মেহের-নেগার

[ ক ]

ঝিলম

বাঁশি বাজছে, আর এক বুক কান্না আমার গুমরে উঠছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হল তখন, যখন বৈশাখের গুমোটভরা উদাস-মদির সন্ধ্যায় বেদনাতুর পিলু-বারোঁয়া রাগিণীর ক্লান্ত কান্না হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরুচ্ছিল। আমাদের দুজনারই যে এক-বুক করে ব্যথা, তার অনেকটা প্রকাশ পাচ্ছিল ঐ সরল-বাঁশের বাঁশির সুরে। উপুড়-হয়ে পড়ে-থাকা সমস্ত স্তব্ধ ময়দানটার আশে-পাশে পথ হারিয়ে গিয়ে তারই উদাস প্রতিধ্বনি ঘুরে মরছিল! দুষ্ট দয়িতকে খুঁজে খুঁজে বেচারা কোকিল যখন হয়রান পেরেশান হয়ে গিয়েছে, আর অশান্ত অশ্রুগুলো আটকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় বারংবার চোখ দুটোকে ঘষে ঘষে কলিজার মত রক্ত-লোহিত করে ফেলেছে, তখন তরুণী কোয়েলিটা তার প্রণয়ীকে এই ব্যথা দেওয়ায় বোধ হয় বাস্তবিকই ব্যথিত হয়ে উঠেছিল,–কেননা, তখনই কলামোচার আমগাছটার আগডালে কচি আমের থোকার আড়ালে থেকে মুখ বাড়িয়ে সকৌতুকে সে কুক দিয়ে উঠল ‘কু-কু-কু’। বেচারা শ্রান্ত কোকিল তখন রুদ্ধকণ্ঠে তার এই পাওয়ার আনন্দটা জানাতে আকুলি বিকুলি করে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু ডেকে ডেকে তখন তার গলা বসে গিয়েছে, তবু অশোক গাছ থেকে ঐ ভাঙা গলাতেই তার যে চাপা বেদনা আটকে যাচ্ছিল, তারই আঘাত খেয়ে সাঁঝের বাতাস ঝিলমতীরের কাশের বনে মুহুর্মুহু কাঁপন দিয়ে গেল।

আমি ডাক দিলুম, ‘মেহের-নেগার’! কাশের বনটা তার হাজার শুভ্রশিষ দুলিয়ে বিদ্রুপ করলে, ‘…আ…র’! ঝিলমের ওপারের উঁচু চরে আহত হয়ে আমারই আহ্বান কেঁদে ফেললে, আর সে রুদ্ধশ্বাসে ফিরে এসে এইটুকু বলতে পারলে, ‘মেহের-নেই-আর’!

পশ্চিমে সূর্যের চিতা জ্বলল এবং নিবে এল। বাঁশির কাঁদন থামল। মলয়-মারুত পারুল বনে নামল বড় বড় শ্বাস ফেলে। পারুল বললে, ‘উ-হু’–মলয় বললে, ‘আ-হা–আঃ’।

আমি বুক ফুলিয়ে চুল দুলিয়ে মনটাকে খুব একচোট বকুনি দিয়ে আনন্দভৈরবী আলাপ করতে করতে ফিরলুম–আমার মত অনেক হতভাগারই ঐ ব্যথাবিজড়িত চলার পথ ধরে। এমন সাধা গলাতেও আমার সুরটার কলতান শুধু হোঁচট খেয়ে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। আমার কিন্তু লজ্জা হচ্ছিল না। আমার বন্ধু তানপুরাটা কোলে করে তখন শ্রীরাগ ভাঁজছেন দেখলুম। তিনি হেসে বললেন, ‘কি য়ুসোফ! এ-আসন্ন সন্ধ্যা বুঝি তোমার আনন্দ-ভৈরবী আলাপের সময়? তুমি যে দেখছি অপরূপ বিপরীত!’ আমার তখন কান্না আসছিল। হেসে বললুম, ‘ভাই তোমার শ্রীরাগেরও তো সময় পেরিয়ে গেছে।’ সে বললে ‘তাই তো! কিন্তু তোমার হাসি আজ এত করুণ কেন,–ঠিক পাথর-খোদা মূর্তির হাসির মত হিম-শীতল আর জমাট?’ আমি উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলুম।

