[ গ ]
আমার স্নেহের বাঁধনগুলো জোর বাতাসে পালের দীর্ণ দড়ির মত পট পট করে ছিঁড়ে গেল। তারপর ঢেউ-এর মুখে ভাসতে ভাসতে, খাপছাড়া–ঘরছাড়া আমি এই ঝিলমে এলুম!–প্রথম দেখলুম এই হিন্দুস্থানের বীরের দেশ পাঁচটা দরিয়ার তরঙ্গ-সংকুল পাঞ্জাব, যেখানের প্রতি বালুকণা বীরের বুকের রক্ত জড়ানো–যেখানের লোকের তৃষ্ণা মিটাত দেশদ্রোহী–আর দেশ-শত্রু ‘জিগরের খুন।’
***
যে ডাল ধরতে গেলুম, তাই ভেঙে আমার মাথায় পড়ল! তাই নিরাশ্রয়ের কুটো ধরার মত অকেজোর কাজ এই সংগীতকেই আশ্রয় করলুম আমার কাজ আর সান্ত্বনা স্বরূপে।
ওঃ, আমার এই বলিষ্ঠ মাংসপেশী-বহুল শরীর, মায়া-মমতাহীন–লৌহ কবাটের মত শক্ত বক্ষ, তাকে আমি চেষ্টা করেও উপযুক্ত ভাল কাজে লাগাতে পারলুম না, খোদা! দেশের মঙ্গলের জন্য এর ক্ষয় হল না! ¬–প্রিয় ওয়াজিরিস্তানের পাহাড় আমার! তোমার দেহটাকে অক্ষত রাখতে গিয়ে যদি আমার এই বুকের উপর তোমারই অনেকগুলো পাথর পড়ে পাঁজরগুলো গুঁড়ো করে দিত, তাহলে সে কত সুখের মরণ হত আমার! ঐ তো হত আমার হতভাগ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা!–আমার জন্যে কেউ কাঁদবার নেই বলে হয়তো তাতে মানুষ কেউ কাঁদত না, কিন্তু তোমার পাথরে–মরুতে–উষ্ণ মারুতে শুকনো শাখায় একটা আকুল অব্যক্ত কম্পন উঠত! সেই তো দিত আত্মায় আমার পূর্ণ তৃপ্তি! আহা, এমন দিন কি আসবে না জীবনে!
আচ্ছা,–ওগো অলক্ষ্যের মহান স্রষ্টা! তোমার সৃষ্ট পদার্থের এত মধুর জটিলতা কেন? পাহাড়ের পাথরবুকে নির্ঝরের স্রোত বইয়েছ, আর আমাদের মত পাষাণের বুকেও প্রেমের ফল্গুধারা লুকিয়ে রেখেছ!…আর তুমি যদি ভালবাসাই সৃষ্টি করলে, তবে আলোর নীচে ছায়ার মত তার আড়ালে নিরাশাকে সঙ্গোপন রাখলে কেন?
আমাকে সবচেয়ে ব্যথিয়ে তুলছে গত সন্ধ্যার কথাটা!–
আবার সহসা তার সঙ্গে দেখা হল সন্ধেবেলার খানিক আগে। তখন ঝিলমের তীরে তীরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁঝিট রাগিণীর ঝমঝমানি ভরে উঠছিল। সে ঠিক সেই স্বপ্নে-দেখা কিশোরীর মতই হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকলে, ‘এখানে এসো!’ … আমি শুধোলুম, ‘মেহের-নেগার, স্বপ্নের কথা কি সত্যি হয়?’ সে বললে, ‘কেন?’ আমি তাকে আমার সেই স্বপ্নের কথা জানিয়ে বললুম, ‘তুমিই তো সেদিন নিশি-ভোরে আমায় অমন করে দেখা দিয়ে এসেছিলে আর তোমার নামও বলে এসেছিলে!… তুমি যে আমার!’ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল তার বুকের বসনে দোল দিয়ে! সে বললে, ‘য়ুসোফ, আমি তো মেহের-নেগার নই, আমি–গুলশন!’ সে কেঁদে ফেললে। … আমি বললুম, ‘তা হোক, তুমিই সেই। … আমি তোমাকে মেহের-নেগার বলেই ডাকব।’ সে বললে, ‘এসো, সেদিন গান শুনাবে বলেছিলে না?’ আমি বললুম, ‘তুমিই গাও, আমি শুনি।’ সে গাইলে,
ফারাকে জানাঁ মে হাম্নে সাকি লোহু পিয়া হেয় শারাব করকে।
তপে আলম নে জিগর কো ভূনা উয়ো হামনে খায়া কবাব কর্কে॥
আহ! এ কোন্ দগ্ধহৃদয়ের ছটফটানি?–প্রিয়তমের বিচ্ছেদে আমার নিজের খুনকেই শারাবের মত করে পান করেছি, আর ব্যথার তাপে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে পুড়িয়ে কাবার করে খেয়েছি!–ওগো সাকি, আর কেন? এসরাজের ঝংকার থামাতে অনেক সময় লাগল।
আমি গাইলুম, ‘ওগো, সে যদি আমার কথা শুধায়, তবে বোলো যে, সারা জনম অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে সে আজ বেহেশতের বাইরে তোমারই প্রতীক্ষায় বসে আছে!’ সে কেঁদে আমার মুখটা চেপে ধরে বললে, ‘না–না, এমন গান গাইতে নেই!’ তারপর বললে, ‘আচ্ছা, এই গান-বাজনায় তোমার খুব আনন্দ হয়,–না?’ আবার সে কোন্ অজানা-নিষ্ঠুরের প্রতি অভিমানে আমার বক্ষে ক্রন্দন গুমরে উঠল! আমি গাইলুম –
শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন মাঝে?
