুগে উঠল। আমাকে দেখে প্রথমটা কেমন থতমত খেয়ে গেল। তারপর এগিয়ে এসে বলল, মধু? এদ্দিন পরে বুঝি মনে পড়ল! মনে মনে তোকে কত ডেকেছি, জানিস? আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখ বেঁধে ফেলবার জন্যে যে ন্যাকড়াটা হাতে নিয়েছিলাম, আস্তে আস্তে সেটা পকেটে পুরে ফেললাম! গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, মা কই, দিদিমণি?
মা?—ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ঝর্ণা, মা তো নেই। দু’মাস হল চলে গেছে।
—পলটু?
–পলটুকে মাসীমা এসে নিয়ে গেছেন। আমাকে বাবা যেতে দিলেন না। ইস্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছেন। একটুও বেরোতে দেন না। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন একটা দোজবরে বুড়োর সঙ্গে—
ছুটে এসে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে তুই নিয়ে চল, মধু। এখানে থাকলে আমি মরে যাবো।…
বাইরে কাশির শব্দ শোনা গেল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল ঝর্ণার।—ঐ বাবা ফিরলেন ক্লাব থেকে—বলেই তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
বাবু বাড়ি ঢুকলেন। প্রথমে আমাকে চিনতে পারলেন না। কাছে এসেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ও, জেলে গিয়ে আর বেত খেয়েও তোর লজ্জা হয়নি হারামজাদা? আবার এসেছিস আমার সর্বনাশ করতে?
বললাম, কী বকছেন পাগলের মতো! সর্বনাশ আমি করেছি, না আপনি করেছেন আমার সর্বনাশ?
—তবে রে! একটা চাকরের এত তেজ! বলে ছুটে এসে দিলেন গলাধাক্কা। পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। ঠিক সেই সময় খোলা দরজা দিয়ে ছুটে এল ছোরা, বিঁধে গেল বাবুর বাঁহাতের উপরদিকে।
চেঁচামেচি শুনে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে লোকজন এসে পড়ল। ছেদীরামের চিহ্ন নেই। আমি ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু বেশীদূর যাবার আগেই সবাই ধরে ফেলল। তারপর এই—
গায়ের জখমগুলো দেখিয়ে দিল মধুসূদন।
ওয়ারেন্ট খুলে দেখলাম, চার্জ গুরুতর—নারীহরণ এবং নরহত্যার চেষ্টা। ৩৬৬/৫১১, তার সঙ্গে ৩০৭।