আদরিনী অভিমানী বধূর মত সন্ধ্যা তার মুখটাকে ক্রমশই কালিপানা আঁধার করে তুলছিল। এমন সময় কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির এক-আকাশ তারা তাকে ঘিরে বললে, ‘সন্ধ্যারাণী! বলি এত মুখভার কিসের? এত ব্যস্ত হসনে লো, ঐ চন্দ্রদেব এল বলে!’ অপ্রতিভ বেচারি সন্ধ্যার মুখে জোর করে হাসার সলজ্জ-মলিন ঈষৎ আলো ফুটে উঠল। চাঁদ এল মদখোর মাতালের মত টলতে টলতে, চোখ মুখ লাল করে। এসেই সে জোর করে সন্ধ্যা বধূর আবরু ঘোমটা খুলে দিলে। সন্ধ্যা হেসে ফেললে। লুকিয়ে-দেখা বউ-ঝির মত একটা পাখি বকুল গাছের থেকে লজ্জারাঙা হয়ে টিটকারি দিয়ে উঠল, ‘ছি-ছি’। তারপর চাঁদে আর সন্ধ্যায় অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়ে সন্ধ্যার চিবুক আর গাল বেয়ে খুব খানিক শিশির ঝরবার পর সে বেশ খুশি মনেই আবার হাসি-খেলা করতে লাগল। কতকগুলো বেহায়া তারা ছাড়া অধিকাংশকেই আর দেখা গেল না।

আমার বিজন কুটিরে ফিরে এলুম। চাঁদ উঠেছে, তাই আর প্রদীপ জ্বাললুম না। আর, জ্বালালেও দীপশিখার ঐ ম্লান ধোঁয়ার রাশটা আমার ঘরের বুকভরা অন্ধকারকে একেবারে তাড়াতে পারবে না। সে থাকবে লুকিয়ে পাতার আড়ালে, ঘরের কোণে, সব জিনিসেরই আড়ালে; ছায়া হয়ে আমাকে মধ্যে রেখে ঘুরবে আমারই চারপাশে! চোখের পাতা পড়তে না পড়তে হড়পা বানের মত হুপ করে আবার সে এসে পড়বে–যেই একটু সরে যাবে এই দীপশিখাটি!–ওগো আমার অন্ধকার! আর তোমায় তাড়াব না।–আজ হতে তুমি আমার সাথী, আমার বন্ধু, আমার ভাই!–বুঝলে ভাই আঁধার, এই আলোটার পেছনে খামখা এতগুলো বছর ঘুরে মরলুম!

আমি বললুম, ‘ওগো মেহের-নেগার! আমার তোমাকে চাই-ই। নইলে যে আমি বাঁচব না! তুমি আমার। নইলে এত লোকের মাঝে তোমাকে আমি নিতান্ত আপনার বলে চিনলুম কী করে?–তুমিই তো আমার স্বপ্নে পাওয়া সাথী!–তুমি আমার, নিশ্চয়ই আমার!’–চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে সে আমার পানে চাইলে, পলাশ ফুলের মত ডাগর টানাটানা কাজল-কালো চোখ দুটির গভীর দৃষ্টি দিয়ে আমার পানে চাইলে! কলসিটি-কাঁখে ঐ পথের বাঁকেই অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সে। তারপর বললে, ‘আচ্ছা,–তুমি পাগল?’–আমি ঢোক গিলে, একরাশ অশ্রু ভিতর দিকে ঠেলে দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললুম, ‘হুঁ’! তার আঁখির ঘনকৃষ্ণ পল্লবগুলোতে আঁশু উথলে এল! তারপর সে তাড়াতাড়ি চলে যেতে যেতে বললে, ‘আচ্ছা, আমি তোমারই!’