অশান্তি যে আঘাত করে তাইতে বীণা বাজে।
নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা—
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের গন্ধ-ঢালা।
বিদায়ের ক্ষণে সে হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলে বললে, ‘আচ্ছা, তুমি আমায় ভালবাসা, তাই আমি একটা ভিক্ষা চাইছি। … বলো, আর আমায় ভালবাসবে না, আমায় চাইবে না।’ সে উপুড় হয়ে আমার পায়ে পড়ল! …চাঁদের সমস্ত আলো এক লহমায় নিবে গেল বিরাট একট জলোমেঘের কালো ছায়ার আড়ালে পড়ে! … আমি কষ্টে উচ্চারণ করতে পারলুম, ‘কেন’? সে একটু থেমে, চোখ দুটো আঁচল দিয়ে চেপে বললে, ‘দেখো, পবিত্র জিনিসের পূজা পবিত্র জিনিস দিয়েই হয়। কলুষ যা, তা দিয়ে পূতকে পেতে গেলে পূজারির পাপের মাত্রা চরমে গিয়ে পৌঁছে। …এই যে তোমার ভালবাসা,–হোক না তা মাদকতা আর উন্মাদনার তীব্রতায় ভরা,–তা অকৃত্রিম আর প্রগাঢ় পবিত্র! তাকে অবমাননা করতে আমার যে একবিন্দু সামর্থ্য নেই। …আমাকে চেন না? এই শহরে যে খুরশেদজান বাইজির নাম শুন, আমি তারই মেয়ে।’ বলেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার সারা অঙ্গ কাঁপতে লাগল! সে বললে, ‘রূপজীবিনীর কন্যা আমি, ঘৃণ্য, অপবিত্র! ওগো আমার শিরায়-শিরায় যে অপবিত্র পঙ্কিল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে! কেটে দেখো, সে লোহু রক্তবর্ণ নয়, বিষ-জর্জরিত মুমূর্ষুর মত তা নীল-শিয়াহ।’ দেখলুম, তার চোখ দিয়ে আগুন ফিনকির মত জ্বালাময়ী অশ্রু নির্গত হচ্ছে। বুঝলুম, এ তো স্নিগ্ধ গৈরিক নির্ঝর নয়, এ যে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত দ্রবময়ী স্রোতের নিঃস্রাব!
বিছার কামড়ের মত কেমন একটা দংশন-জ্বালা বুকের অন্তরতম কোণে অনুভব করলুম। ভাবলুম স্বভাব-দুর্গন্ধ যে ফুল, সে দোষ তো সে ফুলের নয়। সে দোষ যদি দোষ হয়, তবে তা স্রষ্টার। অথচ তার বুকেও যে সুবাস আছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে অসাধারণ যে সে-ই; সাধারণে কিন্তু তার নিকটে গেলেই মুখে কাপড় দেয়, নাক সিঁটকায়। …আমি ছিন্নকণ্ঠ বিহগের মত আহত স্বরে বললুম, ‘তা–তা হোক মেহের-নেগার! সে দোষ তো তোমার নয়। তুমি ইচ্ছা করলে কি পবিত্র পথে চলতে পার না? স্রষ্টার সৃষ্টিতে তো তেমন অবিচার নেই। আর বোধ হয় এমনই ভাগ্যহত যারা তাদের প্রতিই তাঁর করুণা, অন্তত সহানুভূতি একটু বেশি পরিমাণেই পড়ে, এ যে, আমরা না ভেবেই পারি নে!… আর তুমি তো আমায় সত্য করে ভালবেসেছ! এ ভালবাসায় যে কৃত্রিমতা নেই, তা আমি যে আমার হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারছি। আর এ প্রেমের আসল নকল দুটি হৃদয় ছাড়া সারা বিশ্বের কেউ বুঝতে পারবে না।…হাঁ, আর ভালবাসায় জীব যখন কাঁদতে পারে, তখন সে অনেক উঁচুতে উঠে যায়। নীচের লোকেরা ভাবে, ‘এ লোকটার অধঃপতন নিশ্চিত’। অবশ্য একটু পা পিছলে গেলেই যে সে অত উঁচু হতে একেবারে পাতালে এসে পড়বে, তা সেও বোঝে। তাই সে কারুর কথা না শুনে সাবধানে অমনি উঁচুতে উঠতে থাকে। …না মেহের-নেগার, তোমাকে আমার হতেই হবে।’ … সে স্থির হয়ে বসল, তারপর মূর্ছাতুরের মত অস্পষ্ট কণ্ঠে কইলে, ‘ঠিক বলেছ য়ুসোফ, আমার সামনে অনেকেই এল, অনেকেই ডাকল; কিন্তু আমি কোনোদিন তো এমন করে কাঁদিনি। যে আমার সামনে এসে তার ভরা অর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছে, মনে হত আহা, একেই ভালবাসি। এখন দেখছি, তা ভুল। সময় সময় যে অমন হয়, আজ বুঝেছি তা ক্ষণিকের মোহ আর প্রবৃত্তির বাইরের উত্তেজনা। কিন্তু যেদিন তুমি এসে বললে, তুমি আমারই, সে দিন আমার প্রাণমন সব কেন একযোগে সাড়া দিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁগো হ্যাঁ, আমার সব তোমারই। ওঃ, সে কি অনাবিল গভীর প্রশান্ত প্রীতির জোয়ার ছুটে গেল ধমনীর প্রতি রক্ত-কণিকায়! সে এমন একটা মধুর সুন্দর ভাব, যা মানুষে জীবনে একবার মাত্র পেয়ে থাকে,–সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে! আমাদের এই ভালবাসায় আর দরবেশের প্রেমের সমান গভীরতা, এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, যদি সেই ভালবাসা চিরন্তন হয়!’ …ক্লান্ত কান্তার মত সে আমার স্কন্ধে মাথাটা ভর করে আস্তে আস্তে কইলে, ‘তোমাকে পেয়েও যে এই আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, এ তোমাকে ভালবাসতে,–প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পেরেছি বলেই! … আমার–আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে য়ুসোফ, তবে তোমাকে পাওয়ার আশা আমাকে জোর করে ত্যাগ করতেই হবে। যাকে ভালবাসি তারই অপমান তো করতে পারি নে আমি! এইটুকু ত্যাগ, এ আমি খুব সইতে পারব। অভাগিনী নারী জাতি, আমাদের এর চেয়েও যে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তোমরা যাই-ই ভাব, আমাদের কাছে এ কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়, আর কঠিনও নয়।… ওঃ, কেন তুমি আমার পথে এলে? কেন তোমার শুভ্র শুচি প্রেমের সোনার পরশ দিয়ে আমার অ-জাগন্ত ভালবাসা জাগিয়ে দিলে?–না তোমাকে না পেলেও তুমি থাকবে আমারই। তবু আমাদের দুজনকে দুদিকে সরে যেতে হবে।–যে বুকে প্রেম আছে, সেই বুকেই কামনা ওত পেতে বসে আছে। আমাদের নারীর মনকে বিশ্বাস নেই য়ুসোফ, সে যে বড়ই কোমল, সময়ে একটু তাপেই গলে পড়ে। কে জানে এমন করে থাকলে কোনো দিন আমাদের এই উঁচু জায়গা হতে অধঃপতন হবে। … না, না প্রিয়তম, আর এই কলুষবাষ্পে তোমার স্বচ্ছ দর্পণ ঝাপসা করে তুলব না। … আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না। যদি হয়, তবে আমাদের মিলন হবে ঐ–ঐখানে যেখানে আকাশ আর দরিয়া দুই উদার অসীমে কোলাকুলি করছে! … বিদায় প্রিয়তম! বিদায়!!’ বলেই সে আমার হস্ত চুম্বন করে উন্মাদিনীর মত ছুটে বেরিয়ে গেল।
ঝড় বইছিল শন–শন–শন। আর অদূরের বেণুবনে আহত হয়ে তারই কান্না শোনা যাচ্ছিল আহ্–উহ্–আহ্! স্নায়ুছিন্ন হওয়ার মত কট কট করে বেদনার্ত বাঁশগুলোর গিঁটে গিঁটে শব্দ হচ্ছিল।
এক বুক ব্যথা নিয়ে ফিরে এলুম! ফিরতে ফিরতে চোখের জলে আমার মনে পড়ল–সেই আমার স্বপ্নরাণীর শেষ কথা! সেও তো এর মতই বলেছিল, ‘আমাদের মিলন হবে এই উদার আকাশের কোলে এমনই এক তরুণ অরুণিমা-রক্ত-নিশিভোরে যখন বিদায় বাঁশির সুরে সুরে ললিত বিভাসের কান্না তরল হয়ে ক্ষরবে।’