» » মেহের-নেগার

বর্ণাকার

[ ঘ ]

সেদিন যখন আমায় একেবারে বিস্ময়-পুলকিত আর চকিত করে সহসা আমার জন্মভূমি-জননী আমার বুকের রক্ত চাইলে, তখন আমার প্রাণ যে কেমন ছটফট করে উঠল তা কইতে পারব না! … শুনলুম আমাদের স্বাধীন পাহাড়িয়া জাতিটার উপর ইংরেজ আর কাবুলের আমির দুজনারই লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। আর কয়েকজন দেশদ্রোহী শয়তান দুভাগে বিভক্ত হয়ে দেশটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে যে, আমাদের এই ঘরবাড়িহীন পাঠানদের বশে আনতে কেউ কখনও পারবে না। আমরা স্বাধীন–মুক্ত। সে যেই হোক না কেন, আমরা কেন তার অধীনতা স্বীকার করতে যাব? শিকল সোনার হলেও তা শিকল।–না, না, যতক্ষণ এই য়ুসোফ খাঁর এক বিন্দু রক্ত থাকবে গায়ে আর মাথাটা ধড়ের সঙ্গে লাগা থাকবে, ততক্ষণ কেউ, কোনো অত্যাচারী সম্রাট আমার জন্মভূমির এক কণা বালুকাও স্পর্শ করতে পারবে না! ওঃ একি দুনিয়াভরা অবিচার আর অত্যাচার, খোদা তোমার এই মুক্ত সাম্রাজ্যে? এই সব ছোটো মনের লোকই আবার নিজেদের ‘উচ্চ’ ‘মহান’ ‘বড়’বলে নিজেদের ঢাক পিটায়।–ওঃ যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে, যেমন আকাশের অনেকগুলো পাখিকে ধরে এনে চারিদিকে লোহার শিক দেওয়া একটা খাঁচার ভিতর পুরে দিলে হয়। ওঃ আমার সমস্ত স্নায়ু আর মাংসপেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে! আরও শুনছি দুইপক্ষেই আমাদিগকে রীতিমত ভয় দেখান হচ্ছে।–হাঃ হাঃ হাঃ! গাছের পাখিগুলোকে বন্দুক দেখিয়ে শিকারি যদি বলে, ‘সব এসে আমার হাতে ধরা দেও, নইলে গুলি ছাড়লুম!’ তাহলে পাখিরা এসে তার হাতে ধরা দেবে? কখনই না, তারা মরবে, তবুও ধরা দেবে না–দেবে না! শিকারিদের বুকে যে ছুরি লুকানো আছে, তা পাখিরা আপনিই বোঝে। এ তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না। হাঁ, আর যদিই যোগ দিতে হয়, তবে নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখে যেখানে অন্যায় দেখব সেইখানেই আমাদর বজ্রমুষ্টির ভীম তরবারির আঘাত পড়বে! আমার জন্মভূমি কোনো বিজয়ীর চরণ স্পর্শে কখনও কলঙ্কিত হয়নি, আর হবেও না। ‘শির দিব, তবু স্বাধীনতা দিব না’।

তোমার পবিত্র নামের শপথ করে এই যে তরবারি ধরলুম খোদা, এ আর আমার হাত হতে খসবে না! তুমি বাহুতে শক্তি দাও!–এই তরবারির তৃষ্ণা মিটাব–প্রথমে দেশদ্রোহী শয়তানদের জিগরের খুনে, তারপর দেশ-শত্রুর কলুষরক্তে।–আমিন!!!

***

হাঁ, আমার মনে হচ্ছে হয়তো আমার দেশের ভাই-ই আমায় হত্যা করবে জল্লাদ হয়ে! … তা হোক, তবু তো সুখে মরতে পারব, কেননা আমার এ ক্ষুদ্র প্রাণ দেশের পায়েই উৎসর্গীকৃত হবে!–‘খোদা! আমার এ দান যেন তুমি কবুল করো।’

***

বেশ হয়েছে! খুব হয়েছে!! আচ্ছা হয়েছে!!!

আমার এই চিরবিদায়ের সময় কেন কাল মনে হল, সে অভাগিকে একবার দেখে যাই। কেন সে ইচ্ছাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। … গিয়ে দেখলুম তার ত্যক্ত বাড়িটা ধূলি আর জঙ্গলময় হয়ে সদ্যবিধবা নারীর মত হাহাকার করছে! … আর–আর ও কি? … ঘরের আঙিনায় ও কার কবর? যেন কার এক বুক বেদনা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কার পাহাড়পারা ব্যথা জমাট হয়ে যেন মূর্ছিত হয়ে মাটি আঁকড়ে রয়েছে!… কবরের শিরানে কার বুকের রক্ত দিয়ে মর্মর ফলকে লেখা, ‘অপবিত্র জঠরে জন্ম নিলেও ওগো পথিক, আমায় ঘৃণা করো না! একবিন্দু অশ্রু ফেলো, আমার কল্যাণ কামনা করে–আমি অপবিত্র কি-না জানি না, কিন্তু পবিত্র ভালবাসা আমার এই বুকে তার পরশ দিয়েছিল! … আর ওগো স্বামিন্! তুমি যদি কখনও এখানে আস,–আঃ, তা আসবেই–তবে আমায় মনে করে কেঁদো না। যেখানেই থাকি প্রিয়তম, আমাদের মিলন হবেই। এমন আকুল প্রতীক্ষার শেষ অবসান এই দুনিয়াতেই হতে পারে না। খোদা নিজে যে প্রেমময়!–অভাগিনি–গুলশন!’

আমার এক বুক অশ্রু ঝরে মর্মর-ফলকের মলিন রক্ত লেখাগুলিকে আরও অরুণোজ্জ্বল করে দিলে!…

ঝিলমের ওপার হতে কার আর্ত আর্দ্র সুর এপারে এসে আছাড় খাচ্ছিল,

আগর মেয় বাগবাঁ হোতে তো গুলশন কো

লুটা দেতে।

পাকড় কর দস্তে বুলবুল কো চমন সে জাঁ

মেলা দেতে॥

হায়রে অবোধ গায়ক! তুই যদি মালি হতিস, তা হলে বুলবুলের হাত ধরে ফুলের সঙ্গে মিলন করিয়ে দিতিস–অসম্ভব রে, তা অসম্ভব। খোদা হয়তো তোকে সে শক্তি দেননি, কিন্তু যাদের সে শক্তি আছে ভাই, তাঁরা তো কই এমন করা তো দূরের কথা, একবার তোর এই কথা মুখেও আনতে পারে না! তোরই এই ক্ষমতা থাকলে হয়তো তুই এ গান গাইতে পারতি নে!….

***

তবু আমার চিরবিদায়ের দিনে ঐ গানটা বড্ড মর্মস্পর্শী মধুর লেগেছিল।