একটা অসম্ভব আনন্দের জোর ধাক্কায় আমি অনেকক্ষণ মুষড়ে পড়েছিলুম। চমকে উঠে চেয়ে দেখলুম, সে পথের বাঁক ফিরে অনেক দূর চলে যাচ্ছে।

আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার’! সে উত্তর দিল না। কলসিটাকে কাঁখে জড়িয়ে ধরে ডান হাতটাকে তেমনি ঘন ঘন দুলিয়ে সে যাচ্ছিল। তারপর তাদের বাড়ির সিঁড়িতে একটা পা থুয়ে দিয়ে আমার দিকে তিরস্কার-ভরা মলিন চাওয়া চেয়ে গেল। আর বলে গেল, ‘ছি! পথে-ঘাটে এমন করে নাম ধরে ডেকো না!–কী মনে করবে লোকে!’ পথ না দেখে দৌড়ুতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে একবার পড়ে গেছিলুম, তাতে আমার নাক দিয়ে তখনও ঝরঝর করে খুন ঝরছিল! আমি সেটা বাঁ-হাত দিয়ে লুকিয়ে বললুম, ‘আঃ, তাইতো।–আর অমন করে ডাকব না।’

বুঝলে সখা আঁধার! যে জন্মান্ধ, তার তত বেশি যাতনা নেই, যত বেশি যাতনা আর দুঃখ হয়–একটা আঘাত পেয়ে যার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে যায়। কেননা, জন্মান্ধ তো কখনও আলোক দেখেনি। কাজেই এ জিনিসটা সে বুঝতে পারে না,আর যে জিনিস সে বুঝতে পারে না তা নিয়ে তার তত মর্মাহত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। আর, এই একবার আলো দেখে তারপর তা হতে বঞ্চিত হওয়া,–ওঃ কত বেশি নির্মম নিদারুণ!

তোমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার যে প্রতিশোধ নিলে তুমি, তাতে ভাই আঁধার, আর যেন তোমায় ছেড়ে না যাই। তোমায় ছোটো ভেবে এই যে দাগা পেলাম বুকে ওঃ তা,–

সেদিন ভোরে ঝিলম নদীর কূলে তার সঙ্গে আবার দেখা হল। সে আসছিল একা নদীতে স্নান করে। কালো কশকশে ভেজা চুলগুলো আর ফিরোজা রঙের পাতলা উড়ানিটা ব্যাকুল আবেগে তার দেহ-লতাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আকুল কেশের মাঝে সদ্যস্নাত সুন্দর মুখটি তার দিঘির কালোজলে টাটকা ফোটা পদ্মফুলের মত দেখাচ্ছিল। দূরে একটা জলপাই গাছের তলায় বসে সরল রাখাল বালক গাচ্ছিল,–

গৌরী ধীরে চলো, গাগরি ছলক নাহি যায়–

শিরোপরি গাগরি, কমর মে ঘড়া,

পাতরি মকরিয়া তেরি বলখ না যায়, আহা টুট না যায়;–

গৌরী ধীরে চলো।

আমিও সেই গানের প্রতিধ্বনি তুলে বললুম, ‘ওগো গৌরবর্ণা কিশোরী, একটু ধীরে চলো,–ধীরে।–তোমার ভরা কুম্ভ হতে জল ছলকে পড়বে যে। অত সূক্ষ্ম তোমার কটিদেশ ভরা গাগরি আর ঘড়ার ভারে মুচকে ভেঙে যাবে যে! ওগো তন্বী গৌরী, ধীরে একটু ধীরে চলো!’ আমায় দেখে তার কানের গোড়াটা সিঁদুরের মত লাল হয়ে উঠল। আমার দিকে শরম-অনুযোগভরা কটাক্ষ হেনে সে বললে, ছি, ছি, সরে যাও। একী পাগলামি করছ?’–আমি ব্যথিত-কণ্ঠে ডাকলুম, ‘মেহের-নেগার!’ সে একবার আমার রুক্ষ কেশ, ব্যথাতুর মুখ ধুলিলিপ্ত দেহ আর ছিন্ন মলিন বসন দেখে কী মনে করে চুপটি করে দাঁড়াল। তারপর ম্লান হেসে বললে ‘ও হল! আমার নাম “মেহের-নেগার” কে বললে?–আচ্ছা, তুমি আমায় ও নামে ডাক কেন? সে তোমার কে?’ আমি দেখলুম, কী একটা ভীতি আর বিস্ময় তার স্বরটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল। তার শঙ্কাকুল বুকে ঘন স্পন্দন মূর্ত হয়ে ফুটল। আমারও মনে অমনি বিস্ময় ঘনিয়ে এল। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছিল। তাই তার গায়ে হেলান দিয়ে বললুম, ‘আহ! তুমি তবে সে নও? না-না, তুমি তো সেই আমার–আমার মেহের-নেগার! অমনই হুবহু মুখ, চোখ,–অমনই ভুরু, অমনই চাউনি, অমনই কথা!–না গো-না, আর আমায় প্রতারণা কোরো না। তুমি সেই! তুমি –‘! সে বললে, আচ্ছা, মেহের-নেগারকে কোথায় দেখেছিলে?’ আমি বললুম, ‘কেন, খোওয়াবে!’ তার মুখটা এক নিমিষে যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তার সাদা মুখে আবার রক্ত দেখা গেল। সে ঝরনার মত ঝরঝর করে হাসির ঝরা ঝরিয়ে বললে, ‘আচ্ছা, তুমি কবি, না চিত্রকর?’ আমি অপ্রতিভ হয়ে বললুম, ‘চিত্র ভালবাসি, তবে চিত্রকর নই। আমি কবিতাও লিখি, কিন্তু কবি নই।’ সে এবার হেসে যেন লুটোপুটি খেতে লাগল।

আমি বললুম, ‘দেখ, তুমি বড্ড দুষ্টু!’ সে বললে, ‘আচ্ছা, আমি আর হাসব না! তুমি কিসের কবিতা লেখ?’ আমি বললুম, ‘ভালবাসার!’

সে ভিজা কাপড়ের একটা কোণ নিংড়াতে নিংড়াতে বললে, ‘ও তাই,–তা কাকে উদ্দেশ করে?’

আমি সেইখানেই সবুজ ঘাসে বসে পড়ে বললুম, ‘তোমাকে–মেহের-নেগার! তোমাকে উদ্দেশ করে।’ আবার তার মুখে যেন কে এক থাবা আবির ছড়িয়ে দিলে। সে কলসিটা কাঁখে আর একবার সামলে নিয়ে বললে, ‘তুমি কদ্দিন হতে এরকম কবিতা লিখছ?’ আমি বললুম, ‘যেদিন হতে তোমায় খোওয়াবে দেখেছি।’ সে বিস্ময়-পুলকিত নেত্রে আমার দিকে একবার চাইলে, তার পর বললে, ‘তুমি এখানে কী কর?’ আমি বললুম, ‘গান-বাজনা শিখি।’ সে বললে, ‘কোথায়?’ আমি বললুম, ‘খাঁ সাহেবের কাছে।’ সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বললে, ‘একদিন তোমার গান শুনবখন।–শুনাবে?’ তারপর চলে যেতে যেতে পিছন ফিরে বললে, ‘আচ্ছা, তোমার ঘর কোন্খানে?’ আমি বললুম, ‘ওয়াজিরিস্তানের পাহাড়।’ সে অবাক বিস্ময়ে ডাগর চক্ষু দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাইলে; তারপর স্নিগ্ধকণ্ঠে বললে, ‘তুমি তাহলে এদেশের নও? এখানে নূতন এসেছ?’–আমি তার চোখে রেখে বললুম, ‘হুঁ,–আমি পরদেশি।’ … সে চুপি চুপি চলে গেল আর একটিও কথা কইলে না। … আমার গলার তখন বড্ড বেদনা, কে যেন টুঁটি চেপে ধরেছিল। পেছন হতে ঘাসের শ্যামল বুকে লুটিয়ে পড়ে, আবার ডাকলুম তাকে। কাঁখের কলসি তার ঢিপ করে পড়ে ভেঙ্গে গেল। সে আমার দিকে একটা আর্তদৃষ্টি হেনে বললে, ‘আর ডেকো না অমন করে।’ দেখলুম তার দুই কপোল দিয়ে বেয়ে চলেছে দুইটি দীর্ঘ অশ্রু-রেখা।